কবিতাভুবন: বিনয় মজুমদার।
আমার চোখ দু’টো দেখেছ? কেমন? এক চোখে
আমি তোমার ভেতরটা দেখছি, অন্য চোখে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড। একে ট্যারা বলে।
কখনও দিনের পর দিন নির্বাক। কথা বললে, হাস্যরসের আড়ালে এমন গূঢ় মনস্তত্ত্ব। কবিতা লিখলে তা নিয়ে পাঠকের চেয়ে বেশি শোরগোল কবিমহলে। আবার বছরের পর বছর একটি শব্দও না-লেখার কঠিন জেদ। স্কিৎজোফ্রেনিয়ার রোগী, সদা কম্পমান হাতে হ্যারিকেন জ্বালাতে গিয়ে পরের পর দেশলাই কাঠি নিঃশেষ। অথচ জ্যামিতির উপপাদ্য আঁকার সময় নির্ভুল ৯০ ডিগ্রি কোণ। বাড়ি বয়ে পুরস্কার দিতে এলে দরজা এঁটে স্বেচ্ছাবন্দি তিনি। অথচ নিজেই বেরিয়ে পড়েন জোনাকি, প্রজাপতি, হাঁস, পাখি আর মানুষ দেখতে। জলের মধ্যে মাছের খেলা দেখতে দেখতে শিশুর মতো খিলখিলিয়ে ওঠেন,—‘একটি উজ্জ্বল মাছ একবার উড়ে/ দৃশ্যত সুনীল কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে স্বচ্ছ জলে/ পুনরায় ডুবে গেলো—’ সব মিলিয়ে এই হলেন ‘ফিরে এসো চাকা’র কবি বিনয় মজুমদার।
কর্মজীবন, হাসপাতাল আর পাগলা গারদের সময়টুকু বাদ দিলে গোটা জীবন আর স্বেচ্ছানির্বাসন কেটেছে উত্তর ২৪ পরগনার ঠাকুরনগর স্টেশন ছোঁয়া এই শিমুলপুরে। ‘অঘ্রানের অনুভূতিমালা’র কবির সেই প্রিয় বাড়ি সরকারি অবহেলায় এখন জঙ্গল আর আগাছায় খণ্ডহর। শুধু এক পাশে পাঁচিল হয়েছে। বুনোলতা, পরজীবী গ্রাস করেছে গন্ধরাজ, বাতাবি লেবুর গাছ। জানলা ভাঙা। সমাধির উপরে স্মৃতিসৌধ, মর্মর মূর্তিও নেই, কেবল তাঁর একটি ছবি। তবে কবির নামে গ্রন্থাগার করে কিছুটা স্মৃতি জিইয়ে রেখেছে ‘ঠাকুরনগর কবি বিনয় মজুমদার স্মৃতি রক্ষা কমিটি’। তাদের দাবি, ‘আমরা কত দিন ধরে রাখব? কবির জন্য সরকার এখানে কিছু অন্তত করুক।’
এখন যে-বাড়ির চার পাশ কাঁঠাল, আম আর সবেদা গাছের শুকনো পাতায় ভরা, এক সময় এমন ভাবেই চার পাশ ভরে থাকত তাঁর হাতে লেখা খসড়া, ছিন্ন কবিতায়। অনেক যত্নে ছয় থেকে বারো পঙ্ক্তি লিখেই ততোধিক বিরক্তিতে সশব্দে পাতা ছিঁড়ে বজ্রমুষ্টিতে দলা পাকিয়ে বাইরে ছুড়ে ফেলতেন বিনয়। প্রেমিকা গায়ত্রীর মতোই কবিতার প্রতি কখনও তীব্র ভালবাসা, কখনও তীব্র বিদ্বেষে ফুঁসতেন।
ভোরের আলো ফুটতে বনগাঁ, কলকাতার কিছু তরুণ দলাপাকানো সেই ধূসর পাণ্ডুলিপি বস্তায় ভরে নিত। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় বিলি হয়ে যেত বিনয় মজুমদারের সেই বাক্যছত্র। মানানসই শিরোনাম জুড়ে দিতেন সম্পাদক নিজেই। কখনও শিরোনামহীন। সম্মানদক্ষিণা হিসেবে সেই তরুণের কবিতাও ছাপতে হত সম্পাদকের। গ্রাম-মফফ্সল-কলকাতার লিটল ম্যাগাজিনে ছাপা বিনয়ের সেই সব কবিতা আজও অগ্রন্থিত, বিলীয়মান।
২০০০ সালের ভয়াবহ বন্যা। আগে-পরে টানা কয়েক বছর কবিতা লেখেননি বিনয়। স্নায়ুরোগে পাখির ডানার মতো দু’হাত কেঁপে চলে। টেবিলে গেলাস। মুখ নামিয়ে চুমুক দিয়ে খেতে হয় জল। কিন্তু শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নয়, মনই সায় দিত না কবিতা লেখায়। কবিতা চাইতে এলে দরজায় খিল এঁটে লুকিয়ে থাকতেন ভয়ার্ত পাখির ছানার মতো। ঘরময় ছড়িয়ে থাকত পাখির পালক আর লেখা চেয়ে সম্পাদক, প্রকাশকের কাতর অনুরোধপত্র।
ঠাকুরনগরের এই বাড়িতেই কেটেছে কবির স্বেচ্ছানির্বাসন। ছবি: পার্থসারথি নন্দী
পুরস্কার, আত্মপ্রচারের ঘোর বিরোধী। নামজাদা কবি-সাহিত্যিকেরা জন্মদিন পালন করতে, পুরস্কার দিতে বাড়ির উঠোনে জড়ো হয়েছেন। দরজা বন্ধ করে গালিগালাজ করে চলেছেন বিনয়। তাঁকে নিয়ে তথ্যচিত্র করতে এলে ভারতবিখ্যাত পরিচালককে তাড়া করে শিয়ালদহের ট্রেন ধরিয়ে ছাড়তেন বিনয়। আবার বনগাঁর অখ্যাত তরুণ কিংবা শঙ্কর কর্মকারের কথায় শিশুর সারল্যে ছবি তুলতে রাজি। ফলশ্রুতি, ‘অন্য আলো, অন্য আঁধার’ তথ্যচিত্র। বিনয় সম্পর্কিত প্রামাণ্য দলিল বলতে এতটুকুই।
সেই সময়, ২০০৩ সালের মে মাসে আনন্দবাজারের দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে চশমার আড়ালে কোটরে ঢুকে থাকা আত্মমগ্ন গভীর চোখ প্রসঙ্গে রসিক বিনয় বলেছিলেন, ‘‘একে ট্যারা বলে। এই ট্যারা চোখের সুবিধা। শিবরাম চক্কোত্তি বলেছেন।’’
তার পরে মুখের বলিরেখা বদলে যেত স্মিত, পরে গভীর অট্টহাস্যে। গমগম করত পলেস্তারা খসা বাড়িটা। ঘুলঘুলি থেকে বেরিয়ে এসে মাথা নেড়ে নেড়ে অবাক হয়ে ইতিউতি চেয়ে থাকত দু’টো চড়াই। আঙুল তুলে দেখিয়ে বলতেন, ‘‘দেখো, ওদের একটা গায়ত্রীর মতো না! ও কিন্তু পাঁচ ফুট নয় ছিল।’’
১৯৩৪-এ বর্মায় (আজকের মায়ানমার) জন্ম। বারো বছর বয়সে বাংলাদেশ। তার পর ১৯৪৭ সাল থেকে ঠাকুরনগরের এই বাড়িতেই। শিবপুর বি ই কলেজে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময়ে ছাত্র সংসদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। বিভিন্ন ভাষা শিক্ষা, গণিত নিয়ে দেশ-বিদেশে গবেষণাধর্মী লেখা। একের পর এক চাকরি ছেড়ে শুধু কবিতাকে আঁকড়ে বাঁচা। বিনয়ের কথায়, ‘‘জড়, উদ্ভিদ, কীট পতঙ্গ, মানুষ সবার সৃষ্টিরহস্য এক। সে কথা উপলব্ধির পরেই
শুরু হল কবিতা নিয়ে পথ চলা, আমার নিজস্বতা।’’
প্রথম বই, নক্ষত্রের আলোয়। তার পর একের পর এক। —‘ফিরে এসো, ফিরে এসো, চাকা,/ রথ হ’য়ে, জয় হ’য়ে, চিরন্তন কাব্য হ’য়ে এসো।/ আমরা বিশুদ্ধ দেশে গান হবো, প্রেম হবো, অবয়বহীন/ সুর হ’য়ে লিপ্ত হবো পৃথিবীর সকল আকাশে।’ পয়ার ছন্দে বিনয়ের লেখায় সমস্ত কবিতাই যেন অন্তিম, অমোঘ এক গন্তব্য। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, ‘যে কোনও বিষয়েই কবিতা লিখতে পারে বিনয়।’
এই বাড়িতে থাকার সময় ভোরে গিয়ে বসতেন ঠাকুরনগর স্টেশনে। ঘরে ফিরে দরজার ছোট্ট ফুটো দিয়ে তাকিয়ে থাকতেন, কখন আসবে খাবার। রাতে আকাশ দেখা। —‘শুধু চাঁদ দেখবার জন্য আমি বিছানায়/ উঠে বসি, চাঁদ আছে বলে/ ঘুমোতে বিলম্ব হয়।’
এই বাড়িতে বসেই বিনয়োচিত ভঙ্গিতে বলেছিলেন, ‘‘আমি ভারতের প্রথম চাঁড়াল কবি। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, লেখা ছেড়ে দেওয়ার পরেও, আমি যে কবি নই— এ
কথা বলে কিংবা লিখে প্রকাশ করা অসম্ভব হয়ে গিয়েছে। আমি এখন কয়েক জনকে চাঁড়াল কবি বানানোর চেষ্টা করছি।’’
প্রশ্ন ছিল, কবি কে?
বিনয়ের উত্তর, ‘‘যেখান থেকে আলো বেরোয়, সেই জায়গা উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু জোনাকি! দেখেছ? আলো জ্বলে কিন্তু ঠান্ডা।’’
—‘কবিতা বুঝিনি আমি; অন্ধকারে একটি জোনাকি যৎসামান্য আলো দেয়, নিরুত্তাপ,
কোমল আলোক।’
আর কবিতা?
‘‘বাক্যং রসাত্মক কাব্যং।’’ অতি সরলে বিনয়ের ব্যাখ্যা, ‘‘যা হুবহু মনে রাখা যায়, তা-ই হল কবিতা।’’
কবে কবিতা লিখবেন জানতে চাইলে নির্বাক হয়ে যাওয়ার আগে শেষ জবাব ছিল, ‘‘কবিতা লিখব। তবে আরও ৪-৫ বছর পরে।’’
প্রতিবেদকের কাছ থেকে সে-কথা জেনে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রতিক্রিয়া ছিল, ‘‘এত দিন পরে ফের কবিতা লিখব বলা মুশকিল। আমরা চাই, ও লেখায় ফিরে আসুক।’’ সে-বার কৃত্তিবাস পত্রিকার পক্ষ থেকে দু’জন কবি, শঙ্খ ঘোষ ও বিনয় মজুমদারকে সম্মান জানানো হয়েছে, সে কথাও জানিয়েছিলেন সুনীল।
তবে কথা রেখেছিলেন বিনয়।
বাঙুর সাইকায়াট্রি ইনস্টিটিউটে মাস দুয়েক ভর্তি থাকার সময় কবিতা লিখলে তবেই ঠাকুরনগরের বাড়িতে ফিরতে দেওয়া হবে, বুঝিয়ে লেখানো হয় কবিতা। বিনয় নিজেই বলেছেন, ‘‘কবিতা লেখা আমি মাঝে মাঝে ছেড়ে দিই। তখন এমন কাণ্ড ঘটে, যাতে ফের লিখতে বাধ্য হই। আমাকে হাসপাতালে পুরে কাগজ এবং কলম দিয়ে আমাকে বলা হল, ‘কবিতা লিখলে ছাড়া হবে। নচেৎ নয়’।’’
ফলশ্রুতি, ২০০৩ সালে বেরোয় ‘হাসপাতালে লেখা কবিতাগুচ্ছ’ কাব্যগ্রন্থটি। শেষ কাব্যটিতেও হাসপাতালের নানা প্রসঙ্গের সঙ্গে অমোঘ ভাবে এসে গিয়েছেন গায়ত্রী, ‘আমার ঠিকানা আছে তোমার বাড়িতে, তোমার ঠিকানা আছে আমার বাড়িতে, চিঠি লিখব না। আমরা একত্রে আছি বইয়ের পাতায়।’
বিনয় প্রসঙ্গে ওই কাব্যের প্রকাশক উৎপল ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘‘বিনয় মজুমদার গত পঞ্চাশ বছর যাবৎ আমাদের কাব্যচর্চার সঙ্গী। তিনি নীরবে আমাদের ভাষাকে পুষ্ট করে চলেছেন। কিন্তু কোনও সরকারি পুরস্কার কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেতাব অদ্যাবধি তাঁর জন্য বিবেচিত হয়নি। এ শুধু কবির দুর্ভাগ্য নয়, দুর্ভাগ্য বঙ্গ সংস্কৃতি এবং বাংলা ভাষাভাষী সব মানুষেরই।’’ তবে শেষ কাব্যটিই ২০০৫ সালে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পায়। মৃত্যুর এক বছর আগে। মেলে রবীন্দ্র পুরস্কারও।
বিনয়ের উঠোনে ঘাসে পা ছড়িয়ে বসে সে-সব কথাই বলছিলেন সেদিনের চাঁড়াল কবি, তীর্থঙ্কর মৈত্র, শিবেন মাঝি আর মাসির ছেলে খোকন দাসেরা। একের পর এক জ্যামিতি, উপপাদ্যের সঙ্গে জ্যোতির্বিজ্ঞান। তীর্থঙ্কর বলেন, ‘‘আমরাও বুড়ো হচ্ছি। ইস! কবিকে নিয়ে এই বাড়িতে কত কিছুই না
করা যেত!’’
কিন্তু ‘দুর্ভাগ্য’ যে পিছু ছাড়ে না!
ঘরের ভিতরে এখনও ইটের উপরে পাতা সেই তক্তপোশ। অনাদরে, তোরঙ্গ-আলনা। ‘বোকা গেলাস’ উল্টে আছে খাটে। যেন এখনই ‘‘ওহ্!, এত শব্দ কেন,’’ বলে দু’কানে হাত দিয়ে বাক্রুদ্ধ হয়ে যাবেন বিনয়।
তার পোঁতা নানা গাছে ফল ধরেছে। বাতাবি লেবুর ফুলের গন্ধ ম-ম করছে। হঠাৎই আকাশ কালো করে উথালপাথাল নারকেল গাছ, তালগাছ। বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা। সেই বজ্রবিদ্যুতের মধ্যে দরজা খুলে কখন যেন বেরিয়ে আসেন বিনয়। পরনে চেক লুঙি, সাদা হাফহাতা ফতুয়া। এ গাছ, ও গাছ জড়িয়ে জোরে শ্বাস নেন। মাটির ঘ্রাণ। পাখি উড়ে এসে
বসে গায়ে। কাকভেজা বিনয় গান ধরেন, ‘জানি নাই তো তুমি এলে আমার ঘরে...’
তাঁর প্রিয় কবির গান। ঠিক যেন ঋত্বিক ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’র আবহ। ফ্ল্যাশব্যাকে তখন পাগলাগারদের এক-একটা দিন। নাটক লিখছেন এক উন্মাদ, অভিনয় করছেন তাঁর বন্ধু। ঋত্বিক আর বিনয়।
কিন্তু পরজন্মে যে বিশ্বাস ছিল
না বিনয়ের। উঠানের যে পাশটায় সমাধি, সেই মৃত্তিকার গভীরে প্রবেশ করতে করতে স্মিত বিনয় বলেন, ‘‘অবিশ্বাসও করি না। জ্যামিতির ধাঁধার মত আঁকিবুকি। সরলরেখা, বক্ররেখা, শূন্য, বিন্দু। মেলাতে পারলেই....।’’ ঘোর লেগে যায়।
সমাধির শুভ্র সৌধের ছবি থেকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বিনয়। ‘ভালবাসা দিতে পারি/ তোমরা কি গ্রহণে সক্ষম? ...প্রাচীন চিত্রের মতো চিরস্থায়ী হাসি নিয়ে তুমি চ’লে যাবে; ক্ষত নিয়ে যন্ত্রণায় স্তব্ধ হব আমি।’
সেই বিস্ফারিত চোখ। এক
চোখ আকাশে, অন্য চোখে সোঁদা মাটির গন্ধ। ‘‘—এই হল, হল গিয়ে, ট্যারা চোখের সুবিধা।’’
বজ্রপাতের অট্টহাস্যে ফের গমগম করতে থাকে গোটা বাড়িটা।