রবিবাসরীয় ম্যাগাজিন

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৭ জুন ২০১৫ ০০:০৩
Share:

রসুন

Advertisement

পিনাকী ভট্টাচার্য

আমাদের দেশের হেঁশেলে, বিশেষ করে আমিষ রান্নায়, আদা আর রসুনের অবিচ্ছেদ্য বন্ধুত্ব, এক্কেবারে যেন জয় আর বীরু! আদা’র গপ্প নিয়ে তল্লাশি বেশ কিছু দিন আগেই হয়েছে— আজ রসুনের গপ্প।

Advertisement

রসুনের সঙ্গে ঠিক কবে থেকে মানুষের সম্বন্ধ, তা বলা বেশ কঠিন; পশ্চিম এশিয়ার লোককথা বলে, ইডেন-এর স্বর্গ-বাগানে আদমের পতনের পর, শয়তান যখন বাগানের বাইরে পা রাখে, তার বাঁ পা যেখানে রেখেছিল, সেখানে রসুন জন্ম নিয়েছিল!

রসুন হেঁশেলে ঢোকার অনেক দিন আগে থেকেই তার গুণের খ্যাতি চার দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। ফারাওদের আমলে পিরামিড তৈরির জন্য যে শ্রমিকরা নিযুক্ত হত আর মরুভূমিতে প্রচণ্ড কায়িক পরিশ্রম করত, তাদের নিয়মিত রসুন দেওয়া হত খাওয়ার জন্য। রসুন নাকি শ্রম-ক্ষমতা বহু গুণ বাড়িয়ে দিত আর বিভিন্ন অসুখকেও দূরে রাখতে সাহায্য করত। খ্রিস্টপূর্ব ষোড়শ শতাব্দীতে লেখা এবের্‌স প্যাপিরাস নামের এক মিশরীয় মেডিকাল জার্নাল জানিয়েছিল, রসুন ২২ রকম রোগ সারায়। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে গ্রিক ইতিহাসবিদ হেরোডোটাস-এর লেখা থেকে জানা যায় একটা মিশরীয় বইয়ের কথা। সেখানে বিবরণ আছে: রাজা খুফু’র পিরামিড তৈরির সময়, শ্রমিক আর দাসেরা শরীরে শক্তি বাড়াতে ঠিক কত পরিমাণ রসুন, পেঁয়াজ আর মুলো খেয়েছিল।

যদিও রসুনের খ্যাতি ছিল খুব, তবু গ্রহণযোগ্যতা বাড়েনি, বিশেষত সমাজের উচ্চ শ্রেণিতে। প্লিনি’র লেখায় পাওয়া যায়, সেই যুগের মিশরে রসুন আর পেঁয়াজকে ঈশ্বরের জায়গায় বসিয়ে তার সামনে শপথ গ্রহণ করা হত, কিন্তু তা খাওয়ার ব্যাপারে সমাজের উচ্চ শ্রেণি এক্কেবারে শত হস্ত দূরে! আর এই গল্প শুধু মিশরেরই না, গ্রিসেরও। সেবেল’এর মন্দিরের প্রবেশ-দ্বারে শ্বাস পরীক্ষা করা হত। কারও শ্বাসে রসুনের গন্ধ পেলে, তাকে মন্দিরে ঢুকতে দেওয়া হত না।

অদ্ভুত ব্যাপার! রসুনের গুণাগুণ নিয়ে কারও কোনও সংশয় নেই, তাকে দেবত্ব অবধি দেওয়া হচ্ছে, আবার এড়িয়েও চলা হচ্ছে! কারণটা অবশ্য বোঝা সোজা: রসুনের উগ্র গন্ধ। এই গন্ধের প্রতি সেই যুগে এতটাই বিতৃষ্ণা ছিল, দৌড়-প্রতিযোগিতায় জেতার জন্য লোকে রসুন চিবিয়ে নামত! তাতে নাকি প্রতিযোগীর সংখ্যা কমে যেত! কারণ, অনেক দৌড়বাজের কাছে, প্রতিযোগীর মুখ থেকে বেরনো রসুনের গন্ধ সহ্য করার চেয়ে, হার মেনে নেওয়া ভাল! হোমার তাঁর মহাকাব্য ওডিসি’তে মজা করে লিখেছিলেন, সার্‌সি যদিও ইউলিসিসের সব সঙ্গীকে শুয়োরে বদলে দেয়, কিন্তু ইউলিসিস-কে ছেড়ে দেয়, কারণ তাঁর মুখ থেকে বেরনো রসুনের গন্ধে সে ঘাবড়ে গিয়েছিল!

রসুনের যে গুণগুলোর জন্য এত খ্যাতি, তার একটা হল, যৌন উত্তেজনা বাড়ানো। চিনে ডাক্তাররা সুখী দাম্পত্য জীবনের জন্য রসুন খেতে পরামর্শ দিতেন। মধুচন্দ্রিমায় যাওয়ার সময় জামার বোতাম-ঘরে ফুলের বদলে রসুনের কোয়া লাগিয়ে নিয়ে যাওয়ার রেওয়াজ ছিল সে দেশে। আর এই গুণে (দোষে?) দুষ্ট বলে, রসুন বহু দিন নিষিদ্ধ ছিল আমাদের উপমহাদেশে— সাধু, বিধবা আর কিশোর-কিশোরীদের ক্ষেত্রে। মানে, সদ্য বয়ঃসন্ধি পেরোলে, রসুনের নাগাল থেকে দূরে থাকো! এ সব শুনলে ভয় হয়, ভারতীয় সেন্সর বোর্ড কবে আবার পরদায় রসুন খাওয়া দেখালেই, পবিত্র কাঁচিটি বের করে, দৃশ্যটা কচাৎ করে কেটে দেবে!

pinakee.bhattacharya@gmail.com

খগেন পাগলা, নাটা গুন্ডা, অন্যান্য

স্বপ্নময় চক্রবর্তী

কিছু দিন আগে ঘর পালটেছি। কাগজপত্র বাছাবাছির সময় একটা প্যাকেট পেলাম। ওহ্‌, সেই খগেনদার সম্পত্তি? একটা পোস্টকার্ড বের করি। ‘...তোমার জন্য সর্বদা চিন্তায় থাকি। কলিকাতায় নাকি আকাশ হইতে বোম পড়িতেছে। সবাই বলে বোম খুব খারাপ, ঘরবাড়ি গুঁড়া হইয়া যায়, আগুন ছিটকায়। তোমার আর কলিকাতা থাকিবার দরকার নেই। লেখাপড়া আগে না জীবন আগে? পত্র পাইবামাত্র কৃষ্ণ কৃষ্ণ জপিতে জপিতে দেশে ফিরিয়া আস...’

খগেনদা বাগবাজার অঞ্চলে খগেন পাগলা নামেই বিখ্যাত ছিল। গলায় তুলসীর মালা। কখনও দু’হাত তুলে স্ট্যাচু হয়ে যেত, বলত, প্রেমসমাধি হল। দোকানে দোকানে গিয়ে বাণী দিত। যথা: ময়রার দোকানে দাঁড়িয়ে— ‘কৃষ্ণ রাখো বুকের মধ্যে যেমন রাজভোগেতে নকুলদানা, ভক্তিরসে ফুটলে পরে দানার দেখা মিলবে না। কী করে দেখবি? দানা তো ছ্যানার ভিতরে মিশে গেছে রে...’ পাড়ার গার্জেন নাটাদার হুকুমে অন্নপূর্ণা হোটেল ওকে রাত্তিরে রুটি-তরকারি দিত। দিব্য চলে যেত লোকটার। দত্তদের রোয়াক ছিল ওর ঘর-সংসার।

আমাদের বাল্যবয়সে নানা রকম পাগলকে রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়াতে দেখতাম। কাঁচি পাগলা ছিল প্রচণ্ড রকম মোহনবাগান সাপোর্টার। কেউ যদি বলত ‘মোহনবাগান হেরেছে’, কাঁচি পাগলা সুর করে জবাব দিত, ‘তোর বাপ মরে-এ-এ-চে।’ কেউ যদি বলত ‘ইস্টবেঙ্গল চ্যাম্পিয়ান’, ও বলত— ‘তোর বাপ মরেচে খাটিয়া আন।’ এক জন ছিল ছবি পাগলা, ও সেফটিপিন দিয়ে নিজের জামায় নিজের কয়েকটা ছবি আটকে রাখত। রাস্তায় ঘুরে ঘুরে বলত, ‘বাংলার ভাগ্যাকাশে আজ দুর্যোগের ঘনঘটা, বাংলার সৌভাগ্যসূর্য অস্তাচলগামী...’ সৌভাগ্যসূর্য অস্তাচল থেকে ওঠেনি যদিও, কিন্তু রাস্তাঘাটে আগের মতো পাগল দেখি না আর। পাগলরা সব কোথায় গেল? নাটাদা বলেছিল, ক্ষমতায়। ছবি পাগল, কবি পাগল, বাণী পাগল,
মানি পাগল— সবাই আছে।

নাটাদাকে গুন্ডা বলেই জানতাম। গুন্ডাদেরও এখনও দেখি না তেমন। কানাদা, নাটাদা, খোকাদারা নিজেদের গুন্ডা বলতে লজ্জা পেত না। বাগবাজার ছেড়েছি অনেক দিন। বছর দশেক আগে দেখা হয়েছিল, কুঁজো হয়ে গেছে, হাঁপানি ধরেছে। বললাম, চেনাই যাচ্ছে না তোমায়! নাটাদা বলল, ‘এরম হয়। আজ উত্তমকুমার বেঁচে থাকলেও দাঁত থাকত না, গাল ভাঙত, মাথায় টাক পড়ত।’ কথায় কথায় বলল, ‘যাই বল, গুন্ডামিটা আমরাই করে গেছি বুক ফুলিয়ে। এখন এক পিস পিয়োর গুন্ডা দেখাতে পারবি? যে বুক বাজিয়ে বলতে পারবে ইয়েস, আই অ্যাম গুন্ডা! মাঈ কি লাল! সব শালাই বলে আমি সমাজসেবী। তোরা তো জানিস, পাড়ার ভালমন্দটা আমিই দেখতাম। একটা তুড়িতে লোক চমকে যেত। আমাদের বাইক লাগত না, বাইসেপ লাগত। পাড়ার প্রেস্টিজ রাখবার জন্য বোম বানাতাম, নিজে হাতে, দু-চারটে শিষ্যকে শিখিয়েছিলাম। এখনকার বাবুরা রেডিমেড বোম কিনছে, বাইরে অর্ডার দিচ্ছে। নিজে হাতে কদমা, বেদানা, বাতাবি— সব সাইজের বোম বানিয়েছি। পেরেক-ফেরেক দিতাম না খুব একটা। লোক তো মারতে চাইনি, লোক ভড়কানোর জন্য ফক্কা বানাতাম। ধোঁয়া আর শব্দ। এখনকার খোকাবাবুরা সোডার বোতল নেয় মাল খাওয়ার সময়। আমরা কিচাইনের সময় কাচের সোডার বোতল ঝাঁকিয়ে, বাঁকিয়ে ছুড়তাম। সেই আর্ট নষ্ট হয়ে গেল।’

নাটাদা ছিল গোপাল পাঁঠার শিষ্য। আসল নাম গোপাল মুখোপাধ্যায়। ’৫২ সালের ইলেকশনের আগে বিধান রায় ওকে ডেকে বলেছিলেন, ‘একটু জেলে যেতে হবে যে... ভোট আসছে, বাইরে থাকলে নিন্দে হবে যে...’ ইলেকশনের পর পুলিশ কমিশনার বললেন, ‘এই নাও দুটো ট্যাক্সির পারমিট।’ পারমিট ছুড়ে দিয়ে বলেছিল, ‘এ সব ঘুষ নিই না আমি। আমি গোপাল মুখুজ্যে।’ এক কোপে পাঁঠা কাটার মাংস-দোকান করেছিল গোপালদা। নাটাদার কাছে পাঁচির কথাও শুনলাম, যে পাগলিনি কুড়িয়ে পাওয়া একটি শিশুকে নিয়ে রাস্তার ভিখারিনিদের কাছে গিয়ে বলত, ‘একে একটু তোদের বুকের দুধ খাওয়া না...’

নাটাদাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, খগেন পাগলা কোথায় জানো? নাটাদা বলল, ‘খগেনের ইচ্ছে হয়েছিল মহাপ্রভুর মতো নীলাচলে হারিয়ে যাবে। ওকে পুরীর টিকিট কেটে ট্রেনে তুলে দিয়েছিলাম। ও হারিয়ে গেছে। ভাল কথা, ওর একটা প্যাকেট আছে, নিয়ে যা।’ এখন সেই প্যাকেটটা খুলছি। মায়ের চিঠি ছাড়া ওর নিজের লেখা কিছু গানও ছিল। একটা গান: ‘মরে গেলে মড়া হব, নিমতলাতে পুড়তে যাব, পুড়তে পুড়তে ধোঁয়া হয়ে তোকে আমি কাশাব, ফাঁসাতে না পারি যদি নিশ্চিত করে কাশাব...’

ইতিমধ্যে পিংলায় বোম কারখানায় বিস্ফোরক ফেটে অনেকগুলো বাচ্চা মারা গেল। এক সাংবাদিক আমাকে এক টুকরো আধপোড়া কাগজ দিয়ে বললেন, রেখে দিন। বিস্ফোরণস্থলের কাছে হাওয়ায় উড়ছিল। কোনও মায়ের চিঠি। ‘সাবধানে বোম বাঁধিবে। কাজে বসিয়া বিসমিল্লা বলিয়া মশলায় ফুঁ দিবে। কবে ফিরিবে, পথ চাহিয়া আছি।’

খগেন পাগলার আর একটা গান ছিল: ‘বড়লোক খুন হলে পরে, বড়লোকই হল্লা করে, গরিব খুন হলে বলে, বেশ হয়েছে বাঁচা গেল।’

পিংলার কেসটা যদি গড়িয়াহাটে হত?

swapnoc@rediffmail.com

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement