তত্ত্বদর্শী: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ডান দিকে, ‘দ্য রিলিজিয়ন অব ম্যান’, অর্থাৎ বই আকারে প্রকাশিত তাঁর হিবার্ট-বক্তৃতামালার সংকলণের প্রচ্ছদ।
জামাইকান শিল্পপতি রবার্ট হিবার্ট (১৭৬৯-১৮৪৯) মৃত্যুর দু’বছর অগে, ১৮৪৭ সালে ব্যবসা এবং পারিবারিক সম্পত্তি থেকে প্রাপ্ত বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করে ‘হিবার্ট ট্রাস্ট’ নামে একটি ট্রাস্ট গঠন করেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল খ্রিস্টধর্মের প্রচার এবং ধর্ম বিষয়ে ব্যক্তিগত মতবাদকে স্বীকৃতি দেওয়া। এ ছাড়াও দর্শন এবং ধর্ম-বিষয়ক গবেষণার জন্য বিশেষ বৃত্তি ও অনুদানও দেওয়া হত ট্রাস্টের মাধ্যমে। একেশ্বরবাদী হিবার্টের ইচ্ছে অনুযায়ী ধর্ম ও ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে উদার, নিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক আলোচনার জন্য প্রচুর অর্থ অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করা হয়েছিল। শর্ত ছিল, ওই অর্থ থেকে যে সুদ পাওয়া যাবে, সেটা দিয়ে প্রতি বছর বিশ্ববরেণ্য বিদগ্ধ ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ জানিয়ে বিশেষ বক্তৃতামালার আয়োজন করতে হবে। ট্রাস্ট-প্রতিষ্ঠাতার নাম অনুসারে উক্ত বক্তৃতামালা ‘হিবার্ট-বক্তৃতা’ বলে খ্যাতি লাভ করে। যদিও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত প্রথম হিবার্ট-বক্তৃতা অনুষ্ঠিত হয়েছিল রবার্ট হিবার্টের মৃত্যুর ঊনত্রিশ বছর পরে, ১৮৭৮ সালে। প্রথম বক্তা ছিলেন সুপ্রসিদ্ধ জার্মান পণ্ডিত ফ্রিডরিখ ম্যাক্সমুলার। তিনি একাধারে ভারত-বিশারদ, দার্শনিক, ধর্মতত্ত্ব ও সমাজতত্ত্ববিদ। সংস্কৃত ভাষায় তাঁর অসীম পাণ্ডিত্য ছিল। হিবার্ট-বক্তৃতায় তিনি ‘ভারতে ধর্মের উৎপত্তি ও বিকাশ’ নিয়ে আলোচনা ও অন্যান্য পাশ্চাত্য দর্শনের সঙ্গে তুলনা করে, ভারতের বেদশাস্ত্রকে মানবদর্শনের শিখর হিসেবে তুলে ধরেছেন। ম্যাক্সমুলারের মূল্যবান বক্তৃতা ‘ধর্ম ও ভারতীয় সংস্কৃতি’ বিষয়ে পাশ্চাত্যের অনুসন্ধিৎসায় প্রভূত ইন্ধন জুগিয়েছিল।
১৮৭৮ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত মোট ৪৮টি হিবার্ট-বক্তৃতামালার আয়োজন করা হয়েছিল অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, ইলিনয় ইউনিভার্সিটি আরবানা, ইউনিভার্সিটি অব ম্যাঞ্চেস্টার, ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন ইত্যাদি শিক্ষাকেন্দ্রে। অসাম্প্রদায়িক এবং ধর্মতাত্ত্বিক আলোচনা বিষয়ে আগ্রহী যে কোনও ব্যক্তিকে প্রেক্ষাগৃহে বক্তৃতা শোনার অনুমতি দেওয়া হত। হিবার্ট-বক্তৃতামালায় অংশগ্রহণকারী কতিপয় উল্লেখযোগ্য বক্তা হলেন ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ এবং ভাষাতত্ত্ববিদ আর্চিবল্ড হেনরি সেস (১৮৮৭), আমেরিকান দার্শনিক উইলিয়াম জেমস (১৯০৮), ব্রিটিশ শিক্ষাবিদ ও দার্শনিক লরেন্স পিয়ারসাল জেকস (১৯২২) প্রমুখ। এই পর্বের সম্ভবত শেষ বক্তৃতাটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০০৫ সালের ৩০ জুন, ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনে। বক্তা ছিলেন ইংল্যান্ডের বিশিষ্ট ধর্মীয় লেখক কারেন আর্মস্ট্রং এবং ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ চিকিৎসক খালিদ হামিদ। তাঁদের বক্তৃতার বিষয় ছিল আধ্যাত্মিকতা এবং বিশ্ব নাগরিকত্ব। হিবার্ট-বক্তৃতা এমন একটি মঞ্চ, যেখানে জ্ঞান এবং বুদ্ধি, ধর্ম এবং আধ্যাত্মিকতা, দর্শন এবং যুক্তি একত্রিত হয়ে জীবনের উদ্দেশ্য, বিশ্বাস, আত্মা, মৃত্যু ইত্যাদি সম্পর্কিত গভীরতম প্রশ্নগুলি আলোচিত হত।
১৮৭৮ সালে ম্যাক্সমুলারের উদ্বোধনী বক্তৃতার পঞ্চাশ বছর পরে, ১৯২৮ সালে হিবার্ট-বক্তৃতার ৩২তম বক্তা হিসেবে রবীন্দ্রনাথের নাম প্রস্তাবিত হয়। এত দিন ইংল্যান্ড, আমেরিকা, ফ্রান্স, জার্মান, বেলজিয়াম, স্কটল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ইত্যাদি বিশ্বের উন্নততম দেশগুলি থেকেই নির্বাচিত বক্তাদের আমন্ত্রণ জানানো হত। সে বারই প্রথম ‘তৃতীয় বিশ্বের’ কোনও দেশের নাম বিবেচিত হয়েছিল। ট্রাস্টির পক্ষ থেকে ডক্টর ড্রামন্ড ১৯২৭ সালের ২৮ জুন রবীন্দ্রনাথকে পত্র মারফত আমন্ত্রণ জানান। চিঠিতে সাম্মানিক বাবদ রবীন্দ্রনাথকে ২৫০ পাউন্ড দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ছিল।
সেই সময় বিশ্বভারতীর নানা অভ্যন্তরীণ গোলযোগ, অর্থাভাব, অর্থ সংগ্রহের জন্য নিরন্তর দুশ্চিন্তা ও ভ্রমণ, শারীরিক অসুস্থতা ইত্যাদি কারণে রবীন্দ্রনাথ মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছিলেন। তাই সুদূরের ডাকে তাঁর মন সাড়া না দিয়ে পারেনি। সানন্দে আমন্ত্রণ গ্রহণ করে হিবার্ট-বক্তৃতা সংক্রান্ত যোগাযোগের সমস্ত দায়িত্ব অ্যান্ড্রুজ়কে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ আসন্ন যাত্রার জন্য উন্মুখ হয়ে রইলেন। টেলিগ্রাম করে হেনরি ড্রামন্ডকে কবির সম্মতির কথা জানিয়ে দেওয়া হল। জানিয়ে দেওয়া হল রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতার প্রাথমিক রূপরেখাটিও। ইংল্যান্ডেও শুরু হয়ে গেল যাবতীয় প্রস্তুতির। ‘দ্য ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ান’, ‘দ্য স্টেটসম্যান’, ‘ফরোয়ার্ড’-সহ এ দেশেরও বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের হিবার্ট বক্তৃতার সংবাদ প্রকাশিত হতে থাকল।১৯২৮ সালের জানুয়ারি মাস থেকেই রবীন্দ্রনাথ নানাজনকে চিঠি লিখে তাঁর আসন্ন বিদেশ সফরের শুভবার্তাটি জানিয়ে দিয়েছিলেন। সুবোধচন্দ্র মজুমদারকে লিখলেন, “শুনেছ বোধহয় আমি চলেছি য়ুরোপে— ইংলণ্ডে বক্তৃতার নিমন্ত্রণ আছে।” বিশ্বনাথ চট্টোপাধ্যায়কে লিখেছেন, “অক্সফোর্ডে একটি বক্তৃতার ফরমাস আছে সেটাও অবহেলা করবার নয়।”
নানা খুঁটিনাটি প্রস্তুতির পর ১২ মে ১৯২৮ রবীন্দ্রনাথ কলকাতা থেকে প্রশান্তচন্দ্র আর রানি মহলানবিশকে সঙ্গে নিয়ে ট্রেনপথে চলেছেন মাদ্রাজের উদ্দেশে। কথা আছে অ্যান্ড্রুজ় আর আরিয়াম সেখানে কবির সঙ্গে মিলিত হবেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের আকস্মিক অসুস্থতা আর চিকিৎসকদের কঠোর নিষেধ বহু-প্রতীক্ষিত হিবার্ট-বক্তৃতা সহ বিদেশ ভ্রমণের যাবতীয় প্রস্তুতির উপর যবনিকা টেনে দিয়েছিল। এই দুঃসংবাদে ইংল্যান্ডে বক্তৃতা-আয়োজকেরাও হতাশ আর বিভ্রান্ত হয়ে পড়লেও পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে তাঁরা ১৯২৯ সালের এপ্রিল মাসে রবীন্দ্রনাথের জন্য অন্য একটি দিন নির্দিষ্ট করে রাখলেন। আশাহত রবীন্দ্রনাথ ৫ জুন রথীন্দ্রনাথকে লিখলেন, “রথী, এবারের মত যাত্রা রহিত করা গেল। হিবার্ট লেকচারওয়ালারা লিখে পাঠিয়েছে আগামী বৎসরে এপ্রিলে বক্তৃতা দিলে ভালো হয়। যদি শরীরটাকে বিশ্রাম দিয়ে ধীরে ধীরে লিখি, তাহলে লেখা শেষ হলে নিশ্চিন্তমনে যেতে পারব।”আসলে মাদ্রাজে অসুস্থ হয়ে পড়ার পরেও নানা সামাজিক ব্যস্ততা রবীন্দ্রনাথকে মুক্তির অবকাশ দিতে পারেনি। মিসেস বেসান্ত এবং পিঠাপুরম-রাজের আতিথ্য গ্রহণ, পন্ডিচেরিতে অরবিন্দ-সাক্ষাৎকার, কলম্বো-যাত্রা, সিংহল-উৎসবে যোগদান, আরও নানা ধকলে কবির শরীর আরও ভেঙে পড়েছিল।
১৯২৯ সালেও রবীন্দ্রনাথের আশা পূরণ হল না। বিদেশ ভ্রমণের বৃহত্তর আমন্ত্রণে তাঁকে বার বার দেশান্তরি হতে হয়েছিল। ফেব্রুয়ারি মাসের ২৬ তারিখে কলকাতা থেকে যাত্রা শুরু করে জাপান, কানাডার ভ্যাঙ্কুভার, আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলেস, সান ফ্রান্সিসকো হয়ে পুনরায় জাপানে দীর্ঘ অবস্থান। সেখান থেকে ইন্দোচিন, সিঙ্গাপুর হয়ে ১২৪ দিন পরে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেছেন। এই ক্লান্তিকর দীর্ঘ ভ্রমণের পরে রবীন্দ্রনাথ আর ১৯২৯ সালের হিবার্ট বক্তৃতার জন্য ইংল্যান্ড যাওয়ার উৎসাহ পাননি। তাঁর পরিবর্তে সে বারের বক্তৃতা দিয়েছিলেন সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন। ইউনিভার্সিটি অব ম্যাঞ্চেস্টার (ডিসেম্বর ১৯২৯) এবং ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনে (জানুয়ারি ১৯৩০) অনুষ্ঠিত তাঁর বক্তৃতাটির শিরোনাম ছিল ‘জীবনের আদর্শবাদী দৃষ্টিভঙ্গি’। ১৯৩২ সালে তাঁর বক্তৃতা লন্ডন থেকে ‘অ্যান আইডিয়ালিস্টিক ভিউ অব লাইফ’ শিরোনামে বই হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল।
১৯৩০ সাল। আবার আহ্বান এসেছে সুদূর ইউরোপ থেকে। অক্সফোর্ড থেকেও এসেছে হিবার্ট-বক্তৃতা দেওয়ার অনুরোধ। পাশ্চাত্য সংস্কৃতি ও মানসিকতার সঙ্গে পরিচিত হতে রবীন্দ্রনাথ সব সময় ব্যাকুল। এ বারের ইউরোপ ভ্রমণ রবীন্দ্রনাথের কাছে তাই বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এ ছাড়াও তাঁর আঁকা ছবির প্রদর্শনী ইউরোপের শিল্পীদের সামনে তুলে ধরাও ছিল কবির অন্যতম অভিপ্রায়। এ বারের ভ্রমণটি তাঁর একাদশতম বিদেশ সফর।
কলকাতা থেকে যাত্রার সূচনা ২ মার্চ। কবির সঙ্গে চলেছেন রথীন্দ্রনাথ, প্রতিমাদেবী, কন্যা নন্দিনী, ডাক্তার সুহৃৎনাথ চৌধুরী, ডাক্তার নলিনীরঞ্জন এবং আরও কয়েক জন। যাত্রাপথে মাদ্রাজ মেলে বসেই তিনি রচনা করেছেন আমাদের অত্যন্ত পরিচিত ‘সুনীল সাগরের শ্যামল কিনারে, দেখেছি পথে যেতে তুলনাহীনারে’ গানটি। দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার পর ২৬ মার্চ জাহাজ ইউরোপের মাটি স্পর্শ করল।
অক্সফোর্ডে বক্তৃতার তারিখ ১৯ মে। তার আগে রবীন্দ্রনাথের অন্য বাসনাটি, অর্থাৎ ইউরোপের শিল্পীদের সামনে নিজের ছবির প্রদর্শনীর পরিকল্পনাটি মিটিয়ে নিয়েছিলেন। কবির গুণমুগ্ধ ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর প্রচেষ্টা এবং আর্থিক সহযোগিতায় প্যারিসে তাঁর ১২৫টি ছবির এক সার্থক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছিল। অক্সফোর্ড থেকে তিনি ইন্দিরা দেবীকে লিখেছেন, “ফ্রান্সের মত কড়া হাকিমের দরবারেও শিরোপা মিলেচে— কিছুমাত্র কার্পণ্য করে নি।” প্যারিস থেকে অ্যান্ড্রুজ় আর অমিয় চক্রবর্তীকে সঙ্গে নিয়ে মে মাসের ১৭ তারিখে রবীন্দ্রনাথ অক্সফোর্ডে এসে পৌঁছলেন, আতিথ্য নিলেন হেনরি ড্রামন্ডের বাড়িতে।
১৯৩০ সালের হিবার্ট-বক্তৃতায় রবীন্দ্রনাথের বিষয় ছিল মানুষের ধর্ম। যার মূল প্রতিপাদ্য ঈশ্বরের মানবতাবোধ সম্পর্কে ধারণা বা চিরন্তন মানবের দৈবসত্তা। রবীন্দ্রনাথের মানবতাবাদের মূলে রয়েছে মানবিকতা, মানবকল্যাণ ও মানবমুক্তি। রবীন্দ্রদর্শনের একটি মৌলিক দিক হচ্ছে মনুষ্যত্ব, জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সব মানুষের প্রতি প্রেম ও ভালবাসা এবং নিজেকে পরার্থে বিলিয়ে দেওয়া। মানুষকে বাদ দিয়ে বিশ্বজগৎ, পারলৌকিক জগৎ, সত্য, ধর্ম কোনও কিছুর অস্তিত্ব নেই। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘মানুষের ধর্ম’ নামক গ্রন্থে বলেছেন, “ধর্ম মানেই মনুষ্যত্ব— যেমন আগুনের ধর্ম অগ্নিত্ব, পশুর ধর্ম পশুত্ব। তেমনি মানুষের ধর্ম মানুষের পরিপূর্ণতা।”
এই পর্বে রবীন্দ্রনাথ মোট তিনটি বক্তৃতা দিয়েছেন। প্রথমটি ১৯ মে অক্সফোর্ডের ম্যানচেস্টার কলেজে। উপস্থিত ছিলেন সেখানকার খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষজন এবং বহু উৎসাহী স্থানীয় ভারতীয়। সে দিন শ্রোতাদের ভিড়ে প্রেক্ষাগৃহে তিল ধারণের স্থান ছিল না। গত বারের হিবার্ট-বক্তা রাধাকৃষ্ণন তখন অক্সফোর্ডে ‘স্পলডিং অধ্যাপক’ হিসেবে কর্মরত। সে দিন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁকেও ট্রাস্টের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দিয়ে সম্মানিত করা হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের দ্বিতীয় বক্তৃতাটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২১ মে এবং তৃতীয়টি ২৬ মে। রবীন্দ্রনাথের কথা শোনার জন্য মানুষের মধ্যে যে উন্মাদনা তৈরি হয়েছিল, যা ভিড় হয়েছিল, তা অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির হিবার্ট-বক্তৃতার সমস্ত রেকর্ড ভেঙে দিয়েছিল। ম্যানচেস্টার গার্ডিয়ান পত্রিকার সগৌরব প্রতিবেদন ছিল, “নো সিরিজ় অব হিবার্ট লেকচার হ্যাজ় আরাউজ়ড মোর পাবলিক ইন্টারেস্ট দ্যান দ্য প্রেজ়েন্ট ওয়ান।” প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, “এতদিন সাহিত্যিক বলিয়া রবীন্দ্রনাথের পরিচয় ছিল। আজ পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যায়তন তাঁহাকে তত্ত্বদর্শীর সম্মান দান করিল।”
রবীন্দ্রনাথের ‘হিবার্ট-লেকচার’গুলি একত্রে সঙ্কলিত করে ১৯৩০ সালে লন্ডনের ‘অ্যালেন অ্যান্ড আনউইন’ থেকে ‘দ্য রিলিজিয়ন অব ম্যান’ শীর্ষক বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়। পনেরোটি পরিচ্ছেদে বিভক্ত বইটি রবীন্দ্রনাথের আধ্যাত্মিকতা, মানবতা এবং সমস্ত জীবের আন্তঃসম্পর্ক বিষয়ে আত্মোপলব্ধির একটি মূল্যবান দলিল। তাঁর মতে ‘মানুষের ধর্ম’ নির্দিষ্ট বিশ্বাসের সীমানা অতিক্রম করে মানুষের অস্তিত্বের গভীর উপলব্ধি এবং জীবনের পারস্পরিক সম্পর্কগুলিকে উন্নীত করে। ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতা সঙ্কীর্ণ মতবাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে আমাদের দৈনন্দিন জীবন এবং বিশ্বের পরিপ্রেক্ষিতে উদারতার সঙ্গে গ্রহণ করা উচিত। বইটির ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “সকল মানুষের অন্তরাত্মার মধ্যে প্রবাহিত হওয়া একমাত্র সত্য The Religion of Man বিষয়টি আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল শুধু মাত্র দার্শনিক ভাবনা হিসাবে নয়, আধ্যাত্মিক চেতনায় ঋদ্ধ হয়ে। সত্যি কথা বলতে কি, আমার অপরিণত বয়স থেকে আজকের দিন পর্যন্ত জুড়ে, লেখার বৃহৎ অংশে রয়েছে এই ভাবনার ক্রমবর্ধমানের ইতিহাস। ঐক্যবদ্ধ প্রেরণায় গভীরভাবে যুক্ত হয়ে যে কাজ আমি শুরু করেছি, যে শব্দ আমি উচ্চারণ করেছি, সে বিষয়ে অবগত হলেও তার সত্যিকারের সংজ্ঞা আজও আমার অজানা।”
১৯৩৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রবীন্দ্রনাথের হিবার্ট-বক্তৃতাগুলি সঙ্কলিত করে প্রকাশিত হয়েছে ‘মানুষের ধর্ম’ শিরোনামের বই। তাঁর কথায়, “স্বার্থ আমাদের যে-সব প্রয়াসের দিকে ঠেলে নিয়ে যায় তার মূল প্রেরণা দেখি জীবপ্রকৃতিতে; যা আমাদের ত্যাগের দিকে তপস্যার দিকে নিয়ে যায় তাকেই বলি মনুষ্যত্ব, মানুষের ধর্ম।”