এখোলার বোতাম টিপলাম। লিফ্ট চুপ। ফের টিপলাম। ফের চুপ। এ বার হার্টবিট চড়ছে। ঘাড়ের কাছটায় কী যেন একটা যাতায়াত করছে। আটকে গেলাম না কি? দরজায় ধাক্কা দিলাম। ওপরে তাকিয়ে দেখলাম একটা ফ্যান বেশ জোরে ঘুরছে। অনন্ত ওপর দেখা যাচ্ছে। ফের ধাক্কা। ছোট্ট কাচের জানলা দিয়ে দেখলাম কারও কোনও হেলদোল নেই। বাইরে নেহাত সাধারণ জীবন কাঁটায় কাঁটায় বয়ে চলেছে। আমার পেটের ভেতরটা কেমন গুলোচ্ছে। মাথা ঝিমঝিম।কটা সরকারি হাসপাতালে গেছি, একটা কাজে। চার তলায় উঠতে হবে। লিফ্ট এসে দাঁড়াল। সবাই নেমে গেল। ওপরে ওঠার যাত্রী আমি একাই। ঘড়ঘড় শব্দে দুটো দরজা বেশ মানানসই ভাবে একে অন্যের সঙ্গে থিতু হল। তিন নম্বর বোতাম টিপতেই লিফ্ট ধড়ফড় করে নড়ে উঠল। প্রথমে ভাবলাম, পুরনো যন্ত্র তো, একটু নড়েচড়ে বেশি। তার পর দেখি, একদম চুপ করে গেল। ওঠার প্রশ্নই নেই। ভাবলাম, কিছু একটা গন্ডগোল আছে। নেমে যাওয়াই ভাল।
হঠাৎ ব্রেনে চিড়িক! বন্ধ লিফ্টে অক্সিজেন কমে যাচ্ছে না তো? তার মানে একটু পরে নিশ্বাস নিতে পারব না! একটু পরে কেন? এখনই কি পারছি? নিজেকে বললাম, শান্ত হও, শান্ত হও। ডিপ ব্রিদিং। আর নিকুচি করেছে ডিপ ব্রিদিং। একটু পরে আর ব্রিদই করতে পারব না! এমন সময় ঝড়াং শব্দে লিফ্টটা ওপরে উঠতে শুরু করল। একটু ঘাবড়ে গেলেও সামলে নিলাম। যাক। হাতেনাতে ঈশ্বরের প্রমাণ পেলাম বাবা। অবশ্য ঠিক মনে করতে পারলাম না ঠাকুরকে ডেকেছিলাম কি না। লিফ্ট বাধ্য ছেলের মতো চার তলায় উঠল। আমি রেডিসেডি মুক্তির অপেক্ষায়।
কিন্তু না। ফের ঝড়াং শব্দ, কাঁপন, কিছু নড়নচড়ন এবং ফের চুপ। মরিয়া হয়ে লিফ্েটর দরজা প্রাণপণ খোলার চেষ্টা করলাম। কিছুই হল না। এ বার ভীষণ কান্না পেল। এক বার শেষ চেষ্টার জন্য খুব ‘হেল্প হেল্প’ বলে চেঁচালাম, জোরে জোরে ধাক্কা মারলাম। কিন্তু ছোট্ট জানলা দিয়ে দেখলাম চার তলায় কেউ নেই।
ব্রেন দেখছি মরে যাওয়ার আগে পর্যন্ত আলোর স্পিডে ভাবতে পারে। আমি ভাবছি, আমি মরে গেলে কে কে কাঁদবে আর কে কে ফুর্তিতে তিড়িংবিড়িং লাফাবে, একই সঙ্গে হাতড়াচ্ছি কোথাও কোনও ইমার্জেন্সি বোতাম আছে কি না, কোনও ফোন নম্বর লেখা আছে কি না, েযখানে বঁাচাও বঁাচাও বলে একটা ফোন করা যাবে।
ফের? লিফ্টটা শব্দ করে নীচে নামতে লাগল। এ বার বুঝলাম, নিস্তার নেই। এই ভাবে ওঠানামা করে যাবে বছর চারেক, কখনও দরজা খুলবে না। আমার ঘাম, চোখের জল এবং বড় বাইরে— এক সঙ্গে। লিফ্ট এক তলায় দাঁড়াল। অনেক গলার আওয়াজ শুনতে পেলাম। দেখলাম, দরজার বাইরে একটা ফাঁক দিয়ে অনেকে আঙুল চালিয়ে দরজা খোলার চেষ্টা করছে। বেশ কয়েক বার তারা লিফ্ট ডাকার বোতামটাও টিপল। আঙুলগুলো দেখছি, আর কথা শুনতে পাচ্ছি, ‘এই এক লিফ্ট হয়েছে, কখন সুইচ ধরবে, কখন ধরবে না, কিচ্ছু ঠিক নেই।’ ‘আচ্ছা, কেউ কি আছে ভেতরে? কেউ আছেন?’ আমি তখন পাথর।
কত ক্ষণ মনে করতে পারছি না, কিন্তু একটা সময় খুব আওয়াজ করে লিফ্টের দরজা খুলল। আমি কোনও মতে আমার তলানিটুকু সংগ্রহ করে বেরিয়ে এলাম। বেশ কিছু ক্ষণ পর, জল খেয়ে ঘাম মুছে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগলাম। সেই লিফ্টাকেই ঘুরে ঘুরে।