ডাক দিয়েছ কোন সকালে
১৯৮০ সালের ১৮ অগস্ট। কাকভেজা দিন, সকাল থেকেই বৃষ্টি। কে জানাল মনে নেই, শুনলাম, দেবব্রত বিশ্বাস মারা গিয়েছেন। আচমকা একটা আঘাত, ধক করে লাগল বুকের মধ্যে। রক্তের কোনও সম্পর্ক নেই, আত্মীয়-পরিজনও নন, তবু এমন এক জন মানুষের মৃত্যু ভেতরটাকে শূন্য করে দিল। অসুস্থ ছিলেন কিছু দিন যাবত্, জানতাম। কাগজে খবরও বেরিয়েছিল। অচেনা একটা আশঙ্কা তিরতির করছিল— শুধু আমার কেন, অনেকেরই মধ্যে। তখন মানুষ মন খুলে কথা বলতেন। পাড়ার চা-দোকানে, বন্ধু-আড্ডায়, রাজপথে চলন্ত ট্রাম-বাসে সহযাত্রীদের রোজকার আলাপেও গোটা কলকাতা কথা বলছিল জর্জ বিশ্বাসের অসুস্থতা নিয়ে। রেকর্ডিং বা লাইভ অনুষ্ঠানে গান গাওয়া বন্ধ করে দেওয়ায় গানপ্রেমী বাঙালির আক্ষেপ কম ছিল না। এ সব কিছুর ওপর দীর্ঘ একটা ছায়া নেমে এল, ‘জর্জ বিশ্বাস আর নেই’।
সেই দিনটাতেই আমার পার্ট টু পরীক্ষার রেজাল্ট। তখন কলেজ স্ট্রিট পাড়ায় প্রকাশিত গেজেট-এ ইউনিভার্সিটি রেজাল্টের প্রাথমিক সংবাদটুকু প্রকাশিত হত। আর মার্কশিট পাওয়া যেত কলেজে, তবে অনেকটা দেরিতে, বিকেল গড়িয়ে যেত। আমি বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম কলেজেই যাব বলে। এক বন্ধুও আছে সঙ্গে। হাওড়া স্টেশন থেকে ৫ নম্বর বাস ধরলাম। ঝুপঝুপ বৃষ্টি পড়েই চলেছে। বাসচলতিই ঠিক করলাম, কলেজ যাব না। দেবব্রত বিশ্বাসের বাড়ি যাব। দেশপ্রিয় পার্ক নেমে গেলেই হল, ট্রায়াঙ্গুলার পার্কে ওঁর বাড়ি তো ওইটুকু পথ! মার্কশিট কলেজে আজকের পরও পাওয়া যাবে। জর্জ বিশ্বাসকে আর পাওয়া যাবে না।
কত আর আমার বয়স তখন, মেরেকেটে বাইশ! পরীক্ষা আর রেজাল্ট বেরনোর মাঝের এই ক’মাস হাতে কাজ ছিল নিতান্তই কম, আর সময় অফুরন্ত অঢেল। বাড়িতে বসে গান শুনতাম রেডিয়োয়। সেই কবে থেকেই আমার অন্তরকে নন্দিত করে রবীন্দ্রনাথের গান, বিশেষ করে দেবব্রত বিশ্বাস আর কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গলায়। নিতান্ত অল্প বয়স, অপরিণত মন। কিন্তু ‘জর্জ বিশ্বাস’ আর ‘মোহরদি’, এই দুই মানুষের সাংগীতিক ব্যক্তিত্ব, কণ্ঠতরঙ্গ, গায়নের অভিব্যক্তি আর অনুভূতি, চেতনাকে তীব্র ধাক্কা দিয়ে যেত। কলেজে পড়ার সময় সুযোগ হয়েছিল শান্তিনিকেতন যাওয়ার। সেই রেশ থেকে গিয়েছিল ফিরে এসেও— একলা মুহূর্তে খোয়াই-পাড়ের সূর্যাস্ত, ছাতিমতলার আলোআঁধারি নেমে আসত আমার হাওড়ার বাড়িতেই, ওই দুজনের গানের সুর বেয়ে। আর আজ, ১৮ অগস্ট, জর্জ বিশ্বাস চলে গেলেন! বৃষ্টিভেজা রাস্তা দিয়ে বাস ছুটছে, আমার তবু কেমন মনে হচ্ছিল সব শুকনো, খাঁ খাঁ করছে গোটা শহরটা!
পৌঁছলাম ট্রায়াঙ্গুলার পার্কের বাড়ি। নোটিস ঝুলছে: ‘দেবব্রত বিশ্বাসের মরদেহ রবীন্দ্রসদনে রাখা আছে।’ মন বিষণ্ণ হল। বন্ধু একটু উত্কণ্ঠিত, চল না, আগে কলেজে গিয়ে মার্কশিটটা নিয়ে আসি! তার পর নাহয় রবীন্দ্রসদনে যাওয়া যাবে। আমি বললাম, তুই গেলে যা কলেজে। আমি রবীন্দ্রসদনেই যাব। বন্ধু আমায় ছেড়ে যেতে চায় না। অগত্যা দুজনেই চললাম।
আবার বাস। রবীন্দ্রসদন। বৃষ্টিটা একটু থেমেছে, খুব মনমরা ময়লাটে একটা আলো চারদিকে। জর্জ বিশ্বাসের মরদেহ রবীন্দ্রসদন প্রেক্ষাগৃহের সামনের চত্বরে শোয়ানো। সামনের গেট টেনে রেখে পুলিশ ভিড় সামাল দিচ্ছে। বিশিষ্ট জন ছাড়া কাউকে ঢুকতে দিচ্ছে না ভেতরে। গেটের মুখে দাঁড়িয়ে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়, চুপচাপ। একমাথা চুল, এলোমেলো। ও-দিকে ব্যস্তসমস্ত হয়ে সব তদারকি করছেন চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়। ভিড় ঠেলে গেলাম গেটের মুখে। পুলিশকে বললাম, এক বার একটু ভেতরে ঢুকতে দিন, জর্জ বিশ্বাসকে প্রণাম করব। পুলিশ নারাজ। জনতা তেতে উঠছে আস্তে আস্তে। সবাই এক বার ছুঁতে চায় মানুষটাকে। একটা দল জোর করে ঠেলা দিল গেটে, পুলিশ লাঠি উঁচিয়ে তেড়ে এল। আমি হাত দুটো ওপরের দিকে তুলে, মাথা আড়াল করে নিজেকে এগিয়ে দিলাম গেটের দিকে। তুমুল হইহই। ভিড় ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ মৃদু লাঠিচার্জ করল। আমার হাতে, পিঠেও পড়ল রুলের ঘা। চিনচিনে একটা ব্যথা। যাই হোক, ঠেলাঠেলিতে এক ফাঁকে ঢুকে গেলাম ভেতরে।
আমার সামনে শুয়ে আছেন মানুষটা। সাদা ধুতি, গেরুয়া পাঞ্জাবি। একমুখ সমাহিত ঔজ্জ্বল্য নিয়ে স্থির হয়ে শুয়ে আছেন। টেপরেকর্ডে বাজছে একের পর এক গান। সেই গলা, দরাজ, ভরাট। ‘সঘন গহন রাত্রি, ঝরিছে শ্রাবণধারা—।’ ‘কেন তোমরা আমায় ডাকো।’ ‘পেয়েছি ছুটি, বিদায় দেহো ভাই— সবারে আমি প্রণাম করে যাই।’ হাঁটু মুড়ে বসে মাথা রাখলাম দেবব্রত বিশ্বাসের পায়ে। মনটা হু-হু করে উঠল। প্রণাম করে সরে দাঁড়ালাম অন্যদের জায়গা করে দিতে।
অবিরল মানুষ। অবিরাম গান। ভেজা চোখ। ভেজা রাস্তা। ভিড়। প্রণতি। জর্জ বিশ্বাসের দেহ তোলা হল ফুলে-সাজানো ট্রাকে। কয়েক হাজার মানুষের গলায় তখন ‘আকাশভরা সূর্য-তারা, বিশ্বভরা প্রাণ।’ অবিন্যস্ত, কিন্তু স্বতঃস্ফূর্ত মিছিল। মাঝখানে ফুলে-ফুলে ঢাকা তিনি। পা মেলালাম, গানে গলা দিলাম আমিও। পদযাত্রা অগ্রসর হল হরিশ মুখার্জি স্ট্রিটের দিকে। আকাশের নীচে, শুয়ে শুয়েই চলেছেন তিনি, রবীন্দ্রগানের অবিসংবাদিত সম্রাট। চার দিক জমজম করছে সুরে, ‘আর কি কখনো কবে, এমন সন্ধ্যা হবে...’ একটা দশক সবে শুরু হল, আর একটা যুগ শেষ হয়ে গেল। ওই চোখ, ওই তাকানো, হারমোনিয়ামটা টেনে ওই ভাবে বসা, ভেতরটা উথালপাথাল করে দেওয়া ওই গলা আর পাব না। জনমের মতো হায় হয়ে গেল হারা...
আনন্দ, মতিলাল গুপ্ত রোড, বড়িশা
আশির দশকের কোনও ঘটনার সঙ্গে নাড়ির যোগ আছে?
লিখুন এই ঠিকানায়: হ্যালো 80’s, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১। বা, লেখা pdf করে পাঠান
এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in
আজ সকাল দশটায় পার্ক স্ট্রিটের এক অভিজাত পাঁচতারা হোটেলের লবিতে গোলমালের জেরে ধ্বনি-পুলিশ মোতায়েন করতে হয়। ঘটনাটির সূত্রপাত জনৈক মাঝবয়সি মাছ ব্যবসায়ী ও হোটেলের ম্যানেজারের মধ্যে বচসাকে কেন্দ্র করে। হোটেলের ছাদটি হেলিপ্যাডের জন্য রাজ্য সরকারকে ৯৯৯ বছরের জন্য লিজ দেওয়া। বনগাঁ থেকে ঠাকুরপুকুর বাজার অবধি হেলিকপ্টার রুটে পড়ে এই হেলিকপ্টার স্টেশনটি। ২০২০ সালে তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী এই ‘স্বর্গরথ’ প্রকল্পের শিলান্যাস করেন। প্রকল্পটি শেষ হয় ২০২৬ সালে। বর্তমানে ৫৫৬ টাকার স্মার্ট টিকিটে যাতায়াত করা যায় বনগাঁ থেকে ঠাকুরপুকুর বাজার অবধি। মহম্মদ করিম মণ্ডল নামের সেই মাছ ব্যবসায়ী হোটেলের লবির মধ্য দিয়ে আসার সময় তার ঝুড়ি থেকে একটি কাতলা মাছ লবিতে পড়ে গেলে পরিচ্ছন্নতা নষ্ট করার অভিযোগে বচসার শুরু। করিমের দাবি, পরনের লুঙ্গি সামলাতে গিয়ে অনিচ্ছাকৃত ভাবে ঝুড়ি বেসামাল হয়ে এই ঘটনা ঘটে। সরকারি তরফে এই নিয়ে কোনও বিবৃতি দেওয়া হয়নি। আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের একটি বিশেষ বাড়ি অনুষ্ঠান ভবন হিসেবে ভাড়া দেওয়া হয় ২০২০ সাল থেকেই। করিম সেইখানেই বরাবর মাছ দিয়ে আসছেন। কিন্তু এই গন্ডগোলের জেরে এ বার তিনি সময়মত মাছ সরবরাহ করতে পারেননি ও বিশেষ আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। ফলে বিষয়টি সুপ্রিম কোর্ট অবধি গড়ানোর সম্ভাবনা প্রবল। আপাতত হেলিপ্যাডটি বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে পরিবহণ দফতর। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, গত বছর জনৈক মধুমেহ রোগী হেলিকপ্টারে করে নন্দন চত্বরের উপর দিয়ে যাবার সময় মূত্রবেগ সংবরণ করতে পারেননি। নীচে তখন চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান চলছিল। সিবিআই ঘটনাটি তদন্ত করে ও শৌচালয়যুক্ত হেলিকপ্টার চালানোর সুপারিশ করে। সেই মতো ১০০টি হেলিকপ্টার তৈরির বরাত দেওয়া হলেও, আজও তা পাওয়া যায়নি।
জয়শ্রী কোনার, কলকাতা
লিখে পাঠাতে চান ভবিষ্যতের রিপোর্ট? ঠিকানা:
টাইম মেশিন, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১। অথবা pdf করে পাঠান এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in