জামাটা দেখেই চমকে উঠেছিলাম

নীল শর্টস আর লাল জামাটা কয়েক দিন আগেই দুই বছরের ছোট্ট ভাইপো আলানকে কিনে দিয়েছিলেন তিনি। স্কাইপ-ইন্টারভিউতে কানাডা থেকে জানালেন টিমা কুর্দি। নীল শর্টস আর লাল জামাটা কয়েক দিন আগেই দুই বছরের ছোট্ট ভাইপো আলানকে কিনে দিয়েছিলেন তিনি। স্কাইপ-ইন্টারভিউতে কানাডা থেকে জানালেন টিমা কুর্দি।

Advertisement

সীমন্তিনী গুপ্ত

শেষ আপডেট: ১৩ জানুয়ারি ২০১৯ ০০:০০
Share:

আবদুল্লাকে পাঁচ হাজার ডলার পাঠিয়েছেন দিদি। অনেক দূরের দেশ কানাডা থেকে। তুরস্কের নিরাপত্তাহীনতা আর অনিশ্চয়তায় ভরা দিন পিছনে ফেলে ভাই যাতে তাঁর স্ত্রী ও দুই ছেলেকে নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে বেরোতে পারেন।

Advertisement

কিন্তু নিরাপদ আশ্রয় মানে যে সেই ইউরোপ। মাঝখানে দুস্তর ভূমধ্যসাগর। একটা রবারের ডিঙি নৌকায় অতটা রাস্তা পাড়ি দিতে বুক দুরুদুরু করে। বৌটা জলে খুব ভয় পায়। ছেলে দু’টোও বড্ড ছোট। একটার বয়স চার। আর একটা মাত্র দুই। চারটে লাইফ জ্যাকেট কিনেছেন বটে, কিন্তু তাতে যদি কাজ না দেয়? কিছুতেই আর সিদ্ধান্ত নিয়ে উঠতে পারেন না আবদুল্লা। সমুদ্রে বড় বড় ঢেউ উঠছে। মোবাইলে ছবি তুলে পাঠান দিদিকে। দিদি বলেন, আরও কয়েকটা দিন দেখো। আবহাওয়া নিশ্চয় ভাল হবে। কত লোক তো এ ভাবেই ইউরোপে পৌঁছচ্ছে।

সত্যি, কয়েক দিন বাদে আকাশ পরিষ্কার হয়। ঢেউ-ও কমে।

Advertisement

এক পাচারকারী জানায়, আজ রাতেই ছাড়ছে নৌকা। বারো জন যেতে পারবে তাতে। ৫৮৬০ ডলার দিয়ে চার জনের ‘জায়গা’ কি বুক করবেন আবদুল্লা? সাত-পাঁচ ভেবে ‘হ্যাঁ’-ই বলে দেন। দিদিকে জানিয়ে দেন— ‘‘আমরা বেরোচ্ছি। পৌঁছে যোগাযোগ করব।’’

কেটে যায় এক দিন... দু’দিন। আবদুল্লার কাছ থেকে কোনও খবর না-পেয়ে মেসেজের পর মেসেজ পাঠাতে থাকেন দিদি। তোমরা কোথায়? কী হল? সব ঠিক আছে তো?

‘‘কয়েক দিন বাদে উত্তর পেলাম। কিন্তু ভাইয়ের কাছ থেকে নয়, ভূমধ্যসাগরের কাছ থেকে,’’ বলছিলেন আবদুল্লার দিদি টিমা। টিমা মানে টিমা কুর্দি। আলান কুর্দির পিসি। সেই আলান, ২০১৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর তুরস্কের উপকূলে যার উপুড় হয়ে থাকা নিথর দেহের ছবি সারা পৃথিবীকে পশ্চিম এশিয়ার শরণার্থী সমস্যার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল।

সাক্ষী: আলানের পিসি, টিমা কুর্দি। বাঁ দিকে, দুই ছেলে আলান ও গালিবের সঙ্গে বাবা আবদুল্লা

বালির উপরে উপুড় হয়ে পড়ে আছে একটা শিশু। গায়ে লাল জামা। মনে হয় যেন ঘুমোচ্ছে। সেই ছবি দেখে আতঙ্কে শিউরে উঠেছিল বিশ্ব। শিউরে উঠেছিলেন টিমাও। আনন্দবাজারকে স্কাইপ-সাক্ষাৎকারে জানালেন, ‘‘প্রথমেই মনে হল, ওই লাল জামা আর নীল শর্টসটা যে আমি চিনি! আমিই তো ইস্তানবুল থেকে আলানের জন্য ওই জামা কিনেছিলাম। কয়েক দিন আগেই এই জামাটা পরে ওর একটা ভিডিয়োও পাঠিয়েছিল ভাই।’’

ভূমধ্যসাগরে রবারের ডিঙি উল্টে সে-দিন আলানের (পশ্চিমি সংবাদমাধ্যম তাকে ‘আয়লান’ নামে ডাকলেও টিমা জানান, ওর নাম আলান) সঙ্গেই মারা গিয়েছিল তার দাদা গালিব আর মা রেহানা। সঙ্গে আরও পাঁচ জন। বেঁচে গিয়েছিলেন শুধু টিমার ভাই আবদুল্লা। ছ’জনের ডিঙিতে বারো জন চাপাতেই এই বিপত্তি, পরে জানিয়েছিল তুরস্কের উপকূলরক্ষী বাহিনী। সিরিয়া থেকে পালানোর প্রাণান্তকর চেষ্টা চালাচ্ছে আবদুল্লাদের মতো যে-সব পরিবার, তাদের নিয়ে টিমার লেখা বইটি প্রকাশিত হয়েছে সদ্য। নাম— ‘দ্য বয় অন দ্য বিচ: মাই ফ্যমিলি’জ় এসকেপ ফ্রম সিরিয়া অ্যান্ড আওয়ার হোপ ফর আ নিউ হোম’।

টিমা জানালেন, তাঁরা ছয় ভাইবোন। ‘‘সিরিয়ার কোবানিতে দারুণ কেটেছিল আমাদের ছেলেবেলা। কিন্তু যুদ্ধ সব কিছু পাল্টে দিল,’’ ভ্যাঙ্কুভার থেকে বললেন টিমা। দাদা মহম্মদের সঙ্গে অনেক দিন আগে কানাডায় চলে গিয়েছেন তিনি। কিন্তু আইএস-এর হাত থেকে বাঁচতে তুরস্ক ও উত্তর সিরিয়ার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতে হয়েছে আবদুল্লাদের। কিছু দিনের জন্য তাঁরা ফিরে এসেছিলেন কোবানিতেও। সেখানেই জন্ম আলানের। আইএস-এর দৌরাত্ম্যে বেশি দিন সেখানে থাকতে পারেননি। ফিরে যান তুরস্কে। সেখান থেকেই গ্রিসের কস দ্বীপে পৌঁছনোর জন্য রবারের ডিঙিতে চেপেছিলেন।

‘‘কেন যে জোর করেছিলাম!’’ ভেসে আসে টিমার ধরা গলা। সত্যিই তো, দিদির উৎসাহ ও সাহায্যেই যুদ্ধবিধ্বস্ত মাতৃভূমি ছাড়ার কথা ভাবতে পেরেছিলেন আবদুল্লারা। টিমা বলেন, ‘‘আসলে ওখানে থেকে যাওয়ারও তো কোনও উপায় ছিল না। আইএস-এর তাণ্ডবের ভয়ে অনেকে মৃত্যুকেই বেছে নিচ্ছিল। আর ভাইরা বাঁচার শেষ চেষ্টাটা করেছিল।’’

এই অসহায়তাই তাঁর বইয়ে তুলে ধরতে চেয়েছেন টিমা। বললেন, ‘‘সবাই আমাকে জিজ্ঞাসা করে, এ রকম বিপজ্জনক ভাবে কেন সমুদ্র পেরিয়ে আসার চেষ্টা করেন শরণার্থীরা। যাঁরা এই প্রশ্নটা করেন, তাঁদের কল্পনাতেও আসবে না, কী দুঃসহ বিপদের মধ্যে সিরিয়া, আফগানিস্তান বা ইরাকের মতো দেশগুলোতে বসবাস করে ভাইদের মতো লক্ষ লক্ষ পরিবার। কিন্তু বাঁচার স্বপ্ন দেখা কখনও থামায় না। তারা।’’ তাঁর বইয়ে যেমন যুদ্ধবিধ্বস্ত মানুষের নির্মম পরিস্থিতি আর তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা রয়েছে, একই ভাবে রয়েছে যুদ্ধের আগে স্বপ্নের সিরিয়ার কথাও। ‘‘সেই দিনগুলোই আমাদের ফের স্বপ্ন দেখার উৎসাহ জোগায়। শত যন্ত্রণার মধ্যেও,’’ বললেন টিমা।

পরিবার হারিয়েও তাই স্বপ্ন দেখা ছাড়েননি আবদুল্লা। চেষ্টা করেছেন আলানের মতো লক্ষ লক্ষ শরণার্থী শিশুর পাশে দাঁড়াতে। এ বারেও পাশে পেয়েছেন দিদিকে। টিমা বললেন, ‘‘আলানের মৃত্যুর খবর পাওয়ার ঠিক দু’সপ্তাহ পরে আমায় ফোন করেছিল আবদুল্লা। বলেছিল, ‘আমি চাই, আমার ছেলের ছবি সারা পৃথিবীর মানুষের চোখ যেন খুলে দেয়’।’’ তার পরে গত তিন বছর ধরে শরণার্থীদের জন্য ত্রাণ সংগ্রহ করে চলেছেন আবদুল্লা ও টিমা। তৈরি করেছেন ‘কুর্দি ফাউন্ডেশন’, মৃত রেহানা ও তাঁর দুই সন্তানের স্মৃতিতে। ইরাকের কুর্দিস্তান আর্বিলের শরণার্থী শিবিরেই বছরের বেশির ভাগ সময় কাটান আবদুল্লা। টিমা বললেন, ‘‘প্রতি বছর ২ সেপ্টেম্বর কোনও না কোনও শরণার্থী শিবিরে গিয়ে আমরা বাচ্চাদের খেলনা, জামাকাপড় দিই।’’

‘‘তবু আত্মগ্লানি কমে কই,’’ নিজেকেই যেন প্রশ্ন করেন টিমা। ‘‘বারবার ভাবি, কেন আরও টাকা পাঠালাম না? তা হলে হয়তো পাচারকারীরা একটু ভাল নৌকায় তুলত ওদের। সেই নৌকাটা হয়তো ডুবত না। প্রায় প্রতি রাতেই ঘুম স্বপ্ন দেখি, সমুদ্রে ডুবে যাচ্ছি। দমবন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ঘুম ভেঙে যায়...। ভাবতে থাকি, সমুদ্রে ডুবতে ডুবতে কত ক্ষণ ধরে মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে বাচ্চা দু’টোকে,’’ কণ্ঠস্বর ক্ষীণ হয়ে আসে টিমার। তার পরে থেমে যায়। কম্পিউটার স্ক্রিনের ও-প্রান্তে, টিমার ঘরের টেবিলের উপর থেকে খিলখিল করে হাসে আলান-গালিব। ফ্রেমবন্দি দু’ভাই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement