ক্যামেরায় ‘নিজস্বী’ তোলার অভ্যাস যে এত গুরুতর আকার নেবে, এক দশক আগে কেউ ভাবতেই পারেনি। হু (ওয়ার্ল্ড হেল্থ অর্গানাইজেশন)-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী ভারতে স্মার্টফোন ব্যবহারকারীদের ৬০ শতাংশ এই রোগে আক্রান্ত। রোগের নাম ‘সেল্ফিভার’। সমীক্ষা বলছে, পৃথিবী জুড়ে সোশাল মিডিয়ায় আপলোড হওয়া নিজস্বী-ছবির ৩৫ শতাংশই ভারতীয়দের। ডাক্তারদের মতে, এই রোগ মানুষকে আত্মকেন্দ্রিক তৈরি করে। এই অসুখ নেশার মতো ক্ষতিকর। চিড়িয়াখানায় বাঘের সঙ্গে সেল্ফি তুলতে গিয়ে হাত খুইয়েছে এক যুবক। পরীক্ষা দিতে গিয়ে প্রশ্নপত্রের সঙ্গে সেল্ফি তোলায় এক ছাত্রকে বহিষ্কার করা হয়েছে। ব্রিজের রেলিঙে ঝুলতে ঝুলতে বা চলন্ত ট্রেনের সামনে দাঁড়িয়ে সেল্ফি তুলতে গিয়ে মৃতের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে। সেল্ফিভারে আক্রান্ত তেরো জন রুগিকে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে। সেলফোন কেড়ে নেওয়ার পর আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে তাদের এক জন। বিশেষজ্ঞরা দাবি তুলেছেন, ক্যামেরাবিহীন স্মার্টফোন চালু করতে হবে, পাবলিক প্লেসে সেল্ফি তুললে জরিমানা দিতে হবে। এমনকী তাঁরা জুকেরবার্গকে অনুরোধ করবেন, তাঁর সোশাল সাইটে বিশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করতে, যা আগে যাচাই করবে ছবিটি নিজস্বী কি না, অ-নিজস্বী হলে তবেই আপলোড করতে দেবে। ‘ইন্ডিয়ান নার্সিসিস্ট সোসাইটি’ সেল্ফি-বিরোধী এ সব নীতির তীব্র নিন্দা করেছে। তাদের মতে, ‘সেলফি সেলফিশ বানায় না, বরং সুখ-দুঃখের সময় একাও যে জীবনটাকে উপভোগ করা যায়, সেটাই প্রমাণ করে। তা ছাড়া এটা একটা কৌশলী আর্ট এবং দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত।’ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এই যুক্তিকে সমর্থন করছে এবং ধরনা-আন্দোলনের হুমকি দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত তরুণ সাহিত্যিক বলেছেন, এই স্থবির দেশে ‘আত্মস্থ’-বীর হওয়ায় কোনও দোষ দেখি না।
শৌভিক শীল, আইএসআই, কলকাতা
উত্তমকুমারের সঙ্গে চায়ে চুমুক
১৯৬১ সাল। শিবপুর দীনবন্ধু কলেজ থেকে আমরা বাইশ জন নির্বাচিত হয়েছি, আগ্রা সহ আরও নানান জায়গায় এক্সকারশন-এ যাব। ‘শিক্ষামূলক ভ্রমণ’, তাই সঙ্গে যাবেন দুজন শিক্ষকও, গাইড-কাম-অভিভাবক হিসেবে। বলা হয়েছিল সকাল ন’টা কুড়ির মধ্যে হাওড়া স্টেশন এসে বড় ঘড়ির তলায় অপেক্ষা করতে। তুফান এক্সপ্রেস ছাড়বে ন’টা পঁয়তাল্লিশে। চির কালই আমি লেট, ছুটতে ছুটতে সাড়ে ন’টায় এসে দেখি, কেউ কোত্থাও নেই। আট নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে ট্রেন ছাড়বে, জানা ছিল। পড়িমরি দৌড়লাম সে-দিকে। একটা কামরার কাছে দেখি বন্ধুরা দাঁড়িয়ে। তুমুল গালাগালি দিল, তার পর নিজেরাই আবার আমার মালপত্র কম্পার্টমেন্টে তুলে দিল।
এক বন্ধু বলল, জানিস, আমাদের দুটো কম্পার্টমেন্ট সামনে, ফার্স্ট ক্লাসে উত্তমকুমার বসে আছেন! গোড়ায় বিশ্বাস করিনি, কিন্তু আরও অনেকে যখন বলল, কৌতূহলী হয়ে কিছু দূর এগোতেই একেবারে স্ট্যাচু! বাংলা সিনেমার মহানায়ক, ‘গুরু’, আমার সামনে, জানলার ধারে বসে আছেন! উনি ছাড়াও আরও অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রীও ওই কম্পার্টমেন্টের অন্য কুপ-এ ছিলেন। কিন্তু ওঁরা সবাই যাচ্ছেন কোথায়? সামনেই নীল চেক লুঙ্গি পরা এক জনকে দেখে, খানসামা ভেবে আমার এক বন্ধু জিজ্ঞেস করে বসল, এই শোনো, তোমরা কোথায় যাচ্ছ? লুঙ্গিধারী ভয়ানক রেগে গেলেন: ‘ভদ্রতা জানো না? বড়দের সম্মান করে কথা বলতে হয়!’ আমার হঠাৎ মনে হল, এই মানুষটাকেও তো সিনেমায় দেখেছি! আন্তরিক ভাবে ক্ষমা চাইলাম, চেক লুঙ্গির জন্যই যে আমাদের এই ভ্রম, বোঝালাম। উনি একটু নরম হলেন। উনি মানে দিলীপ রায়, বহু ছবির চরিত্রাভিনেতা। জানালেন, তপন সিংহের ‘ঝিন্দের বন্দী’ ছবির শুটিংয়ে পরিচালক সহ পুরো টিম আগ্রা হয়ে রাজস্থানের উদয়পুরে যাচ্ছেন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আর অরুন্ধতী দেবী প্লেনে জয়পুর হয়ে দলের সঙ্গে যোগ দেবেন।
ট্রেন ছেড়ে দিল। আসানসোল পৌঁছতেই আমি আর সেই বন্ধু দিলাম দৌড়। স্টেশন থেকে চার আনা দিয়ে একটা পেন আর ছোট্ট একটা নোটবই কিনে সটান সেই ফার্স্ট ক্লাস কুপ-এ, উত্তমকুমার যেখানে আছেন। আজ ভাবি, কোন সাহস আর স্পর্ধা ভর করেছিল সে দিন, দুই কলেজপড়ুয়া তরুণের ওপর! এ-ও মনে হয়, ‘স্টার’রাও কেমন অমায়িক, কাছের মানুষ ছিলেন সে-কালে! তাঁদের কাছে, পাশে পৌঁছে যাওয়া যেত সহজেই, কথা বলা যেত। একটা গোটা ছবির ইউনিট শুটিংয়ে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের মতোই ট্রেনে চেপে, আজ ভাবা যায়!
১৯৬১-র ৯ জুন মুক্তি পেয়েছিল তপন সিংহ পরিচালিত ‘ঝিন্দের বন্দী’। তারই একটি দৃশ্যে মহানায়ক।
উত্তমকুমারের কুপ-এ উঠে পড়েছি, তাই প্রথমেই ক্ষমা চাইলাম। তার পর চাইলাম সই। অদ্ভুত, উনি একটুও রাগলেন না। মৃদু হেসে আমাদের বসতে বললেন, ওঁর পাশের সিটে! সই দিলেন। কোন কলেজে পড়ি, কোথায় যাচ্ছি, জিজ্ঞেস করলেন। সঙ্গে ওঁর স্ত্রী গৌরী দেবী ও আর এক আত্মীয়া ছিলেন। অন্য কুপ-এ তপন সিংহ সহ আর সবাই। উত্তমকুমারের সঙ্গে কথা বলছি, এই অকল্পনীয় ঘটনাটি আমাদের জীবনে ঘটে যাওয়ার আনন্দে খেয়ালই করিনি, কখন ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে! আমরা তো তখন হতবাক, অভিভূত, বিভোর! পরের স্টেশন পর্যন্ত ওঁর সঙ্গে গল্প করতে করতে চলে এলাম। বিকেলে মধুপুর স্টেশন থেকে ওঁর ভাই তরুণকুমার ট্রেনে উঠলেন।
পর দিন। খুব সকাল, অজানা একটা স্টেশনে সিগনাল না পেয়ে ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে। দেখি, তরুণকুমার প্ল্যাটফর্মে নেমে ‘চা, চা!’ বলে ডাকছেন। হঠাৎ শুনি, উত্তমকুমার চেঁচিয়ে বলছেন, ‘বুড়ো, এখুনি ট্রেনে উঠে পড়!’ সে-ই জানলাম, তরুণকুমারের ডাকনাম ‘বুড়ো’। খুবই মিশুকে আর আমুদে এক জন মানুষ, পরদায় যেমন, বাস্তবেও। পরে আমাদের কামরায় এসে জমিয়ে আড্ডা দিয়েছিলেন।
আর একটা স্টেশন এল। ইঞ্জিন বদল হবে, তাই গাড়ি বেশ কিছু ক্ষণ দাঁড়িয়ে। প্ল্যাটফর্ম-লাগোয়া একটা চায়ের দোকান, দেখি উত্তমকুমার সেখানে দাঁড়িয়ে দিব্যি চা আর সিগারেট খাচ্ছেন। আমরাও ভিড়লাম সেখানে। হেসে, আমাদের জন্যও চায়ের অর্ডার দিলেন। বললেন, ‘সিগারেট চেয়ো না। ওটা দেব না।’ আমরা তো তখন হাতে চা কেন, চাঁদ পেয়েছি! উত্তমকুমারের সঙ্গে এক বেঞ্চিতে বসে চা! দুজন অবাঙালি ছেলে আমাদের পাশে বসে চা খাচ্ছিল, তাদের বললাম, জানতা হ্যায় ইনকো? ফিল্মস্টার উত্তমকুমার! ওরা তাচ্ছিল্য করে বলল, হামলোগ দিলীপকুমার, দেবানন্দ জানতা হ্যায়, ইনকো নেহি। উত্তমকুমার শুনতে পেয়েছিলেন। একটু বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘তোমরা এ কী করছ? আমার তো সর্বভারতীয় পরিচয় নেই। আর কখনও এ রকম কোরো না।’ আমাদের এক শিক্ষক ওঁকে বললেন, আপনি কিছু মনে করবেন না। ওঁর সেই ভুবনবিজয়ী হাসি হেসে উত্তমকুমার বললেন, ‘একদমই না। কলকাতায় এ রকম সুযোগ থাকে না। এখানে এই পরিবেশে বেশ ভাল লাগছে। আসুন, চা খান।’
বিকেলে আগ্রা পৌঁছলাম। ওঁদের ট্রেন রাতে, তাই ওয়েটিং রুমে বিশ্রাম নেবেন। ছবি তোলার অনুমতি চাইলাম। শুধু রাজিই হলেন না, গৌরীদেবীকেও ডেকে বাইরে নিয়ে এলেন। আমার সুটকেস থেকে পিসেমশাইয়ের চৌকো বক্স-ক্যামেরা বার করলাম। পাড়ার কল্পনা স্টুডিয়ো থেকে ১২০ ফিল্ম ভরে এনেছি। জীবনের প্রথম ছবি তোলা, তাও উত্তমকুমারের! আমার ক্যামেরা ধরা দেখে উনি হেসে ফেললেন। নিজেই দেখিয়ে দিলেন, কোন অ্যাঙ্গল থেকে ছবি নেব। বললেন, ‘আমি সিগারেট ধরানোর পর ইশারা করলে তবেই শাটার টিপবে।’ তা-ই করলাম। আমিই বোধহয় প্রথম ও একমাত্র ফটোগ্রাফার, উত্তমকুমারের ছবি তুলে যার ক্যামেরা-দারি শুরু!
আলোক ঘোষাল, অম্বিকা ঘোষাল লেন, শিবপুর
ষাটের দশকের কোনও ঘটনার সঙ্গে নাড়ির যোগ আছে?
লিখুন এই ঠিকানায়: হ্যালো 60’s, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১। বা, লেখা pdf করে পাঠান
এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in