গুরু-শিষ্য: বাম দিক থেকে তৃতীয়, আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। একেবারে বাম দিকে, গোপাল হালদার
ঘড়ি ধরে ঠিক আধ ঘণ্টা সময় বরাদ্দ ছিল সাক্ষাতের। আলিপুর প্রেসিডেন্সি জেলে বন্দির আত্মীয়রা অধীর অপেক্ষা করে থাকতেন, কখন তাঁদের পালা আসবে। ব্রিটিশ পুলিশের নিয়মে শিথিলতার কোনও নামগন্ধ নেই। বিশেষ করে স্বাধীনতা সংগ্রামী রাজনৈতিক বন্দিদের ক্ষেত্রে নজরদারি থাকত খুব কড়া। গোয়েন্দাস্থানীয় কোনও ব্যক্তি গম্ভীর মুখে, সতর্ক দৃষ্টি ও সজাগ শ্রবণের নাগপাশে বেঁধে রাখতেন গরাদের দুই পাশের দু’জনকে।
সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় যখন তাঁর প্রিয় শিষ্য, জেলবন্দি গোপাল হালদারের সঙ্গে দেখা করতে আসতেন, প্রথম দিন থেকে তাঁদের পাহারার দায়িত্বে ছিলেন ভূপেনবাবু। তরুণ, শিক্ষিত গোয়েন্দাটি ভাষাচার্য সুনীতিকুমার সম্পর্কে ‘ওয়াকিফ-হাল’। এমন দর্শনার্থী তো জেলখানায় খুব একটা আসেন না! তাই প্রথম সাক্ষাতের দিনটিতেই ভূপেনবাবুর ‘দৃষ্টির স্থির গাম্ভীর্য একটু একটু করে পরিণত হয়ে গেল শ্রোতার আগ্রহে, মজা পাওয়া মানুষের নাতিপ্রচ্ছন্ন প্রফুল্লতায়।’ আসলে জেলের ভিতরে একটার পর একটা একঘেয়ে সাক্ষাৎকারের পাহারা দিতে গিয়ে যে অনিবার্য শ্রান্তি তাঁকে পেয়ে বসত, সুনীতিবাবু এলে মুহূর্তে মুছে যেত সেই ক্লান্তিরেখা।
দফতরখানার হিসেব অনুযায়ী, ‘একদা’ উপন্যাসের লেখক গোপাল হালদারের প্রথম বারের বন্দিজীবন আরম্ভ হয় ১৯৩২ সালের ২৯ এপ্রিল। এর দু’বছর আগে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারতীয় ভাষাতত্ত্ব ও ধ্বনিবিজ্ঞানের খয়রা অধ্যাপক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের গবেষণা-সহকারী হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু গত শতকের ত্রিশের দশকের সেই অগ্নিক্ষরা দিনগুলিতে এক দিকে দেশ জুড়ে আইন অমান্য আন্দোলন, অন্য দিকে বিপ্লবী আন্দোলনের যে জোয়ার নেমে এসেছিল, তা থেকে দূরত্ব রক্ষা করা গোপাল হালদারের পক্ষে সম্ভব ছিল না। শিক্ষক সুনীতিবাবু তাতে দুঃখিত হলেও ছাত্রকে নিবৃত্ত করতে চাননি। বরং এই অভূতপূর্ব জনজাগরণের প্রতি তাঁরও সহানুভূতি ও সমর্থন যে অকুণ্ঠ ছিল, তার পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল কুখ্যাত হিজলি হত্যাকাণ্ডের কিছু দিন পরেই।
১৯৩১-এর ১৬ সেপ্টেম্বর। মেদিনীপুরের হিজলি বন্দিশালায় গভীর রাতে পাগলা ঘণ্টি বাজিয়ে নির্বিচারে গুলি চালাল ব্রিটিশ পুলিশ। সুভাষচন্দ্র বসুর সহপাঠী সন্তোষ মিত্র এবং মাস্টারদা সূর্য সেনের সহকর্মী তারকেশ্বর সেনগুপ্ত সেখানেই প্রাণ হারালেন। প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠল গোটা বাংলা। ঠিক সেই সময়েই এক দিন আচার্যের বাড়িতে ব্যক্তিগত প্রয়োজনে উপস্থিত গোপাল হালদার। সুনীতিবাবু কিন্তু ছাত্রকে বসতেও বললেন না। বাড়ির প্রধান ফটক থেকে তাঁকে ধরে নিয়ে চললেন রবীন্দ্রনাথের কাছে: “আমার সঙ্গে কবির এখনি সাক্ষাৎ স্থির হয়ে আছে। হিজলীর ঘটনায় কবি বিশেষ মর্মাহত— এখুনি চলুন, যা তাঁর জানার ইচ্ছা তাঁকে জানাবেন।” গোপালবাবুর পরনের খদ্দরের ধুতি-পাঞ্জাবি দু-দিনের বাসি, একদম অপরিচ্ছন্ন হয়ে আছেন; তা ছাড়া গুরুদেবকে একটু ভাবনা-চিন্তা না করে তথ্য পরিবেশন করলে যদি কোনও ত্রুটি ঘটে যায়— এই সমস্ত আপত্তির কোনওটাই টিকল না সুনীতিবাবুর কাছে। ‘বিচিত্রা ভবন’-এর দোতলার দক্ষিণ-পূর্ব প্রকোষ্ঠে কবির সঙ্গে ভাষাচার্যের একান্তে বিশ্বভারতী প্রসঙ্গে কিছু আলোচনা হল। তার পরেই সুনীতিকুমার ছাত্রকে দেখিয়ে রবীন্দ্রনাথকে বললেন: “হিজলীর পরে বিদ্রোহী-পন্থা সম্বন্ধে কিছু জানতে চাইলে এঁকে জিজ্ঞাসা করতে পারেন।” এর পরের পনেরো মিনিট কবি সুনীতি-শিষ্যকে খুঁটিনাটি অনেক কিছু জিজ্ঞাসা করলেন। রবীন্দ্রনাথের প্রতিক্রিয়ায় হিজলি-কাণ্ডের নৃশংসতার প্রতি তীব্র ক্ষোভ গোপালবাবুর নজর এড়িয়ে গেল না। ২৬ সেপ্টেম্বর হিজলি ও চট্টগ্রাম হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে কলকাতায় যে সভা হল, তাতে সভাপতিত্ব করলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
অনতিকাল পরে শুরু হল গোপাল হালদারের কারাজীবন। আইনত রক্তের সম্পর্কের কোনও আত্মীয়ই কেবল বন্দির সঙ্গে দেখা করতে পারেন। সুনীতিকুমার তেমন ‘আত্মীয়’ নন। ‘রাজনৈতিক বন্দি গোপাল হালদার তাঁর অধীনে গবেষণা করেন এবং এই কাজে আচার্যের উপদেশ গবেষকের প্রয়োজন’— এই যুক্তি দেখিয়ে তিনি নিজে কর্তৃপক্ষের সাক্ষাতের অনুমতি প্রার্থনা করলেন। প্রথমে পাওয়া গেল গবেষণাকর্মে সাহায্য করার জন্য চিঠি আদান-প্রদানের অধিকার, তার পর পেলেন প্রয়োজনীয় বইপত্র পাঠানোর অনুমতি। এ সবের মধ্যেই গোপাল হালদারকে কলকাতা থেকে বক্সা বন্দিশালায় পাঠিয়ে দেওয়া হল। সুনীতিবাবুর সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ আর না থাকলেও বইগুলি বন্দির সহযাত্রী হল, সেই সঙ্গে যুক্ত হল ভাষাচার্যের অবিরল পত্রধারা। গোপাল হালদার লিখেছেন: ‘বইপত্র ও চিঠিপত্র— ঐ দুই সূত্রে প্রায় প্রথম থেকেই সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় আমার সম্মুখে জেলখানার বাইরের পৃথিবীর পথ উন্মুক্ত করে রাখলেন— সেই রুদ্ধ প্রাঙ্গণের মধ্যে পত্রগুলির মারফত জীবনের অজস্র ছোট-বড় ঘটনার আলোকরেখা বিচ্ছুরিত হয়ে পড়ত।’
বক্সা বন্দিশালায় অসুস্থ হয়ে পড়েন গোপাল হালদার। চিকিৎসার প্রয়োজনে তাঁকে দু’বার প্রেসিডেন্সি জেলে নিয়ে আসা হয়— ১৯৩৩ সালের অগস্টে এবং ১৯৩৬-এর সেপ্টেম্বরে। দু’বারই দীর্ঘ দিন কলকাতায় রাখা হয়েছিল তাঁকে। সুনীতিকুমার কর্তৃপক্ষের কাছে রীতিমতো ছোটাছুটি করে ছাত্রের সঙ্গে সাক্ষাতের অনুমতি জোগাড় করতে সমর্থ হলেন: “মাসে এক-আধবার জেলখানার কক্ষে আধ ঘণ্টা করে সাক্ষাৎ হত— মুখোমুখি দেখা হত, কথা হত, আর সে কথায় থাকত তাঁর গল্প-আলাপের চিরদিনকার ঐশ্বর্য।” নৃতত্ত্ব ও জাতিতত্ত্ব, পুরাতত্ত্ব, আফ্রিকার নিগ্রো শিল্পের সৌন্দর্য ও তাৎপর্য, চিনা দেবদেবীর কাহিনি, রোমক লিপির পরিকল্পনা, চণ্ডীদাস-সমস্যা, রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতী, বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালী’— কত বিষয় নিয়ে যে সুনীতিকুমার অবিরল কথা বলে যেতেন! ‘আলাপ-শিল্পী’ ভাষাচার্যের কৌতুকস্পর্শে সব কিছুই সজীব সপ্রাণ হয়ে উঠত।
এ সব কথা শুনতে শুনতে আগ্রহ বেড়ে যেত পাহারারত ভূপেনবাবুরও। এমনকি শেষ দিকে দু’-এক সময় তিনি হাসিও গোপন করতে পারতেন না। একঘেয়ে কাজের মধ্যে এই আধ ঘণ্টা সময় শুধু বন্দি মানুষটির নয়, পাহারাদার মানুষটির পক্ষেও বিশেষ টনিকের কাজ করত। দেখতে দেখতে কী ভাবে যে আধ ঘণ্টা কেটে যায়! অবশেষে চলে আসে বিদায়ের ক্ষণ। উঠি-উঠি করেও এক-আধ মিনিট দেরি হয়ে যেত, ‘বুঝতাম দু-দশ মিনিট বাড়িয়ে নিলেও ভূপেনবাবু আপত্তি করতেন না। হয়তো মনে মনে খুশিই হতেন।’ কিন্তু অন্য দর্শনার্থীরা কারাবন্দি নির্যাতিত আত্মীয়-মুখ দর্শনের আশায় জেলের ফটকে বসে আছেন, দেরি হলে তারা অধীর হয়ে উঠবেন— এই ভেবে গুরু-শিষ্য কখনওই সুযোগের অপব্যবহার করতেন না।
ফজলুল হক মন্ত্রী হলেন। ফলে জেলের ভিতর কড়াকড়ি অনেকটাই কমে গেল। ১৯৩৭-এর শুরু তখন। বিদেশ থেকে ফিরে এসে সুনীতিকুমার তাঁর প্রিয় ছাত্রকে নিজের নতুন বাড়ি ‘সুধর্মা’ দেখানোর জন্য উদ্গ্রীব হলেন। ‘গবেষণার বিষয়ে তিনি একটু দীর্ঘ আলোচনা করতে চান, গৃহে না হলে সে সব জেলে সম্ভব হচ্ছে না’— এই ছিল আবেদনের বয়ান। অনুমতি পাওয়া গেল। পুলিশ-পাহারায় ঘণ্টা তিনেকের জন্য বন্দি যেতে পারবেন বালিগঞ্জের সেই ঠিকানায়। ‘সুধর্মা’ নামের বিখ্যাত সেই বাড়িতে সে দিন আচার্য ও শিষ্যের মধ্যে ভাষাতত্ত্ব নিয়ে এতটুকু আলোচনা হয়নি। স্থির মনে, শান্ত স্বাভাবিক কণ্ঠে সুনীতিকুমার সে দিন বলে গিয়েছেন সাধারণ মানুষের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধার কথা।
সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে গোপাল হালদার জেল থেকে ছাড়া পেয়ে নিজ গৃহে অন্তরিন হলেন। গতিবিধি সীমাবদ্ধ, বাইরের কারও সঙ্গে সাক্ষাৎ নিষিদ্ধ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়োজনে দারভাঙা হলে ভারতবিদ্যা-আচার্য ফ্রেডরিক উইলিয়াম টমাস-এর বক্তৃতামালা। বিষয় খোটানে প্রাপ্ত প্রাচীন লিপির বৌদ্ধ পুঁথি। বছর শেষের এই আলোচনাসভাতেও যাতে গোপাল হালদার উপস্থিত থাকতে পারেন, তার অনুমতি বার করে আনলেন সুনীতিকুমার। এই অনুমতি ভাষাচার্য সহজে পেয়ে গিয়েছিলেন তা নয়। কর্তৃপক্ষ তাঁকে সৌজন্য দেখালেও বক্রোক্তি করতে ছাড়েনি: “আপনি বলছেন হালদার আপনার কাছে গবেষণাকর্মে নিযুক্ত ছিলেন, কিন্তু আমাদের রেকর্ড বলছে তিনি অন্য রকম কাজেই বেশি লিপ্ত ছিলেন।” সুনীতিকুমার পরোয়া করেননি এই সন্দেহের তির্যকতা। গোপাল হালদার ‘গুরুভাগ্যের এই সৌভাগ্যের’ কথা স্বীকার করে লিখেছেন: ‘আচার্য সুনীতিকুমারের মতো ‘বন্দীর বন্ধু’ আর কেউ ছিলেন কিনা জানি না, কিন্তু এমন অযাচিত বন্ধুকৃত্য বোধহয় আর কেউ এমন নিরবচ্ছিন্নভাবে করতে পারেননি, করার সুযোগও আয়ত্ত করতে পারতেন না।’
কৃতজ্ঞতা: পল্লব মিত্র, সুমাল্য মৈত্র