এক স্মরণসভায় প্রায় একশো বছর আগে স্বর্ণকুমারী দেবী জানিয়েছিলেন, “...এরূপ প্রতিভাশালী ব্যক্তির যেরূপ অভ্যর্থনা পাওয়া উচিত ছিল, তাহা তিনি পান নাই। ইহাতে আমাদেরই জাতীয় দৈন্য প্রকাশ পাইতেছে।” মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের পঞ্চম পুত্র জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুর পর তাঁর সম্পর্কে বলা মহর্ষি-কন্যা স্বর্ণকুমারীর কথাটি আজও সত্যি। একাধারে নাট্যকার-অনুবাদক-চিত্রশিল্পী-সঙ্গীতস্রষ্টা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের অসামান্য কৃতির সার্বিক মূল্যায়ন হয়নি বললেই চলে। তিনি তাঁর প্রিয় রবির রশ্মিছটা আড়ালে বুঝি একটু ঢাকাই পড়েছেন।
১৮৪৯ সালের ৪ মে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জন্ম এমন এক পরিবারে, বাংলার সারস্বত সাধনায় যাঁদের অবদান প্রশ্নাতীত। ধরাবাঁধা শিক্ষায় মন ছিল না জ্যোতিরিন্দ্রনাথের। পারিবারিক গুরুমশাই, সেন্ট পল’স স্কুল, মন্টেগু’জ় অ্যাকাডেমি, হিন্দু স্কুল, কেশবচন্দ্র সেনের ক্যালকাটা কলেজ পেরিয়ে শেষে প্রেসিডেন্সি কলেজ। পাঠ সমাপ্ত না করেই মেজদা সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে চলে যান মুম্বই। তবে বিদ্যাচর্চা অব্যাহত ছিল। বিভিন্ন ইংরেজি, সংস্কৃত বই পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সত্যেন্দ্রনাথের কাছে শিখলেন ফরাসি ভাষা, আর এক মুসলমান ওস্তাদের কাছে সেতার। মুম্বই থেকে ফেরার পর আঠারো বছরের জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সেতার শুনে সকলে মুগ্ধ। কৈশোর-উত্তীর্ণ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বিবিধ সারস্বত চর্চায় মনোনিবেশ করলেন।
সঙ্গীতানুরাগী মহর্ষি, দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ-সত্যেন্দ্রনাথের চর্চা আর গায়ক বিষ্ণু চক্রবর্তী, যদুভট্ট, মৌলাবক্সের গানের আবহে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সঙ্গীতবোধ গড়ে উঠেছিল। প্রথমে হারমোনিয়াম রপ্ত করলেন, তার পর দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথের পিয়ানোয় হাত পাকিয়ে গানও বাঁধলেন। রবীন্দ্রনাথের কথায়: “এক সময়ে পিয়ানো বাজাইয়া জ্যোতিদাদা নূতন নূতন সুর তৈরি করায় মাতিয়াছিলেন।” বা “জ্যোতিদাদা প্রায় সমস্ত দিন ওস্তাদি গানগুলাকে পিয়ানো যন্ত্রের মধ্যে ফেলিয়া তাহাদিগকে যথেচ্ছা মন্থন করিতে প্রবৃত্ত ছিলেন।” আর তখন সঙ্গী রবীন্দ্রনাথ ও বন্ধু অক্ষয় চৌধুরীর সদ্যোজাত সুরগুলিকে কথা দিয়ে বাঁধার চেষ্টা করতেন। রবীন্দ্রনাথের গান তৈরির শিক্ষানবিশি এই ভাবেই শুরু। বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায়ের ‘জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবন-স্মৃতি' অনুযায়ী ‘বাল্মীকিপ্রতিভা’র প্রায় সব সুর জ্যোতিরিন্দ্রনাথের। তবে রবীন্দ্রনাথের কথা বা অন্যান্য সূত্র অনুযায়ী, ‘প্রায় সব’ নয়, অনেকগুলি গানের সুরকার জ্যোতিরিন্দ্রনাথ।
সঙ্গীত-রচনায় জ্যোতিরিন্দ্রনাথের কাছে অনুপ্রাণিত রবীন্দ্রনাথ চমৎকার সঙ্গীতময় সময় কাটিয়েছিলেন তাঁর জ্যোতিদাদা ও নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবীর সঙ্গে। সেই স্নেহশীলা কাদম্বরী হঠাৎ আত্মহত্যা করেন। রটেছিল, কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুর পর জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্কের অবনতি হয়। এ কথা ঠিক নয়। ক???????াদম্বরী দেবীর মৃত্যুর এক মাসের মধ্যে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তাঁর স্টিমার ‘সরোজিনী’তে বরিশাল যান, সঙ্গী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তা ছাড়া, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ চিরকাল তাঁর জীবনস্মৃতি বা অপ্রকাশিত ডায়েরিতে বার বার প্রিয় রবির কথা বলেছেন।
পিতা এবং অগ্রজ সহোদরদের অনুসরণে গান রচনা করলেও জ্যোতিরিন্দ্রনাথের গানে বৈচিত্র অনেক। ছোটবেলা থেকে শুনে-আসা উচ্চাঙ্গসঙ্গীত যেমন কাজে লাগিয়েছেন, তেমনই পাশ্চাত্য সঙ্গীতকেও অকপটে গ্রহণ করেছেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সুরের একটি বৈশিষ্ট্য তাল-ফেরতা, লয়-বদল, সেই সঙ্গে বিদেশি সঙ্গীতের কর্ড-ব্যবহার। তিনি যথার্থই মনে করতেন, “আমাদের সঙ্গীতে গান বিশেষে, স্থান বুঝিয়া, সুর-পুঞ্জের ঐক্যধ্বনি (কর্ড) অথবা ‘ছেড়’ প্রয়োগ করিলে যে ক্ষতি হয়, এরূপ বোধ হয় না— বরং উহার দ্বারা সৌন্দর্যের আরও বিকাশ হইতে পারে।” ব্রহ্মসঙ্গীত ‘ধন্য তুমি ধন্য’ তাঁর এমনই একটি অসামান্য কম্পোজ়িশন— মূলত দশ মাত্রার ঝাঁপতালের গান, সঞ্চারীতে আসে চার মাত্রার কাওয়ালির ছন্দ, কর্ড-প্রয়োগেও মুনশিয়ানার পরিচয়। প্রেমের গান, ‘কৈ এল, কৈ এল’ ভৈরবী আশ্রিত, কিন্তু সুরের চলনে অভিনবত্ব আছে। রাগের নির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যেই ‘আহা কি চাঁদনী রাত’ লয়ের বিশিষ্টতায় উচ্ছ্বাসময়। রাগ-ছাপানো মাধুর্য রয়েছে ‘মন চুরি করিল’-তে। পাশাপাশি প্রথাবদ্ধ ভাবে বিভিন্ন রাগরাগিণীতে ধ্রুপদ, খেয়াল, টপ্পা অঙ্গের গান রচনা করেছেন, বন্দিশ ভেঙে গান তৈরি করেছেন। একটি সুপরিচিত ভাঙা গান, পঞ্জাবি টপ্পা, ‘ও মিঞা বেজনুওয়ালে’ থেকে ‘হে অন্তর্যামী’। তা ছাড়া উল্লেখযোগ্য ব্রহ্মসঙ্গীত, ‘ওই যে দেখা যায়’, ‘ধন্য তুমি হে’। রাগসঙ্গীতের সঙ্গে পাশ্চাত্য আঙ্গিক মেশা সার্থক সৃষ্টি, দেশাত্মবোধক, ‘চল রে চল সবে’ শঙ্করা রাগে রচিত অথচ ছন্দে বিদেশি মার্চিং সং-এর ধাঁচ। ঝিঁঝিট রাগের সঙ্গে ইটালিয়ান ছন্দ মিলিয়ে সুর করলেন তাঁর ‘অশ্রুমতী’ নাটকের ‘প্রেমের কথা আর বোলো না’, গানটির লেখক অবশ্য অক্ষয় চৌধুরী। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বিভিন্ন ঐতিহাসিক নাটক (পুরুবিক্রম, সরোজিনী, স্বপ্নময়ী), গীতিনাট্য (মানময়ী, পুনর্বসন্ত, বসন্তলীলা) বা প্রহসনে নিজের গান ছাড়াও রবীন্দ্রনাথ ও অন্যদের গান এই ভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। বিশেষ উল্লেখ্য রবীন্দ্রনাথের ‘জ্বল জ্বল চিতা’। ‘সরোজিনী’-তে রাজপুত মহিলাদের চিতাপ্রবেশের দৃশ্যে একটি গদ্যের বদলে কিশোর রবীন্দ্রনাথ চটজলদি এই গানটি লিখে সকলকে চমৎকৃত করেন। ‘পুরুবিক্রম’-এ ছিল সত্যেন্দ্রনাথের বিখ্যাত স্বদেশবোধক গান ‘মিলে সবে ভারতসন্তান’।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বিভিন্ন প্রহসন-নাট্যে সহজে উৎসারিত হয়েছে নির্মল কৌতুক-গীতি: ‘পদী রে! তবু আমি আছি তোর’ (কিঞ্চিৎ জলযোগ) বা ‘গা তোলো রে, নিশি অবসান, প্রাণ’ (অলীকবাবু)। ‘কিঞ্চিৎ জলযোগ’-এ স্ত্রী-স্বাধীনতার বিপক্ষে বললেও সত্যেন্দ্রনাথের প্রভাবে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সংস্কারমুক্ত হন। স্ত্রীকে ঘোড়ায় চড়া শিখিয়ে মাঝে মাঝে এক সঙ্গে ঘোড়ায় চড়ে গড়ের মাঠ পর্যন্ত যেতেন।
বাংলা সঙ্গীতজগতে তাঁর সবচেয়ে বড় অবদান সর্বজনবোধ্য ‘আকারমাত্রিক স্বরলিপি’র উদ্ভাবন— যার প্রসার ঘটান তাঁর ‘স্বরলিপি গীতিমালা’-র মধ্য দিয়ে— আজও তাই অনুসৃত হয়ে আসছে। ‘বীণাবাদিনী’ বা ‘সঙ্গীত প্রকাশিকা’-র মতো সঙ্গীত পত্রিকাও সম্পাদনা করেছেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ।
গান এবং অভিনয়েও তাঁর পারদর্শিতার পরিচয় মেলে। পণ্ডিত রামনারায়ণ তর্করত্নের ‘নবনাটক’-এ ‘নটী’ চরিত্রে অভিনয়ের সঙ্গে সঙ্গে কনসার্টে হারমোনিয়ামও বাজিয়েছিলেন। এমন নিঁখুত সেজেছিলেন যে, এক বিদেশি অতিথি, হাইকোর্টের বিচারপতি, কনসার্ট দেখতে ঢুকে নারীবেশী জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে দেখে ‘বেগ ইয়োর পারডন, জেনানা জেনানা’ বলে অপ্রতিভ হয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। নিজের বিভিন্ন নাটক অভিনীত হয়ে সুখ্যাত হলেও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ যখন দেখলেন গিরিশচন্দ্র ঘোষ ক্রমশ পরিব্যাপ্ত হচ্ছেন, ‘নাটক-রচনা যোগ্যতর ব্যক্তির হস্তে ছাড়িয়া দিয়া, সাহিত্যসেবার অন্য পন্থা অবলম্বন’ করলেন। তাঁর সাহিত্যসেবার একটি বিশেষ দিক অনুবাদকর্ম। তার বিস্তৃতিও বিস্ময়কর। সংস্কৃত থেকে কালিদাসের ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলা’, শূদ্রকের ‘মৃচ্ছকটিক’, বিশাখদত্তের ‘মুদ্রা-রাক্ষস’, ইংরেজি থেকে শেক্সপিয়রের ‘জুলিয়স্ সীজার’। ফরাসি থেকে প্রহসন— মোলিয়েরের ‘হঠাৎ-নবাব’, উপন্যাস— গোতিয়েরের ‘অবতার’। জীবনের শেষ পর্বে স্বচ্ছন্দ অনুবাদ করেছিলেন আলফাঁস দোদে, পুশকিন, এমিল জ়োলা প্রমুখের গল্প, যা বেরিয়েছিল ‘ভারতী’, ‘প্রবাসী’ প্রভৃতি পত্রিকায়। সাহিত্যের প্রসারে তৈরি করেছিলেন ‘বিদ্বজ্জন সমাগম’, ‘কলিকাতা সারস্বত-সম্মিলনী’, সঙ্গীতের জন্য ‘ভারত সঙ্গীত-সমাজ’।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ প্রায় আমৃত্যু চিত্রকলার চর্চা করেছেন। এঁকেছেন নামী-অনামী বহু মানুষের সতেরোশো অবিকল প্রতিকৃতি, রবীন্দ্রনাথের সর্বাধিক। শিকারেও উৎসাহ ছিল। আবার নীলচাষ, জাহাজ-চালানোর ব্যবসা করেছেন উদ্যম নিয়ে।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর রাঁচির মোরাবাদি পাহাড়ে বাড়ি তৈরি করে শেষ জীবন সেখানেই কাটান। প্রয়াত হয়েছেন ১৯২৫-এর ৪ মার্চ। তাঁর শেষ জীবনের স্মৃতিধন্য এই পাহাড়টি লোকমুখে ‘টেগোর হিল’ সুপরিচিত হয়ে উঠেছিল।