Sonar Kella

উট চলেছে মুখটি তুলে, বন্দুক সব গর্জে ওঠে

ছাপোষা বাঙালির জ্ঞানগম্যি অনুযায়ী আমার ধারণা ছিল উট থাকে রাজস্থানে, আর অস্ট্রেলিয়ার জীব হল ক্যাঙারু আর কোয়ালা।

Advertisement

গৌতম ভদ্র

শেষ আপডেট: ০৯ জানুয়ারি ২০২২ ০৫:২৮
Share:

বছর দুয়েক আগেও ড্রোন থেকে গুলি চালিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় খতম করা হয় দশ হাজার বুনো উট। তাদের সংখ্যা ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে যে! অথচ, ভারত, পাকিস্তান থেকে যাওয়া এই সব উটের মাধ্যমেই সেখানে একদা চলত খনিজ দ্রব্য ও পশম পরিবহণ। সভ্যতার ইতিহাস শুধুই অবোলা জীবের নিধনকাহিনি!

Advertisement

আমি এক অলস বাঙালি বুড়ো, একটিই স্বর্গসুখ জানি। শীতের রোদ্দুরে চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে চার-পাঁচটা কাগজ ওল্টানো, তারই ফাঁকে একটু ঝিমিয়ে নেওয়া। মাঝে মাঝে চটকা ভাঙে। যেমন, ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে করোনাসুরের আসার নানা শিরোনাম পড়ার ফাঁকে এক চিলতে ছোট খবর দেখে ঝিমুনি কেটে গিয়েছিল। ওই সপ্তাহে অস্ট্রেলিয়ায় পশুকল্যাণের সব শর্ত অক্ষরে অক্ষরে বজায় রেখে প্রশিক্ষিত কর্মীরা পাঁচ দিন ধরে ড্রোন থেকে গুলি করে নিদেনপক্ষে আট থেকে দশ হাজার বুনো উট নিকেশ করেছে। ‘হাসিখুসি’র ছড়াটি মনের মধ্যে গুনগুনিয়ে উঠল, ‘উট চলেছে মুখটি তুলে, দীর্ঘ ঊ-টি আছে ঝুলে’। ওই টানেই খেয়ালে এল ‘উটের গ্রীবার মতো’ উপমাটি। ফেলু-কাহিনির জটায়ু কানের কাছে ফুকরে উঠলেন, ‘উট কি কাঁটা বেছে খায়?’

ছাপোষা বাঙালির জ্ঞানগম্যি অনুযায়ী আমার ধারণা ছিল উট থাকে রাজস্থানে, আর অস্ট্রেলিয়ার জীব হল ক্যাঙারু আর কোয়ালা। তবে বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু বা জানি! তাই জটায়ুর পরামর্শে একটু এ দিক-ও দিক ‘কালটিভেট’ করতে গিয়ে বুঝলাম যে, অস্ট্রেলিয়ার সমৃদ্ধ আধুনিক সভ্যতার প্রদীপের একটা পিলসুজ ছিল ভারত থেকে আমদানি করা উট। ওই সব উটদের দেখাশোনা ও চালানোর জন্য বেশ কিছু কিছু ভারতীয় উটচালকদেরও বহাল করা হত, তাদের ডাকা হত ‘ঘানি’ বা ‘ঘনি’ বলে। মহাদেশে সাদা অভিবাসী সভ্যতার ইতিহাসের তলায় আছে উট আর ঘানিদের অন্য রকমের ইতিবৃত্ত, ইদানীং একটু-আধটু উঁকি-ঝুঁকি মারছে।

Advertisement

উট বেঢপ জন্তু, কিন্তু বেশ কাজের। ঊষর মরুদেশে এককুঁজি উট এক মাস জল না খেয়ে থাকতে পারে, অবলীলায় দিনে চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ মাইল যেতে পারে, একশো সত্তর থেকে দুশো সত্তর কিলোগ্রাম ওজনের মাল বইতে সক্ষম। মাঝে মাঝে যুদ্ধে নামতেও পিছপা হয় না। সোমালি ল্যান্ডের ব্রিটিশ বাহিনী থেকে অস্ট্রেলিয়ার পুলিশ বাহিনীতে বিকানেরের সুশিক্ষিত জঙ্গি উটদের কদর ছিল।

উনিশ শতকের মধ্যভাগ আর বিশ শতকের গোড়ায় অস্ট্রেলিয়ার ঊষর জায়গায় সোনা, রুপো, তামা ও দস্তার একাধিক খনির হদিস পাওয়া যায়। এই খনিগুলোকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল ছড়ানো-ছিটানো শ্বেতাঙ্গ বসতি, আউট-ব্যাক টাউন নামে খ্যাত।

বসতিগুলির আশপাশে পশুচারণ ক্ষেত্রেরও বিস্তার ঘটত। এই ধরনের কর্মকাণ্ডে উটই যে মানুষের সর্বোত্তম পশুসঙ্গী, এই সারসত্য উদ্যোগপতি ও শ্বেতসভ্যতা-হিতৈষী টমাস এলডার (১৮১৮-১৮৯৭)-এর মতো একাধিক ধুরন্ধর লোক সহজেই বুঝতে পেরেছিলেন।

উটবাহিনী: ‘সোনার কেল্লা’য় অপরাধী ধরতে ফেলুদাদের সহায়

একেবারে শুরুটা অবশ্য সুবিধের হয়নি। ১৮৪০-এ ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জ থেকে কয়েকটি উট অস্ট্রেলিয়ায় আমদানি করা হয়। ওই দঙ্গল থেকে বাছাই করা হ্যারি নামে এক উটের পিঠে চেপে জন হ্যারকস লেক টরেনস-এর দিকে সরেস জমি খুঁজতে বেরিয়ে পড়েছিল। পথে ১ সেপ্টেম্বর ১৮৪৬-এ হাঁটু মুড়ে বসা উটটির পিঠে চড়ে জন পাখি মারার চেষ্টা করে। তখনই উটটি নড়ে-চড়ে উঠে পড়ে। বন্দুকের গুলি বেমক্কা বেরোয়, জনের চোয়াল ভেঙে যায়। উনিশ দিন পরে জন মারা যায়। অবশ্যই পয়লা তারিখে জনের আদেশে হ্যারিকে গুলি করা হয়। অস্ট্রেলিয়ায় শ্বেত সভ্যতার প্রগতির ভিত্তিভূমিতে এক উটের রক্ত ছিটানো আছে।

টমাস এলডার বা স্যামুয়েল স্টাকির মতো উদ্যোগী পুরুষরা ছোটখাটো দুর্ঘটনায় দমে যাওয়ার পাত্র নন। বেলটানা বলে একটা বিস্তীর্ণ জায়গায় উট আমদানি ও প্রজননের জন্য এলডার স্মিথ কোম্পানি খোলা হয়। ১৮৬৬-তে কোম্পানির ফরমায়েশে ভারত থেকে ১২৪টা তাগড়াই উট ও ৩১ জন চালক ব্ল্যাকওয়েল জাহাজে চড়ে অ্যাডিলেড বন্দরে আসেন। ক্রেনে দড়ি-দড়া বেঁধে উট নামানো দেখতে বন্দরে লোক জমে গিয়েছিল। হাজি মোল্লা মেহেরবান নামে এক ধর্মনিষ্ঠ মোল্লা ও কবি ছিলেন চালকদের কৌমী নেতা, বাণিজ্যকর্মে ‘দুবাস’ বা দোভাষীর দায়িত্বও তাঁর উপর ন্যস্ত ছিল। ১৮৬৮-তে চুক্তির ত্রৈবার্ষিক মেয়াদ পার হলে পুরনো উটচালকরা দেশে ফিরে যান। নতুন করে ৬০টি উট ও চুক্তিবদ্ধ চালক পুরনোদের শূন্যস্থান পূরণ করে। একটি হিসাব মতো ১৮৬০ থেকে ১৯২০ পর্যন্ত এই আনাগোনা অব্যাহত ছিল। ৬৫-৭০ বছরের সময় পর্বে ২০,০০০ উট ও উটের সঙ্গে নিদেনপক্ষে ২০০ চালক সমুদ্র পেরিয়ে অস্ট্রেলিয়ার আড্ডা গাড়ে। জাহাজের নামও অচেনা নয়, ‘চিনসুরা’ বা ‘কোহিনূর’।

রাজস্থান-সিন্ধু সীমান্ত অঞ্চল, পাখতুনিস্তান, বালুচিস্তান আর আফগানিস্তান থেকে উটদের আমদানি করা হত। চুক্তিমাফিক করাচির খান বাহাদুর মোরাদ খান করাচি, বম্বে ও কলকাতা থেকে উট রফতানি করতেন, কলকাতার কিছু কাবুলিওয়ালাও এই ব্যবসার শরিক ছিল, জোগাড়ের জায়গা বুঝে উটের দামের একটু কমবেশি হত।

উট চলেছে মুখটি তুলে, সাহেব আছে পিঠে বসে। উটে সওয়ার হয়েই পিটার ওয়ারবার্টন, আর্নেস্ট গাইলস বা ডেভিড লিন্ডসের মতো নামজাদা অভিযাত্রী গ্রেট ভিক্টোরিয়ান ডেজ়ার্ট, স্যান্ডি ডেজ়ার্ট ও গিবসন ডেজ়ার্ট এর মতো মরুক্ষেত্র অতিক্রম করেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল দেশের অভ্যন্তরে খনিজ সম্পদ ও উপয়োগী পশুচারণ ক্ষেত্র আবিষ্কার করা, প্রকৃতির ভাঁড়ার লুঠ করার হরেক রকম সুলুকসন্ধান বাতলানো। এই সব অভিযানের কাহিনিতে মহম্মদ সালে, সালিম, দোস্ত মহম্মদ ও দরবেশ বেজার মতো কষ্টসহিষ্ণু উটচালকদের নাম উঁকি মারে, বিপদে-আপদে এঁরাই সাহেবত্রাতা, ধূ ধূ বালিয়াড়িতে জলের উনুই ও যাত্রাপথের ঠিক দিক সম্পর্কে এঁরাই ওয়াকিবহাল ছিলেন।

বছরভর দক্ষিণ উপকূলের বন্দর পোর্ট অগস্টা থেকে চরণিক জনজাতি চিহ্নিত প্রাচীন পথ ধরে উটের কাফিলা চলত। দক্ষিণ, পশ্চিম ও মধ্য অস্ট্রেলিয়ার সদ্য গজিয়ে ওঠা কর্মমুখর নানা জনবসতি, যেমন উদনাদাতা, ওয়াং-গা-মাননা, মারি, মুলকা, ফারিনা, কুলগারদি ও এলিস স্প্রিং-এর মতো এলাকা, দৈনন্দিন জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় রসদ পেতে উটবাহিত পরিবহণের উপর একান্ত নির্ভরশীল ছিল। ফিরতি পথে ওই সব বসতি থেকে পশমের বস্তা ও খনিজ দ্রব্যের বোরা উটের পিঠেই অ্যাডিলেড বা পার্থ শহরের মালখানায় জমা হত। ১৯০৩-এর ভয়ঙ্কর খরায় এই কাফিলায় পাঠানো সরবরাহই টিবুরা বা হোয়াইট ক্লিফ-এর মতো একাধিক ছোট ছোট বসতির বাসিন্দাদের ধনে-প্রাণে বাঁচিয়েছিল। অস্ট্রেলিয়া জুড়ে টেলিগ্রাফ ও রেলওয়ে লাইন বসানোর যাবতীয় সরঞ্জাম উটের পিঠেই পাঠানো হত, পুলিশি নজরদারির সব ঝক্কির কাজেও লাগানো হত একমেবাদ্বিতীয়ম উটের দঙ্গলকে।

অস্ট্রেলিয়ার আদি জনবাসীদের কাছে ইউজিন ক্রামার-এর মতো দুঁদে মিশনারি উটের টানা গাড়িতে অস্থায়ী ঘর ও চার্চ চাপিয়ে জিশুর ছবি বিলোতেন, ম্যাজিক ল্যানটার্নের সাহায্যে খ্রিস্টজীবনকথা প্রচার করতেন। উনিশ শতকের ষাটের দশক থেকে পরের সত্তর বছর পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ার শ্বেতসংস্কৃতিকে উষ্ট্রবাহন বললে অতিশয়োক্তি হয় না।

ক্যারাভান কেন্দ্র মারি, রুপোর শহর ব্রোকেন হিলস ও সোনার শহর কুলগারদির উপান্তে, মাঝে মাঝে টিনে ঘেরা জায়গায় ‘ঘানি’ তকমায় ভূষিত উটচালকদের ডেরা ছিল। ‘ঘানি টাউন’ নামে ডেরাগুলি খ্যাত, এমনকি মরুশহরগুলির যোগাযোগ রক্ষাকারী আধুনিক ট্রেনের নাম দেওয়া হয়েছে ‘ঘানি এক্সপ্রেস। কাগজে একটু লেখালিখি চলত যে, সব চালকদের ‘ঘানি’ বলা ভুল। ‘ঘানি টাউন’-এর সব বাসিন্দা তো আর আফগান নয়, বালুচ সিন্ধ্রি, রাজস্থানি, পঞ্জাবি, হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে অনেকেই ‘ঘানি টাউন’-এর বাসিন্দা। সাহেবকর্তাদের লব্‌জ শোধরায়নি। ‘ঘানি’ নামটি টিকে গেছে, সাহেবি চোখে এই টাউনের সবাই লম্বা-চওড়া, রং গাঢ় তামাটে, মাথায় পাগড়ি, গায়ে ঢিলেঢালা চোগা, পরনে পাতলুন।

১৯২০-র দশকের শেষ থেকেই পাকা রাস্তা, ট্রেন ও মোটরগাড়ির চাপে উটনির্ভর পরিবহণ ব্যবস্থায় ধস নামল। অবস্থার ফেরে ঘানি বসতিগুলো চৌপাট। একটেরেতে পড়ে থাকা কিছু পুরনো কবর, ওজু করার জন্য কিছু ভাঙাচোরা শুকনো চৌবাচ্চা আর ইতিউতি লাগানো কিছু খেজুর গাছ ঘানিদের ডেরার নিদর্শন হিসেবে পড়ে আছে। বেশির ভাগ বাসিন্দাই দেশে ফিরে গিয়েছে, এডিলেড ও পার্থ-এর মসজিদের ধারে কাছে কেউ কেউ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়ে গেছে। ‘ঘানি’দের ছেড়ে যাওয়া পোষ্য উটেরা ছাড়া পেয়ে বুনো উটে রূপান্তরিত হয়েছে, তাদের বংশবৃদ্ধিও ঘটেছে। পশ্চিম ও দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ায় বুনো উটদের সংখ্যা ক্যাঙারুদের সংখ্যার সঙ্গে পাল্লা দেয়।

বটতলায় ছাপা ‘কাছা-ছোল-আম্বিয়া’, ফারসিতে লেখা ‘কিতাব-উল্-আনবিয়া’র বা নবিদের গল্পের বঙ্গীকৃত সংস্করণ। ব্রোকেন হিলস-এর মসজিদের তাকিয়াতে সামিয়া খাতুন বইটা খুঁজে পেয়েছিলেন, মসজিদে মুমিনরা বইটাকে কোরান ভেবে পড়ত। সাগরপারের ‘ঘানি’দের তৈরি করা মসজিদে বটতলার ছাপা বইয়ের হাল-হকিকতই পাল্টে গেছে। নবিকাহিনির সূত্র ধরে সামিয়া তাঁর লেখা ‘অস্ট্রেলিয়ানামা’র এক-একটি অধ্যায়ে এক-এক জন উটচালকের অভিজ্ঞতার বিবৃতি দিয়েছেন। খণ্ড খণ্ড স্মৃতি-ইতিকথা আর আখ্যানগুলি আলগা ভাবে একটার পিঠে আর একটায় লগ্ন হয়েছে, ফারসি পন্দ-নামার লেখনভঙ্গি যেন সামিয়ার আদর্শ, কার্য কারণ-অভিঘাতের শৃঙ্খলাক্রমে তাঁর রচনা বিন্যস্ত নয়।

শ্বেত-মালিকানার কোম্পানির দেশি কর্মচারীরা নিজেরাই জাঁকালো পরিবহণ কোম্পানি খুলত, তালিকার শীর্ষে ছিলেন আব্দুল ওয়াহিদ। এলডার কোম্পানির প্রাক্তন হাবিলদার ও দুঁদে ব্যবসায়ী ফয়েজ মহম্মদের কর্মচারী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করে ওয়াহিদ গোটা ওয়াং-গা- মাননা ক্ষেত্রই কিনে নেন, এক সময় চারশো উট ও ষাট জন কর্মচারী নিয়ে তৈরি তাঁর ক্যারাভান নিউ সাউথ ওয়েলস-এর সব ‘ঘানি’শহর দাপিয়ে বেড়াত। আদ্যন্ত বিলিতি পোশাকে সজ্জিত ‘আফগান প্রিন্স’ নামে খ্যাত ওয়াহিদের স্ত্রী ছিলেন শ্বেতাঙ্গিনী, সন্তানেরাও সাহেবি স্কুলেই পড়েছে। এ সব সত্ত্বেও অস্ট্রেলিয়ার শ্বেতাঙ্গ সমাজে ওয়াজিদ বড় একটা কল্কে পাননি, শেষে দেশে ফিরে যান।

মহম্মদ আলম উটের ব্যবসায়ী থেকে হয়ে ওঠেন হকিমি চিকিৎসার ওস্তাদ, গভর্নরের পরিবারও তাঁর দেওয়া ওষুধের ভক্ত ছিল। উট সরবরাহকারী মোরাদ খানের ভাইপো মুসা খানের বইয়ের দোকান পার্থ শহরে ছিল, আহমদিয়া সম্প্রদায়ের পুস্তিকা তার ছাপাখানায় মুদ্রিত হয়ে ইউরোপে রফতানি হত। ওই সব বর্ণময় জীবনের পাশাপাশি হতদরিদ্র ইমাম গোলাম রসুল ও ফেরিওয়ালা মোংগা খানের আর্তিপত্রে জীবন-বিড়ম্বনার কথাও পড়ি। বালুচ গোলাম বাদুল্লা ভালবেসে জনজাতির ইয়ামাজি বা মারিয়ানকে নিকা করেছিলেন, তাঁদের সন্তানদের নাগরিক অধিবাসীর স্বীকৃতি দিতে স্থানীয় প্রশাসন গররাজি হয়।

ভারতীয় উটচালকদের সুখ-দুঃখের কাহিনি ছাড়া অস্ট্রেলিয়ার অভিবাসনের ইতিহাস একমেটে, এই কথা সামিয়া খাতুন, ক্রিস্টিন স্টিফেন্স বা কেনির মতো গবেষকরা ইদানীং বলতে শুরু করেছেন। কিন্তু উটদের কথা বলবে কে ?

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও সৌদি আরবের ক্রমবর্ধমান বাজারে জ্যান্ত উট, টিনভরা উটের দুধ ও মাংস রফতানি করে অস্ট্রেলিয়ার উদ্যোগপতিরা বেশ কিছু কামাই করে। পরিত্যক্ত ‘ঘানি’শহরে উটের সাফারি ও দৌড় এখনকার পর্যটনশিল্পের আকর্ষণ। অস্ট্রেলিয়ার অর্থকরী বুনো প্রাণিজ সম্পদ উট। কেবল খরার বছরগুলিতে তৃষার্ত উটেরা জলের খোঁজে দক্ষিণ ও পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার শহরে ঢুকে পড়ে জলাশয়ে জল খায়, শহর-ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়। অতএব মাঝে মাঝে চোখ বুজে ঝাড়ে-বংশে কয়েক হাজার উট নিকেশ করা ছাড়া সভ্য মানুষের বাঁচার উপায় কী? ২০০৮, ২০০৯, ২০১২ ও ২০১৯-এ সভ্য বিবেকসম্মত নিয়ম মেনেই উট নিধন চলছিল। উট চলেছে মুখটি তুলে, বন্দুক সব গর্জে ওঠে।

দল, জাত ও গোষ্ঠী কচুকাটা করার অনেক বধ্যভূমি সভ্যতার মাইলফলক হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে, জার্মানির নামিবিয়া ও পোল্যান্ড, ইটালির লিবিয়া ও ইথিয়োপিয়া, আমেরিকার গুয়াতেমালা ও সুহার্তোর ইন্দোনেশিয়া, আফ্রিকায় রুয়ান্ডা-বুরুন্ডি, এশিয়ায় কম্পুচিয়া ও মায়ানমারের রোহিঙ্গা কিলিং ফিল্ডের মাত্র এই কয়েকটি নাম মোটেই সব নয়। এরই সঙ্গে উন্নয়নের নামে চলেছে মানুষের হাতে নির্বিচার ধ্বংসলীলা, যেমন আমেরিকান তৃণভূমিতে বাইসন হত্যা, মেরু প্রদেশে ভোঁদড় নাশ, কমিউনিস্ট চিনে চড়ুইপাখি বধ— আবার ইতিহাসের কয়েকটি ঘটনামাত্র— সব নয়। প্রগতিকামী প্রভুমন্য মানুষই ঠিক করে চলেছে কোন প্রজাতির কারা বাঁচবে, কারা মরবে— ফলে আজ পার্থিব সভ্যতা আর অমানুষী গ্রহজগৎ মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। জনজাতি হত্যা থেকে চড়ুইপাখি ও উট নিকেশের দায় কী ভাবে মিটবে, সেই প্রশ্নের সঙ্গত জবাব নিরঙ্কুশ প্রগতিবাদী আর প্রযুক্তিসেবী গ্রহনিবাসী মানুষের জানা নেই। আজকের মানুষের অভিজ্ঞতার অভিধানে সভ্যতার অর্থ তো সহজ প্রাণের স্বচ্ছন্দ প্রকাশ নয়, বরং প্রজাতি নির্বিশেষে প্রাণ নিকেশের অবাধ ছাড়পত্র মাত্র।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement