ছবি: অমিতাভ চন্দ্র
গৌড়ের রাজা লক্ষ্মণ সেন, ১১৭৮-৭৯ থেকে ১২০৬ খ্রিস্টাব্দ তাঁর রাজত্বের সময়সীমা। খ্রিস্টীয় দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতক বাংলার এক বিশেষ সময়— তুর্কি আক্রমণ, ধর্মান্তর গ্রহণের জোয়ার, ক্রমবর্ধমান সামাজিক অবক্ষয়— তারই মধ্যে লক্ষ্মণ সেনের রাজসভা আলো করে রয়েছেন নবরত্ন, যাঁদের মধ্যমণি কবি জয়দেব, যাঁর ‘গীতগোবিন্দ’ কাব্য সংস্কৃত সাহিত্যের মূলধারার শেষ গরিমাময় রচনা। এর অনেক পরের আবিষ্কার ‘সেকশুভোদয়া’, সংস্কৃত সাহিত্যের মূল ধারার বাইরে এক অদ্ভুত কথাসাহিত্য, যার লেখক হলায়ুধ মিশ্র, যিনি লক্ষ্মণ সেনের মন্ত্রী এবং নবরত্ন সভার অন্যতম রত্ন হিসেবে প্রসিদ্ধ। ‘সেকশুভোদয়া’ গ্রন্থটি বিচিত্র এবং নানা কারণে উল্লেখযোগ্য।
বঙ্গদেশে হিন্দু-মুসলমানের পারস্পরিক অবস্থানের সর্বপ্রথম চিত্র এই গ্রন্থটিতে ধরা আছে। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ও সুকুমার সেনের মতে এ গ্রন্থের রচনাকাল ষোড়শ শতকের মাঝামাঝি, কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম দাসের ‘চণ্ডীমঙ্গল’-এর সমসময়ে। তাঁদের মতে এ গ্রন্থটি লক্ষ্মণ সেনের মন্ত্রী হলায়ুধের রচনা হতে পারে না, কারণ তিনি ছিলেন বিদগ্ধ পণ্ডিত, ‘ব্রাহ্মণসর্বস্ব’ প্রভৃতি গুরুগম্ভীর মীমাংসা ও ধর্মশাস্ত্র গ্রন্থের রচয়িতা। আর এ দিকে, ‘সেকশুভোদয়া’ গ্রন্থটি লেখা হয়েছে তথাকথিত অশুদ্ধ সংস্কৃতে, যা কিনা সুকুমার সেনের মতে ‘ডগ স্যাংস্ক্রিট’, জায়গায় জায়গায় মনে হয়, যেন বাংলা ভাষাকেই অনুস্বার বিসর্গ দিয়ে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে, যেমন— ‘কশ্চিৎ চিল্লঃ ছুয়িং দত্তবান্’—একটা চিল ছোঁ দিল। তবু দীনেশচন্দ্র সেনের মতো বাংলা সাহিত্যের গবেষক এটিকে লক্ষ্মণ সেনের মন্ত্রী হলায়ুধের রচনা বলেই গ্রহণের পক্ষপাতী। তাঁর মতে হলায়ুধের মূল রচনার উপরে পরবর্তী সময়ের মূর্খ পুঁথিলেখকরা লেখনী চালিয়ে ভাষার এই অশুদ্ধি ঘটিয়েছে।
কিন্তু শুধু ভাষাগত কারণেই নয়, এই সাতাশ অধ্যায়ের কাহিনিমালার চমৎকারিত্ব অন্যত্র। এই গ্রন্থের নামকরণই এর বিষয়বস্তুর ইঙ্গিত দিচ্ছে। তখনও ইসলামের সঙ্গে বিশেষ পরিচয়হীন বঙ্গদেশে এক মুসলমান সাধু বা সেকের (শেখ) শুভাগমন। এ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত কাহিনিগুলির নায়ক হলেন শেখ জালালউদ্দিন তাব্রিজি, বাংলায় আসা প্রথম সুফি পির, সুহ্রাবর্দি ধারায় ইসলামের প্রচার করতে যিনি আসেন রাজা লক্ষ্মণ সেনের গৌড়ে, তাঁর অলৌকিক আগমনটি ‘সেকশুভোদয়া’-র শুরুতেই বর্ণিত— রাজা গঙ্গা-প্রণাম করছেন, এমন সময়ে দেখলেন পশ্চিম দিক থেকে এক বীরপুরুষ, পরনে কালো পোশাক, মাথায় পাগড়ি, হেঁটে আসছেন নদীর জলের উপর দিয়ে… এহেন শেখের অলৌকিক ও আধ্যাত্মিক শক্তির পরিচয় পেয়ে লক্ষ্মণ সেন অচিরেই তাঁর অনুগত হয়ে পড়লেন। কালো পোশাক পরিহিত পাগড়িধারী শেখকে রাজার সঙ্গে আসতে দেখে তাঁর মন্ত্রী উমাপতি ধর বললেন— অকার্যং তে কৃতং রাজন্ননেন সহ গম্যতে/ কৃষ্ণাম্বরধরো বেশো দৃশ্যতে যবনাকৃতিঃ//— রাজা, আপনি এর সঙ্গে পথ হেঁটে অকার্য করেছেন, এই কালো কাপড় পরা লোকটির আকৃতি যবনদের মতো দেখছি!
রাজা কিন্তু তত ক্ষণে শেখের মহিমায় প্রভাবিত, মন্ত্রীকে প্রত্যুত্তরে বললেন— কিং বৃথা ভাষসে মূঢ় প্রভুতত্ত্বং ন জানতঃ/ দুর্বেশবেশমাস্থায় সাক্ষাদিন্দ্র ইহাগতঃ//— মূঢ়, প্রভুর মহিমা না জেনে কী বৃথা বকছ, দরবেশের বেশ ধরে সাক্ষাৎ ইন্দ্র এখানে এসেছেন! লক্ষণীয়, ফার্সি দরবেশ শব্দটির সংস্কৃতায়িত ‘দুর্বেশ’ রূপটি।
ইতিহাস অবশ্য লক্ষ্মণ সেনের মুসলমান বিদ্বেষেরই সাক্ষ্য দেয়, তাই এই গ্রন্থটির ঐতিহাসিক সত্যতা নিয়ে পণ্ডিতেরা সন্দিহান, কিন্তু তা হলেও এখানে উল্লিখিত কাহিনিগুলি, যেগুলি আসলে ত্রয়োদশ-চতুর্দশ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গদেশে প্রচলিত জনপ্রিয় লোককথা, সেগুলির মধ্যে তৎকালীন সমাজমানসের যে প্রতিফলন ঘটেছে তার সত্যতা সন্দেহের ঊর্ধ্বে।
‘সেকশুভোদয়া’ জানাচ্ছে, মন্ত্রী উমাপতি ধর ও অন্যদের বিরোধিতা গ্রাহ্য না করে লক্ষ্মণ সেন শেখের বসবাস ও উপাসনার জন্যে দান করলেন বাইশ হাজার রাজস্ব মূল্যের একটি ভূমি, গৌড়ের কাছেই পাণ্ডুয়ায়। শুধু তা-ই নয়, লক্ষ্মণ সেনের প্রতিদিনের জীবনচর্যায়, এমনকি রাজ্যশাসনের ব্যাপারেও শেখ তাব্রিজি হয়ে উঠলেন তাঁর পথপ্রদর্শক গুরু।
মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি বঙ্গদেশ আক্রমণ করেন ১২০৪ খ্রিষ্টাব্দে, যখন গৌড়ের অধিপতি লক্ষ্মণ সেন। কথিত আছে, মাত্র আঠারো জন সেনা নিয়ে বখতিয়ার খলজি গৌড়ের রাজপ্রাসাদ দখল করেন, বঙ্গেশ্বর গোপনে পালিয়ে যান দক্ষিণ-পূর্ববঙ্গে, তাঁর উত্তরসূরিরা সেই অঞ্চলটুকুরই রাজা হয়ে আরও দুই পুরুষ পর্যন্ত কোনও মতে কাটিয়ে যান। ‘সেকশুভোদয়া’-র নায়ক শেখ তাব্রিজি তুর্কি আক্রমণের বেশ কিছুটা আগেই এসে পৌঁছেছিলেন বাংলার মাটিতে। সুফি-সাধকদের সর্বপ্রাচীন জীবনী সঙ্কলন ‘সিয়ার আল-আফ্রিন’-এ (১৫৩০-৩৬ খ্রিস্টাব্দ) প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে ইরানের তাব্রিজ প্রদেশে জন্মে সুফিধর্মে দীক্ষাপ্রাপ্ত জালালউদ্দিন তাব্রিজি যুবক বয়েসে বাগদাদে যান, সেখানেই সাত বছর শেখ শিহাব আল-দিন সুহ্রাবর্দিকে গুরু হিসেবে পান।
সুহ্রাবর্দিরই নির্দেশে তাব্রিজি ভারতে সুফিধর্ম প্রচার করতে আসেন প্রথমে দিল্লিতে। দিল্লিতে তিক্ত অভিজ্ঞতা হওয়ায় তাব্রিজি আরও পুবে যাত্রা করে প্রথমে লখনউ ও পরে সেখান থেকে বাংলার রাজধানী গৌড়ে এসে পৌঁছন। সেখানে দেবমহল (বর্তমান দেওতলা) নামক স্থানে সুফিদের একটি আস্তানা বা ‘তাকিয়া’ নির্মাণ করেন এবং সেখানেই এগারো বছর পর তাঁর এন্তেকাল হয়।
মালদহের পাণ্ডুয়া অঞ্চলে অধুনা ‘বড়ি দরগা’ বলে পরিচিত বাইশ হাজারি দরগাটি শেখ তাব্রিজির মূল উপাসনাকেন্দ্র হিসেবে স্থাপিত হয় লক্ষ্মণ সেনের আমলেই, সেখানকার লক্ষ্মণসেনী দালান এখনও তার সাক্ষ্য বহন করে। এই দরগায় সযত্নে রক্ষিত থাকত হলায়ুধ মিশ্ররচিত ‘সেকশুভোদয়া’-র একমাত্র পুঁথিটি, যেটিকে সকলে বলত ‘পুঁথি মুবারক’, বিশেষ বিশেষ পুণ্যতিথিতে অথবা বিপত্তির সময়ে সেটি বার করে পাঠ করা হত— মানুষের বিশ্বাস ছিল, এই পাঠে বিপদ কেটে যায়।
ঊনবিংশ শতকের শেষ দিকে, যখন উমেশচন্দ্র বটব্যাল মালদহ জেলার কালেক্টর সাহেব, তাঁর দৃষ্টিগোচর হয় এই আশ্চর্য পুঁথিটি। সেটির জীর্ণ দশা দেখে বটব্যাল স্থানীয় বিদগ্ধ পণ্ডিত রজনীকান্ত চক্রবর্তী ও হরিদাস পালিতকে দিয়ে এটির একটি নকল করান। এর কিছু সময় পরেই উমেশচন্দ্র মালদহ থেকে বদলি হয়ে যান, সঙ্গে করে তিনি নাকি নিয়ে যান মূল পুঁথি ও তার শুদ্ধ নকল বা ‘ফেয়ার’ কপিটি। ১৮৯৮ সালে উমেশচন্দ্রের মৃত্যুর পরে মূল পুঁথি বা তার ‘ফেয়ার কপি’ কোনওটিরই আর হদিস পাওয়া যায়নি। শ্রীহরিদাস পালিতের কাছে থাকা একটি অসম্পূর্ণ খসড়া বা রাফ কপি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সুকুমার সেনের হস্তগত হয় এবং ১৯২৭ সালে তিনিই এটিকে সম্পাদনা করে প্রকাশ করেন, আরও পরবর্তী সময়ে যা ইংরেজি অনুবাদ-সহ কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত হয়। অবশ্য ১৩৭৩ বঙ্গাব্দে মালদহের বাইশ হাজারি ওয়াকফ এস্টেট প্রায় ষোলো বছরের চেষ্টায় ‘সেখ শুভোদয়া’ নামে এই গ্রন্থের একটি বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করে, যার ভূমিকাটি লিখেছিলেন মতিলাল দাস ১৩৫৭ বঙ্গাব্দে, সেখানে তিনি জানাচ্ছেন এই গ্রন্থের একটি পাণ্ডুলিপি নাকি ওয়াকফ এস্টেটের মোতোয়ালিদের কাছে সংরক্ষিত ছিল, যার সম্পাদনা ও সংস্কার করেন ইতিহাসের অধ্যাপক যতীন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় এবং বঙ্গানুবাদ করেন পণ্ডিত রামচন্দ্র কাব্যবেদান্ততীর্থ।
এ তো হল গিয়ে পুঁথিরহস্য, কিন্তু এর মধ্যে যে বস্তু আছে তা সেই যুগের জনজীবনের এক চলচ্চিত্রবৎ সজীব উপস্থাপনা। কী নেই সেখানে! এক দিকে কুটিল রাজনীতি, মেরুদণ্ডহীন অশক্ত রাজা, সমাজের সার্বিক নৈতিক অধঃপতনের ছবি, গরিব মানুষের দুর্দশা, কাপালিক ও যোগীদের দৌরাত্ম্য, রাজপরিবারের স্বজনপোষণ— আবার, আর এক দিকে ন্যায়বিচারের জন্যে সাধারণ মানুষ, বিশেষত মেয়েদের সরব হওয়া, প্রকৃত পণ্ডিত ও গুণিজনের সামাজিক সমাদর, অপরিচিত ধর্মের মানুষের মধ্যেও মানবিকতা দেখলে তার প্রতি সাধারণ মানুষের অনুরাগ, দশ জনের মতের সামনে স্বয়ং রাজারও নত হওয়া— সব মিলেমিশে এই গ্রন্থটিকে অনন্য করেছে। সংস্কৃত কেন, সে সময়কার কোনও বাংলা সাহিত্যেও এর তুলনা নেই।
‘সেকশুভোদয়া’-য় সমসময় বা তারও আগেকার গৌড়ের মেয়েদের দেখা মেলে এই গ্রন্থে। এদের মধ্যে যেমন আছেন বল্লভা, কমলসেনী, সোমপ্রভা, সাবিত্রীর মতো রাজরানি, মাধবীর মতো ধনী বণিকঘরের বৌ, কবি জয়দেবের অসামান্য প্রতিভাময়ী সঙ্গীতজ্ঞা স্ত্রী পদ্মাবতীর মতো অভিজাত ও উচ্চবর্গের নারীরা; তেমনই আছেন বিদ্যুৎপ্রভা ও শশিকলা নামে নটী, ধোপার বৌ, শুঁড়ির বৌ, এমন আরও কত সমাজের তথাকথিত নিম্নবর্গের মেয়ে।
‘সেকশুভোদয়া’-র প্রথম পরিচ্ছেদেই দেখা মেলে গাঙ্গো নটের পুত্রবধূ বিদ্যুৎপ্রভার। এই বলিষ্ঠ চরিত্রটি এ গ্রন্থের বিভিন্ন অধ্যায়ে ফিরে ফিরে আসে, পেশায় সে নর্তকী, দেহব্যবসাও করে পরিবারের জ্ঞাতসারেই, অথচ আশ্চর্য এই যে, সমাজের প্রান্তিক স্থানের এই নারী যখন প্রকাশ্য রাজসভায় কথা বলেন, তখন তা শোনা হয়। এমনকি স্বয়ং রাজমন্ত্রীর বিরুদ্ধে তাঁর আনা অভিযোগও সমাজের মাথারা গুরুত্ব দিয়ে শুনে ন্যায্য বিচার করেন। তাঁর সাহস, তেজ ও ক্ষুরধার বাক্যের কাছে সর্বসমক্ষে মন্ত্রী উমাপতি ধর অবধি নতি স্বীকার করতে বাধ্য হন। গ্রন্থের শুরুতেই শেখ তাব্রিজি ও লক্ষ্মণ সেনের যখন প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে গঙ্গাতীরে, তার