মানুষের মধ্যে যতখানি মানুষের নাগালের বাইরে, প্রেম তারই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট,’ লিখেছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। মানুষের সুস্থতা ও অপ্রকৃতিস্থতার যে সীমারেখাটি বারবার গুলিয়ে যায়, নিজেকে সুস্থ ভেবে মানুষ অপ্রকৃতিস্থের মতো আচরণ শুরু করে আর তার ভেতরেও আশ্চর্য ভাবে সুস্থতার লক্ষণগুলিকে প্রকাশ করে চলে, মানিক সেই সীমারেখাটিকেই স্পর্শ করেছেন বারবার। স্মৃতিচারণে প্রেমেন্দ্র মিত্র লিখেছেন, ‘তাঁর রচনায় যেটুকু অসুস্থতার ছায়া তা আমাদেরই রুগ্নতার প্রতিবিম্ব। কোনো দিকেই মাঝারি হবার সৌভাগ্য নিয়ে তিনি আসেননি। চূড়াও যেমন তাঁর মেঘ-লোক ছাড়ানো, খাদও তেমনই অতল গভীর। তাই মানিয়ে নেবার মানুষ তিনি নন।’
১৯০৮ সালে আজকের দিনেই দুমকায় জন্ম মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের। ষোলো বছর বয়সে মায়ের মৃত্যু তাঁর জীবনকে গভীর ভাবে প্রভাবিত করেছিল। ‘জননী’ উপন্যাসে চিনে নেওয়া যায় সেই হারিয়ে যাওয়া মা’কে। ঝুঁকি নিতে ভালবাসতেন মানিক, মাঝিমাল্লাদের সঙ্গে চলে যেতেন এখানে-ওখানে। বন্ধুদের সঙ্গে ভরা বর্ষার নদীতে বাইচ খেলতে যেতেন। কুস্তি শিখতেন, গাড়োয়ানদের সঙ্গে গল্প করতে ভালবাসতেন। গান গাইতেন চমৎকার। বাঁশি বাজাতেন। আর ভালবাসতেন বই পড়তে। লিখেছিলেন, ‘বই কেন ভালোবাসি? মানুষকে ভালোবাসি বলে। বইয়ের মধ্যে মানুষের সঙ্গ পাই।’ মন দিয়ে পড়েছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র আর রবীন্দ্রনাথ, বিশেষ করে ‘বিষবৃক্ষ’ আর ‘গোরা’। ‘একখানা বই পড়তাম আর তার ধাক্কা সামলাতে তিন-চারদিন মাঠে ঘাটে, নৌকায় নৌকায়, হাটবাজারে মেলায় ঘুরে তবে সামলে উঠতাম,’ লিখেছেন।
স্কুলজীবনেই কয়েক বার পড়ে ফেলেন ‘শ্রীকান্ত’। ‘চরিত্রহীন’ পড়ে অভিভূত, বিচলিত বোধ করেছিলেন। লিখেছেন, ‘বোধহয় আট-দশবার বইখানা পড়েছিলাম তন্ন তন্ন করে। বাংলা সাহিত্যের কত দূঢ়মূল সংস্কার আর গোঁড়ামি যে চুরমার হয়ে গিয়েছিল এই উপন্যাসে!’ তাঁর উপন্যাসেও বারবার এসেছে যৌনতা। লিখেছিলেন, ‘সমাজজীবন যৌনজীবনকে নিয়ন্ত্রিত করে। সমাজজীবন অসুস্থ হলে যৌনজীবনও অসুস্থ হতে বাধ্য। অসংখ্য গলদ-ভরা সমাজে মানুষ বঞ্চিত ও বিকৃত জীবনযাপন করে। দেহমনের পূর্ণতা বা স্বাস্থ্য সে কোথায় পাবে?’
মানিক আঘাত করতে শুরু করেন তথাকথিত ভদ্র জীবনকে। ‘ভদ্রজীবনের বিরোধ, ভণ্ডামি, হীনতা, স্বার্থপরতা, অবিচার, অনাচার, বিকারগ্রস্ততা, সংস্কারপ্রিয়তা, যান্ত্রিকতা ইত্যাদি তুচ্ছ হয়ে এ মিথ্যা কেন প্রশ্রয় পায় যে ভদ্রজীবন শুধু সুন্দর ও মহৎ?’
ভদ্রসমাজের বিকার ও কৃত্রিমতা থেকে মুক্ত চাষি-মজুর-মাঝি-মাল্লা-হাড়ি-বাগদিদের বিচিত্র অবহেলিত জীবন নিয়ে তিনি লিখতে শুরু করেন; এই ‘বিরাট মানবতা’কে তুলে আনেন সাহিত্যে। বারবার নিজের লেখায় কাটাকুটি করতে ভালবাসতেন। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত লিখেছেন, ‘প্রখর একটা ক্ষিপ্রতা তাঁর মুখে, যেন বুদ্ধির সন্দীপ্তি।’ প্রথম উপন্যাস লেখার আগেই তাঁর ফ্রয়েড এবং হ্যাভলক এলিস পড়া।
সারা জীবন ধরে একের পর এক রূপক লিখে গেছেন মানিক। ‘দিবারাত্রির কাব্য’র মতো প্রেমকাহিনির কেন্দ্রে শেক্সপিয়র-শেলি-কিটস পড়া এক সৃষ্টিছাড়া পুরুষ, হেরম্ব। যে নারী তাকে ভালবাসে, তাকেই সইতে হয় অসহ্য যন্ত্রণা। সুপ্রিয়ার অন্যত্র বিয়ে হয়ে যায়, যদিও স্বামী অশোককে সে কোনও দিনই ভালবাসতে পারে না। উমা তাকে বিয়ে করেছিল, কিন্তু আত্মহত্যায় বাধ্য হয় শেষে। দু’বছরের মা-মরা মেয়ের প্রতিও হেরম্ব সম্পূর্ণ নিরাসক্ত, সে প্রেমে পড়ে বছর আঠারোর আনন্দের। আনন্দ কিন্তু জানে, প্রেম ক্ষণস্থায়ী। হেরম্বকে যে দিন পাবে, সে দিনই তার প্রেমকে সে হারাতে শুরু করবে। মা-বাবার প্রেমের ট্র্যাজেডিকে চোখের সামনে দেখেছে আনন্দ, দেখেছে সুপ্রিয়ার জীবনের করুণ পরিণতিকেও। যে জীবনে প্রেম নেই, সেই জীবন সইতে পারবে না সে, তাই নাচতে নাচতে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে আগুনে ঝাঁপ দেয়। হেরম্বের মধ্যে রেখে যায় প্রেম ও কামনা তৃপ্ত না হওয়ার জ্বালা।
১৯৩৬-এ প্রকাশিত হয় ‘পদ্মানদীর মাঝি’ আর ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’। পরিবারের সঙ্গে বিচ্ছেদের ফলে এ সময়ে তাঁর খুবই অর্থাভাব ছিল। শুধু মুড়ি খেয়েও কখনও কাটাতে হয়েছে। লেখার আলাদা ঘর, চেয়ার-টেবিল ছিল না। তবু লেখালিখি চালিয়ে গেছেন কঠোর সাধনার মতো। গভীর পড়াশোনা করেছিলেন মনস্তত্ত্ব ও যৌনবিজ্ঞান নিয়ে। ১৯৩৫ সালে মৃগীরোগে আক্রান্ত হন। অত্যধিক শারীরিক-মানসিক পরিশ্রম, অতিরিক্ত উত্তেজনাই ছিল এর কারণ। তবু তাঁকে লিখে যেতে হয়েছে, কারণ, ‘আজ এখন ওষুধ খেয়ে ঘুমোলে কাল হাঁড়ি চড়বে না।’
‘পদ্মানদীর মাঝি’র গোড়াতেই কুবের খবর পায় তার একটি পুত্রসন্তান হয়েছে, কিন্তু সে ঝাঁঝিয়ে উঠে বলে, ‘পোলা দিয়া করুম কী, নিজগোর খাওন জোটে না, পোলা!’ পঙ্গু স্ত্রী মালা, বৃদ্ধা পিসি আর তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে গড়া সংসারের প্রতি কুবের আসক্তি বোধ করে না, সে আকৃষ্ট হয় মালার ছোট বোন কপিলার প্রতি। বিবাহিত দুই নারী-পুরুষের পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ নানান ছলনার মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ করে। তারা খুঁজে নিতে চায় বিকল্প পথ, যে পথে গেলে তাদের প্রেম ও যৌনতার স্বাধীনতা চরিতার্থ হবে। এই বিকল্প পথেরই সন্ধান নিয়ে আসে হোসেন মিয়া, ‘ময়নাদ্বীপি যাবা কুবির?’ কুবেরদের নিয়ে সে গড়ে তুলতে চায় ‘ময়নাদ্বীপ’ নামের নতুন এক উপনিবেশ।
‘পুতুলনাচের ইতিকথা’-য় শশী নিজেই যেন ঔপনিবেশিক নিষ্ক্রিয়তার প্রতীক। একটি মৃতদেহ নিয়ে সে গ্রামে ঢোকে, ক্রমে সেই মৃতদেহের জড়তাই যেন গ্রাস করতে থাকে তার অস্তিত্ব। তার বিলেত যাওয়ার ও কলকাতায় চিকিৎসক হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভের স্বপ্ন, সর্বোপরি বিবাহিত কুসুমের প্রতি অবদমিত প্রেম ও যৌনতা, কিছুই সফল হয় না। শশী চিরকালের মতো গ্রামেই থেকে যায়, আর অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে যায় কুসুম। অদ্ভুত সব ‘এনিগমা’ তৈরি হয় এই আখ্যানে। যাদব চেয়েছিল লোকের চোখে মহাপুরুষ হয়ে উঠতে, তাই স্বেচ্ছামৃত্যুর কিংবদন্তি ছড়িয়ে দেয়, আত্মহত্যা করে মিথ হয়ে যায় সে। মৃত্যুর বিনিময়ে একটি মানুষ অর্জন করতে চায় মহৎ হওয়ার গৌরব।
যৌনতা দিয়ে সামাজিক আচরণ বুঝে নেওয়ার এই প্রক্রিয়া চলতেই থাকে। ‘চতুষ্কোণ’ উপন্যাসে রাজকুমার এক ‘চিন্তাগ্রস্ত নিউরোটিক’, যৌনতা নিয়ে সমাজের কোনও ভণ্ডামি ও অনুশাসন সে মানতে রাজি নয়। নিজে নিরাসক্ত হলেও সে নারীহৃদয়ে অনায়াসে কামনা জাগাতে পারে। মালতী তাকে প্রথমে প্রশ্রয় দেয়, পরে ভয় পেয়ে এড়িয়ে চলতে শুরু করে। রিনিকে সে নগ্ন অবস্থায় দেখতে চায়, কিন্তু রিনি তাকে প্রত্যাখ্যান করে। পরে রিনি উন্মাদ হয়ে যায়, সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে টের পায়, মানুষ হিসাবে রাজকুমার আসলে কতটা খাঁটি, নিজের অবচেতনকে কোনও আড়াল না রেখে সে প্রকাশ করতে পারে।
মানিক দেখাতে চেয়েছেন, নারীশরীরের প্রতি পুরুষের আকর্ষণ স্বাভাবিক। কোনও পুরুষ এই স্বাভাবিক ইচ্ছাকে নিরাসক্ত ভাবে, শুধু জ্ঞানার্জনের জন্যও প্রকাশ করলে এক-এক নারী এক-এক ভাবে প্রতিক্রিয়া জানায়। এই প্রতিক্রিয়াগুলিই বুঝিয়ে দেয়, একটা স্বাভাবিক ব্যাপার সমাজের চাপে কী ভাবে অস্বাভাবিক হয়ে ওঠে। নিজেকে বাঁচাতে সমাজ তখন অকপট মানুষকে বিকৃতমনস্ক প্রতিপন্ন করে!
‘অহিংসা’ উপন্যাসে ধর্ম নিয়ে সদানন্দের কোনও মাথাব্যথা নেই, নিজের সনিষ্ঠ ভাবমূর্তি গড়ে তুললেও মাঝে মাঝেই তার নানান দুর্বলতা ও পাগলামি প্রকাশ পায়, যা আসলে ‘অতিরিক্ত জ্ঞানের অভিব্যক্তি’। সদানন্দের প্রচণ্ড জীবনীশক্তি ও জ্ঞানই মাধবীলতার প্রতি এক অদম্য যৌনতার জন্ম দেয় তার মনে, আর মাধবীলতা নিজেকে নানা ছলনায় ভুলিয়ে রাখতে চাইলেও ভেতরে ভেতরে এক অমোঘ আকর্ষণকেই বয়ে চলে। দস্তয়ভস্কির মতোই অতিরঞ্জন ও অতিনাটকীয়তার মধ্য দিয়ে মানুষের সত্তার শাঁসটিকে বুঝে নেওয়ার তীব্র ক্ষমতা মানিকের ছিল, টের পাওয়া যায় তা।
ভয়ানক দারিদ্রের মধ্যেও বজায় ছিল তাঁর চরম আত্মমর্যাদাবোধ। এক বার চাকরির আবেদন করেও তিনি আবেদনপত্র প্রত্যাহার করে নেন, কারণ জানতে পারেন, অন্য এক জনের সেই চাকরিটির প্রয়োজন ছিল আরও বেশি। অথচ অর্থের অভাবে তখন নিজের চিকিৎসা পর্যন্ত ঠিক মতো করতে পারছেন না তিনি। বিয়ে করেছেন, তার কিছু দিনের মধ্যেই চাকরিতে ইস্তফা দিয়েছেন। কর্মক্ষেত্রের অন্যায় ও বৈষম্যকে সহ্য করতে পারেননি। বেহিসেবির মতো বাজার করতেন, লোকজনকে খাওয়াতে ভালবাসতেন। এক বার এক ছাপাখানা ও প্রকাশন সংস্থা শুরু করেন, সেও ব্যর্থ হয়। লেখালিখিই হয়ে ওঠে তাঁর জীবিকা। ১৯৪৩-এর গোড়ায় যোগ দেন ফ্যাসিবিরোধী লেখক ও শিল্পী সঙ্ঘে। বুধবারের বৈঠকগুলিতে যখন তিনি গল্পপাঠ করতেন, ‘সে সব দিনে শ্রোতাদের ভিড় অফিস ছাপিয়ে সিঁড়ি অবধি পৌঁছত,’ লিখেছেন চিন্মোহন সেহানবীশ।
সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশতে ভালবাসতেন। ছাত্রদের সঙ্গে রাস্তায় বসে গল্প করতেন। ১৯৪৬-এ সৈন্যরা এক বার তাঁকে ধরে এনে রাস্তা সাফ করানোর চেষ্টা করে। তিনি প্রতিবাদ করলে তাঁকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়। পৈতৃক বাড়ি বিক্রির পর যে আট হাজার টাকা পেয়েছিলেন, তার পুরোটাই পার্টিকে দান করে দিয়েছিলেন। তাঁর শেষজীবন কাটে ভাড়াবাড়িতে। সেখানে মৃত সন্তান প্রসব করা অসুস্থ স্ত্রী, বৃদ্ধ পিতার দায়দায়িত্ব ক্রমেই তাঁর উদ্বেগ বাড়িয়ে তোলে। নানান সরকারি আমন্ত্রণ, এমনকি চাকরির প্রস্তাবও সেই সময় প্রত্যাখ্যান করেছেন। নিজের রাজনৈতিক বিশ্বাসকে কোনও সরকারি সুযোগ-সুবিধার জন্য বর্জন করা বা লুকিয়ে রাখা তাঁর প্রকৃতিবিরুদ্ধ ছিল।
অথচ টাকার চিন্তায় বারংবার অস্থির হয়ে উঠেছেন তিনি। জানতেন, একটা দিন কাজ করতে না পারলে তাঁর সংসার চলবে না। প্রকাশকদের দরজায় দরজায় ঘুরেছেন, তবু পাওনা টাকা আদায় করতে পারেননি। লংক্লথের পাঞ্জাবি, ধুতি আর চটি, এই ছিল তাঁর পোশাক। বাড়িতে লুঙ্গি আর খড়ম পরতেন। সস্তা এক জোড়া টেবিল-চেয়ারে বসে লিখতেন। টেবিল ভরা থাকত বইপত্রে, পাণ্ডুলিপির এলোমেলো পাতায়। আর ছিল ছেঁড়াখোঁড়া বিস্তর মাসিকপত্র। ১৯৫৫ সালের ২০ অগস্ট তাঁকে লুম্বিনী মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ফিরে আসার পরও মাঝে মাঝেই অসুস্থ হয়েছেন। মৃত্যুর আগে যখন প্রায় সংজ্ঞাহীন, তখনও তাঁর ডান হাত বারবার শূন্যে সঞ্চালিত হয়েছে লেখার চেষ্টায়!