বিজয়িনী: মাইক হাতে হাকিমা ও ডান দিকে জামিলা। মায়া রেচেল-এর (বধূবেশে বাঁ দিকে) বিয়ের অনুষ্ঠানে।
সেকেন্ড পিরিয়ডের ক্লাস শেষ হতেই জামিলা লস্করকে ক্লাসের বাইরে ডেকে নিয়েছিলেন ক্লাস টিচার। বলেছিলেন, “তোমার আর পড়া হবে না জামিলা। তোমার বাবা এসেছিলেন আজ। তিনি স্কুল ছাড়িয়ে দিতে চান।”
কথাটা শুনে হাত-পা অসাড় হয়ে গিয়েছিল ক্লাস এইটের মেয়েটার। বাবার সঙ্গে বাড়িতে কথা হয়েছিল। বাবা বলেছিলেন, মেয়েকে আর স্কুলে পাঠানোর ক্ষমতা নেই তাঁর। তার থেকে বিয়েশাদি তাড়াতাড়ি করিয়ে দিলে কিছু লাভ হয়। কথা হলেও সত্যিই যে এটা হতে পারে, ভাবেনি জামিলা। স্কুলের দিদিমণিরাও চেষ্টা করেছিলেন অনেক, যাতে মেয়েটিকে স্কুল ছাড়তে না হয়। বাউরিয়ার এই স্কুলটার মেধাবী ছাত্রী সে। অঙ্ক আর সংস্কৃতে তুখোড়। মাধ্যমিকে ভাল রেজ়াল্ট করবে বলে আলাদা করে কোচিং দেবেন ভাবছিলেন শিক্ষিকারা। তার মধ্যে এই কাণ্ড! ক্ষতি হয়ে যাবে খুব এ ভাবে স্কুল ছাড়লে। কিন্তু বাবা রাজি হননি। সামান্য জুট মিলের কর্মী তিনি। তাঁর পক্ষে আর সম্ভব নয়। সাময়িক ভাবে ভেঙে পড়েছিলেন জামিলা। কিন্তু জেদ আর আত্মবিশ্বাস হারাননি।
প্রায় পনেরো বছর পর এক স্বনির্ভর গোষ্ঠীতে কাজ করতে গিয়ে যখন জানতে পারেন মেয়েদের কাজির কোর্স করানো হচ্ছে, সেই সুযোগ ছাড়েননি তিনি। মেয়ে হবে কাজি! এমন অদ্ভুত কথা কে কবে শুনেছে? বাধা এসেছিল সব দিক থেকে। পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন— পাশে ছিলেন না কেউই। মেয়েরা যে কাজি হতে পারে, দিতে পারে বিয়ে বা তালাক, এই ধারণাই ছিল না জামিলার আশপাশে কারও। হাওড়ার ছোট প্রান্তিক গ্রামটায় শোরগোল পড়ে যায়। কিন্তু জামিলা তাঁর সিদ্ধান্তে অনড়।
বড় গন্ডগোল এড়াতে পাড়ায় বৈঠক ডাকেন মৌলানা। বহু বাগ্বিতণ্ডার পর সেখানেই স্থির হয়, কোরানে মেয়েদের কাজি হতে বাধা নেই কোথাও। যা কিছু হচ্ছে শরিয়ত মেনেই হচ্ছে। অসন্তোষ না কমলেও গোলমাল স্তিমিত হয় খানিক।
এর পর জামিলা পাড়ি দেন মুম্বই। সেখানে দু’বছরের কোর্স করে চার বছর আগে কাজির সাম্মানিক ডিগ্রি নিয়ে পাশ করেন। মহিলা কাজিদের গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রাম দেশে এই প্রথম। ২০১৫-তে গ্র্যাজুয়েশনের কোর্স শুরু হয় ৩০ জন মহিলাকে নিয়ে। দু’বছরের কোর্স শেষে ‘ভারতীয় মুসলিম মহিলা আন্দোলন’ নামে মুম্বইয়ের একটি সংস্থা থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে পাশ করেন ১৫ জন। এই সংস্থার সহ-প্রতিষ্ঠাতা নূরজাহান সোফিয়া নিয়াজ বলছিলেন, “ছেলেদের কাজির শিক্ষা দেওয়ার জন্য দেশে বিভিন্ন জায়গায় মাদ্রাসা আছে। কিন্তু মেয়েদের এ রকম কোনও ব্যবস্থা নেই। শুধু পুরুষতান্ত্রিকতা ভাঙাই নয়, বিয়েতে মেয়েদের যথাযথ অধিকার প্রতিষ্ঠার কাজেও মহিলা কাজিদের ভূমিকা আছে।”
জামিলার সঙ্গেই পাশ করেন হাওড়ার আর এক মেয়ে হাকিমা খাতুন। হাকিমার বাবা দীর্ঘ দিন ধরেই ডোমজুড়ের গ্রামের মেয়েদের নানা ভাবে স্বনির্ভর করার চেষ্টা করতেন। হাকিমার ক্ষেত্রে তাই পারিবারিক বাধা না এলেও পাড়াপ্রতিবেশী আপত্তি জানায়। একা মেয়ে মুম্বই যাবে পড়তে, পাড়ার লোকের পক্ষে এতটা মেনে নেওয়াও কঠিন। জামিলার স্বামী তাঁদের সঙ্গে কথা বলাতেও কাজ হয়নি তেমন। এর পর সেই অগতির গতি পাড়ার মৌলবি। জামিলার মতোই হাকিমাও স্থানীয় মসজিদের মৌলবির সঙ্গে আলোচনায় বসেন। মৌলবি বলেন, কোরানে এই কাজে মেয়েদের কোনও বাধা নেই, তবে কাজ করতে হবে মাথা ঢাকা দিয়ে।
মহিলা কাজিদের কথা সংবাদমাধ্যম সূত্রে জেনেছিলেন মুম্বইয়ে কর্মরতা মায়া রেচেল। বিয়ের সময় তিনি এবং তাঁর হবু বর সামায়ুন আহমেদ সিদ্ধান্ত নেন যে, কোনও এক জন মহিলা কাজিই তাঁদের বিয়ের পৌরোহিত্য করবেন। সেই সময় এবং তার বেশ কিছু দিন আগে থেকেই এই কাজিদের নিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঝামেলা চলছিল। জামিলাদের সঙ্গেই পাশ করে বেরোনো জাহানারা আর আফরোজ বেগমকে ক্ষমা চাইতে হবে, এই দাবিতে রাজস্থানের কিছু অংশ এক সময় উত্তাল ছিল। এলাকার পুরুষ কাজি এবং কিছু কট্টর নেতা একজোট ছিলেন তাঁদের বিরুদ্ধে। পরে সেই ঝামেলা মিটলেও তার রেশ রয়ে গিয়েছিল। এই খবরগুলি সবই শুনেছিলেন মায়ারা, কিন্তু কোনও কিছুতেই তাঁদের সিদ্ধান্ত বদলায়নি। বিয়ের জন্য মহিলা কাজির খোঁজ করতে শুরু করেন তাঁরা। দু’বছর আগের কথা বলতে গিয়ে হাসছিলেন মায়া, বললেন, “হালই ছেড়ে দিয়েছিলাম খুঁজতে খুঁজতে। ভেবেছিলাম ভুল খবর পেয়েছি। সব জায়গা থেকেই নেতিবাচক উত্তর আসছিল। শেষে টানা সাত-আট মাস খোঁজ করার পর জামিলাদের কথা জানতে পারি। তার পর আর দ্বিতীয় বার ভাবিনি।”
২০১৯-এ বিয়ে করেন তাঁরা। পুরুষ কাজিদের শর্ত অবশ্য এমনিতেই মেনে নিতে রাজি ছিলেন না মায়ারা। ব্রিটিশ বাবা এবং বাঙালি মায়ের কন্যা মায়ার নাম বদলাতে হবে বলে জানিয়ে দিয়েছিলেন তাঁরা। সেই সঙ্গে ব্রিটিশ নাগরিকত্ব ছেড়ে দেওয়ারও শর্ত দেওয়া হয়েছিল। সামায়ুনও রাজি ছিলেন না এই সব বিষয়ে। দুই বাড়ি থেকে মহিলা কাজি নিয়ে ছুতমার্গও ছিল না একেবারেই। কলকাতায় হওয়া এই বিয়েতে জামিলা এবং হাকিমা দুজনেই কাজি ছিলেন। এই বিয়েই পশ্চিমবঙ্গের তো বটেই, দেশেরও প্রথম মহিলা কাজির দেওয়া বিয়ে।
শুধুমাত্র বিয়ে দেওয়া নয়, বিয়ের আইনি দিক, বিয়েতে মেয়েদের প্রাপ্য মোহর ঠিক মতো দেওয়া হল কি না, তা থেকে শুরু করে ডিভোর্স-সংক্রান্ত সব বিষয় দেখেন এই কাজিরা।
মেয়েরা কাজি হওয়ায় সমাজের পিছিয়ে পড়া মেয়েদের খানিকটা সুবিধে হবে বলে মনে করছেন হাকিমা। তিনি বলছিলেন, বিয়েতে পুরুষরা যে মোহর অর্থাৎ টাকা দেন, মেয়েদের সেটা প্রায়শই দেওয়া হয় না। কাজি মহিলারা দেখেন বিয়ের দিনই যেন নগদে টাকা চলে আসে মেয়েদের হাতে। তবে বিয়ের আগে পাত্রের আর কোনও বিয়ে আছে কি না, পরিষ্কার সে কথা জেনে নেন হাকিমা-জামিলারা। ছেলের আর কোনও বিয়ে থাকলে দ্বিতীয় বিয়ে দেন না তাঁরা। ডিভোর্স হলেও তা যেন আইনত হয়, সে দিকেও নজর রাখেন। জামিলাও বললেন, “পুরুষরা বিয়ে-ডিভোর্সের যাবতীয় আইনি বিষয় দেখতেন বলে এত দিন অবাধে তিন তালাক থেকে বহুবিবাহ চলে এসেছে। মেয়েরা এই ক্ষেত্রে যত বেশি প্রবেশ করবে, ততই মেয়েদের অধিকার সুরক্ষিত হবে।” একই মত নূরজাহানের। তিনি বলছিলেন, “এখন আর তিন তালাক দেওয়া যায় না বলে, মেয়েদের ওপর প্রচণ্ড শারীরিক-মানসিক অত্যাচার চলে, যাতে বাধ্য হয়ে তাঁরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। আর এইখানেই সুবিধে পুরুষদের। শরিয়ত আইন অনুযায়ী, কোনও স্ত্রী নিজে ঘর ছাড়লে তাঁকে খোরপোশ দিতে বাধ্য নন পুরুষ। মহিলা কাজিরা এই জায়গাতেই মেয়েদের পাশে দাঁড়াতে পারেন।” কিছু দিন আগে এই রকমই একটি ডিভোর্সে স্বামীর তরফ থেকে স্ত্রীকে দু’লক্ষ টাকা খোরপোশ দিতে বাধ্য করেছেন মুম্বইয়ের জুবেইদা খাতুন।
মহিলা কাজিদের দেওয়া মায়া রেচেলের বিয়ে দেশে প্রথম হলেও, এর আগে ২০০৮ সালে এক মহিলা বিয়ে দিয়েছিলেন। সেই বিয়ে সব দিক থেকে অন্য রকম। সেই সময় ‘ভারতীয় মুসলিম মহিলা আন্দোলন’-এর কর্মী, লখনউ-এর মহিলা সমাজসেবী নয়েশ হাসান তাঁর বিয়ে দিতে অনুরোধ করেন মুসলিম পণ্ডিত এবং প্ল্যানিং কমিশনের তৎকালীন সদস্যা ডক্টর সৈয়দা হমিদাকে। সমস্ত দিক থেকে ছকভাঙা এই বিয়ের চার সাক্ষীও ছিলেন মহিলা। বিয়ের মন্ত্র উচ্চারিত হয়েছিল ইংরেজিতে। যাতে উপস্থিত সকলে তার মানে বোঝেন। এই বিয়ে নিয়ে তুমুল আলোড়ন হয় সেই সময়। মুসলিম সমাজ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায় উচিত অনুচিতের তর্কে। শুধু তাই নয়, এই বিয়ে নিয়ে ব্যাপক গন্ডগোল শুরু হয় উত্তরপ্রদেশের নানা জায়গায়। তার পর এই নিয়ে আর কেউ উদ্যোগ করেননি। নয়েশ হাসানের বিয়ে সাহসী আর ব্যতিক্রমী, কিন্তু এই বিয়ে হয় মুসলিম সমাজের আলোকিত অংশে। বর-বধূ এবং পুরোহিত এঁরা সবাই ছিলেন উচ্চবর্গের মানুষ।
জামিলা-হাকিমাদের যুদ্ধ কিন্তু এঁদের থেকে অনেকটাই আলাদা। সমাজের যে অংশে বসে তাঁরা এই অসাধ্যসাধন করেছেন, তার প্রায় সবটাই অশিক্ষা আর দারিদ্রের ছায়ায় ঢাকা। ক্লাস এইটে পড়া ছেড়ে দেওয়া, দুই সন্তানের মা জামিলা এত দিন পর আবার পড়াশোনা শুরু করছেন। মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে এখন পুরোদস্তুর স্নাতক হওয়ার পথে তিনি। কাজির কোর্স, বাইরে গিয়ে থাকা তাঁকে আরও বেশি আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে। হাকিমাও পূরণ করেছেন জীবনের অনেক অপূর্ণ স্বপ্ন। তাঁর দুই মেয়েকে হস্টেলে রেখে পড়াচ্ছেন তিনি। যদিও এখনও বিয়ে অথবা বিবাহবিচ্ছেদ মানুষ পুরুষদের দিয়েই করাতে পছন্দ করেন, তাও কোথাও অন্তত মেয়েদের চলার পথটুকু তৈরি হয়েছে, এই আশ্বাসটুকু পাচ্ছেন নূরজাহানরা। রাজস্থানের জাহানারা, আফরোজ বেগম, বান্দ্রার জুবেদা খাতুন, কলকাতার হাকিমা, জামিলাদের অন্ধকার পেরিয়ে আলোর দিকে যাত্রা শুরু হয়ে গিয়েছে।
ছবি সৌজন্য: মায়া রেচেল