ওঁরা তিন জন

স্কুলের গণ্ডি পেরোননি কেউই। প্রত্যেকেই নিম্নবর্ণের হিন্দু। কিন্তু বিহারের গ্রামে পরিত্যক্ত মসজিদ সংস্কারের কাজে এগিয়ে এসেছেন তাঁরাই। গৌতম চক্রবর্তীঅদূরে একটা ঝিলের পাশে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংসস্তূপ। মাখনের মতো মসৃণ রাস্তা, পর্যটকদের অবিরাম যাতায়াত।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৪ নভেম্বর ২০১৯ ০০:০৩
Share:

নিরলস: এই মসজিদ সংস্কারের কাজই চলছে।

পর্যটকদের ভিড়ে আক্রান্ত বিশ্ব-ঐতিহ্যকে পাশ কাটিয়ে ঢুকে এলেই ভাঙাচোরা, ধুলোয় ধূসর রাস্তা। পিচের চাকলা উঠে গিয়েছে, মাঝে মাঝেই ইতিউতি ঘুরে বেড়াচ্ছে মোষ। গরু নয়, কষ্টসহিষ্ণু পোষ্য হিসেবে এখানে মোষই বেশি জনপ্রিয়।

Advertisement

অদূরে একটা ঝিলের পাশে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংসস্তূপ। মাখনের মতো মসৃণ রাস্তা, পর্যটকদের অবিরাম যাতায়াত। গত রবিবার সকালেও নজরে এল, জাপানি পর্যটকদের নিয়ে ঢুকে আসছে বিলাসবহুল বাস।

প্রদীপের নীচেই সবচেয়ে বেশি অন্ধকার। অতএব, মসৃণ রাস্তা, বিলাসী যানের নামগন্ধ ঝিলের এ পারে নেই। সরু পিচের রাস্তা মাঝে মাঝেই দাঁত বার-করা জীর্ণ ইটের বাড়িকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে, এক জায়গায় খাটিয়ায় বসে জটপাকানো চুলে উকুন মারছে থুত্থুরে এক বুড়ি।

Advertisement

মাঢ়ী গ্রামের সেই তিন যুবক

আলপথের মতো সঙ্কীর্ণ রাস্তায় দ্বিতীয় কোনও যান নেই। একটু আগে বেরিয়ে গেল ধুলো-মাখা এক অটো রিকশা। পেটে, কোলে, কাঁখে আর মাথার ছাদে প্রায় জনাদশেক লোক। বিহারের গ্রামে মানুষ এ ভাবেই যাতায়াত করে।

এই রকম রাস্তা বেয়েই মরসুয়া, নীরপুর, মাঢ়ী ইত্যাদি হতদরিদ্র সব গ্রাম। দূরে একটা খাল, শুনলাম এর নাম পায়মার নদী। এখন শুকনো, কিন্তু বর্ষায় ভয়ঙ্কর। এখানে কলকাতার মতো সাইনবোর্ড নেই, গ্রামের রাস্তায় লোকজনকে জিজ্ঞেস করতে করতে এগিয়ে চলা। ভাবা যায়, এই সব গ্রাম নালন্দার বিশ্বখ্যাত ধ্বংসস্তূপ থেকে মেরেকেটে দশ-বারো কিলোমিটার দূরত্বে!

মাঢ়ী গ্রামে পৌঁছেছিলাম এ ভাবেই। গ্রামের ভিতরে গাড়ি ঢোকার রাস্তা নেই, অগত্যা এবড়োখেবড়ো লাল মাটির শুঁড়িপথ বেয়ে এগিয়ে যাওয়া। আসল দিকচিহ্নটি দেখলাম, সবাই চেনে। মসজিদটা কোথায় জিজ্ঞাসা করতেই গ্রামের লোকেরা এক বাক্যে বলে দিলেন, ‘‘ওই তো ও দিকে। আর একটু এগিয়ে যান।’’

বিবর্ণ ইটের দেওয়ালের পাশে ততোধিক বিবর্ণ, সাদা রঙের একটা মসজিদ। মাথার তিনটি গম্বুজ এবং পাশের মিনারগুলি অবশ্য অক্ষত। অদূরে কোনও পিরের কবর বা মাজার। সেখানে বিবর্ণ চাদর। বড় কবরের পায়ের কাছে আরও দুটো ছোট কবর। ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে দেখা গেল, উঠোনের এক কোণে ডাঁই করে-রাখা বালি ও সিমেন্ট। মসজিদের ভিতরে বাঁশের ভারা বেঁধে কাজ করছেন ওঁরা তিন জন—অজয় পাসোয়ান, বাখোরি জমাদার আর গৌতমপ্রসাদ মাহাতো। কেউ লোহার কড়াইতে সিমেন্ট মাখছেন, কেউ বা মাচায় উঠে রং-চটা দেওয়ালে পলেস্তারা লাগাচ্ছেন। গত ছয়-সাত বছর ধরে বিহারের অজ গ্রামের পরিত্যক্ত মসজিদ সংস্কারের কাজে নেমেছেন এই তিন হিন্দু যুবক।

তিন জনেরই বয়স তিরিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে। কেউ বিশেষ ‘শিক্ষিত’ নন, গ্রামের স্কুলে ক্লাস সেভেন-এইট অবধি পড়েছেন। এই ভারতে মসজিদ সংস্কারের ‘সেকুলার’ দুঃসাহস কী ভাবে পেলেন তিন গ্রাম্য তরুণ?

গ্রামীণ: অদূরে বটগাছের ছায়ায় মাজার, তার সামনে দুই যুবক

কথার শুরুতেই তাই ধাক্কা খেলাম। গামছা-পরা বাখোরি জমাদার সিমেন্ট মাখতে মাখতে বললেন, ‘‘হমলোগ সেবা দেতা হ্যায়।’’ শুধু মন্দির, মঠ বা গুরুদ্বারে নয়, মসজিদেও স্বেচ্ছায় সেবা দেওয়া যায়। প্রথম ধাক্কাই বুঝিয়ে দিল, শহুরে সাংবাদিককে তার চেনা লব্‌জগুলি ভুলে অন্য ভাবে এগোতে হবে।

বারোশো ঘরের এই গ্রামে এখন এক জনও মুসলমান নেই। ওঁরা জানালেন, স্বাধীনতার পরে পরে এবং ষাট-সত্তরের দশকে মুসলমানেরা সকলে গ্রাম ছেড়ে চলে গিয়েছেন। এঁরা জন্ম ইস্তক এই গ্রামে কোনও মুসলমান চাচাকে দেখেননি।

বাঙালির ছেলে, আর কিছু না হোক, ‘বিহারি মুসলমান’ যে কী ভয়ঙ্কর, কলকাতা ও নোয়াখালির দাঙ্গায় তারা কেমন ভূমিকা নিয়েছিল, শুনে অভ্যস্ত। কিন্তু সেই শ্রুতিও কাজে এল না। হিন্দু-অধ্যুষিত এই গ্রামে এখনও সবচেয়ে বেশি জমি ভুট্টো মিঞা নামে এক ভদ্রলোকের। প্রায় কুড়ি বিঘা। ভুট্টো মিঞা অবশ্য এখানে থাকেন না, বিহার শরিফের স্কুলে পড়ান, সেখানকার পাকাপাকি বাসিন্দা। ‘‘গ্রামের অবস্থা তো দেখতেই পাচ্ছেন। এখানে ডাগদরবাবু জ্বরজ্বারি, পেট ব্যথায় বড়ি দেন। বড় কিছু হলে বিহার শরিফের হাসপাতালেই নিয়ে যেতে হয়,’’ বললেন গৌতমপ্রসাদ। বুঝলাম, এই ভারতে দাঙ্গা, লুটতরাজের গল্প সত্য, তবু শেষ সত্য নয়।

