এবার নাহয় বৃষ্টি একটু আগে থেকে রোদে মেঘে লুকোচুরি শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু প্রতি বার তো আর তা হয় না। মাটি ঝলসে ওঠে রোদের তাপে। পুড়ে যায় ফসল। রোদ্দুরে শুকোয় পুকুর খাল বিল। নিস্তব্ধ নিঝুম সূর্যপোড়া দুপুর প্রখর গ্রীষ্মের চিত্র আঁকে। অপেক্ষা থাকে, এক ফোঁটা বৃষ্টির জলের। তখনই শুরু হয় বৃষ্টিকে আহ্বান করার নানা লৌকিক প্রথা।
গ্রামটার নাম মুর্শিদাবাদের গরিবপুর। গ্রামের প্রবীণরা সবাই মিলে ঠিক করলেন বৃষ্টি আনতে এ বার ব্যাঙের বিয়ে দিতে হবে। লতিকা, বিলকুচ, ভেলাম, প্যাটরা— গ্রামের বাচ্চারা লাফিয়ে উঠল এ কথা শুনে। নির্দিষ্ট দিন দেখে শুরু হল তোড়জোড়। কেউ আনল কুলো, কেউ আনল ধামা, কেউ আনল গোটা কাঁচা হলুদ, তেল, সিঁদুর। আবার কোন বাড়ি থেকে এল নামাবলি। এ বার আসল কাজ, জোগাড় করতে হবে ‘ব্যাঙ বর’ আর ‘ব্যাঙ কনে’! সন্ধে রাতে সেই কাজে নেমে পড়ত গ্রামের ছেলে মেয়েরা। অনেক ব্যাঙ ধরা হত। গ্রামের এক জন প্রবীণ ঠিক করে দিতেন কোন ব্যাঙজোড়া নেওয়া হবে। নির্বাচিত পুরুষ ও স্ত্রী কোলাব্যাঙ নিয়ে শুরু হত বিয়ের অনুষ্ঠান।
প্রথমে ব্যাঙ দুটোকে স্নান করানো হয়। তার পর মেয়ে ব্যাঙটাকে তেল হলুদ মাখিয়ে কপালে সিঁদুরের টিপ দিয়ে নামাবলি মুড়ে ধামায় বসানো হয়। ছেলে ব্যাঙটাকেও তেল হলুদ মাখিয়ে নামাবলি জড়ানো হয়। তার পর দুই ব্যাঙকে মাথায় নিয়ে বেরোনো হয় গ্রাম পরিক্রমায়। শুরু হয় মেঘরাজার কাছে জল চেয়ে ব্যাঙের বিয়ের গান। এক জন বা দু’জন গায়ক। বাকি সব দোহার। গানটা ছিল— আল্লার বান্দা গুনাগার পুড়ে হল ছারখার/ আল্লা মেঘের পানি দেরে, পানি দেরে আল্লা তুই/ কোদুর ভুঁইয়ে ছিপছিপানি ধানের ভুঁইয়ে হাঁটু পানি/ দেরে পানি আল্লা ওরে মেঘের পানি দেরে তুই/ শীতল কর তুই জমিন আসমান, মেঘের পানি দিয়া রে॥
গান গেয়ে পুরো গ্রাম ঘুরে যেই না মাঠের মাঝে আসা, অমনি কোথা থেকে যেন ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামে। গ্রামের সকলের সে কী আনন্দ! চল্লিশ বছর পুরোনো আনন্দের স্মৃতি মনে করে বলতে বলতেই চোখে জল আসে মালতীর। মেয়েবেলার বন্ধুদের মধ্যে বিলকুচ বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছে। ভেলামের মৃত্যু হয়েছে অসময়ে, কর্কট রোগে। বাকিরা কোথায় যে হারিয়ে গেল, শুধু সময় সে কথা জানে।
শুধু মুর্শিদাবাদ নয়, ভারতের অন্য প্রান্তেও মেঘ ডাকার পরব হত। মধ্য ভারতের এক আদিবাসী সম্প্রদায়ের নাম বাইগা। এই জনজাতির মানুষেরা প্রকৃতিকে এতটাই ভাল বোঝে যে সকলে তাদের বলে ‘প্রকৃতিপুত্র’। বাইগাদের গ্রামগুলো পাহাড়ের কোলে থাকে। একটা পাহাড়ি ঝর্নাকে পাশে রেখে বাইগা গ্রাম শুরু হয়। বৃষ্টি না হলে শুকিয়ে যায় ঝর্না। জলের কষ্ট হয়। তখন বাইগারা গ্রামের সবাই এক সঙ্গে ‘বড়া দেও’ বা বড় দেবতার কাছে যায়। জঙ্গলে বড় দেবতার থানে শুরু হয় পুজো। পুজোর পর ঘরে ফিরে এসে মেঘকে সন্তুষ্ট করার জন্য নাচ গান করে তারা। বাইগা ভাষার এমন এক গানের বাংলা অনুবাদ হল—
মেঘ তুই তারার গায়ে থাকিস/ মিলিয়ে কেন থাকিস?/ মেঘের ঘরের জল তুই/ আমাদের জঙ্গলে নামিস॥
তার পরেই বৃষ্টি নামে ঝমঝমিয়ে। পাহাড়ের গা বেয়ে বৃষ্টির জল পৌঁছে যায় ঝর্নায়। মেঘের বন্ধু বৃষ্টিকে পেয়ে প্রাণ ফিরে পায় পাহাড়িয়া ঝর্না।
পাহাড় থেকে নেমে আসে গঙ্গা। তার পাড়ের জেলা মালদহ। এখানেও বৃষ্টি ডাকার নানা রকম আচার অনুষ্ঠান হত। হরিশচন্দ্রপুর, রতুয়া, কুমারগঞ্জ প্রভৃতি এলাকায় ‘গাছহিংড়ি’ লোক উৎসব হত। মামার বাড়িতে জন্মেছে এমন একটি বাচ্চা ছেলে লোকচক্ষুর আড়ালে গিয়ে উলঙ্গ হয়ে একটা গাছের ছালে ছোট্ট কুঠুরি তৈরি করে সেখানে হিং পুরে দিত। বিশ্বাস ছিল এর পরেই বৃষ্টি আসে।
বৃষ্টি না এলে ‘সাতঘরিয়া’ বলে একটা খেলা হত মালদহের অনেক গ্রামে। গ্রামের মানুষদের বিশ্বাস ছিল এই খেলা করলে বরুণ দেবতা খুশি হয়ে বৃষ্টি দেবে। মালদহতেই একটা লোক উৎসব ছিল ‘নোড়াপোঁতা’। এই উৎসব পালন করা হত বৃষ্টি ডাকার জন্য। পাড়ার সব থেকে ঝগড়ুটে মহিলার বাড়ি থেকে নোড়া চুরি করা হত। তার পর নোড়াটাকে অন্য বাড়ির উঠোনে পুঁতে দেওয়া হত। লোকবিশ্বাস ছিল, নোড়া না পেয়ে ঝগড়ুটে মহিলা ঝগড়া করত, আর সেই ঝগড়া শুনে মেঘ রেগে গিয়ে বৃষ্টি দিত।
উত্তরবঙ্গের কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ির বিভিন্ন প্রান্তে হত ‘মেঘপরব’ বা ‘হুদুমদেও’ উৎসব। বৃষ্টি নামানোর জন্য এই ধরনের জাদুধর্মী পুজো করা হত। সঙ্গে চলত নাচ-গানের অনুষ্ঠান। দেশে অনাবৃষ্টি, খরা প্রভৃতি ঘটলে মেঘদেবতাকে সন্তুষ্ট করতে আয়োজন শুরু হত। এই অনুষ্ঠানে পুরুষের প্রবেশাধিকার ছিল না। মেঘপুজোর জন্য উপকরণ হিসেবে জোগাড় করা হত ফিঙে পাখির বাসা, সন্তানবতী এক জননীর গা-ধোওয়া জল, গণিকার চুল, একটি কলাগাছ, জলপূর্ণ ঘট, কুলো, ধূপ-বাতি, নৈবেদ্য ও তার সাজ-সরঞ্জাম, গোটা পান-সুপারি, বরণডালা ইত্যাদি।
দিনের বেলা এই সব উপকরণ সংগ্রহ করা হত। মেয়েরা গভীর অন্ধকার রাতে লোকালয় থেকে বহু দূরের কোনও মাঠ বা নির্জন নদীর ধারে মশাল জ্বালিয়ে পুজো শুরু করত। মেঘদেবতার প্রতীক হিসেবে একটা কলাগাছকে পুজো করা হয়। এই অনুষ্ঠানে সধবা বিধবা উভয়ই অংশগ্রহণ করতে পারে। তবে কুমারীরা অংশ নিতে পারত না। তার পর শুরু হত নাচগান। মেঘদেবতার অধিবাস থেকে শুরু করে বিয়ে, বিরহ-মিলন, বৃষ্টির কৃপা ভিক্ষা সবই নাচে-গানের বিষয় হয়ে উঠত। মেঘদেবতার কৃপা চেয়ে গাওয়া হত— হুদুম দ্যাও হুদুম দ্যাও, এক ছলকা পানি দ্যাও/ হুদুম দ্যাও হুদুম দ্যাও, নদীতে পানি ভইর্যা দাও/ কালা ম্যাগ, উতলা ম্যাগ, ম্যাগ ম্যাগের ভাই/ এক ঝাঁক পানি দ্যাও গো, গাও ধুইবারে চাই॥
শিলাবতী নদী উপত্যকায় রয়েছেন সিনি দেবী। মহাভারতে সিনি হলেন অঙ্গিরার পত্নী ও শ্রদ্ধার কন্যা। সিনি হলেন বৃষ্টি ও শস্যের দেবী। শস্য ভাল হওয়ার জন্য তিনি বৃষ্টি দেন। সিনি দেবীর পুজো হয় পয়লা মাঘ। এই পুজো মূলত নিম্নবর্গের মানুষরাই করেন। দেবীর থানে হাঁস, মোরগ, পায়রা বা ছাগ বলি হয়। সিনি দেবীরও কিছু রূপভেদ আছে, তাঁদের মধ্যে ঘাগরাসিনি শুধু বৃষ্টি দেন। বনদুবরাজপুর পঞ্চায়েতের রায়বাঁধ গ্রামে ঘাঘরী পুকুরপাড়ে আছে দেবীর থান। পুজোয় নৈবেদ্য হিসেবে মদ লাগে। মানুষের বিশ্বাস, দেবীর পুজো শেষ হলেই মুষলধারে বৃষ্টি নামে।
উত্তর বিহারের নানা প্রান্তে হয় বৃষ্টি ডাকার গান। আপাং গাছের ডাল, শালপাতা, খেজুরপাতা, নিমপাতা দিয়ে কুণ্ড তৈরি করে স্থানীয় গুনিন। গ্রামের সবাই ঘিরে থাকে গুনিনকে। গুনিন মেঘ ডাকার গান ধরেন। গ্রামের মানুষদের বিশ্বাস গুনিনের তৈরি কুণ্ডের ধোঁয়ায় মেঘের চোখ জ্বলবে। তখন মেঘ কাঁদবে। কান্নার জল বৃষ্টি হয়ে ঝরবে মাটির বুকে।
মানুষ বরাবর বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করে এসেছে প্রকৃতির কাছে। প্রকৃতি তার নিজস্ব কাজকর্মে (যেমন জলচক্র) বৃষ্টি দিয়ে মানুষের চাহিদা পূরণ করেছে। প্রকৃতিকে শাসন নয়, প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থান বাঁচার এক মাত্র পথ, সে কথা বার বার প্রমাণ হয়েছে। পৃথিবীকে শাসন করতে গিয়ে আমরা জঙ্গল কেটে শেষ করছি। উষ্ণায়নের জন্য পৃথিবী গরম হচ্ছে। বৃষ্টিপাতের তারতম্য হচ্ছে। প্রকৃতির বিরক্তি টের পাওয়া যাচ্ছে বৃষ্টির খামখেয়ালে।