একটু পরেই শেখ দেখেন একটি কঞ্চুক পরিহিতা রমণী কাঁখে কলসি নিয়ে পথ দিয়ে যাচ্ছে। ইতিপূর্বে নারীঘটিত মিথ্যা অপবাদে শেখের একাধিক বার লাঞ্ছনা ঘটেছে, হয়তো বা সে কারণেই এই অপরিচিত প্রগল্ভ নারীটির উদ্দেশে শেখ একটি বাঁকা কথা বলে বসেন, ‘ওহে শূন্যকলসী-কাঁখে পাপীয়সী নারী, নিজের ভালো যদি চাও তাহলে বাড়ি ফিরে যাও…’ এই নারীটিই বিদ্যুৎপ্রভা, বিদ্যুৎস্ফুলিঙ্গের মতো ঝলসে উঠে সে শেখকে দশ কথা শুনিয়ে দিয়ে বলল, যদি নারীমাত্রেই পাপীয়সী হয়, তা হলে শেখ-ও পাপী, কারণ তাঁর জন্মও তো নারীরই গর্ভে— “সিংহ থেকে সিংহ জন্মায়, মৃগ থেকে মৃগ, পাপ থেকে পাপেরই জন্ম… তুমিও তা হলে পাপী, পাপ থেকেই তো জন্মেছ, তাই তুমিও পাপের কারণ, তবে আমাকে পাপীয়সী বলে কথা শোনাচ্ছ কেন?” (সেকশুভোদয়া ১।২৬)
আবার, এ গ্রন্থের ষোড়শ পরিচ্ছেদে দেখি, রাজসভায় বিদ্যুৎপ্রভা ও শশিকলা এই দুই নর্তকীর অপূর্ব গান শুনে সভায় উপস্থিত সবাই যখন উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করছে, তখন মন্ত্রীকে চুপ করে থাকতে দেখে শেখ তাব্রিজি তাঁর নীরবতার কারণ জিজ্ঞেস করেন। তিনি কোন উত্তর দেওয়ার আগেই বিদ্যুৎপ্রভা বলে ওঠে, “মন্ত্রী আমার উপরে রেগে আছেন।” মন্ত্রী বিরক্ত হয়ে বলেন, “আরে পাপিষ্ঠা, আমার নামে যা-খুশি বদনাম দিচ্ছ!” শেখ দু’জনের মধ্যেকার এই বিবাদের কারণ জানতে চান, নানা চাপান-উতোরের মধ্যে মন্ত্রী এক রকম কোণঠাসা হয়ে বলে ফেলেন যে, বিবাদ কী নিয়ে, সে ব্যাপারে বিদ্যুৎপ্রভা যা বলবে তা-ই সত্যি বলে তিনি মেনে নেবেন। বিদ্যুৎপ্রভা তখন বলে, মন্ত্রী নাকি তাকে আর শশিকলাকে এক সঙ্গে নিজের বাড়িতে ডেকে পাঠিয়ে সারা রাত যথেচ্ছ সুরতক্রীড়া করে তাদের মাত্র কুড়িটি মুদ্রা দিতে যান। নর্তকীরা পাঁচশো মুদ্রা চান, কিন্তু তিনি তা দেন না। ক্ষুব্ধ নর্তকীরা তাঁর থেকে কোনও অর্থই নেন না এবং বাড়ি ফিরে নিজের নিজের শ্বশুর-শাশুড়িকে মন্ত্রীর এই কীর্তির কথা জানিয়ে দেন। ভরা রাজসভায় সামান্য এক নটীর মুখে এমন অভিযোগ শুনে মন্ত্রী তো একেবারে ‘হা হতোঽস্মি’ বলে চিৎকার করে মাটিতে পড়ে গেলেন। তার পর উঠে বসে বললেন, “হে সভাসদবৃন্দ, এই রাজ্যে এমনটাই যদি রীতি হয়ে থাকে, তবে তো ভালই, নয়তো এই পাপীয়সী নর্তকীকে আমি উচিত শাস্তি দেবই।”
সঙ্গে সঙ্গে ফুঁসে উঠে বিদ্যুৎপ্রভা বলেন, “কী, আমার সঙ্গে ফুর্তি করে একটা কানাকড়িও দাওনি, উল্টে আবার শাস্তি দিতে চাও!”
মন্ত্রী বললেন, “তোমার অভিযোগের সাক্ষী ডাকাও।”
বিদ্যুৎপ্রভা বলে, “কেউ আবার সাক্ষী রেখে পরদারগমন করে নাকি? বলতে তোমার লজ্জা করছে না?” এই সব কুরুচিকর ঝগড়ার সমাধান করতে শেখ রাজাকে অনুরোধ করলে পরে রাজা মুখ নিচু করে বলেন “আমি এ সব কিছু জানি না।”
এতে শেখের মনে হল, ‘এই রাজ্যে মন্ত্রী যখন পরদারগমন করেন, রাজাই বা বাদ যাবেন কেন!’ অগত্যা শেখ রাজসভায় উপস্থিত ব্রাহ্মণ সভাসদদের এ বিবাদের নিষ্পত্তি করতে অনুরোধ করলেন। সকলেই বললেন, “হে মহাবুদ্ধি, আপনি থাকতে আমরা আর কী বলব?”
শেখ বললেন, “আপনারা আমাকে ভয় পাচ্ছেন কেন! আমি তো অতিথি, আর এই রাজ্য তো চিরকাল আপনাদেরই, আপনারা মহাপণ্ডিত, আপনারাই শাস্তির বিধান দিন, নতুবা দুই পক্ষকেই সমান বলে মেনে নেওয়া হোক।”
তখন ব্রাহ্মণরা মন্ত্রীকে বললেন, “আপনি না প্রথমেই কথা দিয়েছিলেন, বিদ্যুৎপ্রভা যা বলবে তা-ই মেনে নেব, এখন সে এ কথা বলছে, তা হলে মানতে অস্বীকার করছেন কেন? আমরা রায় দিচ্ছি, আপনিই অপরাধী, অন্য কেউ নয়।”
সভাসদদের এই রায় শুনে মন্ত্রী একেবারে চিৎকার করে কেঁদে উঠে বললেন, “আমি জলে প্রবেশ করে প্রাণত্যাগ করব, এর অন্যথা হবে না।” তখন বিদ্যুৎপ্রভা মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে সব সভাসদদের উদ্দেশে বললেন, “আমার ন্যায্য পাওনা আমি এত ক্ষণে পেলাম।”
ভয়ে সেই সভায় তখন কেউ আর কোনও কথাই বলছে না দেখে শেখ ঘোষণা করে দিলেন, “বাদী ক্ষমা করে দিয়েছে, অপরাধী ছাড়া পেলেন।” তার পরে তিনি বিদ্যুৎপ্রভাকে বললেন, “নানা ব্যভিচার আর অন্যায় করেছেন বলে মন্ত্রীকে অপরাধী প্রমাণ করেও তার পরে তাঁকে ক্ষমা করে দেওয়ার কারণ কী?” তখন বিদ্যুৎপ্রভা যে উত্তর দিলেন তা অবাক করে দেওয়ার মতো, তিনি দু’টি সুভাষিত শ্লোক উদ্ধৃত করে বললেন, “অসন্তুষ্ট হলে ব্রাহ্মণদের, সন্তুষ্ট হলে রাজাদের, সলজ্জা হলে গণিকাদের আর নির্লজ্জা হলে কুলস্ত্রীদের বিনাশ ঘটে। তাই, হে মহাবুদ্ধি, এটাই ধরে নেওয়া উচিত, যে রাষ্ট্রে মন্ত্রী পরদারগমন করেন, সেখানকার রাজাও তা-ই করেন। আর, যেখানে রাজা আর মন্ত্রী দুজনেই ব্যভিচারী সেই রাষ্ট্রের বিনাশ যে অবশ্যই ঘটবে, এতে কোনও সন্দেহই নেই।” বিদ্যুৎপ্রভার এই কথা শুনে শেখ ‘সাধু সাধু’ করে ওঠেন এবং বলেন, “এই নর্তকী ধন্য।” বহু ধন দান করে বিদ্যুৎপ্রভাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হল।
রাজসভায় কোনও নারীর আনা অভিযোগ এবং তার নাটকীয় পরিণতির আর একটি ঘটনা দেখা যায় ‘সেকশুভোদয়া’-র তৃতীয় পরিচ্ছেদে। মাধবী নামে এক বণিক বধূ তার মুমূর্ষু স্বামীর সঙ্গে সহমরণে যেতে বদ্ধপরিকর। তাঁর শ্বশুর, শাশুড়ি কেউই তাঁকে আটকাতে পারছেন না। হাতে একটা ছুরি নিয়ে স্বামীর সঙ্গে নিজেকে এক কাপড়ে বেঁধে মাধবী গঙ্গাতীরে যাচ্ছেন চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে। এই গোলমাল শুনে শেখ তাব্রিজির কথায় রাজা মাধবীকে রাজসভায় আনালেন। মাধবী শুধু সহমরণে যেতে চায়, কেউ তাঁকে বাধা দিতে এলে তাকে তিনি ছুরি দিয়ে মারবেন, এতটাই খেপে আছেন। শেখ ও অন্য সভাসদেরা তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে সহমরণে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া রাজার পক্ষে অসম্ভব, কারণ তাতে স্ত্রীহত্যার দোষ ঘটবে। মাধবী কেন বাঁচতে চান না, সেটা তিনি বরং বলুন। তখন প্রকাশ্য রাজসভায় মেয়েটি নিজের হেনস্থার কথা বলতে শুরু করে, যদিও এই প্রগল্ভতার জন্য তার শ্বশুর তাকে একটা চড় মারেন, তবু শেখের মধ্যস্থতায় মেয়েটি মুখ খুলতে পায়। সে জানায়, এক দিন গঙ্গাস্নানের সময়ে রানি বল্লভার ভাই কুমারদত্তের নজরে সে পড়ে গিয়েছিল। তখন থেকে সমানে সেই লম্পট রাজশ্যালকের নানা প্রলোভন আর ভয় দেখানোর মধ্যেও সে কোনও মতে নিজেকে বাঁচিয়ে চলছিল। কিন্তু, দুর্বুদ্ধি কুমারদত্ত ফন্দি করে মাধবীর স্বামী ও শ্বশুরকে মিথ্যা অভিযোগে গ্রেফতার করিয়ে এক দিন রাতে মাধবীর বাড়িতে ঢুকে তার গায়ে হাত দেয়। মাধবীর চিৎকারে পাড়া-প্রতিবেশী এসে তাঁকে বাঁচায় ও কুমারদত্তকে ধরে মন্ত্রীর কাছে নিয়ে যায়। কিন্তু, রাজার শালা, একে শাস্তি দিলে রানি চটবেন, ফলত রাজাও— এই সব সাতপাঁচ ভেবে মন্ত্রী উমাপতি ধর কুমারদত্তকে ছেড়ে দেন এবং মাধবীকে বলেন, রাজদরবারে নালিশ জানাতে। অতি ধনবান বণিকের গৃহবধূ হওয়া সত্ত্বেও মাধবী ভয়ানক নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকেন এবং সে সময়ই তিনি জানতে পারেন তাঁর স্বামী মারাত্মক রোগে আক্রান্ত ও তাঁর মৃত্যু নিশ্চিত। এ অবস্থায় তিনি স্বামীর সঙ্গে সহমরণে যাওয়াই শ্রেয় বলে ভাবেন। রাজসভায় মাধবীর এই অভিযোগের বৃত্তান্ত জানতে পেরে লক্ষ্মণ সেনের রানি বল্লভা সেখানে ছুটে আসেন এবং সভার মধ্যেই মাধবীকে কুৎসিত গালি সহযোগে মারতে শুরু করেন। এই সব কাণ্ড দেখে সভায় উপস্থিত গোবর্ধনাচার্যের মতো সর্বজনমান্য ব্রাহ্মণ পণ্ডিত ক্রুদ্ধ হয়ে রাজাকে ভয়ানক ভর্ৎসনা করে শাবল তুলে রানির দিকে তেড়ে যান, পরে আত্মসংবরণ করে বলেন, “রাজপত্নী হওয়ার অহঙ্কারে এমন অধর্ম আচরণ করছ তুমি? তোমার ভাই একে ধর্ষণ করেছে, তুমিও একে তাড়না করছ! শিগ্গিরিই এই রাজ্যের রাজলক্ষ্মী বিদায় নিতে চলেছে। শোনা যায়, বহু দিন আগে রাজা রামপালের একমাত্র পুত্র এক নারীকে ধর্ষণ করেছিল, সে কথা জানতে পেরে রাজা তাঁর নিজের ছেলেকে শূলে দিয়েছিলেন। আজ অবধি লোকে এই জন্যে তাঁর যশ গায় যে, রাজা রামপাল, অপরাধী হোক বা না-হোক, নিজের একমাত্র পুত্রকে শূলে দিয়েছিলেন”— এই বলে লাঠি আর কমণ্ডলু নিয়ে গোবর্ধনাচার্য চলে যেতে উদ্যত হন। তখন রাজা নিজে উঠে তাঁর পায়ে পড়ে তাঁকে শান্ত করেন, এবং খড়্গ হাতে কুমারদত্তকে বধ করতে যান। সে মুহূর্তে গৃহবধূ মাধবীও নটী বিদ্যুৎপ্রভার মতোই এক অদ্ভুত কথা বলেন। রাজাকে কুমারদত্তের প্রাণ না-নিতে অনুরোধ করে বলেন, “মহারাজ, এ আমার গায়ে হাত দিয়েছে বলে আমার প্রাণ তো যায়নি, জাতও নয়। আপনি যে এটুকু করেছেন তাতেই আমি বিচার পেয়েছি, এখন একে মাপ করে দিন। হয়তো আমারই দুর্দৈব অথবা জন্মান্তরের কোনও পাপের জন্য এই লাঞ্ছনা আমার কপালে ছিল। এখন সব কিছুর শান্তি হোক।” এই কথায় সভার সকলে সাধু সাধু করে ওঠে।
পাঞ্চাল দেশের মেয়ে দ্রৌপদী, দুঃশাসন তাঁর চুলে হাত দিয়েছিল বলে তার রক্ত দিয়ে যত ক্ষণ না সেই চুল ধুতে পারছেন, তত দিন চুল বাঁধবেন না বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, বেধেছিল কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ, আর গৌড়ের মেয়ে মাধবী বলেন কি না তার গায়ে একটা খারাপ লোক হাত দিয়েছে বলে তার প্রাণ তো যায়নি, কাজেই লোকটাকে ক্ষমা করে দেওয়া হোক, রাজ্যে শান্তি নামুক! বঙ্গরমণীরা চিরকালই প্রতিবাদী, আবার শান্তি কামনায় ক্ষমাশীলাও। সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে।