আলিপুরে প্রেসিডেন্সি জেলের প্রধান আকর্ষণ ‘অরবিন্দ সেল’। দিনকয়েক ওয়ার্ডে, তার পর ৯ বাই ১১ ফুটের এই ছোট্ট কক্ষটিতে অরবিন্দ বন্দি ছিলেন ৫ মে ১৯০৮ থেকে ৬ মে ১৯০৯ সাল পর্যন্ত। এখন সেটি একটি মন্দিরতুল্য দর্শনীয় স্থান যে কোনও দর্শনার্থীর কাছে। এই মন্দিরের মধ্যে আছে ঋষি অরবিন্দর ছোট একটি মূর্তি ও ছবি। ঘরটি আলোকিত রাখা হয় সারা রাত। সকালে পুজো হয় নিয়মিত, এক জন সাজাপ্রাপ্ত আবাসিকই পুজো করে।
শ্রীঅরবিন্দর সেই বন্দিদশার ১০০ বছর পর, ২০০৮ সালে আমি এই সংশোধনাগারের মুখ্য নিয়ামক হিসেবে দায়িত্বভার হাতে নিই। সে সময় আবাসিকদের নিয়ে ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়ের আবৃত্তির ওয়ার্কশপ, রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আঁকায় মকশো, অমল দত্তর ফুটবলের পাঠ, ঊষা গঙ্গোপাধ্যায়ের নাটক নিয়ে নাড়াচাড়া, অলকানন্দা রায়ের ‘বাল্মীকিপ্রতিভা’ নৃত্যনাট্য প্রস্তুতি ইত্যাদি লেগেই থাকত। সেই সময় এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অতিথি হয়ে এসেছেন নবনীতা দেবসেন। অনুষ্ঠানমঞ্চে যাওয়ার পথে তিনি সেই ‘অরবিন্দ সেল’ তথা মন্দিরের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করছেন, কিন্তু আধ ঘণ্টা হতে চলল উঠছেন না। এ দিকে অধ্যক্ষ কমল মুখোপাধ্যায় ও সংশোধনী পরিষেবার মহানির্দেশক বংশীধর শর্মা এত দেরি দেখে খোঁজ নিতে কারারক্ষী পাঠিয়েছেন। কোনও রকমে সাহস করে বলেছিলাম, ‘নবনীতাদি, উঠুন এ বার।’ ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে চোখ মেললেন, আরও সময় নিলেন সংবিৎ ফিরে পেতে এবং আঁচলে বাঁধলেন সেখানকার এক টুকরো মাটি। এমনই মহিমা কক্ষটির!
থিয়েটার রোডের মামার বাড়িতে (এখন অরবিন্দ ভবন) অরবিন্দর জন্ম ১৮৭২ সালের ১৫ অগস্ট। তা হলেও, জেলের অ্যাডমিশন রেজিস্টারে শ্রীঅরবিন্দর ঠিকানা ঘোষপাড়া, কোন্নগর, হুগলি। উচ্চতা ৫ ফুট ৬.২ ইঞ্চি। বয়স ৩৭, চিবুকে ছুঁচলো দাড়ি, পিঠে তিনটি তিল ইত্যাদি।
১৯০৮ সালের আলিপুর জেলে (এখনকার প্রেসিডেন্সি) মে মাস থেকে ছিল ভরা সংসার। মানিকতলা বোমার মামলায় শ্রীঅরবিন্দ ছাড়াও এসেছেন আরও চল্লিশ জন বিপ্লবী। এত ভিড় ও কোলাহল পছন্দ নয় শ্রীঅরবিন্দর। তাই তাঁকে একা রাখা হল সেলে। কিন্তু তাতেও রেহাই নেই, রাত হলেই পাহারাদারদের ঘন ঘন ‘কোই হ্যায়’ বলে তারস্বরে হাঁক, তন্দ্রা এলেও তার দফারফা।
শ্রীঅরবিন্দ সেলের বাইরে সকাল-বিকেল এক ঘণ্টা করে থাকার অনুমতি পেলেন। বিপ্লবীরা খুব একটা তাঁর কাছে ঘেঁষতে চাইতেন না, কিন্তু শ্রীরামপুরের জমিদারপুত্র নরেন্দ্রনাথ গোস্বামী তাঁর সঙ্গে খুব গল্প করতেন।
শ্রীঅরবিন্দ এক রকম ঘোরের মধ্যে থাকতেন। সকালের জলখাবার যতটা না নিজে খেতেন, তার বেশি পিঁপড়ে টিকটিকি আরশোলাদের খাওয়াতেন। প্রায়ই দেখতেন কারখানার কাছে ডেঁয়ো পিঁপড়ের দল চেপে বসেছে লাল পিঁপড়ের ঘাড়ে। তাঁর স্বস্তি নেই যত ক্ষণ না ডেঁয়োদের তাড়াচ্ছেন। সব থেকে মুগ্ধ হতেন দেখে— সকালে গাই দোয়ানো হয়ে গেলে গরুর পাল যখন গলায় ঘণ্টা দুলিয়ে টুংটাং আওয়াজ করে পুকুরপাড় দিয়ে যেত ঘাস খেতে। জেলে দু’বেলা গরুর পাল দেখে উচ্ছ্বসিত হতেন, কারণ ছোটবেলায় বাড়িতে ছিল না বাঙালিয়ানা। বাবা ছিলেন বিলেত-ফেরত ডাক্তার কৃষ্ণধন ঘোষ। অরবিন্দ যখন পাঁচ বছরের, তখন থেকে দু’বছর লোরেটো কনভেন্টে পড়াশোনা করেন। তার পর সাত বছর বয়সে বাবা তাঁকে ইংল্যান্ডে নিয়ে গিয়ে ধর্মযাজক অ্যাকরয়েডের কাছে সঁপে দিলেন মানুষ করতে, যাতে ছেলের মনে কোনও ভাবে ভারতীয় সংস্কৃতির ছোঁয়া না লাগে। অরবিন্দ যেন পুরোদস্তুর এক জন ইংলিশম্যান হয়ে ওঠে। কিন্তু মানুষ ভাবে এক, হয় আর এক।
স্মৃতিধন্য: প্রেসিডেন্সি জেলের এই কুঠুরিতেই কারাবন্দি ছিলেন শ্রীঅরবিন্দ। (ছবি সৌজন্য: লক্ষ্মীজ় হাউস, শ্রীঅরবিন্দ ইনস্টিটিউট) মূল ছবি, শিল্পী বিকাশ ভট্টাচার্যের তুলিতে শ্রীঅরবিন্দ
ইংল্যান্ডে তাঁর মন বসেনি। কষ্টের প্রলেপ দিয়ে চিত্তশুদ্ধি করতেন তিনি। বাড়ি থেকে যখন টাকা আসছে না, লন্ডনের প্রচণ্ড শীতে আগুন জ্বালানোর রসদ নেই, হাঁটুতে মাথা গুঁজে শীত তাড়িয়েছেন। পড়াশোনায় প্রাণপাত পরিশ্রম করে একাধিক স্কলারশিপ পেয়ে নিজের খরচ চালিয়েছেন।
জেলজীবনে অরবিন্দর নিঃসঙ্গতার কথা ভেবে এ বার সবাইকে এক সঙ্গে রাখা হল ২৩ নং ওয়ার্ডে। এটাই ছিল সবচেয়ে আনন্দ ও উত্তেজনাপূর্ণ পর্ব। সকালে চলত বই পড়া, বিকেলে যুযুৎসু চর্চা, দশ-পঁচিশ খেলা আর সন্ধ্যায় গানের মজলিশ। প্রায় সকলের কাছেই বই ছিল। অরবিন্দ খুব খুশি হয়েছিলেন, সব বইপত্র ওয়ার্ডের এক কোণে জড়ো করে ছোট্ট লাইব্রেরি মতো তৈরি করতে পেরে। নিয়মিত পড়তেন গীতা, উপনিষদ ও আধ্যাত্মিক বইপত্র। ওয়ার্ডের সকলেই খেয়াল রাখতেন, যাতে তাঁর যোগসাধনার বিঘ্ন না ঘটে। উল্টে তিনি এই প্রথম সুযোগ পেলেন অনেকের সঙ্গে পরিচিত হতে। আদালত থেকে ফিরে তিনি রঙ্গরসিকতাও করতেন জজ বার্লি কী ভাবে ফিরিঙ্গি বাংলায় জেরা করেন, ব্যারিস্টার নর্টন সাহেবের প্যান্টে কোথায় ছেঁড়া, কোর্ট ইন্সপেক্টরের গোঁফ ইঁদুরে খেল না আরশোলায় কাটল এ সব নিয়ে।
কোর্টে যেতে লাগে মিনিট দশেক মাত্র, এই সময়টাও বৃথা যায় না উল্লাসকর দত্ত থাকায়। তিনি কখনও গাইছেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বদেশি গান, কখনও বা দেখাচ্ছেন ক্যারিকেচার। শ্রীঅরবিন্দ অত্যন্ত মর্মাহত হয়েছেন হ্যারিসন রোডের ধরণী ও নগেন্দ্র, দুই কবিরাজ ভাইকে শান্ত ভাবে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করতে দেখে। বারীন না জানিয়ে এক বাক্স বোমা তৈরির মশলা লুকিয়ে রেখেছিল তাঁদের দোকানে। উদ্বিগ্ন ছিলেন নাগপুর থেকে ধরে আনা বালকৃষ্ণ কানে-কে নিয়ে। তাঁর বাড়ির লোকজন আসছে না বলে উকিল রাখতে পারছে না, সারা ক্ষণ মনমরা।
ছোট ভাই বারীন্দ্র যখন স্বপ্ন দেখছেন ‘যুগান্তর’-এ আর কী কী চাঞ্চল্যকর খবর ছাপবেন, তখন হেমচন্দ্র কানুনগো নিজেই যেন এক মহাকাব্য। মেদিনীপুর টাউন স্কুলের ড্রয়িং-শিক্ষক হেমচন্দ্র দাস ১৯০৭ সালে ‘যুগান্তর’-এ যোগ দিয়ে দেখেন, সমিতির মাথা বারীন যে বোমা নিয়ে পুব বাংলার লাট ব্যামফিল্ড ফুলারকে মারবেন বলে অস্থির, সেটি কালীপটকার বেশি কিছু নয়। মেদিনীপুর ফিরে হেমচন্দ্র জমি জায়গা যা ছিল বেচে প্যারিস পাড়ি দিলেন বহু কষ্টে। হেমচন্দ্র যখন প্যারিসে, বারীন উল্লাসকে দিয়ে তৈরি করান কয়েকটি মাইন। ১৯০৮ সালের জানুয়ারিতে হেমচন্দ্র দেশে ফিরে বারীনের নির্দেশে তিনটি শক্তিশালী বোমা তৈরি করেন। তিন নম্বরটি দেওয়া হয় ক্ষুদিরাম আর প্রফুল্ল চাকির হাতে। লক্ষ্য কিংসফোর্ড। পরবর্তী তদন্তের ফলে রাজা নবকৃষ্ণ স্ট্রিটের ভাড়াবাড়ি থেকে গ্রেফতার হলেন হেমচন্দ্র দাস। দ্বীপান্তরের জীবন শেষ করে তিনি মেদিনীপুরে ফিরে জমি জরিপের কাজ করতেন জেলা বোর্ডের অধীনে। পেশার খাতিরে তখন থেকে হেমচন্দ্র দাস হয়ে গেলেন হেমচন্দ্র কানুনগো।
এ দিকে শ্রীঅরবিন্দ বিস্ফারিত চোখে দেখছেন, সারা সকাল ধরে ওয়ার্ডের মধ্যেই কিছু ছেলে শুধু দৌড়ে যাচ্ছে! আসলে অরবিন্দকে না জানিয়ে অতি উৎসাহী কিছু যুবক ঠিক করল জেল ভেঙে পালাবে। সাঁওতাল পরগনা থেকে বিন্ধ্যাঞ্চল, তার পর পশ্চিম ভারত। সেখান থেকে কাবুল হয়ে পারস্য! এত দূর হাঁটতে হবে, তাই প্রতি দিন সকালে ওয়ার্ডের ভেতরেই ছোটা অভ্যেস করতে শুরু করেছে পাঁচ-সাড়ে পাঁচ মাইল করে। তাতে কারও পায়ে ফোস্কা পড়ে, কারও কুঁচকির সমস্যা, আবার কারও ব্যথার তাড়সে ১০৬ ডিগ্রি পর্যন্ত জ্বর! কানাইলাল দত্তর মতো কেউ কেউ আবার একদম চুপচাপ। কারণ কিছু দিন ধরে তাঁরা লক্ষ করছেন, গোয়েন্দা পুলিশ সামসুল আলম ঘন ঘন জেলে আসছেন এবং নরেন গোঁসাই দেখা করছেন, কথা বলছেন দু’-তিন ঘণ্টা করে। যখন জানাজানি হয়ে গেল যে নরেন গোঁসাই রাজসাক্ষী হয়েছেন, তোড়জোড় শুরু হল কেমন করে তাঁর ভবলীলা সাঙ্গ করা যায়।
কে দায়িত্ব নেবে? দায়িত্ব নেওয়ার জন্য কেঁদেকেটে অস্থির শ্রীহট্টের সুশীল সেন। আসলে কিংসফোর্ড কিশোর সুশীল সেনকে জনসমক্ষে ১৫ বার বেত্রাঘাত করেছিলেন। সেই বিপ্লবী বালকই প্রথমে দায়িত্ব পেয়েছিল মজফ্ফরপুর গিয়ে কিংসফোর্ডের ভবলীলা সাঙ্গ করার। কিন্তু হঠাৎ বাবা অসুস্থ হওয়ায় সুশীলকে শ্রীহট্ট চলে যেতে হয়। সেই দায়িত্ব গিয়ে পড়ে ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকির ওপর।
তত দিনে কানাইলালের উদ্যোগে চন্দননগরের বিপ্লবীরা দুটো পিস্তল পৌঁছে দিয়ে গেছে জেলে। ১ সেপ্টেম্বর সকালে সত্যেন্দ্রনাথ বসু ও কানাইলাল দত্ত হাসপাতাল চত্বরে গুলি করে হত্যা করলেন নরেন গোঁসাইকে। যে যেখানে ছিল, ছুটে এল গুলির শব্দ শুনে। গেলেন না শুধু অরবিন্দ ঘোষ।
নরেন গোঁসাই হত্যাকাণ্ডের পর সম্পূর্ণ বদলে গেল জেলের পরিবেশ পরিস্থিতি। ভেস্তে গেল পালানোর প্ল্যানও। শ্রীঅরবিন্দর স্থান হল আগের সেলেই, বাকিদের ৪৪ ডিগ্রি সেল ব্লকে। কোলাহল ও আন্দোলনের মধ্যে ছিলেন যিনি, আবার ফিরে এলেন সম্পূর্ণ নীরবতার মধ্যে।
নানা ভাবনা ও অস্থিরতার মধ্যে তাঁর দিন কাটছিল। খাওয়া-দাওয়া প্রায় বন্ধ। প্রাণায়ামের মাধ্যমে তিনি অশান্ত মনকে কিছুটা শান্ত করলেন। আর তারই মাঝে কিছু অলৌকিক বাণী ও রহস্যময় কথা তিনি শুনতে পেতেন। উপলব্ধিও করতেন। এই সব বাণীকে অবলম্বন করে তিনি এক দিন আশ্চর্য ভাবে প্রত্যক্ষ করলেন স্বামী বিবেকানন্দের আনন্দঘন প্রিয় সান্নিধ্য। গভীর রাতে উপলব্ধি করতেন স্বয়ং বাসুদেব এসে কথা বলছেন।
সতীর্থ উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় লক্ষ করলেন, অরবিন্দর জীবনে এসেছে এক অদ্ভুত মৌলিক পরিবর্তন। এই সময় তিনি ক্রমশ আরও বেশি চুপচাপ হয়ে গেলেন। উপেন্দ্রনাথ আরও দেখলেন, তাঁর মাথার চুল চকচক করছে অথচ তাঁরা কেউ মাথায় মাখার তেল পান না। মাথায় তেল মাখেন কি না খোঁজ করায় জানা গেল, তিনি স্নানই করেন না। শ্রীঅরবিন্দ বলেছিলেন, সাধনের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর শরীরে কতগুলো পরিবর্তন আসছে। এ সব গুহ্য সাধনের কথা তিনি কোথায় পেলেন জিজ্ঞেস করায় জানালেন, এক জন মহাপুরুষ সূক্ষ্মশরীরে এসে তাঁকে এই সমস্ত শিক্ষা দিয়ে যান।
তরুণ ব্যারিস্টার চিত্তরঞ্জন দাশের সওয়ালে তছনছ হয়ে গেল পুলিশের সাজানো মামলা। গ্রেফতারের সময় তাঁর বাড়ি থেকে যে সব কাগজপত্র পাওয়া গিয়েছিল, কোর্টে জমা দিতে দেখা গেল, সেগুলো স্ত্রী মৃণালিনী দেবীকে লেখা চিঠি, দেশ তাঁর কাছে কী তার ব্যাখ্যা। চিত্তরঞ্জন তীক্ষ্ম যুক্তিজালে প্রমাণ করলেন, অরবিন্দ এক সর্বত্যাগী মহামানব। বিনা পারিশ্রমিকে তিনি মামলা লড়লেন, মামলার অন্যান্য খরচ চালাতে বিক্রি করলেন শখের ব্রুহাম গাড়ি ও ওয়েলার ঘোড়া এবং স্বয়ং ঝাঁপালেন স্বদেশি আন্দোলনে। ১০ নভেম্বর ফাঁসি হয়ে গেল কানাইলালের, দেহ পোড়ানো নিয়ে বাইরে ছিল জনজোয়ার ও অরন্ধন। ভেতরে শ্রীঅরবিন্দ দেখলেন, এক স্বল্পমেয়াদি বন্দি জেলের দেয়ালে ‘লং লিভ কানাইলাল’ লেখায় তার সাজা বেড়ে গেল আরও চার দিন। ফাঁসি হয়ে গেল সত্যেন্দ্রনাথ বসু ও সরকারি উকিল আশুতোষ বিশ্বাস হত্যাকারী চারুচন্দ্র বসুরও। সত্যেন্দ্রনাথ ছিলেন শ্রীঅরবিন্দর মামা। জেলের বাইরে উত্তেজনা কমাতে সত্যেন্দ্রনাথ ও চারুচন্দ্রর দেহ পোড়ানো হয় জেলের মধ্যে, কিন্তু কোনও ঘটনাই শ্রীঅরবিন্দকে তাঁর সাধনা থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। তিনি এক আশ্চর্য নির্লিপ্তির জগতে অবস্থান করছিলেন।
একা থাকতে থাকতে ইদানীং নিজের ভেতর থেকে একটা স্বর শুনতে পেতেন— ‘অপেক্ষা কর, কী হয় দেখ।’ গ্রেফতারের এক মাসের মধ্যেও একটি আহ্বান এসেছিল সব কাজ ছেড়ে নির্জনবাসে যেতে এবং নিজের অন্তরের মধ্যে সন্ধান করতে, যাতে তিনি ভগবানের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ ভাবে যুক্ত হতে পারেন। সেলে থাকতেই তিনি সক্ষম হলেন গীতার সাধনপথ অনুসরণ করতে।
কিছু দিন পর তাঁকে সকাল-সন্ধ্যা আধ ঘণ্টা করে সেলের বাইরে বেড়াতে দেওয়া হয়। যখন বেরোলেন, মনে হল জেলের উঁচু প্রাচীরের মধ্যে তিনি আর বন্দি নেই, তাঁকে ঘিরে রয়েছেন বাসুদেব। যে গাছতলায় পায়চারি করতেন, সে গাছও এখন বাসুদেব, স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ ছায়া ধরে রেখেছেন। যে কোনও কেসের আসামি, কোর্টের ম্যাজিস্ট্রেট, সবাইকে মনে হল বাসুদেব। সরকারি উকিলকে দেখলেন স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ, প্রিয় বন্ধুর মতো বসে হাসছেন। রাগ-দ্বেষ আকাঙ্ক্ষা থেকে মুক্ত তিনি তখন সম্পূর্ণ অন্য মানুষ।
অবশেষে ৬ মে ১৯০৯, প্রিজ়ন ভ্যানে উঠলেন সতীর্থদের সঙ্গে, কারণ আজ দায়রা আদালতে বিচারক বিচক্রফট রায় দেবেন। অন্যদের ফাঁসি, দ্বীপান্তর প্রভৃতি সাজা হলেও অরবিন্দ বেকসুর খালাস পেলেন। তিনি আগেই দৈববাণী শুনেছিলেন, মুক্ত হবেন। ইংল্যান্ডের কিংস কলেজের প্রাক্তন সহপাঠী বিচারক বিচক্রফট কোনও প্রমাণ পেলেন না তাঁর বিরুদ্ধে।
মুক্ত অরবিন্দ জেলে যে আধ্যাত্মিক জগতের সন্ধান পেলেন, তাতে আর বৈপ্লবিক জগতে ফিরে যেতে মন চাইল না। অগ্নিযুগের ঋত্বিক অরবিন্দ, যিনি চেয়েছিলেন কংগ্রেসের সব সদস্যকে বিপ্লবী করে গড়ে তুলবেন, এক বছর পর জেল থেকে বেরোলেন ঋষি অরবিন্দ হয়ে। সোজা চলে গেলেন চন্দননগর। সেখান থেকে পরের বছর এপ্রিলে ডুপ্লে জাহাজে চড়ে ফরাসি পন্ডিচেরির উদ্দেশে।