Dhol

বাঘও যাদের ভয় পায়

এক ধরনের জংলি কুকুর। নাম ‘ঢোল’। বাঘও এদের দেখলে পালাতে পথ পায় না। চিতাও শিকার ফেলে হাত গুটিয়ে নেয়। দশগুণ বেশি ওজনের জন্তুকেও দল বেঁধে ঘায়েল করতে পারে ঢোল। হিংস্র শিকারি, তবু পৃথিবীতে এদের সংখ্যা বর্তমানে মাত্র আড়াই হাজার। দেবদূত ঘোষঠাকুর এত তাড়াতাড়িই যে ভাগ্য সহায় হবে তা কে জানত! বিকেলে ঢুকেছি জঙ্গলে, তখন সন্ধে হব-হব। আমরা ছাদখোলা গাড়িতে চেপে জঙ্গল প্রায় চষে ফেলেছি। একটা জলাশয়ের ধারে হঠাৎ এক ঝাঁক হরিণ সন্ত্রস্ত হয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৯ জানুয়ারি ২০২০ ০০:১০
Share:

সতর্ক: ঢোল। মধ্যপ্রদেশের পেঞ্চ-এর জঙ্গলে

বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা। আর বাঘ যাদের ডরায় তারা ছুঁলে?যে জঙ্গলে হাতি নেই, সিংহের মতো বড় মাংসাশী প্রাণী নেই, সেখানে বাঘের আবার ভয় কাদের?

Advertisement

‘‘আছে, আছে। বাঘ ওদের দেখলে পালানোর পথ পায় না,’’ বললেন জঙ্গলের ধারে বেড়ে ওঠা টুরিস্ট গাইড, মধ্য-পঞ্চাশের সুখরাম। বলেন, ‘‘আপনি শীত, বসন্ত বা গ্রীষ্মে এই জঙ্গলে আসুন, বাঘের দেখা মিলবেই। কিন্তু বাঘকে ভয় পাওয়ানো সেই ‘ওদের’ দেখা মেলা ভার।’’

কুড়ি বছর ধরে পর্যটকদের জঙ্গল ঘোরানো টুরিস্ট গাইড একটু থামলেন। শেষ কবে ওই বাঘ-ডরানো প্রাণীটি তিনি দেখেছেন, মনে করতে পারেননি প্রৌঢ় মানুষটি। বলেন, ‘‘ওদের দেখানোর গ্যারান্টি বছরের কোনও সময়েই দিতে পারব না।’’

Advertisement

গত বর্ষার ঠিক পরেই গিয়েছিলাম মধ্যপ্রদেশে পেঞ্চ-এর জঙ্গলে। বাঘ দেখার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু সুখরাম আরও একটা প্রাণী নিয়ে কৌতূহল বাড়িয়ে দিল! বাঘের ঘরে এসে বাঘ-ডরানো চতুষ্পদটিকে দেখার বাসনা আরও তীব্র হল। পেঞ্চ-এর মুদিয়ারিথ গ্রামের এক রিসর্টের ম্যানেজার রাজর্ষি কর বলছিলেন, ‘‘বাঘের বদলে যদি ওদের দেখতে পান, জানবেন আপনি ভাগ্যবান।’’

এত তাড়াতাড়িই যে ভাগ্য সহায় হবে তা কে জানত! বিকেলে ঢুকেছি জঙ্গলে, তখন সন্ধে হব-হব। আমরা ছাদখোলা গাড়িতে চেপে জঙ্গল প্রায় চষে ফেলেছি। একটা জলাশয়ের ধারে হঠাৎ এক ঝাঁক হরিণ সন্ত্রস্ত হয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল। ‘বাঘ’, ‘বাঘ’ বলে এক সঙ্গে অনেক আওয়াজ উঠল। আগে-পরে দাঁড়িয়ে গেল বেশ কয়েকটি গাড়ি। সবাই সাফারিতে বেরিয়েছে। কারও কারও ঝুলি থেকে বেরিয়ে পড়ল লম্বা লেন্সওয়ালা ক্যামেরা।

জঙ্গলের ভিতর থেকে একটা ক্ষীণ আওয়াজ আসছে! চারিদিকে চোখ বুলিয়ে অভিজ্ঞ সুখরাম জানিয়ে দিলেন, ‘‘শের নেহি হ্যায় সাব।’’ বুঝলেন কী করে নেহি হ্যায়? আশপাশের গাছের ডালগুলিতে এবং মাটিতে নিশ্চিন্তে বসে থাকা হনুমানগুলোকে দেখিয়ে সুখরাম বললেন, যেখানে শের (বাঘ) থাকে, সেখানে লাঙ্গুর (হনুমান) থাকে না। ওদের মধ্যে খাদ্য-খাদকের সম্পর্ক যে!

কিন্তু জঙ্গলের মধ্যে নিশ্চয়ই কিছু আছে, যার জন্য এমন ঊর্ধ্বশ্বাসে পালিয়ে গেল হরিণের পাল! এমন কিছু, যার থেকে হরিণদেরও প্রাণ সংশয়ের আশঙ্কা রয়েছে!

বর্ষার পরে সদ্য গজিয়ে-ওঠা, হাঁটু অবধি ঘাসের জঙ্গলে অনেক ক্ষণ কিছু খুঁজতে থাকলেন সুখরাম। তার পরে গাড়ির চালককে দিকনির্দেশ দিলেন। অন্যেরা তখনও বাঘের দর্শন পেতে ঠায় দাঁড়িয়ে। আমাদের গাড়ি কিছুটা এগিয়ে একটা ইউ টার্ন নিল। ফিসফিস করে উঠলেন সুখরাম, ‘‘মিল গয়া সাব।’’

তত ক্ষণে ঘাসের জঙ্গল ফুঁড়ে রাস্তায় উঠে এসেছে একটা প্রাণী। রাস্তার কুকুর যেমন হয়, দেখতে সে রকমই। দৈর্ঘ্যে একটু বড় হবে কেবল। পিঠের দিকটা লাল। ঘাসের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে রাস্তায় এসে সে হাঁটতে লাগল আমাদের সামনে সামনে। সুখরাম তো বেজায় উত্তেজিত! ফিসফিস করেই বললেন, ‘‘ইয়ে জংলি কুত্তা সাব। শের ভি ইসকো ডরতা হ্যায়।’’ এই জংলি কুকুরের অন্য একটা নাম আছে, ঢোল।
আমরা বেশ কিছুটা দূর থেকে ওর পিছু নিলাম। উল্টো দিক থেকে আসা একটা গাড়ির হেডলাইটে বিরক্ত হয়ে রাস্তার ধারের ঘাসের বনে নেমে গেল সেই ঢোল। ঘাসের জঙ্গলের ভিতর থেকে আমাদের গতিবিধির উপরে নজর রাখতে লাগল। অনেকটা কাছ থেকে আমরাও দেখতে থাকলাম ওকে। মুখের গড়নটা শেয়াল আর নেকড়ে মেশানো। গলার কাছটা ধূসর। পিঠের লাল রংটা দেখে চেনা চেনা লাগছিল, ভাল করে দেখতেই মনে পড়ে গেল। এরা তো ‘জাঙ্গল বুক’-এর সেই ‘রেড ডগ’! এই কুকুরগুলোর কথাই তো লিখেছিলেন কিপলিং সাহেব! ভয়ানক হিংস্র। যারা দল বেঁধে থাকত সেই হাতিরা, বা শের খানও এদের দেখলে রাস্তা ছেড়ে দিত! শেষ অবধি মোগলি আর তার নেকড়ে-পরিবার কা নামের সাপটার সঙ্গে হাত মিলিয়ে কুকুরগুলোকে জঙ্গলছাড়া করতে পেরেছিল।

সুখরাম বললেন, ‘‘এই রাস্তা দিয়েই ও যাবে। আমাদের চলে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে।’’ তত ক্ষণে অন্য গাড়িটি দাঁড়িয়ে গিয়েছে। সেখানকার সওয়ারিরা বিদেশি। বেরিয়ে এল ক্যামেরা। শাটার পড়তে লাগল পটাপট। বোধ হয় তাতেই ভারী বিরক্ত হল সে। ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল গভীর ঘাসের জঙ্গলে।
বইয়ে পড়েছি, টিভি চ্যানেলেও দেখেছি— ঢোল যূথবদ্ধ প্রাণী। ১০-১২টি থেকে শুরু করে ৪০টি পর্যন্ত এক সঙ্গে ঘোরে। তাই শিকার কখনও পালাতে পারে না। কিন্তু আমাদের ওই ঢোল তবে একা একা কী করছিল জঙ্গলে? সে কি দলত্যাগী, না কি হারিয়ে গিয়েছে জঙ্গলে?

বন দফতরের এক কর্তাকে ধরলাম। তিনি গাছগাছালির বিশেষজ্ঞ, আর এক কর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিলেন। আমার প্রশ্নের জবাব পেয়ে গেলাম।

সেই বনকর্তা জানালেন, ওই একাকী ঢোল আসলে দলের অন্যতম অভিজ্ঞ সদস্য। একা একা ঘোরা হাতি বা সিংহের মতো দলছুট বলে ওকে ভাবলে নিতান্তই ভুল হবে। কোথায় নিরাপদে দলের মেয়ে কুকুরেরা নিরাপদে সন্তান প্রসব করবে, কোথায় শিকার পাওয়া যাবে, কোথায় প্রতিদ্বন্দ্বী দল ওত পেতে রয়েছে, এ সব ব্যাপারে দলের কাছে ঠিক খবর পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব ভাগ করা থাকে ঢোলদের মধ্যে। ও তেমনই এক জন দায়িত্বপ্রাপ্ত ‘কর্মী’। ওর পুরো দলটাই আশেপাশেই কোথাও আছে। এ ক্ষেত্রে ঢোলটি কী করছিল, এর বেশি তাঁর পক্ষে বলা সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দিলেন ওই বনকর্তা।

তবে জঙ্গল সংলগ্ন গ্রামের বাসিন্দা, টুরিস্ট গাইড সুখরামের ব্যাখ্যা, হরিণগুলি যে দিকে ছুটে পালাচ্ছিল, আমাদের দেখা ঢোলটি সেই অভিমুখে এগোচ্ছিল। এমনও হতে পারে, ও পুরো হরিণের ঝাঁকটিকে পাঠিয়ে দিয়েছে দলের বাকি সব সদস্যের কাছে। তার পরে নিজে ফিরছে দলের কাছে।

আমরা ওর ফেরার পথে বাধা সৃষ্টি করলাম শুধু শুধু। এখন যদি ওর কপালে খাবার না জোটে? সুখরাম হাসলেন, ‘‘ওরা আমাদের মতো নয়। ওর ভাগের মাংসটা কেউ না কেউ রেখে দেবে।’’

জার্মান শেফার্ডের থেকে ছোট ওই জংলি কুকুরকে নাকি ভয় পায় এখানকার বনের রাজা বাঘও! একটু ছোট চেহারার চিতাবাঘেরা ওদের সামনে শিকার ধরতেও ভয় পায়। চেহারায় বেশ ছোট ঢোলকে এত ভয় কেন বাঘেদের? বাঘের থাবার এক ঘায়ে তো বরং ঢোলের প্রাণ বেরিয়ে যাওয়ার কথা!

এক বনকর্তা আমার প্রশ্নের জবাব দিলেন। তাঁর কথায়, ‘‘ওরা দলবদ্ধ ভাবে আক্রমণ করে বাঘকে। দলের বেশ কয়েক জন প্রথমে বাঘের মনোযোগ আকর্ষণ করে তার নজর ঘুরিয়ে দেয় অন্যত্র। সেই ফাঁকে এক জন অতর্কিতে লাফ মেরে বাঘের নাক কামড়ে ধরে। অন্য দু’জন টার্গেট করে বাঘের চোখ দুটোকে। বাকিরা কেউ লেজ কামড়ে ঝুলে পড়ে। কেউ কেউ ঘন-ঘন কামড়াতে থাকে বাঘের সর্বাঙ্গে। আর তাতেই বাঘ কুপোকাত।’’

ওই বনকর্তা এও জানালেন, ঢোল নিজেদের ওজনের দশ গুণ বেশি ওজনের প্রাণীকেও অনায়াসে ঘায়েল করে ফেলতে পারে। ওই প্রাণীটিকে ঘিরে ধরে ঢোল অতর্কিতে তার চোখে আঘাত করে। আর সেই আক্রমণে হতচকিত হয়ে যায় আক্রান্ত প্রাণীটি। এর পর নিজের বিশাল আকৃতি আর ওজন সত্ত্বেও সে আর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে না।

চিতাবাঘেরা ঢোলের দল দেখলে সামনে শিকার থাকলেও হাত গুটিয়ে বসে থাকে। কারণ ওই শিকার হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। চিতাবাঘ শিকার ধরার অবব্যবহিত পরেই সেখানে ঢোলের দল চলে এলে, সেই শিকার ছিনিয়ে নিয়ে পালায় জংলি কুকুরের দল। তাই শিকার-সহ চিতাবাঘ ঢোলের মুখোমুখি পড়ে গেলে তারা মগডালে উঠে যায়। তবে ভারী শিকার হলে সেটিকে নিয়ে সে খুব উপরে উঠতে পারে না। এক সময় শিকার তার মুখ থেকে নীচে পড়ে যায়।

ঢোলের কথা শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, ওই প্রাণীটিকে যদি না দেখতাম, তবে আফসোস করতে হত। বাঘের থেকেও বিরল এই জংলি কুকুর দেখে রিসর্টে ফিরলাম যুদ্ধজয়ের ভঙ্গিতে। রিসর্টের ম্যানেজারবাবু সব শুনে মন্তব্য করলেন, ‘‘যে প্রাণীটির মাত্র আড়াই হাজার সদস্য এখন পৃথিবীতে টিকে আছে, তার একটিকে আপনি দেখে এসেছেন। লটারির টিকিট কেটে ফেলুন মশাই!’’

মনটা খচখচ করে উঠল শুনে। এমন দুর্ধর্ষ শিকারি প্রাণী, তবু আড়াই হাজারে নেমে এল! খোঁজ নিয়ে শুনলাম, ঘরে পোষা হাঁস, মুরগি, গরু, ছাগল বাঁচাতেই চিরকাল মেরে ফেলা হয়েছে ঢোলদের। গুলি, বিষ তির, শক্ত তারের ফাঁদ, বিষ মেশানো খাবার— উপকরণের কিছু কমতি ছিল না। মধ্য এশিয়ায় বিভিন্ন অঞ্চল, চিনের মাঞ্চুরিয়ায় এক সময় ঢোলের লোম ও চামড়ার তৈরি ফার কোট সবচেয়ে ভাল, দামি আর গরম পোশাক বলে মনে করা হত। ফলে যা হওয়ার, তা-ই হয়েছে।

বাঘ, সিংহ, চিতা— সকলেই ভয়ঙ্কর। তার চেয়েও ভয়ঙ্কর ঢোল।
কিন্তু হিংসায় মানুষের সঙ্গে পেরে ওঠেনি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement