দরকার হলে ডাকব’খন, ‘নিজের কাজ করগে যা...’ দরজার কপাট বন্ধ করার আগে মহিলা বললেন, ‘খিল তুলে দিচ্ছি।’ আমি ঘাড় নাড়লাম। একটু আগে পুলিশি যোগাযোগে এক জন দালাল আমায় এ ঘরে পৌঁছে দিয়ে গেছে। এ অঞ্চল ‘রেড লাইট এরিয়া’ বলে আদ্যিকাল থেকে চিহ্নিত।
আমি একটা চেয়ারে। মহিলা আমার সামনে এসে খাটে বসলেন। বললাম, ‘আপনার নাম কী?’
‘কৃষ্ণা নামটা আপনার পছন্দ হচ্ছে না দাদা?’
আমি মুখ তুলে তাকাই। পঞ্চাশের দিকে ঢলে পড়া মহিলা এখনও পেশায় আছেন। বললেন, ‘পুলিশের লোকদের আমি দাদা বলি।’
‘আমি পুলিশ নই। ইনফর্মারের লাইনে কবে থেকে?’
‘খোচড় বলুন... সেটা তো জেনেই এসেছেন।’
‘কী লক্ষ রাখেন? কাদের লক্ষ রাখেন?’
‘কাদের, সেটা আলাদা করে বলা যাবে না। হঠাৎ কেউ ফুলে-ফেঁপে উঠলে, তখন কোন মানুষগুলো তার ঘরে যাতায়াত করছে, সেই খবরগুলো রাখতে হয়।’
‘তার পর খবর পাঠিয়ে দেন?’
‘পাঠিয়ে দিই না, মোবাইলেও কিছু বলি না। দু-এক দিন অন্তর লোক আসে আমার কাছে। তবে তেমন বুঝলে খবর পাঠাই।’
‘অন্য ঘরের মেয়েরা খবর পায় না?’
‘বয়ে গেল! আড়ালে গালাগালি করে। সামনে ‘হ্যাঁগা দিদি, ত্যাঁগা দিদি’ বলে ভেজানোর চেষ্টা করে।’
‘পয়সার জন্যে করেন শুধু?’
উত্তরে তিনি জানান, যে পয়সা পাওয়া যায়, তার চেয়ে তাঁর এই বয়সেও ঘরে ‘লোক বসানো’র ‘রেট’ বেশি। ভালবেসে করেন। হয়তো ঝুটো, তবু সম্মান পান।
‘সোনার দোকানের চুরিটা ধরে দিতে পেরে আনন্দ হয়েছিল?’
‘হয়েছিল।’ কৃষ্ণার মুখ ঝকঝক করে ওঠে।
বিরাট চুরির কিনারার মূলে যে তিনি, এ কথা সাধারণ লোকেরা জানতে পারেনি। কাগজে বেরিয়েছে, ‘সোর্স’ মারফত খবর পেয়ে পুলিশ তাদের পাকড়াও করেছে।
এই ‘সোর্স’দেরই সাদা বাংলায় ‘খোচড়’ বলা হয়। আর লোকটি ওপরমহলের হলে, বলা হয় ‘ইনফর্মার’। অনেক সময় খোচড় লাগানো হয় রাজনৈতিক নেতাদের পিছনে। একটা গল্প বলি। গত শতাব্দীর ষাটের দশকের ঘটনা। সে সময় কমিউনিস্ট নেতাদের পেছনে খোচড় লেগেই থাকত। ‘কাকাবাবু’ নামে বিখ্যাত মুজফ্ফর আহমেদ-এর গতিবিধি নজরে রাখার জন্য পুলিশের দুজন মাইনে করা খোচড় ছিল।
সারা দিন তারা কাকাবাবুকে ফলো করে। কাকাবাবু তাদের চিনে ফেলেছিলেন। ওঁর নিয়ম ছিল, সকালে একটা বড় চায়ের দোকানে চা, টোস্ট, ওমলেট খেতে যেতেন। এক দিন সেখানে ঢুকেছেন, দেখলেন তাঁর পেছন-পেছন সোর্স দুজনও ঢুকল। কাকাবাবু অর্ডার দিলেন: তিনটে চা, আর তিন প্লেট টোস্ট ওমলেট। ‘বয়’ অবাক হয়ে জানতে চাইল, বাকি দুজন কারা। কাকাবাবু খোচড় দুজনকে দেখিয়ে দিলেন। তারা খাবার পেয়ে তো হতভম্ব! একটু দূরে বসা কাকাবাবু তাদের ইঙ্গিতে খেতে বললেন। তারা চোখ বড় বড় করে খেয়ে নিল।
তার পর, কাকাবাবু তাদের কাছে ডাকলেন। বললেন, ‘দেখছ তো, কেমন গরম পড়েছে। আমি এখন বাড়ি চলে যাব। দুপুরের রোদ্দুরটা একটু পড়লে পার্টি অফিস যাব। এই গরমে রাস্তায় ঘুরে তোমরা কী করবে? এখন বাড়ি যাও, তিনটে নাগাদ এখানটাতেই এসো। আমি এসে গেলে আমার পেছন-পেছন যেও।’
‘পুলিশের চোখ’, ‘এজেন্ট’ বা ‘কনট্যাক্ট’— যে নামেই ডাকা হোক না কেন, পুলিশের গোপন ফাইলে এদের পরিচিতি স্রেফ চিহ্ন হিসেবে, যেমন: ‘XA4’ বা ‘NC3’। এগুলো হল পুলিশি কোড। ডায়েরি বা এফআইআর লেখার সময়, আসামির খবর কোথা থেকে পাওয়া গেল, এই প্রশ্নের উত্তরে কখনও কখনও এই ‘কোড’ ব্যবহার করা হয়। তবে এরা ‘রেগুলার সোর্স’। আর এক দল হল ‘ক্যাজুয়াল সোর্স’। যার মধ্যে সমাজের সব শ্রেণির লোক থাকতে পারে। যেমন ছিলেন এক রাজনৈতিক নেতা।
বছর কয়েক আগের কথা। তখনকার শাসক পার্টির লোকজন মধ্য কলকাতার এক থানা ঘেরাও করেছে, তাদের দাবি: বিরোধী পার্টির ক্রিমিনাল ‘সঞ্জা’কে (নাম পালটে দেওয়া হল) এক্ষুনি গ্রেফতার করতে হবে। পুলিশ এ দিকে সঞ্জার পাত্তা পাচ্ছে না। হঠাৎ তাদের মনে পড়ল ওই রাজনৈতিক নেতার কথা। সঞ্জা তাঁর শেল্টারে থাকতেই পারে। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে টেলিফোন করে বলা হল, সঞ্জা বাইরে থাকলে যে কোনও মুহূর্তে খুন হয়ে যেতে পারে। তাই তাঁর উচিত হবে সঞ্জার খোঁজ পুলিশে জানানো, যাতে পুলিশ তাকে লক-আপে পুরে নিরাপদ রাখতে পারে।
নেতা তখনই ব্যবস্থা করে, নিজের লোক দিয়ে, সঞ্জাকে থানার পিছনের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকিয়ে দিলেন।
এ দিকে বাইরে তুমুল বিক্ষোভ। তার ওপর শাসক দল। লালবাজার থেকে তদানীন্তন ডিসি যশপাল সিংহ ছুটে এসেছেন। বাইরের নেতারা তাঁর সঙ্গে কথা বলতে ভেতরে এলেন। থানার ওসি বললেন, ‘ওরা সঞ্জাকে ধরতে বলছে? যাব্বাবা! সে তো থানার লক-আপেই আছে।’ হাতেনাতে প্রমাণ দিতে সঞ্জাকে বাইরে আনা হল। বিক্ষোভবাবুদের থোঁতা মুখ ভোঁতা।
এই রাজনৈতিক নেতার মতো উঁচু স্তরের ইনফর্মাররা কখনওই পয়সাকড়ি নেন না। ‘রেগুলার’রা কিন্তু পয়সা পান। পরিমাণে যেটা খুবই কম। ডিসি ডিডি-র ‘সিক্রেট ফান্ড’ থেকে দেওয়া হয়। থানাতেও কিছু বন্দোবস্ত থাকে, তবে সেখানে কর্তৃপক্ষ সাধারণত ‘হিঁয়া কা মাটি হুঁয়া’ করেন। রেগুলার-দের রিক্রুট করেন ঝানু অফিসাররাই। যারা বহাল হয়, তাদের বেশির ভাগই পুরনো পাপী। প্রথম দিকে চাপে কিংবা ঠেকায় পড়ে অন্য অপরাধীদের ঠেকের সন্ধান দেয়, পরে অভ্যস্ত হয়ে যায়। কিন্তু প্রথমে যাঁর গল্প বলেছি, সেই কৃষ্ণার নিয়োগ হওয়ার কাহিনিটা একটু অন্য রকম।
কলকাতার এক রেড লাইট এলাকার কাছের থানায় এক দিন হঠাৎ খবর এল, সেখানকার একটি মেয়ে দু’হাতে দা আর বঁটি নিয়ে বাইরে বেরিয়ে তাণ্ডব করছে, কার ওপর নাকি বদলা নেবে। অফিসার তাড়াতাড়ি গাড়ি নিয়ে সেখানে পৌঁছলেন। কেউ মেয়েটির ধারেকাছেও যাচ্ছে না। অফিসার মেয়েটিকে বললেন, ‘বোন শুনুন, কার ওপর রাগ বলুন, আমরা তাকে ধরে নিয়ে যাব।’ মহিলা, মানে কৃষ্ণা, থেমে গেলেন। কৃষ্ণা তখন বাইরে থেকে এ পাড়ায় কাজ করতে আসতেন। ‘আয়ার কাজ করছি’ বলে বাড়ি থেকে বেরোতেন। সাধারণত যা হয় আর কী, এখানকার একটি মেয়ে কৃষ্ণার বাড়িতে সত্যিটা জানিয়ে দিয়েছিল। ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে সংসারে তুমুল অশান্তি ও অপমান। তার পর, রাগে দুঃখে, কৃষ্ণা দা ও বঁটি নিয়ে সেই মেয়েটিকে খুন করতে এসেছেন।
অফিসারের মধ্যস্থতায় ব্যাপারটা মিটে যায়। হয়তো তাঁর সহৃদয়তার ফলেই, পুলিশের সঙ্গে কৃষ্ণার যোগাযোগটা থেকে যায়। এক সময় কলকাতার এক সোনাবাজার এলাকার একটি দোকানে ডাকাতি হয়, ডাকাতকে ধরে দেন কৃষ্ণাই। সেই ডাকাত ওই পাড়ার একটি মেয়ের ‘বাবু’ ছিল। ওই মেয়েটির গলায় দু-একদিনের মধ্যে দুটো ঝলক-দেওয়া নতুন হার দেখে, ‘চোখ-কান খোলা রাখা’ কৃষ্ণা সে কথা যথাস্থানে জানিয়েছিলেন, তাতেই বিরাট ডাকাতির কিনারা।
এমনিতে পুলিশ কোনও কুখ্যাত ক্রিমিনালকে কোনও দুষ্কর্মের জন্য সন্দেহ করলে, তার বিরোধী পক্ষের সমাজবিরোধীদের ‘ট্যাপ’ করে। তা ছাড়া, কিছু লোক কারণে-অকারণে থানায় আসে, পুলিশের সঙ্গে গা ঘষতে ভালবাসে। তাদেরও ‘সোর্স’ করে নেওয়া হয়। আবার, হিংসের চোটেও অনেকে সোর্স বনে যায়। এক ব্যবসায়ীর দেওয়া খবরে আর এক জন ব্যবসায়ীর বেআইনি কচ্ছপ বিক্রি থেমে যায়, এক পুলিশ অফিসার ৫৭টা কচ্ছপ-সহ মাঝরাত্তিরে পাতিপুকুর মাছগুদামে তাকে ধরেন।
অনেক সময় এই ক্যাজুয়াল সোর্স বিনা পয়সায় শুধু পুলিশের পিঠ-চাপড়ানির প্রত্যাশায় রেগুলার সোর্স হয়ে যায়, যদিও তার ‘বস’ অবসর নিলে তখন আর থানায় যোগাযোগ থাকে না। আসলে, এই এক অদ্ভুত ব্যাপার— এক পুলিশ অফিসারের সোর্স যে অন্য অফিসার ব্যবহার করবেন, বা আগের অফিসার যাওয়ার সময় সোর্সকে পরবর্তী কর্তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে যাবেন, এমনটা সচরাচর ঘটে না।
অনেকের আবার এই খোচড়গিরিতে নেশা ধরে যায়। তখন সে নিজেই দু-চার জনকে পয়সা দিয়ে খবর সংগ্রহের কাজে লাগানো শুরু করে। এরা হল খোচড়ের খোচড়। এ রকম এক জনের সঙ্গে আলাপ হল। মধ্য তিরিশের সাহিল (পালটে দেওয়া নাম) জানাল, কারও কথা বিশেষ করে বলে দেওয়া হলে তার ওপর নজর রাখে। তবে, অন্যদের জন্যেও চোখ-কান খোলা রাখতে হয়। মধ্য আর দক্ষিণ কলকাতার সংযোগ এলাকায় রেললাইন পেরিয়ে যে অঞ্চলে তার বাস, সেখানে নাকি শুধু খবর আর খবর। তাই ‘চারি দিকে চোখ না ঘোরালে যদি কিছু ‘মিস’ হয়ে যায়! কখন কোনটা কাজে লাগে কে জানে? ভাইয়াও সে রকম বলেছেন।’
‘ভাইয়া?’
‘ছাড়ুন ও সব। আর কী জিজ্ঞেস করবেন?’
‘খবরগুলো নোট করে, মানে, লিখে রাখেন তো? এতগুলো, এত রকমের খবর! পরে ভুল হয়ে যায় যদি!’
‘কোথায় লিখব? পড়াশুনো করেছি না কি? এখানটায় লিখে রাখি।’ সাহিল নিজের বুকের ওপর আলতো টোকা মারে।
‘পুলিশের সঙ্গে দেখা করার সময় কেউ দেখে ফেললে বিপদ হবে না?’
‘পুলিশের সঙ্গে তো দেখা হয় না। আমরা হলাম ‘খাবরির খাবরি’। খবর নেওয়ার লোক আছে আমাদের কাছ থেকে, তারা চালান করে।’
পুলিশের তরফ থেকে অবশ্য এদের সকলকেই ‘প্রোটেকশন’ দেওয়া হয়। তবে ইনফর্মার খুন হয়ে গেলে তার পরিবার কোনও ক্ষতিপূরণ পায় না। সে যে ‘সোর্স’ ছিল, সে কথা স্বীকার করবে কে?
পুলিশের ‘সোর্স’ জোগাড় করার আর একটা রাস্তা হল ‘সরষের মধ্যে ভূত খোঁজা’। এখন বেড়ে যাওয়া ‘ব্যাংকিং ফ্রড’ ধরার জন্যে পুলিশ যেমন প্রথমেই ব্যাংক-কর্মচারীদের ‘ট্যাপ’ করে। এও শোনা যায়, সারদা কেলেংকারির অনেক খবরই নাকি পাওয়া গিয়েছে সারদার কর্মচারীদেরই কাছে।
শেষে আর এক কমিউনিস্ট নেতার গল্প। হরেকৃষ্ণ কোঙার-এর পিছনেও দুই সোর্সকে লাগানো হয়েছিল। তিনি তাদের সঙ্গে ইচ্ছে করে লুকোচুরি খেলতেন। এ দিক-ও দিক উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরে তাঁদের ঘোরাতেন, তার পর হঠাৎই লাফিয়ে চলন্ত ট্রামের সেকেন্ড ক্লাসে উঠে পড়ে ভেতরে ঢুকে যেতেন।
এক দিন, তিনি ট্রামে উঠলেন ঠিকই, কিন্তু দরজা ছেড়ে ভেতরে গেলেন না। তাঁর পর পরই সোর্স দুজন উঠতে গেলে, এক জনকে দিলেন ল্যাং, অন্য জনকে কনুইয়ের গুঁতো। ব্যস, তারা ট্রাম থেকে মাটিতে ছিটকে পড়ল। তাদের ডেটল-এর খরচ পুলিশ জুগিয়েছিল কি না, সে কথা বলতে পারব না।
mallikabikash@yahoo.co.in