মুসলমানদের অবর্তমানে, গ্রামের এই গল্পটা অন্য পরিত্যক্ত মসজিদের মতোই। বড় বড় ঘাস ও জঙ্গল গজিয়ে যায়, নিয়মিত বসতে থাকে দিশি মদ ও জুয়ার আড্ডা। তার পরই গল্পটা ঘুরিয়ে দেন এই তিন বন্ধু। এঁরা গ্রামেই চাষাবাদ করেন, রাজমিস্ত্রির কাজ করতে কখনও কখনও পটনা, কলকাতা বা কোয়ম্বত্তুর গিয়েছেন।

‘‘সেখানে কোনও মসজিদে ঢুকেছেন? মেরামতির কাজ করেছেন?’’ সমস্বরে উত্তর, ‘‘না।’’

‘‘তবে এই কাজটা ঘাড়ে নিতে গেলেন কেন?’’

তিন গ্রাম্য তরুণ যত না বিস্মিত, তার চেয়েও বেশি আহত। ‘‘কী বলেন? আমাদের গ্রামের মসজিদ, আমরা ভার নেব না তো কারা নেবে?’’ বুঝলাম, নিতান্ত সহজ বুদ্ধির গর্ভেই হিন্দু তরুণদের এই মসজিদ সংস্কারের চিন্তার উৎপত্তি। আমার গ্রামের পুকুর হোক বা মন্দির-মসজিদ, আমাকেই পরিষ্কার রাখতে হবে। এর সঙ্গে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বা ‘স্বচ্ছ ভারত’ গোছের ভারী শব্দ জুড়ে দেওয়া নিষ্প্রয়োজন।

‘‘মসজিদ সংস্কারে বাধা আসেনি? গ্রামের বাকিরা কিছু বলেনি?’’ ওঁরা ঘাড় নাড়লেন, না!

‘‘এই লেড়কারা ভাল কাজ করছে, গ্রামের লোক বাধা দেবে কেন?’’ মসজিদ প্রাঙ্গণে এলেন গামছা-পরা, খালি গা, চাপদাড়ি এক জন। একটু আগে গ্রামের রাস্তায় এঁকে দেখেছি। শুনলাম, ওঁর নাম অবনীশকুমার। এই গ্রামের অন্যতম মাতব্বর, সবাই ওঁকে ‘মুখিয়া’ বলে। মুখিয়াজি নিজেই জানালেন, পঞ্চায়েত ভোটে উনি বিজেপি-র হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, হেরে গিয়েছেন। শহুরে সাংবাদিক এ বার চমৎকৃত, ‘‘আপনি বিজেপি করেন, কিন্তু মসজিদ সংস্কারে আপত্তি নেই?’’ মুখিয়া হাসলেন, ‘‘বিজেপি নিয়ে আপনাদের, কলকাত্তার পড়িলিখা আদমিদের অনেক ভুল

ধারণা আছে।’’

তিন রাজমিস্ত্রি শুধুই মসজিদের মেঝে আর দেওয়াল সংস্কার করেই থেমে যাননি। কুলুঙ্গিতে জং-ধরা আদ্যিকালের এক সাউন্ড সিস্টেম, ‘‘বিহার শরিফের বাজারে কিনেছি,’’ বললেন ওঁরা। নমাজ পড়া, কলমা পাঠ কিছুই জানেন না, কিন্তু নিয়ম করে রোজ ভোর সাড়ে ৪টা, সকাল ১১টা, বিকেল সাড়ে ৩টা, সন্ধ্যা ৫টা ১৫ আর ৬টা ৪৫ মিনিটে এই সাউন্ড সিস্টেম চালিয়ে দেন। ১১টায় আমি নিজেও শুনলাম সেই আহ্বান: ‘লা ইলাহা...’ আমি সাক্ষ্য দিই, ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়, মহম্মদ তাঁর প্রেরিত পুরুষ। জিজ্ঞাসা করলাম, এই আজানের মানে জানেন? ওঁরা লজ্জিত মুখে ঘাড় নেড়ে জানালেন, আরবি বোঝেন না। ‘‘আমরা ঠিক করেছি, মসজিদের কাজ হয়ে গেলে ও পাশে ইমামের একটা ঘর করে দেব। দরকারে তাঁকে এখানে একটু চাষের জমিও দেব, অসুবিধা হবে না।’’

‘‘এ ভাবে মসজিদে কাজ করেন, আজানের ব্যবস্থা করেন, আপনাদের বউ, বাল-বাচ্চারা কিছু বলে না?’’ ওঁরা ফের অবাক, ‘‘না তো! আমরা জমিতে লাঙল দিই, কখনও রাজমিস্তিরির কাজ করি। পরিবারের দায়দায়িত্ব সব নিয়ে তবেই তো মসজিদের কাজ।’’ ফের ধাক্কা খেলাম। তাই তো! এক জন লোক একই সঙ্গে চাষি, রাজমিস্ত্রি, স্বামী, ছেলেপুলের বাবা, মসজিদ সংরক্ষক ইত্যাদি বহু পরিচিতিতে থেকে যেতেই পারেন। তত্ত্ব যখন সারল্যে মিশে যায়, সাংবাদিকের বোবা হয়ে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না।

ইতস্তত করে প্রশ্নটা সেরেই ফেললাম, ‘‘আপনারা গরু খান?’’ তিন জনেই শিউরে উঠলেন, ‘‘সর্বনাশ! বলছেন কী?’’ ‘‘বেশ তো, শুয়োর?’’ ফের শিহরন, ‘‘না না, ও সব খেতে যাব কেন?’’ ‘‘তা হলে কি মাছমাংস খান না?’’ ওঁরা ফের অবাক, ‘‘খাব না কেন? মুরগি, পাঁঠা এ সব খাই তো।’’ মাঢ়ী গ্রাম ফের আজন্মলালিত নাগরিক সংস্কারে সজোরে নাড়া দিল। পার্ক স্ট্রিট বা রাজাবাজারে গোমাংস ভক্ষণ মানেই সেকুলারিজ়মের পরাকাষ্ঠা নয়।

ধর্মনিরপেক্ষতা তা হলে কোথায়? শুনলাম, গ্রামে আজও যখন বিয়ের শোভাযাত্রা বা ‘বরাত’ বেরোয়, বর-কনে যুগলে এসে মসজিদের চৌকাঠে মাথা ঠেকিয়ে যায়। যখন আগাছায় ভরা জুয়ার ঠেক ছিল, তখনও ব্যত্যয় ঘটেনি। গ্রামের নীলেশকুমার পাণ্ডে জানালেন, নিজের বিয়ের সময়েও তিনি এই মসজিদের দাওয়ায় ‘গোড়’ লাগিয়েছিলেন বা প্রণাম করেছিলেন। নীলেশজি ব্রাহ্মণ। দেড় হাজার ঘরের এই গ্রামে যে পাঁচ ঘর ব্রাহ্মণ আছেন, নীলেশ পাণ্ডে তাঁদের অন্যতম। হিন্দু এবং মুসলমানকে যাঁরা দুটো আলাদা মেরু ভাবেন, তাঁরা খেয়াল করেন না, এই সব প্রত্যন্ত গ্রামে মসজিদ বা মাজারও অনেক সময় গ্রামদেবতার আসন নেয়। এলাকার রক্ষক, আপামর লোকদের ইমান ও ইজ্জত তাঁর বরকতেই পুষ্ট হয়।

গ্রামদেবতাই বটে! গৌতমরা জানালেন, একটু দূরে মরসুয়া গ্রামে নিয়ে যাবেন। মাঢ়ীতে না থাকলেও, সেই গ্রামে পাঁচ ঘর মুসলমান আছেন। দুপুরে কাউকে পাওয়া গেল না, কিন্তু নদীর দিকে যেতে একটা বড়সড় বটগাছ দেখা গেল। বটের ডালে বাচ্চারা দোল খাচ্ছে, গাছের নীচেই এক পিরের কবর বা মাজার।

সেখানেও কেউ বিবর্ণ চাদর চাপিয়ে গিয়েছে। মাঢ়ী গ্রামের মতো এখানেও কোনও মসজিদ নেই। তবে ভারতবর্ষ এ রকমই! নদীর ধারে বুড়ো বটের নীচে শিবমন্দির বা মাজার থাকতেই পারে। ‘‘ইদে আমরা এখানে মুরগি জবাই করতে আসি,’’ জানালেন হিন্দুসন্তান অজয় পাসোয়ান।

এলাকার বড় মসজিদ মরসুয়া ছাড়িয়ে আরও চার কিলোমিটার দূরে, বেন গ্রামে। বড় গ্রাম, রবিবারে হাট। ছোট ম্যাটাডোরে বোঝাই হচ্ছে ধানের বস্তা। সেই মসজিদের উঠোনে বসে বয়স্ক মহম্মদ বেলাল, শামি আহমেদরা জানালেন, মাঢ়ী গ্রামে মসজিদ সংস্কারের ঘটনাটা তাঁরা জানেন। মসজিদের সংস্কার তো ভাল কাজ, হিন্দুরা করলে আপত্তি হতে যাবে কেন? ‘‘কাটলে হিন্দুর গায়ে লাল রক্ত বেরোবে, আমারও,’’ বললেন মহম্মদ শাহনওয়াজ। বেন গ্রামে হাজার দেড়েক মুসলমান থাকেন, ইদে গরুও জবাই করা হয়। গ্রামগুলি বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের বিধানসভা কেন্দ্রে, আজ অবধি গোহত্যা নিয়ে ঝঞ্ঝাট হয়নি, জানালেন বাসিন্দারা।

‘মুখিয়া’ অবনীশকুমার ইতিমধ্যে ফেরার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন, তাঁর অন্য কাজ আছে। অজয় পাসোয়ানরা বললেন, ‘‘চলুন, এ বার আপনাকে একটা জিনিস দেখাব। জলপাথর।’’

ফেরা হল মাঢ়ী গ্রামের তিন গম্বুজওয়ালা সেই বিবর্ণ মসজিদে। অজয়রা বলছেন, মসজিদ অনেক দিন আগের। প্রায় তিনশো বছরের পুরনো বলে তাঁরা শুনেছেন। তিনশো না চারশো, সেটি পুরাতত্ত্ববিদদের বিষয়। তবে ওয়াকিবহাল মহলের ধারণা, এক সারিতে তিন গম্বুজ অনেকটাই মুঘল আমলের স্থাপত্যচিহ্ন। মুঘল জমানার শেষ দিকে, আলিবর্দি খানের আমলে মুর্শিদাবাদের মোতি মসজিদও অনেকটা এ রকম দেখতে।

মুঘল কেন, তারও আগে সুলতানি আমল থেকেই এই এলাকায় সুফি প্রভাব রয়েছে। বিহার শরিফেই রয়েছে সুলতানি আমলের ‘বড়ি দরগা’। মকদুম শরফুদ্দিন ইয়াহিয়া মানেরি নামে এক সুফি সাধক সেখানে দেহ রেখেছিলেন, পরে সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলক সেই সুফি সাধকের স্মৃতিতে একটি স্মৃতিসৌধ তৈরি করে দেন।

জলপাথর প্রকৃতির অবদান। নদীস্রোতে, বালির ঘষটানিতে অনেক সময় কিছু পাথরকে ছেঁড়া কাগজের টুকরোর মতো লাগে। সেই রকম একটা পাথর মসজিদের উঠোনে রাখা। ‘‘এখানে স্পর্শ করে জল খেলে অসুখ সেরে যায়,’’ বললেন অজয়।

গ্রাম্য কুসংস্কার? হতে পারে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক কার্যকারণকে দূরে সরিয়ে এই সংস্কারগুলিকে ঘাঁটাঘাঁটি করলেও অনেক সত্য বেরিয়ে আসে। পাথর নিয়ে এই নালন্দা, রাজগির অঞ্চলে অনেক মিথ। আমার গাড়ির চালক, রাজগিরের নন্দলাল সিংহ বলছিলেন, ‘‘মকদুম কুণ্ডে এর চেয়ে বড় পাথর আছে। সেখানেও হিন্দু-মুসলমানে বিরোধ নেই। মকদুম কুণ্ডের সংস্কারে আমরাও হাত লাগাই।’’

গিয়েছিলাম রাজগিরের সেই উষ্ণ প্রস্রবণের কুণ্ডে। টুরিস্ট অধ্যুষিত উষ্ণ প্রস্রবণের ব্রহ্মকুণ্ড, সুরজকুণ্ড, চন্দ্রকুণ্ড থেকে ৫০০ মিটার দূরে একক, নিঃসঙ্গ মকদুম কুণ্ড। এই কুণ্ডেই ছোট্ট এক মসজিদ আছে। সেখানকার খাদেম সৈয়দ ফিরোজ মকদুমি বললেন, ‘‘উষ্ণ প্রস্রবণে এটা হিন্দুদের কুণ্ড, ওটা মুসলমানদের— এ রকম বিধিনিষেধ থাকে না। মসজিদের পাশে ওই যে বড় পাথরটা দেখছেন, ওটা পৃথিবী আর স্বর্গের মধ্যে আটকে ছিল। বাবা শরফুদ্দিন মানেরি এটাকে নামিয়ে এনে পৃথিবীকে রক্ষা করেন।’’ আল্লার রহমতে রক্ষক তো এঁরাই, সুফিশ্রেষ্ঠ শরফুদ্দিন থেকে ইমাম, সাধারণরা এঁদের কাছেই শিকায়ত করেন।

পাথরকে বন্দি করার মিথে ইতিহাস লেগে থাকতেই পারে। বিহার শরিফে দেহ রাখার আগে সুফি সাধক মকদুম শরফুদ্দিন ইয়াহিয়া মানেরি এই রাজগিরেই সাধনা করতেন।

তারও আগে, এই রাজগৃহেই একদা ওপর থেকে একটা বড় পাথর গড়িয়ে দিয়ে গোতম বুদ্ধকে মারার চেষ্টা করেছিল দেবদত্ত! একই পাহাড়, কখনও বুদ্ধ-কাহিনি, কখনও বা সুফি-সংবাদ। সেই জনসংস্কৃতিতে হিন্দু নন্দলাল এবং তার বন্ধুরা আজও সুফি সাধকের স্মৃতিমাখা মকদুম কুণ্ডের সংস্কারে হাত লাগাবে, স্বাভাবিক!

অস্বাভাবিকতা অন্যত্র। মকদুম কুণ্ড থেকে হেঁটে ব্রহ্মকুণ্ডের দিকে এগোচ্ছি, রাস্তায় চা-দোকানে তিন-চার জন আড্ডা দিচ্ছেন। পরনে ধুতি আর ফতুয়া, কপালে রক্তচন্দনের টিকা। রাস্তা জিজ্ঞাসা করতেই উত্তর, ‘‘ও দিকে যান। ওটা আমাদের, হিন্দুদের কুণ্ড। এ দিকে মকদুম কুণ্ডটা মুসলমানদের।’’ বাপ রে, নাস্তিক গোতম বুদ্ধের ধর্মপ্রচারের শহরেও হিন্দু কুণ্ড আর মুসলমান কুণ্ড!

