কলকাতার পুলিশ কমিশনার চার্লস টেগার্টের দাবি শুনে বিরক্ত হয়েছিলেন বাংলার অস্থায়ী মুখ্যসচিব প্রেন্টিস সাহেব। জানতে চেয়েছিলেন, ‘পথের দাবী’ বই আকারে প্রকাশিত হওয়ার আগে ‘বঙ্গবাণী’ পত্রিকায় যখন ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হচ্ছিল, তখন পুলিশ কেন আপত্তি করেনি? এখন বলা হচ্ছে, এই বইতে অনেক আপত্তিকর বিষয় আছে, যা ব্রিটিশ-বিরোধী! শরৎচন্দ্র চট্রোপাধ্যায়ের লেখা বই ‘পথের দাবী’ নিষিদ্ধ করার আর্জি জানিয়ে টেগার্ট সাহেব মুখ্যসচিবকে চিঠি লিখলে প্রেন্টিস সাহেব শেষ পর্যন্ত প্রাথমিক সম্মতি দিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু সঙ্গে তাঁর বিরক্তিও একটি নোটের মাধ্যমে জানাতে ছাড়েননি। প্রেন্টিস আরও বলেছিলেন, বইটি নিষিদ্ধ করা হলে হাইকোর্টে নানা প্রশ্ন উঠতে পারে। সরকার যাতে বেইজ্জত না হয়, তাই এ বিষয়ে অ্যাডভোকেট জেনারেলের অভিমত জানাটাও জরুরি।
শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’ বই আকারে প্রথম প্রকাশিত হয় ১৩৩৩ বঙ্গাব্দের ভাদ্র মাসে। প্রকাশক, উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। ছাপা হয়েছিল কটন প্রেস থেকে। মুদ্রাকর, সত্যকিঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। দাম তিন টাকা। সাদা কাগজে মোড়া পিচবোর্ডের মলাট। বইয়ের উপর দিকে লাল হরফে ছাপা নাম, ‘পথের দাবী’। নীচের দিকে লেখকের নাম, শ্রী শরৎচন্দ্র চট্রোপাধ্যায়। রূপসজ্জার দিক থেকে একেবারেই সাদামাটা এই বই-ই ব্রিটিশ সরকারের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল।
‘পথের দাবী’-র পাণ্ডুলিপি ফেলেই রেখেছিলেন শরৎচন্দ্র। তেমন কিছু সাহিত্যগুণ এই লেখার নেই বলেই মনে হয়েছিল তাঁর। উমাপ্রসাদ জোর করে ‘বঙ্গবাণী’-র জন্য লেখাটি চেয়ে নেন। এই পত্রিকার দ্বিতীয় বর্ষের প্রথম সংখ্যা থেকে (১৩২৯ সাল) ‘পথের দাবী’ প্রকাশিত হতে থাকে। তিন বছর তিন মাস ধারাবাহিক ভাবে ছাপা হয় উপন্যাসটি। শেষ কিস্তি ছাপা হয় ১৩৩৩ বঙ্গাব্দের বৈশাখে।
শরৎচন্দ্রের প্রথম পরিচয় তিনি সাহিত্যজীবী। তবে এর বাইরেও তিনি ছিলেন এক জন রাজনৈতিক কর্মী— হাওড়া জেলা কংগ্রেসের সভাপতি ও প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির সদস্য। মহাত্মা গাঁধীর সব মত মেনে না নিলেও অসহযোগ আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন। সম্ভবত বাংলার বিভিন্ন বিপ্লবীর সঙ্গে ব্যক্তিগত মেলামেশার অভিজ্ঞতা থেকেই ‘পথের দাবী’র কেন্দ্রীয় চরিত্র সব্যসাচীর মধ্যে তিনি বিপ্লবীদের একটি ‘টাইপ’ তৈরি করেছিলেন। চার্লস টেগার্ট এই বিপ্লবী টাইপটিকেই ভয় করতেন। তাঁর আশঙ্কা ছিল, ‘পথের দাবী’র সব্যসাচী, বাস্তব সব্যসাচীদের মনে সংগ্রামের বীজ বপন করবে। এই প্রবণতা ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে বিপজ্জনক। তাই ‘পথের দাবী’-র সব্যসাচীকে টেগার্ট অঙ্কুরেই বিনাশ করতে চেয়েছিলেন।
