সুরসাধক: সঙ্গীত পরিবেশনার সময় মন এবং মস্তিষ্কের সঠিক মেলবন্ধনে বিশ্বাস করতেন আচার্য চিন্ময় লাহিড়ি (মাঝখানে)
পরিচিত ছক ভেঙে এগিয়ে চলাই বোধ হয় প্রকৃত শিল্পীর ধর্ম। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পী আচার্য চিন্ময় লাহিড়িও প্রচলিত প্রথার বাইরে বেরিয়ে সারা জীবন নতুনত্বের সন্ধান করে গিয়েছেন। আজ তাঁর কথা লিখতে গিয়ে ভাবছি, কোন দিক নিয়ে লিখি? তিনি তো শুধুই সঙ্গীতশিল্পী ছিলেন না, ছিলেন একাধারে সঙ্গীতস্রষ্টা, গুরু, স্বামী, পিতা এবং অগণিত মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালবাসার পাত্র, তাদের প্রিয় শিল্পী।
ছোটবেলা থেকে আমি বড় হয়েছি অসমে আমার মামা ও প্রথম গুরু শ্রদ্ধেয় বীরেন্দ্রকুমার ফুকনের কাছে। উনি তৎকালীন অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো গুয়াহাটি ও ডিব্রুগড় স্টেশনের স্টেশন ডিরেক্টর ছিলেন। উনি একাধারে পণ্ডিত শ্রীকৃষ্ণ রতন ঝংকারজি ও পণ্ডিত চিন্ময় লাহিড়ির শিষ্য ছিলেন। তখনকার দিনে আকাশবাণীতে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ‘চেন কনসার্ট’-এর প্রচলন ছিল। তা ছাড়া অসমের বিভিন্ন অঞ্চলে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অনুষ্ঠান হত। সেই সুবাদে পণ্ডিত চিন্ময় লাহিড়িকে প্রায়ই অসমে যাতায়াত করতে হত। সেই সময় গুয়াহাটি বা ডিব্রুগড়ে কোনও অনুষ্ঠান থাকলে আমার মামা আমাদের বাড়িতে ওঁর থাকার ব্যবস্থা করতেন। আমি তখন স্কুলে ক্লাস ফাইভ-সিক্সের ছাত্রী। ভোর চারটেয় পণ্ডিতজির কাছে মামার তালিম শুরু হত। পাশে আমিও বসে থাকতাম। কিন্তু কিছু বুঝতাম না। তাও একটা কথা বুঝতে পারি যে, সেই সময়ই আমার মগজ ও মনন— এই দুটির মধ্যেই একটা সুষ্ঠু সঙ্গীতের প্রভাব পড়তে শুরু করে। এর পর যথারীতি মামা চলে যেতেন অফিসে, আমি চলে যেতাম স্কুলে। সন্ধ্যাবেলা পণ্ডিতজির অনুষ্ঠান শুনতে আমরা সবাই যেতাম এক সঙ্গে। কী যে আনন্দের দিন ছিল! পণ্ডিতজি আমাদের বাড়িতে থাকার সময় মামার আমার ওপরে কড়া নির্দেশ ছিল পণ্ডিতজির ঘর নিজে হাতে গুছিয়ে রাখার। তা ছাড়া সাইড টেবিলে জলের জগ ও গ্লাস রাখা, ওঁর জুতো পরিষ্কার করা— এগুলোও আমার কাজ ছিল। মামার প্রবল ইচ্ছা ছিল আমাকে পরবর্তী কালে সঙ্গীতশিক্ষার জন্য পণ্ডিতজির হাতে তুলে দেওয়ার। গুরুসেবা করাটা যে শিষ্যদের একটা কর্তব্য ও ধর্ম, যা কৃতজ্ঞতা থেকে আসে, সেটা মামা আমাকে ওই বয়সেই শিখিয়েছিলেন।
ম্যাট্রিকুলেশনের পরে জেঠুর কাছে সঙ্গীত শিক্ষার জন্য চলে আসি কলকাতায়, যোগমায়া দেবী কলেজে ডিগ্রি কোর্সেও ভর্তি হই। ওই অঞ্চলেই থাকার ব্যবস্থা হয়। জেঠু তখন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের অধ্যাপক। আমার কলেজ ছিল সকালে। ফলে গান শেখার সময় নির্দিষ্ট হল ভোর পাঁচটায়। উনি সেই ভোরে প্রতি দিন ছাদে অপেক্ষা করতেন। এক দিন আমার পৌঁছতে দশ মিনিট দেরি হওয়ার দরুন উনি আমাকে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সে দিন আমি জীবনে সময়ের যথার্থ মূল্য আরও ভাল করে বুঝতে শিখলাম। পরবর্তী কালে আমি ওঁর পুত্র শ্যামল লাহিড়ির স্ত্রী হিসেবে এই পরিবারেরই সদস্য হই। তবে কোনও দিনই পুত্রবধূ হিসেবে নয়, আমি ওঁর কাছে যে স্নেহ পেয়েছি, তা এক কন্যার প্রতি এক পিতার স্নেহ। পরীক্ষার সময় পেনে কালি ভরে দেওয়া থেকে শুরু করে নতুন বই এলে তাতে মলাট দিয়ে দেওয়া, সবই যেন ওঁর আনন্দের কাজ ছিল। বাবা খেতে এবং খাওয়াতে খুব ভালবাসতেন। নিজে স্বল্পাহারী হলেও রান্নাটা সঙ্গীতের পাশে ওঁর আর একটা প্যাশনের জায়গা ছিল। কখনও কখনও সন্ধেবেলা ছাদে মাদুর পেতে উনি আমাকে তালিম দিতেন। আমাদের রান্নাঘরটাও ছাদেই। এক দিন আমি যখন রেওয়াজে মগ্ন, হঠাৎ দেখি এক প্লেট পকোড়া আর চা নিয়ে বাবা হাজির। হাসতে হাসতে বললেন, “নে, এগুলো খা। রেওয়াজ করতে আরও এনার্জি পাবি।’’ তবে উল্টো দিকে দুঃখও ছিল! ভোরবেলা মিক্সারের আওয়াজ ছিল আমার কাছে আতঙ্ক। তৈরি হত করলার রস এবং প্রতি দিন সকালে খালি পেটে একটু হলেও সেটা সেবন করতে হত। বাবার বক্তব্য ছিল, পেট পরিষ্কার তো গলা পরিষ্কার।
পণ্ডিত চিন্ময় লাহিড়ি সৃষ্টি করেছিলেন এক অনন্য গায়কি, যা অন্যান্য শিল্পীদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। বলা বাহুল্য উনি প্রায় সমস্ত রাগেরই বন্দিশ রচনা করে গিয়েছেন (বিলম্বিত/ তিনতাল/ ঝাঁপতাল/ রূপক/ দ্রুত একতাল/ ন’মাত্রার তাল ইত্যাদি) আর সেইগুলি উনি নোটেশন আকারে নিজের হাতে লিখে রেখে গিয়েছেন। খেয়ালের বাণীর উপর তিনি বিশেষ প্রাধান্য দিতেন, যাতে সেটা অর্থবহ হয়। আমাদের শেখাতেন খেয়ালের বাণী কী ভাবে ব্যবহার করা উচিত। বলতেন, “শুধু একটা শব্দ নিয়েই তোরা বিস্তার করবি না, পুরো বাক্যটা নিয়ে বিস্তার করবি, যাতে শ্রোতারা কবিতার মানেটা বুঝতে পারে।’’ বলতেন, “খেয়াল গানেও নাটক থাকতে হবে, কিন্তু শাস্ত্র ক্ষুণ্ণ করলে চলবে না। যে হেতু এটা শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, এখানে শাস্ত্রের মান রক্ষা করেই খেয়াল পরিবেশন করা উচিত।’’ সঙ্গীত পরিবেশনায় ‘দিল অউর দিমাগ’ অর্থাৎ হৃদয় ও প্রজ্ঞামিশ্রিত প্রামাণ্যতায় বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। সে কারণে তিনি যখন কোনও রাগ পরিবেশন করতেন, দু’তিনটে স্বর প্রয়োগ করলেই বোঝা যেত কোন রাগটি পরিবেশন করতে যাচ্ছেন। বিলম্বিত লয়ে বন্দিশকে নিয়ে খেলা, শেষে একটা দুরূহ তেহাই দিয়ে সমে ফেরা ছিল ওঁর বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এমন দৃশ্যও হল-এ দেখেছি, দ্রুত খেয়াল গাইবার সময় উনি শ্রোতাদের বলছেন, “আপনারা যেখান থেকে হাত তুলবেন আমি সেখান থেকেই তেহাই দিয়ে সমে আসব।’’
১৯২০ সালের ২০ মার্চ চিন্ময় লাহিড়ির জন্ম পাবনার তাঁতিবন্ধের জমিদার পরিবারে। পিতা শ্রীজীবচন্দ্র লাহিড়ি পেশায় ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার, কর্মসূত্রে লখনউতে থাকতেন। শৈশব থেকেই পণ্ডিতজির দুটি ব্যাপারে খুব আগ্রহ ছিল। শরীরচর্চা ও সঙ্গীতসাধনা। পড়াশোনা লখনউয়ের বয়েজ় অ্যাংলো ইন্ডিয়ান স্কুলে। গোঁড়া ব্রাহ্মণ পরিবারে সঙ্গীতসাধনা? তখনকার দিনে অসম্ভব ছিল! কিন্তু মাতা সরোজবাসিনী দেবীর অনুপ্রেরণায় তেরো বছরের বালকটি সঙ্গীতসাধনায় নিজেকে সঁপে দিলেন। শুধু কি সঙ্গীতকে ভালবাসলেই হবে? তার জন্য তো শিক্ষা চাই। অতঃ কিম্? ভাইয়ের মনের বাসনার কথা জানতে পেরে দাদা তারাচাঁদ লাহিড়ি ওঁরই বন্ধু, বিখ্যাত সঙ্গীতবিদ ও সেতার শিল্পী শ্রদ্ধেয় ধ্রুবতারা জোশির কাছে ভাইকে নিয়ে গেলেন। জোশিজি আবার ওই ছোট ছেলেটিকে নিয়ে গেলেন ১৯২৬ সালে স্থাপিত লখনউয়ের মরিস কলেজ অব মিউজ়িক-এর (এখন ভাতখণ্ডে বিশ্ববিদ্যালয়) তৎকালীন অধ্যক্ষ পণ্ডিত শ্রীকৃষ্ণ রতন ঝংকারজির কাছে। প্রথমে এই ছোট ছেলেটিকে দেখে পণ্ডিতজির গান শেখানোর অতটা আগ্রহ না থাকায় ছেলেটিকে দুটি কঠিন পাল্টা তিন দিনের মধ্যে ‘তৈয়ারি’ করে শোনাতে বললেন। কিন্তু ওই জেদি ও আত্মবিশ্বাসী বালক ওই দুটি দুরূহ পাল্টা এমনই রেওয়াজ করল যে গলাটা গেল ভেঙে। ওই ভাঙা গলাতেই বালক গিয়ে পণ্ডিতজিকে পাল্টা শোনালে, ছোট ছেলের গান শেখার প্রবল আগ্রহ দেখে পণ্ডিত শ্রীকৃষ্ণ রতন ঝংকারজি তাঁকে শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করলেন।
নানা পরীক্ষানিরীক্ষার ভিতর দিয়ে পণ্ডিত চিন্ময় লাহিড়ি অজস্র রাগ-রাগিণী সৃষ্টি করে গিয়েছেন। তার মধ্যে কয়েকটি হল শ্যামকোষ, যোগমায়া, প্রভাতী টোড়ি, সন্ত ভৈঁরো, কুসুমী কল্যাণ ইত্যাদি। তাঁর অসামান্য সৃষ্টি ‘নন্দকোষ’ পরিবেশনার সময় সঙ্গীত সম্মেলনে উপস্থিত ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সাহেব এবং উস্তাদ হাফিজ আলি খাঁ সাহেব মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। অনুষ্ঠান শেষে ওঁরা দুজনেই রাগের বন্দিশ সংগ্রহ করেন পণ্ডিত চিন্ময় লাহিড়ির থেকে। পরবর্তী কালে ওস্তাদ আলি আকবর খাঁ সাহেব, ওস্তাদ বাহাদুর খাঁ সাহেব এবং ওস্তাদ আমজাদ আলি খাঁ সাহেব বহু বার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এই নন্দকোষ পরিবেশন করেছেন। বেগম পরভিন সুলতানার গাওয়া, বাবার কাছে শেখা বাবারই তৈরি বন্দিশটি এইচএমভি থেকে পরবর্তী কালে প্রকাশিত হয়।
‘মগন’— এই ছদ্মনামেই উনি বিভিন্ন রাগের বন্দিশ রচনা করেছেন। লখনউতে থাকার ফলে ওঁর হিন্দি এবং উর্দু ভাষার উপরে বিশেষ দখল ছিল। এ ছাড়া উনি বিভিন্ন রাগে ঠুম্রি, দাদরা, হোলি, ত্রিবট, চতুরঙ্গ, গীত, ভজন, গজল, বাংলা রাগপ্রধান সৃষ্টি করে গিয়েছেন এবং এই ভিন্নধর্মী প্রতিটি গান স্বরলিপির আকারে নিজের হাতে লিখে রেখে গিয়েছেন পরের প্রজন্মের জন্য। ওঁর তৈরি অসংখ্য রাগরাগিণীর বন্দিশ, তান ও বিস্তার ‘মগনগীত ও তানমঞ্জরী’— এই সঙ্গীত গ্রন্থের চারটি খণ্ডে নিবদ্ধ আছে। বাংলা রাগপ্রধান বললে ‘শাপমোচন’ ছায়াছবির কালজয়ী সেই বিখ্যাত গান— পটদীপ রাগে ওঁরই সুর করা এবং প্রখ্যাত গায়িকা প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে গাওয়া ‘ত্রিবেণী তীর্থপথে কে গাহিল গান’— বাঙালি কি কোনও দিনও ভুলতে পারবে?
শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে আমার গুরু ছিলেন অকৃপণ। যার মধ্যে একটু প্রতিভা বা সম্ভাবনা দেখেছেন, কোনও রকম সঙ্কীর্ণতাকে আঁকড়ে না ধরে দু’হাত ভরে সাহায্য করেছেন তাঁকে, উৎসাহিত করেছেন এবং প্রাণ ভরে শিখিয়েছেন। ফলস্বরূপ আমরা পেয়েছি মীরা বন্দ্যোপাধ্যায়, গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, বেগম পরভিন সুলতানা, শিপ্রা বসু প্রমুখ স্বনামধন্য শিল্পীদের। ‘মগন মন্দির’— আচার্য চিন্ময় লাহিড়ির স্মৃতিরক্ষার্থে আমার, আমার স্বামী শ্যামল লাহিড়ি এবং আমাদের সমস্ত ছাত্রছাত্রীর উদ্যোগে ২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠিত সাংস্কৃতিক সংস্থা। আমাদের গুরুর ছদ্মনাম ‘মগন’কে নিয়েই তৈরি এই ‘মগন মন্দির’।
‘খেলাঘর’ নামের ৪/১৩ চণ্ডীতলা লেনের বসতবাড়িটিতেই ১৯৫৮ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ২৭টি বছর কাটিয়েছেন আচার্য চিন্ময় লাহিড়ি। ২০০৭ সালে রাস্তার নাম পরিবর্তিত হয়ে হল পণ্ডিত চিন্ময় লাহিড়ি সরণী। এটা আমাদের কাছে একটা বড় প্রাপ্তি। এই বাড়িটাতে আমারও কেটে গেল ৪২ বছর। ১৯৮৪ সালের ১৭ অগস্ট অন্য আর এক পৃথিবীতে পাড়ি দিলেন বাবা। হয়তো সেই পৃথিবীকে এখন সুরের জালে বাঁধছেন তিনি, সৃষ্টি করছেন নতুন রাগ, তাঁকে ঘিরে রাখছে তাঁর প্রিয় ছাত্রছাত্রীরা! কোনও শেষই যে শেষ নয়, বরং এক নতুন চলার শুরু, তিনিই শিখিয়ে গিয়েছেন।
‘রবিবাসরীয়’ বিভাগে নিবন্ধ পাঠান। শব্দসংখ্যা ৬০০-১২০০। ইউনিকোড ব্যবহার করা বাঞ্ছনীয়। পিডিএফ-এ নয়, ওয়ার্ড ফাইল ইমেল করুন।
ইমেল: rabi.article@abp.in
সাবজেক্ট: Rabibasariya Nibandha
পাণ্ডুলিপিতে ফোন নম্বর ও সম্পূর্ণ ঠিকানা দেবেন।