অজয় পাসোয়ানদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে ইতিমধ্যে মাঢ়ী গ্রাম নিয়ে আরও তথ্য জানা হয়ে গিয়েছে। পাঁচ ঘর ব্রাহ্মণ ছাড়া এই গ্রামে বেলদার, রবিদাস, তেলি ইত্যাদি নিম্নবর্গের জনসংখ্যাই বেশি। মসজিদ সংস্কারে হাত-লাগানো ওঁরা তিন জনও ব্যতিক্রম নন। অজয় পাসোয়ান অস্পৃশ্য, দুসাদ সম্প্রদায়ের। রামবিলাস পাসোয়ান যেমন! বাখোরি জমাদার ‘বেলদার’ বা নিষাদ সম্প্রদায়ের। গৌতমপ্রসাদ নামেই মালুম। গ্রামের থান ও প্রকৃতির উপাসক কুরমি সম্প্রদায়।

নিম্নবর্ণের তিন গ্রাম্য হিন্দু এক মসজিদ সংস্কারে! এই নব্য ভারতেও চকিতে বিস্মৃত এক বাঙালির কথা মনে পড়ল। বরিশালের যোগেন মণ্ডল। অম্বেডকরকে বাংলা থেকে কেন্দ্রীয় আইনসভায় জিতিয়ে নিয়ে এসেছিলেন, দেশভাগের পর পাকিস্তানে গিয়ে মন্ত্রী হয়েছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক তত্ত্বই ছিল, নিম্নবর্ণের তফসিলি হিন্দু আর মুসলমান কাছাকাছি, উচ্চবর্ণের হিন্দুর অত্যাচারে দুজনে প্রায় একই অভিজ্ঞতার শরিক। বিহারের গ্রামে নিচুতলার তিন হিন্দুর মসজিদ সংস্কারে আজও কি অলক্ষে তিনি লুকিয়ে থাকলেন?

এ সব ভাবতে ভাবতেই মসজিদ থেকে বেরিয়ে আসছিলাম। মেঠো রাস্তায় এখন সন্ধ্যার বিষণ্ণ অন্ধকার। হেমন্তের ধান কাটা শুরু হয়ে গিয়েছে, খেতে শুকনো, কাটা খড়ের গোছা। ‘‘একটা কথা বলব, স্যর?’’ এক ছায়ামূর্তির প্রশ্নে চটকা ভাঙল। এই গ্রামেরই লোক, সকালেও দেখেছি।

ভদ্রলোক অযাচিত ভাবে বললেন, ‘‘পড়িলিখি আদমি, সব লিখে নিচ্ছেন। বরং মুখিয়ার নামটা বাদ দিন, স্যর। এই মসজিদের কোনও উপকারে আসেনি, উল্টে অনেক জ্বালিয়েছে।’’

পল্লিসমাজ? গ্রাম্য রাজনীতি? একটু কড়া স্বরে বললাম, ‘‘সে কি! উনি তো এই মসজিদ সংস্কারের প্রশংসাই করে গেলেন।’’

ছায়ামূর্তির ঠোঁটে বিষণ্ণ হাসি, ‘‘সে আপনি কলকাতা থেকে এসেছেন, কাগজে নাম উঠবে বলে। জানেন না স্যর, ওরা মাঝে মাঝেই ঝঞ্ঝাট পাকিয়েছে। বলেছে, আজান দিচ্ছিস কেন? অথচ, এক পয়সা দিয়েও সাহায্য করেনি। আজ অবধি যা করেছে, ওরা নিজেরা।’’

অন্ধকারেই চেনা চেহারা তিনটে গাড়ির কাছ ঘেঁষে এল। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘‘উনি ঠিক বলছেন? মুখিয়াজি কোনও সাহায্য করেননি?’’

‘‘পটনার ফুলহারা শরিফ থেকে এক বার এক জন পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে গিয়েছিলেন,’’ অন্ধকারে অজয়দের বিষণ্ণ গলা শুনলাম, ‘‘আর গ্রাম? তারা ঝঞ্ঝাট পাকাতে এলে আমরাও বলে দিয়েছিলাম, আমরা তো চাঁদা চাইতে যাইনি, তা হলে তোমাদের আপত্তি কিসের? তার পর ওরা থেমে যায়।’’

তিন এখন চার। কণ্ঠে কাকুতি, ‘‘সবই মুখোশ। মুখিয়াদের আপনি চেনেন না স্যর!’’

এই না হলে ভারতবর্ষ!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement