ছবি: অমিতাভ চন্দ্র
চন্দন কাঠমাত্র। পাথরে ঘষে শীতচন্দনপঙ্ক তৈরি করা যায়। কৌশলী ব্যবহারে হয়ে ওঠা অসম্ভব নয় চন্দন-দস্যুও।
চুয়া গন্ধদ্রব্যমাত্র। যেমন রূপচাঁদ পক্ষীর হোরিগানে— ‘আনি চুয়া চন্দন/ গোলাব সহিত আবিরী’। চুয়া ক্ষরিত হওয়াও।
মধু পুষ্পরসমাত্র। স্বল্পজ্ঞানে মৌ-বমি, সুশ্রুতবীক্ষায় ঔষধি, মহাকাব্যকালে মদ, ঋতুবন্দিশে বসন্ত, পুরাণপথে দৈত্য।
দই প্রক্রিয়াজাত দুধমাত্র। অণুজীবের গেঁজিয়ে তোলা লীলা বলা যায়, স্তন্যপায়ীর অধিকারের জৈবিক বিকেন্দ্রিকতাও।
প্রদীপ আলোপাত্রমাত্র। জ্বালিয়ে অন্ধকার নিরসন করা যায়। লঙ্কাকাণ্ডেও জুড়ি নেই।
এবং দূর্বা তৃণমাত্র।
এবং ভাইফোঁটা লোকপার্বণ-মাত্র।
এবং ভাই-বোন মানুষি ভাবনা-মাত্র।
মানুষি ভাবনা। কার্তিকের শুক্লা দ্বিতীয়া। নানা পুরাণকথায়। দীপোৎসবকল্পের কাহিনি— নন্দীবর্ধন মহাবীরের অনুগামী, মহাবীর দেহ রাখলেন, অন্ধকার দেখলেন নন্দীবর্ধন। গ্রাস করল বিষণ্ণতা। খাওয়াদাওয়া, মেলামেশা সব বন্ধ। বোন অনসূয়া ভাইকে জীবনছন্দে ফেরালেন। মহাবীরের দর্শনের সারমর্ম, ঈশ্বর-নিরপেক্ষ বহুত্ববাদী-অনেকান্ত-অসৃষ্ট মহাবিশ্বের বীক্ষা, জীবনধর্মের কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন। স্মরণ করালেন রাজধর্ম পালনের কথাও। নন্দীবর্ধন খেলেন বোনের হাতে। বোন কপালে এঁকে দিলেন প্রাণচিহ্ন— ভাইফোঁটা।
শ্রীকৃষ্ণ নরকাসুর বিনাশ করে ফিরলেন। বোন সুভদ্রা তাঁর কপালে আঁকলেন জয়টিকা। করে এলেন তো খুন। তা হলে জয়টিকা? অশুভনাশের তত্ত্বের পাশাপাশি সম্ভবত এটাও— সে যুদ্ধে যোলো হাজার মেয়েকে বাঁচিয়েওছিলেন শ্রীকৃষ্ণ, মতান্তরে বিয়ে করেছিলেন। যে মেয়েদের নরকাসুর বন্দি করে রেখেছিলেন। শ্রীকৃষ্ণের পুরুষকার উদ্যাপনে সুভদ্রা— ভাইফোঁটা।
বেদ-পুরাণে যম-যমী, যম-যমুনার নানা কাহিনি। যম-যমীতে ভাই-বোন সম্পর্কের সমাজনীতি নির্ধারণ। পুরাণে সূর্য-সংজ্ঞার সন্তান যমুনা-যম। যমুনা তিন বর চান ভাই যমের কাছে— যমুনায় স্নান যেন শান্তি দেয়, এই দিনে যেন ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয় তাঁর। তৃতীয়টি দারুণ— যম যেন সেই ভাইকে স্পর্শ না করতে পারেন, যাকে তার বোন ফোঁটা দিয়েছে। যমের কাছে চাওয়া বরে যমেরই অস্ত্র কাড়ার আখ্যান— ভাইফোঁটা।
এই রকমই নানা মানুষি ভাবনা। শিকড়ে শপথ-শুভেচ্ছা-ভালবাসা। যদিও ট্র্যাজেডি হল— অনসূয়ার স্মরণ করিয়ে দেওয়া মহাবীরের বহুত্ববাদ নয়, আমরা একচক্ষু উগ্রতাকেই মাথায় তুলেছি। শ্রীকৃষ্ণের বান্ধবমূর্তিকে নয়, দ্রৌপদীর চিরসখার আবেশকে নয়, যোলো হাজার দারগ্রহণ আর সম্ভোগের গল্পকথাকেই মান্যতা দিয়েছি। রক্ষার তাবিজ খুলে বা ধারণ করেই ধর্ষকের চাহনিতে দেখতে অভ্যস্ত হয়েছি যমুনাদের।
‘কার মিলন চাও বিরহী’
নদিয়ার চাকদহের কাছে একটি জায়গা বিরহী। মদনগোপালের মন্দির সেখানে। যার পৃষ্ঠপোষকতার সঙ্গে জুড়ে রয়েছে কৃষ্ণচন্দ্রের নাম। ভাইফোঁটায় সেখানে মেলা বসে। যোগ দেন হিন্দু-মুসলিম সবাই। জায়গার নাম বিরহী কেন? জনশ্রুতি— একাকী অধিষ্ঠিত মদনগোপাল নিজেকে বিরহী মনে করেছিলেন, চেয়েছিলেন সঙ্গী। যমুনায় ভেসে আসা কাঠে তৈরি হল রাধামূর্তি। বিরহী দশা কাটল। মন্দিরে রাধামূর্তি প্রতিষ্ঠার পরে যুগলে সুখে-শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিলেন। জনশ্রুতি-মধ্যবর্তী লোকশ্রুতি— সে গ্রামে এক জনের সাত মেয়ে, ছেলে নেই। জঙ্গলে এক শিশুকে খুঁজে পেয়ে ছেলে হিসেবে মানুষ করতে লাগলেন। কালক্রমে বোধি জন্মাল— শিশুটি শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং। এক দিন দেবশিশু অরণ্যানীতে মিলিয়ে গেল। তার পরে ‘স্বপ্নাদেশ’, মদনগোপালের মন্দির প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি-প্রভৃতি এবং মদনগোপালের বিরহী হয়ে ওঠা। সে সবেরই স্মারক ভাইফোঁটার মেলা? কিন্তু শ্রীরাধা তো শ্রীকৃষ্ণকে ভাই বলে স্বপ্নেও ভাবেননি! তবে কেন সাত বোনের এই মায়াময় ভাইটি? তাই কি এই দিনে নিজেদের আরাধিকা ভগিনীপ্রতিমা বিবেচনায় মদনমোহনের সামনে সম্প্রদায়-লিঙ্গ নির্বিশেষ সচন্দন উপচার সাজিয়ে রাখা?
এ কাহিনি, যম-যমুনার আখ্যান বা সাত ভাই চম্পার একমাত্র বোন পারুলের রূপকথা সম্মানজনক সম্পর্কের কথাই বলে। বলে মানুষি ভাবনার কথা। আমিত্ব কাটিয়ে উঠতে পারলে তার নাম কখনও পারিবারিকতা, কখনও সামাজিকতা, কখনও বিশ্বজনীনতা। তাতে প্রেম, ভালবাসা, আত্মীয়তা রয়েছে। ধর্ষণ নেই। থাকার কথা নয়।
ভাইফোঁটা লোকপার্বণ ভারত প্রেমকথাই। তবে সীমাগণ্ডিতে নয়। ‘প্রেম’ শব্দের স্বাধীনতা যত খর্ব করেছি, তত নেমন্তন্ন জানিয়েছি বিপন্নতাকে। ভাই-বোনের সম্পর্ককে এই উৎসবে যে শপথে উদ্যাপন করা হয় বা করার কথা, তার মধ্যে মানুষি প্রেমটিই প্রধান। বাৎসল্যও যেমন প্রেম, আত্মীয়তার বোধও প্রেম। নানা বিভঙ্গে নানা সম্প্রদায়-লোকাচারেতার অভিযাত্রা। না, সে অভিযাত্রায় ধর্ষণ নেই। থাকার কথা নয়।
তবে সমস্যা হল, কালীপুজো যেমন গৃহস্থ ও ডাকাত দু’তরফই করে থাকে, তেমনই ভাইফোঁটার শুভেচ্ছা-আয়োজনে নিশ্চিত ভাবে যোগ দেয় কিছু ধর্ষকামী ভাইও। এক বোনের ফোঁটা নিয়ে অন্যের বোনকে শেষ করে দেওয়ার পরমার্থ পরিকল্পনার মতো পৌরুষ আর কিসে! ‘সব চেয়ে দুর্গম’ মানুষ কোথায়? ‘আপন অন্তরালে’ই।
এ প্রশ্ন বরং ভাইফোঁটার দিনেই করা যাক— নিষ্পেষণ কি তা হলে সমাজে স্বাভাবিক হয়ে উঠল? না হলে কেন এত রক্ত? কেন ধর্ষণের জোয়ার? এখানেও ভাবার কথা, সত্যিই নতুন জোয়ার? না কি ছিলই? কলকাতার ডাক্তারি-পড়ুয়া মেয়েটির শেষ হয়ে যাওয়া আর প্রতিবাদ ঘনিয়ে ওঠার সূত্রে মানুষ কিছুটা সরব হলেন বলেই কি গ্রামে-গঞ্জে-শহরে নানা বয়সের ধর্ষিত-গলিত শরীরগুলো ভেসে উঠতে শুরু করেছে?
খুন, ধর্ষণ, যৌন নির্যাতন, অ্যাসিড ছোড়া, মায় ছোট করে হাত-পা নামিয়ে দেওয়াও যেন ‘কর্তব্য’। যেন এ সবের আর্থ-সামাজিক ‘হিন্টারল্যান্ড’ প্রস্তুত, যেন তৈরি রাজনৈতিক ডামাডোলের দিগন্তবিস্তৃত কুরুক্ষেত্রও। এবং সেখানেও ধৃতরাষ্ট্র রাষ্ট্র কর্তৃক ধৃত। তাঁর সামান্যই কাজ। নিয়মমাফিক জিজ্ঞেস করা— ‘মামকাঃ পাণ্ডবাশ্চৈব কিমকুর্ব্বত সঞ্জয়’। কে না জানেন, একার্থে মহাভারতের সঞ্জয়ও সিভিক ভলান্টিয়ার। তবে সে কালে তিনি সত্যবাদী, ন্যায়পরায়ণ সমাজ-স্বেচ্ছাসেবী। বিবতর্ন! বিবর্তন?
‘সুন্দরের বন্ধন নিষ্ঠুরের হাতে’
এ গানের ‘বন্ধন’ বন্দি করার বাঁধন। নিষ্ঠুরের হাতে বাঁধন-বন্দি সুন্দর। প্রশ্ন— ‘ঘুচাবে কে’? প্রশ্ন আজও এক। ‘বন্ধন’ যুক্ত হওয়ার কথাও বলে। সে বন্ধন মিলন, মুক্তযোগে বাঁধা পড়া। রবীন্দ্রনাথ বঙ্গভঙ্গের নিদানের প্রতিবাদে রাখিবন্ধনের কথা ভেবেছিলেন। উপমহাদেশের নানা প্রান্তের বোন-ভাইয়ের রাখি-রীতির আত্মীয়তাই টেনেছিল কবিকে। সে ভাবনায় জোড়াতালি নয়, জোড়ার কথা ছিল। আর এক চৈত্রপূর্ণিমায় সেই কবিরই রাজার বুকের মধ্যে রক্ত ঢেউ খেলিয়ে উঠল, ভুলে-যাওয়া কুহেলিকার ভিতর থেকে গুঞ্জরিত হয়ে উঠল— ‘বাঁধিনু যে রাখি পরানে তোমার সে রাখি খুলো না, খুলো না’।
পরানে রাখি বাঁধা যায়? নিছকই কাব্যভাষ? বাগাড়ম্বর? অতিশয়োক্তি? ‘কব্জি’ শব্দে না-হয় কাব্য কম পড়িত, কিন্তু হাত-হস্ত-মণিবন্ধ কী দোষ করল?
না, হাতে রাখি বাঁধা কম বড় কথা নয়, তবে পরানে বাঁধাটা বড় বেশি প্রণম্য আর কঠিন। আসলে, প্রেম-অপ্রেম, সত্য-ছলনা, সম্মান-ঘৃণার রসায়নটি জটিল। ভাইফোঁটায় ভিক্ষাজীবীকে, অনাথ আশ্রম বা বৃদ্ধাশ্রমের আবাসিকদের, যৌন-শ্রমিককে ফোঁটা দিয়ে কিংবা রক্ষাবন্ধনে রাখি পরিয়ে যে সামাজিকতা, তাকে সম্মান জানিয়েও প্রশ্ন জাগে, তার কতটুকুতে প্রাণের যোগ? পরানের রাখিটি পরানো না হয়ে ওঠায় মুখ্য হয়ে ওঠে শ্রেণিমাহাত্ম্য। অনুপম রায়ের সেই ছুঁয়ে যাওয়া গানটি ধার করা যায়— যেন মনে করিয়ে দেওয়াই— ‘একবার বল, নেই তোর কেউ নেই’!
বানিয়ে তোলা সম্মাননা আর অবচেতন-ঘৃণার রসায়ন এক। যে আমি পরিবারের ছোটদের লালন করি সংখ্যালঘুকে হেয় করার প্রশিক্ষণে, ঠারেঠোরে বা সরাসরি সমাজে ‘নারীর স্থান’ বুঝিয়ে দিয়ে, উগ্র জাতীয়তাবাদে তিলক পরিয়ে বা প্রতিবেশী ভূখণ্ডের আমজনতাকে যুদ্ধবাজ তকমায় ভূষিত করে নিজেদের শান্তি-পারাবত বিঘোষণায়, সেই আমিও আশা করি, বুদ্ধপূর্ণিমায় ফ্রিজে বিশেষ মাংস রাখায় খুন করা হবে না? ভাইফোঁটার দিনে বানতলা-উন্নাও-কামদুনি-হাথরস-আর জি কর হবে না? কোনও এক পঁচিশে বৈশাখে ‘গীতবিতান’ হাতে কুচকাওয়াজ করবে সীমান্তের প্রহরী?
‘বিশ্বাস হারানো পাপ’। অবিশ্বাস্য হয়ে ওঠা পাপ নয়?
‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’
তা সে ভাইফোঁটা হত বটে আমাদের কালে!— ঠাকুমা বলত। শুধু ভাইফোঁটা নয়, দুগ্গাপুজো, ইতুপুজো, জামাইষষ্ঠী, পয়লা বোশেখ মায় আঁতুড় তোলার আচারও। তাদের কালে কী হত, মোটেই নেই জানার ইচ্ছে। তবু না শুনলে ছাড়ে কে!
—শোন, শেঠপুকুরে জাল ফেলা হত! সে ইয়া-বড়-বড়, মানে চোকে না দেকলে বিশ্বেস যাবি না, মাছ সব! বলব কী, উঠোনে ফেলার পরও ছটপট-ছটপট কত্ত!
—অত বড়! ভাজা হত?
—শোনো কতা! ভাজা হত মানে! উটোনের উনুনে পেল্লাই কড়ায় এক্কেবারে ছাঁকা তেলে ভাজা হত! সেই সক্কাল থেকে! অনেক লোক তো! বাড়িতেই জনা-পনেরো। তার পর জামাইরা সব আসত, বৌদের বাপের বাড়ি থেকেও ভাই-টাইরা আসত ফোঁটা নিতে। তার পর বাবার দুই বন্ধু ছিল। বৌ-বাচ্চা নিয়ে আসত। মা-পিসিরা ফোঁটা দিত। ওদের বোন-টোন ছিল না। আর খ্যাঁটনের লোভও ছিল! তা সে হবে না-ই-বা কেন! আমাদের রান্নার পাড়া-জোড়া সুনাম ছিল কিনা! এক বার তো...
—কত বড় কড়ায় মাছ ভাজা হত, ঠাম্মা? ‘চারমূর্তি’ সিনেমার ‘গুলগুল-গুল্লা খাব তোকে’র মতো? ইয়া-বড় কড়া?
—অ! বুজেচি! ফাজলামি হচ্চে! ঝক্মারি হয়েচে! বলব না! বাঁদর তৈরি হোয়োচো একটা!
—আচ্ছা ঠাম্মা, বাঁদরদের ভাইফোঁটা হয়?
—আ মোলো! বাঁদর কি মানুষ যে ফোঁটা হবে! বাজে কতা! এই উটলাম! বললাম না, বলব না!
‘বলব না’ বলেও ঠাম্মা বলে চলত। পানের বাটা থেকে এক খিলি মুখে পুরে, দু’আঙুলে অল্প দোক্তা মুখে ছড়িয়ে কাহিনির কড়া থেকে, পায়েস থেকে, চন্দন থেকে, চন্দ্রপুলি থেকে স্মৃতির কোন অতলে ডুব দিয়ে সাঁতরে চলে যেত বহু কাল আগের কোন এক প্রতিবেশী মাছ-কাটিয়ে ‘স্বপনদা’র গল্পে। চলে যেত একান্ত নিজের, সযত্ন-গোপন সেই ‘স্বপনদা’র বিস্ময়কর কর্তন-কুশলী হাতের জাদুর বিবরণে। সে রূপকথায় আমার অশীতিপর ঠাম্মাই রানি, ঠাম্মাই মৎস্যকন্যা আর তার চিরযুবা ‘স্বপনদা’ রাজাধিরাজ। বহু যুগ আগের আমার-আমাদের না-দেখা উৎসব থেকে ভেসে আসত মাছবঁটির আঁশগন্ধ, মাছভাজার সুবাস, পরমান্ন-সৌরভ। আবার সেখান থেকে কখন যেন ঠাম্মা ঢুকে যেত সেই স্বপ্নময় আঁশবঁটিটি ঠাম্মার ঠাম্মার নিরামিষ রান্নাঘরে ঢুকিয়ে ফেলায় কুরুক্ষেত্র সংঘটনের গল্পে।
ঠাম্মা আমাদের ভাইফোঁটা দিত। তখনও বাড়িতে বোন জন্মায়নি। ঠাম্মাই আমাদের বোন, আমাদের দিদি। নিজের ভাইদের সঙ্গে পুঁচকে দুই নাতিকে ফোঁটা দিত ঠাম্মা। কারণ, সন্তানের সন্তান নাকি সহোদর-প্রতিম। ঠাম্মা ফোঁটা দিত তার মেজ ভায়ের দুই নাতনিকেও। হয়তো অজান্তেই বোনফোঁটার চল শুরু করে ফেলেছিল ঠাম্মা নিজের সংসারে। হয়তো ঠাম্মার সংসারের মেয়ে-বৌরাও আশা করত, এক দিন তারাও পাবে ফোঁটা। হয়তো ফোঁটা পাওয়ার আশা ঠাম্মারও ছিল।
আরও এক জনকে ফোঁটা দিত ঠাম্মা। নিজের ঘরে, নির্জনে। অকালমৃত ছেলেকে, দেওয়ালে। দেওয়াল শুষে নিত দই-চন্দন। ঠাম্মা চোখের জল। মাকেও দেখেছি, টানাটানির সংসারে সব বার ভাইদের ডাকতে না পেরে দেওয়ালেফোঁটা দিতে।
সেই সব দেওয়াল কেমন আছে?
‘নিম খাওয়ালে চিনি বলে’
এই মুহূর্তে যে ঘটনাটি বিশ্বসংসারে ঘটে গেল, যে কোনও ঘটনাই হতে পারে, আপাত-তুচ্ছ, তুচ্ছ, আপাত-বৃহৎ বা মহতী— সত্যিই ঘটে গেল? না ঘটানো হল? প্রশ্নটি হয়তো দর্শনের, বিজ্ঞানের। তবে তলিয়ে দেখলে স্বয়ম্ভু কিছুই নয়। কার্যকারণের মধ্যে কারণসম্ভূত কার্যই বিশ্বনাট্যসংলাপ। বিচ্ছিন্ন করে দেখাটা সুবিধাবাদ। সুবিধাবাদও স্বয়ম্ভু নয়। আমরা নির্লজ্জ হতে ভাসবাসছি; কারণ, লজ্জার ধারণা বদলে দেওয়া হচ্ছে। নীরবতাকে হিরণ্ময় ভাবছি; কারণ, নীরব থাকার দীক্ষাই দেওয়া হয়ে এসেছে। আচমকা সরবতার যে ব্যতিক্রমী প্রক্ষেপ, তার বিশ্বাসযোগ্যতাকে কঠিন লাগছে; কারণ, সরবতার রং-রঙিন জামার বহুরূপী নৈঃশব্দ্যে আমরা অভ্যস্ত।
আজ এখনই যদি ঘটে আরও একটি ধর্ষণ? যদি কেন! দেবীর আরতি-পর্বে যেটুকু সময় লাগে, তার মধ্যেই এ দেশে অন্তত একটি মেয়ের সঙ্গে সেই ঘটনাই ঘটে চলেছে যে! সেই মেয়েটিও কারও মা, মেয়ে, প্রেমিকা, বোন বা দিদি। আজ যদি ভাইফোঁটার আয়োজনকে কোনও মেয়ের পরাভবের উদ্যাপন বলে মনে হয়, তাকে সামাজিক ভাবে অসুস্থ বলা যাবে? যদি সে প্রশ্ন করে— কেন দেব ভাইফোঁটা? দিলে কোন স্বর্গীয়-হেভেনলি-বেহেশতি পরমার্থ লাভ হবে? কী হবে উত্তর?
আমি বোন। ফোঁটা দেব ভাইকে। ভাই পুরুষ এবং হয়তো অবচেতনে ধর্ষণের সমর্থক, হয়তো-বা সচেতন ধর্ষকও। অবশ্যই সব ভাই নয়, কিন্তু হাতে-গোনা হলেও কিছু ভাই তো বটেই। তারা আকাশ থেকে পড়েনি। অবিশ্বাস করতে মন চাইলেও তাদের অনেকে দুনিয়াজোড়া ভাইতন্ত্রেরই প্রতিনিধি। কিছু ভাই মনেও করে, নারী সন্তানোৎপাদন যন্ত্র এবং তার জায়গা পায়ের নীচে। কিছু ভাই তো অর্থ না বুঝে বা বুঝে ধর্মাধর্ম-নির্বিশেষ ঘৃণামন্ত্র আউড়ে সাংস্কৃতিক ধর্ষণই করে চলেছে নানা আচারে। অবশ্যই একই ঔদ্ধত্য-দোষে পুষ্ট পুরুষালি যন্তরমন্তরে ধৌতমগজ নারী-পুরুষ সকলেই। তবে মন্ত্রের ভুল নির্বাচন না হয় শব্দের ভাষা না জানা। কিন্তু দেহের ভাষা? চোখের ভাষা? রাজনীতির ভাষা? পুরুষতন্ত্রের ভাষা? ক্ষমতার ভাষা? সেখানে মেয়েরা একা এবং একাই। শুধু মেয়েরাই নয়, পুরুষকারও একা এবং একাই। মনুষ্যত্বই নির্জন একাকী।
জিঘাংসা যদি বিবর্তন-সূত্রে প্রাপ্ত মনে করি, তবে মানা উচিত, সভ্যতার বিবর্তনে অধিকার নেই আমাদের। ভাইফোঁটা দূরের কথা, পোশাকেরই প্রয়োজনই নেই তা হলে। অধিকার নেই আগুনেও, চাকাতেও। মানসিক-শারীরিক ধর্ষণের জিগীষা-জুগুপ্সা যদি অবচেতন-লালিতই হয়, তবে অনস্বীকার্য, মানুষ হয়ে উঠিনি, পোষ্যের মতো আমিও প্রাকৃতিক জীবমাত্র। যদিও জীবজগতে হাতে-গোনা প্রাণীই ধর্ষণে অনুরক্ত।
আদতে, সমস্যা আম-পুরুষের নয়, আম-সঞ্চারিত পুরুষতন্ত্রের। নিষ্পেষণকে স্বাভাবিক আর ঐশী গণ্য করা যায় তখনই, যখন বিসর্জন এসে প্রতিষ্ঠাকে নিয়ে যায়। জীবন থেকে প্রেমের বিসর্জন ঘটে যাচ্ছে কি? ক্যালিগুলা খুঁজতে রোমে যেতে হয় না। পুরাণে, মহাকাব্যে, ইতিহাসে তারা সতত সঞ্চরমাণ। এখানেই প্রশ্ন— ক্যালিগুলার কল্যাণকামী রূপও ছিল, এমন সওয়াল যদি মিথ্যে হয়ে থাকে, তবে রেওয়াজ-রীতি থাকলে ক্যালিগুলাকেও ফোঁটা দিত কোনও বোন?
‘দূরে তাকিয়ো নাকো,ঘাড় বাঁকিয়ো নাকো’
নান্টুদা টিউশন পড়ায়। চাকরি পায়নি। কমার্স গ্র্যাজুয়েট। বেশ গরিব। বাড়িতে তার সঙ্গে মা, মায়ের সঙ্গে সে।
রুবিদি ইলেভেন। সচ্ছল একান্নবর্তী পরিবার। এইট অবধি রুবিদিকে পড়িয়েছে নান্টুদা। পরে অন্য মাস্টার রাখা হলেও নান্টুদা সাহায্য করত।
নান্টুদাকে রুবিদির বাড়ির সবাই ভালবাসত। রুবিদির মা বলতেন— ‘নান্টুর মতো হ! এত ভাল পড়াশোনায়, অথচ কী লাজুক, কী শান্ত!’ খেদোক্তিও বাদ যেত না— ‘কেন যে চাকরি জুটছে না, কে জানে! যা দিনকাল!’ রুবিদির বাবা— ‘তা তোমাদের সরকার কি সে সুযোগ রেখেছে! রাজ্যটাকে তো বেকারের ঢিবি বানিয়ে তুলেছে!’ সরকারের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক বুঝতে না পেরে চুপ যেতেন রুবিদির মা। চুপ নান্টুদা-রুবিদিও। রুবিদির একশো ছুঁই-ছুঁই দাদু শুধু গলা খাঁকারি দিয়ে বলে উঠতেন— ‘আজ রামবাবুবেঁচে থাকলে...!’
এই রামবাবুর কথা রুবিদির দাদু মাঝেমধ্যেই বলে উঠতেন। তবে কে সেই রামবাবু, সম্ভবত কেউ জানত না। তিনি রামচন্দ্র, রামপ্রসাদ সেন, রামরাম বসু, রামমোহন রায়, রামনারায়ণ তর্করত্ন— যে কেউ হতে পারেন। কিন্তু তাঁর বা তাঁদের সঙ্গে নান্টুদার চাকরির কী সম্পর্ক, দাদু বলে যাননি। ‘থামো তো!’— বাবাকে দাবড়ে থামাতেন রুবিদির বাবা।
আগের শতকের নব্বইয়ের দশক। আমাদের মফস্সলে তখন দোতলা বাস, লাল রঙের। ধর্মতলায় যেত সেই বাস। ছোটবেলায় মা-বাবার সঙ্গে সে বাসে উঠলেই মনে হত, বেড়াতে যাচ্ছি! পরে একা ওই বাসে ওঠা শুরু হতেই প্রত্যয় জাগত, বড় হয়ে গিয়েছি! বাসে উঠে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় পৌঁছে যাওয়াটাই কর্তব্য ছিল। ফাঁকা সময়ে সহজেই হত। সামনে প্রথম আসনে বসার চেষ্টা, একেবারে চালকের মাথার উপর! অনেক বাসে চালকের আলাদা কামরা থাকত। ট্রেনের কামরার মতো, কেন্নোর মতো জোড়া থাকত মূল বাসের সঙ্গে। বাড়তি কেবিনের বাসে মজাও বাড়তি! কেমন আমাদের আগেই বাঁক নিত চালকের কামরা। পিছন-পিছন ছাঁদনাতলায় সাতপাক ঘোরা বর-বৌয়ের মতো আমরাও!
সেই দোতলা বাসেই কাণ্ড ঘটল। রুবিদির ইলেভেনেই। এক সন্ধ্যায় রুবিদির বাবা রুবিদি-নান্টুদাকে এক সঙ্গে দেখে ফেললেন। ওই বাসেরই সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসতে দেখলেন। কাছাকাছি কোনও জায়গা থেকে উঠে পাদানিতে দাঁড়িয়েছিলেন। রুবিদিরাও নামছিল বাড়ির স্টপে নামবে বলে। দেখে ফেললেন।
রাতেই বাড়িতে মিটিং বসল। চিরকালই যা হয়, বেশ কিছু কমিটি তৈরি হল। রুবিদির মেজ কাকা, মেজ কাকিমা বাড়ির মেয়েকে পাহারা দেওয়ার কমিটিতে। নান্টুদা যাতে বাড়ির চৌহদ্দিতে ঘেঁষতে না পারে, তার জন্য গঠিত কমিটিতে স্থান পেলেন ছোটকা আর রুবিদির দাদা বরুণদা। পড়াশোনার অন্য কমিটি। এমনই নানা রকম। সব কমিটিরই মাথায় রুবিদির বাবা। তিনি সে রাতেই নান্টুদার বাড়ি গিয়ে জানিয়ে এলেন, ভুলেও তাঁদের বাড়িতে আসার চেষ্টা যেন না করা হয়।
এগারো ক্লাসের রুবিদি কী করে থাকবে নান্টুদাকে না দেখে, বুঝে উঠতে পারল না। কেঁদে ভাসাল। লাভ হল না। উল্টে ‘কবে থেকে চলছে এ সব’ শুনতে শুনতে কান আগুন হল। শান্ত নান্টুদা শান্তিময় হয়ে গেল। পড়াতে পড়াতে কবে যে মনে ঠিকরে পড়েছে রুবির আলো, নিজেও বোঝেনি। রাস্তাঘাটে দেখা হলেও কথা বলার জো নেই। রুবি-প্রহরী কেউ না কেউ।
এ ভাবেই চলতে লাগল। তবে রুবিদি কলেজে যাওয়ার পরে পটবদল। মাঝের বিচ্ছেদের জরিমানা আদায় করতে উড়ে বেড়াতে লাগল দু’জন। সে খবরও গেল যথাস্থানে। আবারও মিটিং।
এ বার মিটিংয়ে পাড়ার দু’জনকে দেখা গেল— হাবলাদা আর পিলুদা। পরিচিত, শিক্ষিত মুখ। এলাকার সব উৎসবে-ব্যসনে তারা এগিয়ে আসত, রাষ্ট্রবিপ্লবের লক্ষ্যেই সম্ভবত। তাদের সঙ্গে রুবিদির বাবার গভীর শলা হল। কী শলা, জানল না কেউ।
ঘটনাটা ঘটল ভাইফোঁটার দিন। রুবিদিদের বাড়িতে ঠান্ডা ব্যস্ততা। সকাল ন’টা নাগাদ পাড়ার সেই দুই দাদা এবং সঙ্গে আরও কয়েক জন হাসিমুখে নান্টুদাকে টানতে টানতে নিয়ে এল রুবিদিদের বাড়িতে। নান্টুদা ক্ষীণ গলায় প্রশ্ন করার চেষ্টা করলেও কেউ শুনল না। রুবিদিদের বই-ঠাসা বসার ঘরে ঢুকল ওরা নান্টুদাকে নিয়ে। এক দেওয়ালে রবীন্দ্রনাথের বিপুল ছবি, মালা পরানো। অন্য দেওয়ালে অন্নপূর্ণা আর ঈশ্বরী পাটনী, ক্যালেন্ডার কেটে বাঁধানো, মালা পরানো। লাল মেঝেতে আসন পাতা। প্রদীপ জ্বলছে। আসনের সামনে এক থালায় সন্দেশ, নাড়ু। অন্য থালায় ধান-দুব্বো, চন্দনবাটি, শাঁখ। ঘরে বেশ কয়েকজন— রুবিদির মা, বাবা, কাকা, কাকিমা। ইজ়িচেয়ারে দাদুও।
ঘাড় ধরে আসনে বসিয়ে দেওয়া হল নান্টুদাকে। ঘরে কৌতুকী হাসি। পিলুদা বলল— “নিয়ে আসুন, কাকা।” রুবিদির বাবা ইশারা করলেন। মেজ কাকিমা ভিতরে ঢুকে গেলেন। অল্প পরেই ফ্যাকাসে, মাথা-নিচু রুবিদিকে নিয়ে এ ঘরে ঢুকলেন।
গল্পের বাকিটা সবারই জানা। কিছু কিছু আজও যেমন হয়ে থাকে, অন্তত গঞ্জেগাঁয়ে।
হ্যাঁ, রুবিদিকে ভাইফোঁটা দিতে হয়েছিল নান্টুদাকে। সেই দোর্দণ্ড হুমকি-কালচারের সামনে দু’জনের কেউই কিছু করতে পারেনি। কারণ, সামনে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্র স্বয়ং— হাবলাদা, পিলুদা। শাঁখে বেজেছিল ভালবাসার ‘গার্ড অব অনার’। গলা খাঁকারি দিয়ে দাদু বলে উঠেছিলেন— ‘আজ রামবাবু বেঁচে থাকলে...!’
ভালবাসার মানুষকে ফোঁটা দিতে হয়েছিল রানী চন্দকেও। শান্তিনিকেতনের আশ্রমিক, কথাশিল্পী-কলাশিল্পী রানী চন্দ। তবে সে ফোঁটার গল্প অন্য, অনন্যও। ভাইফোঁটার দিন— “সারি বেঁধে বসে আছেন দাদা-ভাইরা... পুরোভাগে রথীদা (রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর), বিবিদি (ইন্দিরা দেবী) রথীদাকে ফোঁটা দিলেন, সব ভাইরাও বিবিদির হাতে ফোঁটা নিলেন। অন্যরা এক-এক করে ফোঁটা দিলেন।” এ বার পালা রানীর। সমস্যা হল— “আমার স্বামীও বসে আছেন সারিতে।” তাঁর স্বামী অনিলকুমার চন্দ, রবীন্দ্রনাথের সচিব ছিলেন যিনি। অনিল যত উঠে যাওয়ার ফিকির খোঁজেন, অন্যেরা চেপে বসিয়ে দেন। কী করবেন রানী?— “রথীদাকে ফোঁটা দিয়ে প্রণাম করলাম। পর পর ফোঁটা দিয়ে চললাম... স্বামীর কাছে যখন এসেছি, হাসাহাসির একটা ধুম পড়ে গেল। ফোঁটা দিতেই হবে। সবার জুলুম।” অগত্যা মন তৈরি করে নিলেন রানী— “ভাইফোঁটা দিতে কড়ে আঙুলে চন্দন তুলে নিতে হয়— নিয়ম। আমি মধ্যম আঙুলে চন্দন তুলে নিলাম, স্বামীর কপালে ফোঁটা দিলাম— বললাম, তোমাকে সাজালাম।” এর পরেই রানী চন্দ চলে যাচ্ছেন— “শেষ দিনটিতে যখন নিজের হাতে স্বামীকে সাজিয়ে কপালে শ্বেতচন্দনের ফোঁটা এঁকে দিলাম— এই দিনটির কথা মনে পড়ছিল, সেদিন মনে মনে বললাম, তোমাকে সাজালাম।”
নান্টুদা ছাত্র পড়ায় না আর। চাকরি পেয়েছে। কলকাতায় ছোট কমার্শিয়াল ফার্মে। রুবিদি পড়ায়, লিলুয়ার স্কুলে।
ঘোর সংসারী দু’জনই।
‘মমির দেশের মেয়ে নেচে যায়’
নিধুবাবু, রামনিধি গুপ্ত, এক তুমুল অসহায়তার টপ্পাগান বেঁধেছিলেন, যার পঙ্ক্তি— ‘তুমি মারিলে মারিতে পারো, তবে রাখিতে কে করে মানা’। বয়ান নারীর ভাবলে ‘প্যারাডক্স’! যেন দয়া করে সহ্য করা ‘অনুগতজনে’। যেন ‘বিনা অপরাধে বধ’ হওয়ার নিমিত্তেই তার জন্ম। যেন সত্যিই ‘মারিলে মারিতে পারো’।
কিন্তু কে অনুগত? কেন অনুগত? কিসের আনুগত্য? ‘কর্তা বলে সবাই মানে’ ভাবার যুগ আজও? ‘অর্ধেক আকাশ’ নামের গ্যাসবেলুন হাতে ধরিয়ে দেওয়ার অধিকার কে দিয়েছে? হাতে কী রয়েছে অর্ধেক আকাশের? কিছু স্বর ওঠা মানেই শ্রেয় প্রতিষ্ঠিত, নয় মোটেই। স্বর কোথায় গ্রামীণ মেয়ের? গ্রামেই তো অধিকাংশের বাস। তাঁদের ‘মালিক’ আজও পুরুষ। নিদানদাতা আজও খাপ পঞ্চায়েত। আজও তাঁদের কাজ, ব্রতপালন— সামাজিক, পারিবারিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক ব্রত।
ছোটবেলা থেকে মাকে কত কিসিমের ব্রত করে যেতে দেখা। শিবরাত্রি, বিপত্তারিণী, হাজারো ষষ্ঠী, কত কী। আলসার-আশিসধন্য সেই সব উপোসি ব্রতগুলি অন্যদের জন্যই। স্বামী-সন্তানের জন্য। নিজের জন্য কেন একটাও ব্রত রাখা গেল না? কেন বাবা-মামা-কাকা-পিসে-মেসো ব্রত করল না মা-মামি-কাকিমা-পিসি-মাসির জন্য? আমায় করতে হল না কেন? ব্রতের দায় ‘অনুগতজনের’? আশি-পেরোনো মা এখন সারা ক্ষণ বাংলা সিরিয়াল দেখে, আর কোনও এপিসোডে ব্রতপালনে ‘ত্রুটি’ দেখলেই মুখে ভেসে ওঠে অদ্ভুত হাসি। কখনও-সখনও মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে— ‘ধুস! ও ভাবে নয়!’
এই মা, আমার মা, কী চমৎকার গান গাইত! কোথায় গেল সেই গান? ভোর পাঁচটায় উঠে উনুনে ঘুঁটে-কয়লা সাজাতে সাজাতে, আপিসবাবুদের ভাত রাঁধতে রাঁধতে, দুপুরে নারকেলপাতা থেকে ঝাঁটা তৈরি করতে করতে, রাতে ঘুমডুবন্ত চোখেও তখনও বাড়ি না-ফেরা রোজগেরে বা বেকার পুং-সদস্যদের জন্য রুটি-তরকারি নিয়ে বসে থাকতে থাকতে কোথায় উবে গিয়েছে সেই সব গান! কদাচিৎ হারমোনিয়ামে বসলে শুনতে হয়েছে— ‘বৌ কি সন্ধ্যা মুকুজ্জে হবে?’ সমে ফেরেনি কোনও প্রতিস্বর। কপাল বা দেওয়ালের ফোঁটারাও নীরব থেকেছে।
নিধুবাবুর সে গানের শুরু— ‘অনুগতজনে কেন করো এত প্রবঞ্চনা’। আগমার্কা প্রেমের গান। আনুগত্য অসহ্য হলেও ‘অনুগতজনে’র ব্যবহার হয়তো প্রেমার্থেই। তবু মোক্ষম প্রশ্নটি রেখে গিয়েছেন রামনিধি— কেন করো এত প্রবঞ্চনা? প্রিয় গান। জানা নেই কেন, লালচাঁদ বড়ালের রের্কড-বয়ানে সে গান গড়ায় যত, টপ্পার উচ্চাবচতায় দাসপ্রথার মুখোমুখি রুখে দাঁড়ানো তীক্ষ্ণ গর্জনগন্ধ জেগে ওঠে।
‘যমুনাবতী সরস্বতীগেছে এ পথ দিয়ে’
মানুষি ভাবনা কি আজ এই সুন্দর বন্ধনের লগ্নে নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ দেবে? ক্ষমা, সমাজের সচেতন অংশ হয়ে না উঠতে পারার জন্য। ক্ষমা, গ্রাম-প্রত্যন্তে নিরন্তর ঘটে চলা অত্যাচারকে শহুরে নির্দশনের মুখাপেক্ষী করে তোলার জন্য। ক্ষমা, জ্ঞানে-অজ্ঞানে প্রেমহীন পুরুষত্বের সাড়ম্বর বিঘোষণার জন্য। ক্ষমা, বিচ্ছেদ, অসম্মাননা, অবজ্ঞার জন্য। ক্ষমা, শক্তের অপরাধ আড়াল করার জন্য, চুরিকে অধিকার ভাবার জন্য, ঔদ্ধত্যকে করুণা ভাবানোর জন্য। ক্ষমা, রাজধর্মহীন রাজনীতির জন্য, দিশাহীন নেতৃত্বের জন্য, কুশলতাহীন কৌশলের জন্য, সত্যহীন ঢক্কানিনাদের জন্য, বিদ্যাবিহীন গৌরব-বিলাসের জন্য, মুষ্টিহীন কামনার জন্যও।
আজ হেমন্তের এই নির্জনতায় শিশির ঝরে পড়া নিয়ে নরম কাব্যটি যে করে ওঠা যাচ্ছে না, তার দায় আমাদেরই। উপন্যাসের চরিত্র বা রুপোলি পর্দার সংলাপ যে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠছে না, তার দায় আমাদের। কোনও গান যে সুরে বাজছে না, নীরক্ত কোলাহলে পর্যবসিত হচ্ছে, এড়াতে পারি না তার দায়। উন্নাসিক উদাসীনতায় নিত্যবলি গ্রাম-শহরের সব তিলোত্তমা। এক দিনে হয়নি, হয় না। টোটো-অটো-বাস-ট্রেন-রাস্তায়, রেস্তরাঁয়, শিক্ষায়তনে, কর্মক্ষেত্রে, পরিবার সঞ্চালনায়— সর্বত্র ঘনিয়ে তোলা ছোট-বড় ঔদ্ধত্যের ক্ষমা হবে?
সন্ধিঋতুর ছাতিমের মতোই সুগন্ধি এক সংশোধনের পরিসরআজ এই সঙ্কল্পের উৎসব। ‘দাদা, আমি কিন্তু বাঁচতে চেয়েছিলাম’— শুধু এক অবিস্মরণীয় সংলাপ হয়েই রয়ে যাবে? বাস্তবে বাঁচতে-বাঁচাতে পারার মতো বাসযোগ্য পৃথিবী তৈরি জরুরি নয়?