আরও পড়ুন: তাঁর আমলে চিড়িয়াখানায় ওয়াজিদ আলি শাহ থেকে বিবেকানন্দ
‘পথের দাবী’ প্রথম সংস্করণে মোট তিন হাজার কপি ছাপানো হয়েছিল। বই হয়ে বেরনোর সঙ্গে-সঙ্গেই সব কপি বিক্রি হয়ে যায়। প্রথম দিকে ইংরেজ কর্তৃপক্ষের উদ্দেশ্য ছিল বইয়ের লেখক, মুদ্রক ও প্রকাশক— সকলকেই শাস্তি দেওয়া। কিন্তু সে সময়কার পাবলিক প্রসিকিউটর রায়বাহাদুর তারকনাথ সাধু এই কাজ থেকে কর্তৃপক্ষকে নিবৃত্ত করেন। তাঁর চেষ্টায় শুধু বইটিই নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর পরই টেগার্ট সাহেব চিঠি দেন মুখ্যসচিবকে। চিঠির সঙ্গে মূল বইয়ের আপত্তিকর অংশের পাতাগুলি ইংরেজিতে তরজমা করে দেওয়া হয়। অন্তত পঞ্চাশটি পাতা ইংরেজিতে পাঠানো হয়েছিল। টেগার্ট সাহেবের চিঠির ধাক্কায় সরকারি মহলে তৎপরতা ছিল তুঙ্গে। মুখ্যসচিবের নির্দেশমতো যাবতীয় কাগজপত্র পাঠানো হয় অ্যাডভোকেট জেনারেল ব্রজেন্দ্রলাল মিত্রের কাছে।
‘পথের দাবী’ নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়া শুরু হল অ্যাডভোকেট জেনারেল ব্রজেন্দ্রলাল মিত্রের নোট থেকেই। বলা যায়, তাঁর নোট থেকেই ইংরেজরা ‘পথের দাবী’ সম্বন্ধে শাস্তিবিধানের পথনির্দেশ পেয়ে গেল। অ্যাডভোকেট জেনারেল তাঁর নোটে অভিমত দিতে গিয়ে বললেন, এই বইতে নির্দিষ্ট ভাবে বিপ্লবের কথা প্রচার করা হয়েছে। ব্রিটিশ সরকারকে ঘৃণা করার বার্তাও পরিষ্কার। সুতরাং এই বই অবশ্যই ভারতীয় দণ্ডবিধির সেকশন ১২৪এ, সেকশন ৯৯এ ধারায় অভিযুক্ত হওয়ার মতো।
অ্যাডভোকেট জেনারেলের নোট পেয়েও মুখ্যসচিব প্রেন্টিস সাহেব পুরোপুরি খুশি হননি। কারণ নোটের প্রথমাংশে বলা ছিল শরৎচন্দ্র বাংলার অন্যতম ঔপন্যাসিক এবং তাঁর বই অত্যন্ত জনপ্রিয়। ওঁর আগের উপন্যাসগুলিতে আপত্তিজনক কিছু নেই। তিনি তাঁর মত জানিয়ে এগজ়িকিউটিভ কাউন্সিলের সদস্য নবাব বাহাদুর আলি সাহেবের কাছে পাঠালেন। আলি সাহেব নোট দিয়ে জানালেন, লেখক এক জন বিশিষ্ট ব্যক্তি, তাই বিষয়টি বড়লাটের কাছে পাঠানো হোক। বড়লাট বইটি নিষিদ্ধ করার পক্ষে সবুজ সঙ্কেত দিলেন। শেষ পর্যন্ত ১৯২৭ সালের ৪ জানুয়ারি প্রেন্টিস সাহেব সরকারি হুকুমনামায় স্বাক্ষর করলে ‘পথের দাবী’ বাজেয়াপ্ত ঘোষিত হল।
‘পথের দাবী’ যখন বাজেয়াপ্ত হয়, সেই সময় রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় প্রকাশিত বিখ্যাত আমেরিকান পাদরি ও লেখক জে টি সান্ডারল্যান্ড-এর লেখা ‘ইন্ডিয়া ইন বন্ডেজ’ বইটিও ব্রিটিশ সরকার বাজেয়াপ্ত করে। এর বিরুদ্ধে প্রকাশক বাংলার সরকারের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে মামলা করলে শরৎচন্দ্রও মামলা করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি তাঁর বন্ধু বিখ্যাত আইনজীবী নির্মলচন্দ্র সেনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কিন্তু নির্মলচন্দ্র শরৎচন্দ্রকে মামলা করতে নিষেধ করেন। এ দিকে রামানন্দ চট্রোপাধ্যায় মামলায় হেরে যান। এমনটাই যে ব্রিটিশ আদালতে ঘটবে, সে কথাই নির্মলচন্দ্র তাঁর বন্ধুকে বোঝাতে চেয়েছিলেন। শরৎচন্দ্রও মামলা করার সিদ্ধান্ত বদলান।
শরৎচন্দ্র রবীন্দ্রনাথকে এ সম্পর্কে মতামত দিতে বলেছিলেন। তিনি নিজে তাঁর বই রবীন্দ্রনাথকে পৌঁছে দেন। ১৩৩৩ বঙ্গাব্দের ২৭ মাঘ রবীন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্রকে চিঠি লেখেন, ‘‘‘পথের দাবী’ পড়া শেষ করেছি। বইখানি উত্তেজক। অর্থাৎ ইংরেজদের সম্পর্কে পাঠকের মনকে অপ্রসন্ন করে তোলে। লেখকের কর্তব্য হিসাবে সেটা দোষের না হতে পারে— কারণ লেখক যদি ইংরেজরাজকে গর্হণীয় মনে করেন, তা হলে চুপ করে থাকতে পারেন না। কিন্তু চুপ করে না থাকার যে বিপদ আছে, সেটুকু স্বীকার করাই চাই।’’ রবীন্দ্রনাথ আরও লেখেন যে, ইংরেজরা যথেষ্ট সহিষ্ণু, যা আর কোনও দেশে দেখতে পাওয়া যায় না। কলম বন্ধ না করে শক্তিকে স্বীকার করে কলম চালানোর কথা বলেন রবীন্দ্রনাথ। শক্তিকে আঘাত করলে প্রতিঘাত সইতে হবে, এ রকম মত প্রকাশ করেন তিনি। ২ ফাল্গুন শরৎচন্দ্র নিজেকে কবির সেবক হিসেবে উল্লেখ করে লেখেন যে, তিনি বই লিখেছেন মাত্র। ইংরেজদের প্রতি পাঠকের মন অপ্রসন্ন হয়ে উঠলে তার দায় লেখকের নয়। প্রতিবাদ না করলে গায়ের জোরকেই প্রকারান্তরে ন্যায্য বলে স্বীকার করা হয়। ইংরেজদের সহিষ্ণুতা প্রসঙ্গে শরৎচন্দ্র লেখেন, ‘ইংরাজশক্তির এই বই বাজেয়াপ্ত করবার জাস্টিফিকেশন যদি থাকে, পরাধীন ভারতবাসীর প্রোটেস্ট করবার জাস্টিফিকেশনও তেমনি আছে।’ উভয়ের মতপার্থক্য এর বেশি গড়ায়নি। শরৎচন্দ্র চেয়েছিলেন এই অন্যায়ের প্রতিবাদ আসুক রবীন্দ্রনাথের কাছে থেকেও! কারণ রবীন্দ্রনাথ আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নোবেলজয়ী কবি। কিন্তু তা না হওয়ায় শরৎচন্দ্র দুঃখিত হয়েছিলেন।
‘পথের দাবী’ বাজেয়াপ্ত হলেও বিরুদ্ধ-সমালোচনা চলতে থাকে। রাজদ্রোহের সঙ্গে ওঠে অশ্লীলতার অভিযোগও! বলা হয়, এতে সোনাগাছির ইয়ার্কিরও অভাব নেই! তৎকালীন মাসিক পত্রিকা ‘মানসী ও মর্মবাণী’-তে জনৈক ডেপুটি কয়েকমাস আলোচনা করে এই সিদ্ধান্তে আসেন। শরৎচন্দ্র এই হাস্যকর সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেননি। পরে তিনি সমালোচনাটির উল্লেখ করে এক জায়গায় বলেছিলেন, ‘‘আগে-আগে অনেক গালাগাল খেয়েছি, এখন আর বড় একটা খাই না, তবে সম্প্রতি ‘পথের দাবী’ লিখে এক ডেপুটিবাবুর ধমক খেয়েছি। বইখানার কোথায় নাকি সোনাগাছির ইয়ার্কি ছিল, অভিজ্ঞ দৃষ্টিতে তা ধরা পড়ে গেছে!’’ এমনই ছিলেন শরৎচন্দ্র।