প্রতিভা: সাহিত্য ছাড়াও সংস্কৃতির বহু শাখায় কৃতী ছিলেন ওয়ালীউল্লাহ্
কোথাও লালচে মাটি, কোথাও কাঁটা ভরা ঝোপঝাড়। অস্ট্রেলিয়ার বিচিত্র বন্য নিসর্গ। জঙ্গলের ভিতর এক বিশাল পাথরের ওপর বসে আছেন বছর তেইশের এক ফরাসি যুবতী। তাঁর চোখ মগ্ন হয়ে আছে যে পুরুষসঙ্গীটির কথায়, তিনি বাঙালি। বত্রিশ বছরের তরুণ গভীর উচ্চারণে বলে যাচ্ছেন ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে তাঁর উপলব্ধি ও অবিশ্বাসের কথা। অথবা জীবনের অর্থ নিয়ে তাঁর নানা আশা ও আশঙ্কার কথা।
কোনও দিন আবার ওঁরা পৌঁছে যান ক্যানবেরায়। শ্বেতশুভ্র বালুকাময় নির্জন সৈকত জার্ভিস বে-তে হেঁটে যাচ্ছেন তাঁরা নোনাজল ছুঁয়ে। বাঙালি যুবকটির পরনে একটি পশমি জ্যাকেট, মেয়েটি মুঠো মুঠো ঝিনুক ভরে দিচ্ছেন তাঁর পকেটে। গতকাল রাতে হোটেলের ঘরে ভেসে আসা আবছা সাগরধ্বনি প্রেক্ষাপটে রেখে তাঁরা কথা বলেছেন অনেক। রাত্রিবাসরের নিভৃত আলিঙ্গনের ঈষৎ পূর্বে দু’জনেই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন— ‘মানুষের ভিতর স্বভাবসুলভ মঙ্গলচিন্তা কাজ করে। তাতেই এই পৃথিবীর অশুভ শেষ হবে, ঘটবে শুভ ঘটনা।’ সেই মায়াকাজল চোখে নিয়ে আজ তাঁরা হেঁটে যাচ্ছেন সৈকতের দূর প্রান্তবেলায়।
রানি এলিজাবেথ যখন সিডনিতে এলেন, সবাই তাঁকে দেখার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে পড়েছিল। সিডনি নগরীর পথের দু’ধারে আস্তানা গাড়তে শুরু করে দিল মানুষজন। এই ভিড় থেকে পালাতে হবে— মনস্থির করে ফেললেন ওঁরা। পুরুষটি পাকিস্তান দূতাবাসের প্রেস অ্যাটাশে, আর নারীটি ফরাসি দূতাবাসের কর্মী। পালানোর অবলম্বন ভদ্রলোকটির ছোটখাটো হিলম্যান গাড়িটি। গাড়িটির নাম রাখা হয়েছে ‘সুজি’। কেন এমন নাম, জানা নেই। তাতে চড়ে দু’জনে আবারও নিরুদ্দেশ হলেন অরণ্যানীর নিভৃতাবাসে।
এই তরুণই সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্। কয়েকজন অস্ট্রেলীয় সাংবাদিক বন্ধু পাকিস্তানি দূতাবাসের এই উচ্চপদস্থ লাজুক তরুণটিকে ভালবেসে ডাকতেন ‘উলুমুলু’ বলে। সিডনির একটি জায়গার নামে বিদেশি বন্ধুটির নামকরণ। ওঁরা অনেকে মিলে ক্রিকেট খেলতেন। ফরাসি মেয়েটিকে তেমন আকর্ষণ করত না এই অলস খেলা। তবু বন্ধুদল নাছোড়বান্দা, তাঁরা ক্রিকেটের যাবতীয় নিয়মকানুন শিখিয়েই ছাড়বেন। মেয়েটির মনে হয় এর থেকে জটিল নিয়মাবলি পৃথিবীর আর কোনও খেলায় নেই। সিডনির শহরতলি ভাউক্লুসে বাঙালি তরুণটি যে বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলেন, সেটি পাহাড়ের উপরে। সামনে বিস্তীর্ণ সমুদ্র দেখা যায়। সেখানে বসে তরুণটি শুনতেন শ্যুবার্টের সিম্ফনি। মনে ভেসে আসত চট্টগ্রামের স্মৃতি। যেখানে ১৯২২-এর ১৫ অগস্ট তাঁর জন্ম। মনে পড়ত সেখানকার ঢেউ খেলানো সবুজ পাহাড়। রাঙামাটির আনারস ক্ষেত। কর্ণফুলি নদী। নৌকোবিহার। তিনি যে ‘কেরায়া’ নামে একটি ছোটগল্প লিখেছেন, সেখানে আছে তাঁর পুববাংলার নদীমাখা অভিজ্ঞতার ধারাবিবরণ— ‘বাইরে নির্মেঘ আকাশ উপুড়-করা রোদে উজ্জ্বল মোহিনী সাপের মতো হয়ে ওঠে। …অবশেষে সূর্য যখন রক্তিম রূপ ধারণ করে, পৃথিবীতে ছায়া নাবে, নম্রতা আসে, সে-নির্লজ্জ সাপ তখন আবার নদীতে পরিণত হয়। ...তারপর নৌকাটি সুপরিচিত বাঁক পেরুলে এবার গ্রামটি নজরে পড়ে। দিগন্তে একমুঠো ছায়ার মতো দেখায় সে-গ্রাম।” আজ থেকে ঠিক পঞ্চাশ বছর আগে, বয়স যখন তাঁর পঞ্চাশ, তাঁর জন্মভূমির নতুন নাম হবে ‘বাংলাদেশ’, ঠিক তখনই যদি তাঁর অকালমৃত্যু না হত, তবে তিনি ফিরে আসতেন ওই নদীটির পাড়ে, যেখানে ‘সঙ্কীর্ণ রাঙাপথ ছেড়ে কাজলী নদীর ধারে-ধারে বরফ-কণার মতো সাদা ঘাসফুল পায়ে মাড়িয়ে ওরা দু’জন হাঁটছিল...’
সেই তরুণের স্মৃতিপথে ফিরে আসে কলকাতা, কৃষ্ণনগরের অমলিন কথকতাগুলিও। আব্বার বদলির চাকরি। পড়তে হয়েছে অনেক স্কুলে, কলেজে। ১৯৪১-এর শীতার্ত বর্ষশেষের কোনও এক দিন। কৃষ্ণনগর সরকারি কলেজে সে দিন আবশ্যিক বাংলার ক্লাস নিচ্ছিলেন অধ্যাপক। প্রিয়দর্শন, ঋজু, দীর্ঘকায়, গৌরবর্ণ ছাত্রটির মন নেই সেই একঘেয়ে বক্তব্যে। বহু শিক্ষার্থীর আড়ালে এক কোণে মনের সর্বস্ব দিয়ে তিনি এঁকে চলেছেন একটি রবীন্দ্র-প্রতিকৃতি। মাত্র কয়েক মাস আগে প্রয়াত হয়েছেন কবিগুরু। ধ্যানস্থ অঙ্কনে ঢেলে দিচ্ছেন অশ্রুর আর্তি। ঘটনাটি খেয়াল করেছিলেন সহপাঠী হৃষীকেশ লাহিড়ী। ক্লাস শেষের আলাপচারিতা পৌঁছে গেল খেলার মাঠের সবুজ ঘাসে। মিঠে রোদে পিঠ দিয়ে বসলেন তাঁরা। কিন্তু হৃষীকেশ কি জানেন নবপরিচিত এই সহপাঠী ধর্মে মুসলমান? আচমকা রবি-অনুরাগী ছেলেটি বলে উঠলেন: ‘আমাদের বন্ধুত্ব আরও গাঢ় হবার আগে আমার যথার্থ পরিচয় আপনার জানবার দরকার। আমি মুসলিম লীগের একনিষ্ঠ কর্মী। আশা করি আপনি হয় কংগ্রেসকর্মী, নয় কংগ্রেস সমর্থক। এবার আপনি ঠিক করুন আমাদের আর অগ্রসর হওয়া ঠিক হবে কিনা।’ এই অভাবিত স্পষ্টভাষণ দুই সহপাঠীর বন্ধুত্বের দরজাটিকে সম্পূর্ণ উন্মুক্ত করে দিল যেন। কৃষ্ণনগর ছেড়ে যাওয়ার পরে চিঠিপত্রের উষ্ণতায় থাকে হৃদয়ের যোগ। হৃষীকেশ রক্ষা করতে পেরেছেন এমনই চব্বিশটি চিঠি। তার দু’-একটিতে যে ‘শ্রীণি’-র কথা আছে, তিনি হয়তো ক্ষণিকের বসন্ত-বাতাস বয়ে এনেছিলেন মেধাবী মুসলমান ছাত্রটির হৃদয়ে, কিন্তু তাঁর সুহৃদ ‘ঋষি’ অনেক পরেও সে বিষয়ে প্রকাশ্য মন্তব্যে রাজি হননি। পত্রালাপের সময়-পরিসর ন’ বছর, ১৯৪২ থেকে ১৯৫১। ঋষিকে আট দশক আগের একটি চিঠিতে লিখছেন— ‘বিভিন্ন পত্রিকায় এক সাথে আমাকে ৫/৬ টা গল্প পাঠাতে হচ্ছে। এই যে পাঠাচ্ছি, আর পরীক্ষার আগে কোথাও পাঠাবো না, হাত মুছে ফেলে পড়তে হবে, নইলে পাস করা হবে না ভাই।’ সহপাঠী হলেও হষীকেশ তখনই বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর এই প্রিয় বন্ধু অন্যদের থেকে পূর্ণ স্বতন্ত্র। সে প্রতিভাবান গল্পকার। তখনই বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠিত পত্রপত্রিকায় তাঁর গল্প ছাপা হচ্ছে। ‘মোহাম্মদী’, ‘সওগাত’, ‘চতুরঙ্গ’, ‘পূর্বাশা’, ‘পরিচয়’-এর মতো পত্রিকায় তিনি সমাদৃত। এমনই একটি চিঠিতে হৃষীকেশ জানতে পারছেন— ‘সঞ্জয় ভট্টাচার্যের পূর্বাশা পাবলিশিং হাউস আমার একটা বই করছেন। নাম স্থির হয়েছে নয়নচারা।’
মনে পড়ে কলকাতায় যখন তিনি একটি ইংরেজি দৈনিকের সাব-এডিটর, পেয়েছিলেন কবি জীবনানন্দ দাশের একাধিক চিঠি। ইংরেজিতে লেখা। তাতে কবি পত্রপ্রাপকের নামের বানান বারম্বার ভুল করছেন বলে ক্ষমাপ্রার্থনা করেছেন। একটি চিঠিতে আছে পঞ্চাশ টাকা সম্মানদক্ষিণা চেক প্রাপ্তির ধন্যবাদ জ্ঞাপন। ওই সংবাদপত্রে তিনি চাকরি করেছেন আড়াই বছর।
সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি ছবি আঁকেন, চিত্রসমালোচনা করেন। কলকাতার ঠিকানায় যাত্রা শুরু হল তাঁর প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের— কমরেড পাবলিশার্স। প্রকাশ করলেন হান্টারের ‘দ্য মুসলমান’, আহসান হাবীবের ‘রাত্রিশেষ’, রুচিমান ইংরেজি সাময়িকী ‘কনটেম্পোরারি’ আশা জাগাল সংস্কৃতি মহলে। আর এই প্রিয় নগরে বসে লিখে ফেললেন একটি উপন্যাস ‘লাল শালু’।
প্রথম উপন্যাসেই খ্যাতি পেয়ে গেলেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্। এখন আর তাঁর নামের বানান ভুল করে না কলকাতা। যে ‘শনিবারের চিঠি’ তাঁর ‘অমীমাংসিত’ গল্প ছেপে লেখকের নাম লিখেছিল ‘অলিউল্লাহ্’ কিম্বা ‘বুলবুল’ পত্রিকায় তাঁর আঁকা ছবির নীচে ছাপা হয়েছিল ‘ওলীউল্লাহ’, এখন সে সব ভ্রান্তি মেরামত করে নিয়েছেন মহানগরীর নক্ষত্রেরা। যদিও কলকাতার দেওয়া আঘাতের পূর্বাপর মনে রাখতে চান না তিনি, তবু কী করে ভোলেন সেন্ট পলস্ কলেজের ছাত্র যখন, পিকনিকে মুসলমান বলে তাঁকে আলাদা বসে খেতে হয়েছিল। রেলস্টেশনে জলের কল থাকত দুটো— একটা হিন্দুদের, অন্যটা মুসলমানদের জন্য। বেশ কিছু বছর পর, তিনি তখন পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিক এবং জাকার্তায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার তথ্য পরিচালক পদে কর্মরত। ছুটি কাটাতে সস্ত্রীক কলকাতা হয়ে চট্টগ্রাম যাবেন। ভেবেছিলেন, নবপরিণীতাকে ঘুরিয়ে দেখাবেন কলকাতা। অথচ ১৯৫৮ সালের অগস্টে কলকাতা বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ এই দম্পতিকে বিমান থেকে নামার অনুমতি দিল না। সঙ্গে প্রয়োজনীয় ভিসা ছিল, তবু ওয়ালীউল্লাহ্ তাঁর বিদেশিনী স্ত্রী আন মারিকে ঘুরিয়ে দেখাতে পারলেন না প্রিয় নগরী।
প্যারিস তাঁকে দিয়েছিল সুখী গার্হস্থ্য আর সৃজনমুখর মননের পরিসর। পেরিগরের একটি দুর্গে পনেরো দিন ছিলেন তিনি। ফরাসি ভাষা শিখতে আগ্রহী বিদেশিরা এই দুর্গে এক পক্ষকালের একটি কোর্স করেন। ভাষা শেখানোর পাশাপাশি পরিবেশিত হত ফরাসি খাবার, শেখানো হত ফরাসি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের পাঠ। ওয়ালীউল্লাহ্ দ্রুত শিখে নিয়েছিলেন সব কিছু, আমন্ত্রিত হয়ে বক্তৃতাও দিলেন ফরাসিতে। প্যারিস তাঁকে দিয়ে লিখিয়ে নিল ‘চাঁদের অমাবস্যা’, ‘কাঁদো নদী কাঁদো’-র মতো উপন্যাস, ‘সুড়ঙ্গ’, ‘তরঙ্গভঙ্গ’ নাটক, কিছু ছোটগল্প। ইংরেজি উপন্যাস ‘দি আগলি এশিয়ান’-ও এই পর্বে শেষ করেন।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ মনেপ্রাণে ছিলেন বাঙালি মুসলমান। স্ত্রী আন মারি ‘ওয়ালী, মাই হাজ়বেন্ড, অ্যাজ় আই স হিম’ শিরোনামে লিখছেন— ‘...মেঝেতে হাঁটু মুড়ে বসতে পছন্দ করত ও। পৃথিবীর সর্বত্রই ঘরে লুঙ্গি পরে থাকতে ভালবাসত। বড়দের পা ছুঁয়ে কদমবুসি করত। সুপারি চিবোত। ভাটিয়ালি গান খুব পছন্দ করত। মাঝে মধ্যেই বাংলা গান গেয়ে উঠত।’ ফ্রান্স থেকে তাঁরা সপরিবারে বহু ভ্রমণে গেলেও গ্রানাদার আলহামরা ও করদোবরা মসজিদ ঘুরে দেখার সময়ে মুসলিম স্থাপত্যবৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যায় স্বামীর চোখমুখের ঔজ্জ্বল্যে অভিভূত হয়েছিলেন আন মারি।
১৯৭০-এ পূর্ববঙ্গের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের মতো একই সময়ে ওয়ালীউল্লাহ্র জীবনেও আছড়ে পড়ল বেসামাল ঝড়। ইউনেস্কোর চাকরির চুক্তি বাতিলের ফলে বেকার হয়ে যাওয়া, সংসারে অর্থ জোগানোর জন্য স্ত্রীর পুনরায় চাকরি সন্ধান, পাকিস্তানে যুদ্ধ শুরুর মর্মান্তিক অভিঘাতে— ‘ওয়ালী সারাদিন একা বাসায় বসে থাকে, দুশ্চিন্তা করে আর সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ে। এরপর লণ্ডনে গিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের অন্যান্যদের সঙ্গে যোগ দিয়ে দেশকে সাহায্য করার সমস্ত পরিকল্পনা করে ফেলে। কিন্তু ফিরে আসার অল্প কিছুদিনের মধ্যে হার্ট স্ট্রোকে আধ ঘণ্টার মাথায় ওর মৃত্যু হয়। তারিখটা ছিল একাত্তরের ১০ অক্টোবর। … ম্যুঁদ শহরে, যেখানে আমরা একটা বাড়ি কিনেছিলাম, সেখানেই তাকে সমাহিত করা হয়।’ লিখেছেন আন মারি। বাংলা কথাসাহিত্যের ‘নিঃসঙ্গ রাজপুত্র’ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ শতবর্ষ স্পর্শ করলেন আজ।
ঋণ: বেনজীন খান