স্মরণীয়: আনে ফ্রাঙ্ক, ১৯৪১ সালের ছবি। ডান দিকে, লাল ডায়েরির পাতায় আনের লেখা ও ছবি। নীচে, ১৯৪৭ সালের ২৫ জুন প্রকাশিত প্রথম ডাচ সংস্করণ ‘হেট্ আখ্ট্যারহ্যাইস্’-এর প্রচ্ছদ। সৌজন্য: উইকিমিডিয়া কমন্স
মেয়েটা দু’বছর ঘরবন্দি ছিল। ঘরবন্দি ছিলাম তো আমরাও, এই সে দিনও, যখন অতিমারি দাপাচ্ছিল ঘরে-বাইরে। আমাদেরও দুটো বছর পেরিয়েছে দুঃখতাপে ব্যথিত চিতে। কিন্তু মেয়েটার পরিস্থিতি ছিল আরও ভয়ঙ্কর। কারণ তাকে গা-ঢাকা দিয়ে থাকতে হচ্ছে দুটো বছর, বাইরে দাপাচ্ছে হিটলারের নাৎসি বাহিনী। সেনার গাড়ি, পুলিশের বুটের তাও আওয়াজ পাওয়া যায়, কিন্তু জার্মান খপ্পরে পড়ে যাওয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এই আমস্টারডাম শহরে কে চর, কে-ই বা খোঁচড়, সেও কি জানার উপায় আছে? যুদ্ধ ঘরকেও পর করে— যদিও ডাচ সরকার ঘোষণা করেছে দেশের মানুষের, বিশেষত ইহুদিদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে শত্রুর হাতে তুলে দেওয়া ‘চরম অপরাধ’ বলে গণ্য হবে, কিন্তু কথা হল, সেই সরকারই বা আছে কোথায়? জার্মান অধিগ্রহণে নেদারল্যান্ডস থরহরিকম্প, ইহুদিদের ধরপাকড় অত্যাচার চালান থেকে অন্তর্ধান, সবই চলছে চারিদিকে।
তাই আনে ফ্রাঙ্ক, তেরো বছরের ইহুদি কিশোরী, আত্মগোপন করল ‘গুপ্ত মহল’-এ। সঙ্গী আরও সাত জন: বাবা ওটো ফ্রাঙ্ক, মা এডিথ, দিদি মার্গট, আর ফান পেলস পরিবার (বাবা-মা আর পিটার নামের কিশোর ছেলেটি), ফ্রিৎজ় ফেফার নামে আরও এক পরিচিতজন। সবাই ইহুদি। আমস্টারডাম শহরের কেন্দ্রেই ওটোর কাজের জায়গা— অফিসবাড়ি ও গুদামঘর— কর্মীরা কাজে আসেন হপ্তাভর। সেই বাড়িরই উপরের একটা দিকে, সিঁড়ি দিয়ে উঠে একটা সাদামাটা বুকশেলফ। তার পিছনেই লুকোনো একটা অংশ: ঘর বাথরুম এটা-ওটা মিলিয়ে জায়গাটা বিরাট বড় নয়, তবে ছোটও নয় খুব। এটাই আনের ভাষায় ‘হেট আখ্ট্যারহ্যাইস্’— ‘সিক্রেট অ্যানেক্স’— ‘গুপ্ত মহল’। ৬ জুলাই ১৯৪২ থেকে ৪ অগস্ট ১৯৪৪, দু’বছরেরও বেশি সময় আটটি মানুষের ‘অজ্ঞাতবাস’-এর ঠিকানা।
কেমন সে থাকা? কল্পনা করতেও গা শিউরে ওঠে। আটটা লোক থাকছে, খাচ্ছে, ঘুমোচ্ছে, কথা বলছে, কিন্তু কোনও শব্দ করা যাবে না। অন্তত সকালের দিকে ও দিনভর কোনও ভাবেই না, লোকে কাজ করতে আসে, হাজারটা বাইরের মানুষেরও নিত্য আসাযাওয়া। চেনা, বিশ্বস্ত কর্মীদের মারফতই খাবারদাবার আর অন্য জিনিসপত্র আসে লুকিয়ে, যুদ্ধের বাজারে প্রয়োজনের তুলনায় সামান্যই তা। সে হোক, কিন্তু ফিসফিসিয়ে ছাড়া কথা নেই, জানলার পাশে বা কাছে ভুলেও নিজের ছায়া পর্যন্ত দেখা না যায়, কী ভাবে সম্ভব? বাথরুমে কলের আওয়াজ, জলের শব্দটুকুও হবে না? সম্ভব— যখন যুদ্ধ চলে। যখন প্রাণ বাঁচানোটুকুই প্রথম ও শেষ শর্ত হয়ে দাঁড়ায় অস্তিত্বের। সম্ভব, যখন এই কালবেলায় মনের সব কথা, সব ভাবনা ভাগ করে নেওয়ার একটা কেউ থাকে। সেই ‘কেউ’ হয়তো মানুষ নয়, ‘কিছু’। একটা ডায়েরি— লাল রঙের, খোপ-কাটা মলাট, ১৯৪২-এর ১২ জুন তার তেরো বছরের জন্মদিনে উপহার পেয়েছিল আনে। লুকিয়ে থাকার ওই দু’বছরে প্রথমে সেই ডায়েরিতে, পরে ইস্কুলের খাতায়, তারও পরে স্রেফ সাদা কাগজে মনগড়া ‘ডিয়ারেস্ট কিটি’কে উজাড় করে দিয়েছিল সব।
আজ আমরা ‘দেশভাগ সাহিত্য’ পড়ি আলাদা করে, ‘পার্টিশন লিটারেচার’ নিয়ে কত সভা, সন্দর্ভ। দেশভাগ আমাদের মনে ও মননে যে অনপনেয় ছাপ ফেলেছে, ইউরোপে একই রকম প্রভাব ‘হলোকস্ট লিটারেচার’-এরও। সাহিত্য বলা হলেও, আসলে তা ইতিহাসও— জীবনের, সময়ের। এই হলোকস্ট লিটারেচার-এর শীর্ষবিন্দু ‘দ্য ডায়েরি অব আ ইয়ং গার্ল’, আনে ফ্রাঙ্কের ডায়েরি, বলাটা অত্যুক্তি নয়।
১৯৪৭ সালের ২৫ জুন বেরিয়েছিল বইটা। ডাচ ভাষায় লেখা, ‘হেট আখ্ট্যারহ্যাইস্’। গতকাল পেরিয়ে গেল সেই দিন, ৭৫ পূর্ণ হল প্রথম প্রকাশের। ডাচ ভাষার ওই শব্দদুটোর মানে আগেই লেখা হয়ে গিয়েছে— ‘সিক্রেট অ্যানেক্স’, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ভাষান্তরে ‘গুপ্ত মহল’ (‘আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরী’, ১৯৫৯)। বইয়ের নাম কি পাল্টে গেল তবে? ‘হেট্ আখ্ট্যারহ্যাইস্’ একেবারেই অজানা, ‘সিক্রেট অ্যানেক্স’ও অশ্রুতপূর্ব, সারা বিশ্ব বইটাকে চেনে ইংরেজিতে ‘দ্য ডায়েরি অব আ ইয়ং গার্ল’ নামে, ১৯৫২ সালে তা বেরিয়েছিল ইংরেজিতে, ব্রিটেন ও আমেরিকায়, দুই দেশে দুই সংস্করণ। এই ইংরেজি নামটাই থেকে গিয়েছে, ছড়িয়ে পড়েছে, হয়ে উঠেছে কিংবদন্তিপ্রতিম। এ বছরটা, এবং বিশেষত এই জুন মাসটা আক্ষরিক অর্থেই ঐতিহাসিক: আনে ফ্রাঙ্কের ডায়েরির প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশের পঁচাত্তর, প্রথম ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশেরও সত্তর বছর পূর্তি হল।
ইংরেজিতে বা বাংলায় বইটা প্রায় সবার পড়া। সত্তরেরও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে আনে ফ্রাঙ্কের ডায়েরি, যুদ্ধ প্রাণহানি মানবাধিকার-ভঙ্গের এই কৃষ্ণকালেও সমান প্রাসঙ্গিক। আনে লেখা শুরু করেছিল তেরো বছরের জন্মদিনের পরে, যখন খাতায় শেষ লেখাটি লিখছে তখন সে পনেরো। বইটা জানা, কিন্তু অনেকেই জানেন না পরের ঘটনাক্রম: ১৯৪৪-এর ৪ অগস্ট গেস্টাপো এসে গুপ্ত মহল থেকে গ্রেফতার করে ধরে নিয়ে যায় আট জনকেই, সেপ্টেম্বরে আনেদের পরিবারকে পাঠানো হয় অউশভিৎজ় কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে, নভেম্বরে মার্গট আর আনেকে পাঠানো হয় জার্মানির বের্গেন-বেলসেন কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে, কয়েক মাস পর সেখানেই মৃত্যু হয় দুজনেরই। বন্দিশিবিরে দুঃসহ জীবনের দোসর হয়ে এসেছিল টাইফাস মহামারি, সেটাই মৃত্যুর কারণ, বলছে ইতিহাস। মা এডিথেরও মৃত্যু হয়েছিল, অউশভিৎজ় সয়েও বেঁচে ফেরেন একমাত্র ওটো ফ্রাঙ্ক, সব-হারানো হতভাগ্য পিতা।
নাৎসিরা আনেদের ধরে নিয়ে গেলেও, ফেলে গিয়েছিল আনের লেখা ডায়েরি, খাতা, কাগজগুলো। ভাগ্যিস! আরও ভাগ্য, অফিসবাড়ির এক সহায়িকা, মিপ গিজ়, তুলে রেখেছিলেন আনের সব লেখাপত্তর। ‘হেট আখ্ট্যারহ্যাইস্’ বা তারও পরের ‘দ্য ডায়েরি অব আ ইয়ং গার্ল’ হতেই পারত না, যদি না এই মানুষটি আনের লেখাজোখা সযত্নে গুছিয়ে রাখতেন নিজের কাছে, তারও বড় কথা: যদি না ওটো ফিরে এলে তাঁর হাতে তুলে দিতেন সব!
বাবা তো মেয়ের লেখার কথা জানতেন। কিন্তু যুদ্ধের পরে, মেয়েকে হারিয়ে মেয়ের লেখা পড়তে পারাটা একটা অসম্ভব কাজ। ওটো গোড়ায় পারেননি। যখন পারলেন, একটা দিগন্ত খুলে গেল। ঠিক হল প্রকাশকের কাছে পাঠানো হবে, যদি বই আকারে বার করা যায়। খুব সহজ বা সুখের হয়নি সে অভিজ্ঞতা। এমন ছাপ ফেলে গিয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, মানুষ আর অতীতের দিকে তাকাতে চাইছে না। তারও বড় কথা, ফেলে আসা সময়ের দিকে তাকানো মানে তখন অনেক হিসাব বুঝে নিতে চাওয়া: বিশ্বাসভঙ্গের হিসাব, এর জীবনের মূল্যে ওর বেঁচে যাওয়ার হিসাব। কে চায় সেই কবর খুঁড়তে?
তবু ‘হেট আখ্ট্যারহ্যাইস্’ বেরোল। ১৯৪৭-এর জুন সংস্করণে ৩০৩৬ কপি। দেশের নিরিখে ভাবলে খুব বড় সংখ্যা নয়। সে বছরেই ডিসেম্বরে ৬৮৩০ কপি, পরের ফেব্রুয়ারিতে ১০৫০০। ১৯৫০-এ ফ্রান্স ও জার্মানিতে দুই ভাষার সংস্করণ প্রকাশিত হল, ফরাসি সংস্করণটা হাতে আসে আমেরিকান লেখক-সাংবাদিক মেয়ার লেভিন-এর। আমরা ইতিহাস থেকেও স্রেফ পছন্দটুকু ছেঁকে নিয়ে নাড়াচাড়া করি, তাই মেয়ার লেভিনকে মনে রাখিনি। মনে রাখলে জানতাম, আজ যে ‘দ্য ডায়েরি অব আ ইয়ং গার্ল’ বইটা ঘরে ঘরে, তার জনপ্রিয় ‘হয়ে ওঠা’র পিছনে এই মানুষটির কৃতিত্ব অনেকখানি। আনে ফ্রাঙ্কের ডায়েরি ছিল মেয়ার-এর ‘অবসেশন’, এই লেখা তিনি মঞ্চে আনতে চেয়েছিলেন, কারণ মঞ্চে নাট্যরূপে আনের জীবনের চুম্বকে হলোকস্ট-এর ইতিহাস তুলে ধরে মানুষের মনে ঘা দেওয়ার এর চেয়ে সদুপায় আর কী-ই বা হতে পারে। ওটোর সঙ্গে তিনি গোড়ায় এই নাট্যরূপ নিয়ে বসেছিলেন, স্ক্রিপ্টও লেখা হয়, কিন্তু পরে মতবিরোধ ঘটে, এমনকি ব্যাপার গড়ায় আদালতেও। আগ্রহী পাঠক পড়তে পারেন মেয়ার লেভিন-এর ‘দ্য অবসেশন’ নামের চমৎকার বইটি, আনের জীবন সত্যিই ছিল তাঁর ‘অবসেশন’।
নাটকটা হয়েছিল। অন্য দুই স্ক্রিপ্ট-লেখক— ফ্রান্সেস গুডরিচ ও অ্যালবার্ট হ্যাকেট-এর হস্তক্ষেপে। প্রথম অভিনয় ১৯৫৫ সালের ৫ অক্টোবর, নিউ ইয়র্কের মঞ্চে। তার তিন বছর আগেই ১৯৫২ সালে আমেরিকায় বেরিয়েছে ‘দ্য ডায়েরি অব আ ইয়ং গার্ল’, জনা দশ প্রকাশকের প্রত্যাখ্যানের পরে ‘ডাবলডে’ প্রকাশনা সংস্থা ছেপেছিল (ভূমিকা লিখেছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যিনি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট সেই ফ্রাঙ্কলিন রুজ়ভেল্টের স্ত্রী, ইলিনর রুজ়ভেল্ট)। আজ ভাবলে আশ্চর্য লাগে, এমনকি রাগও হয়, এই বইও প্রকাশক পায়নি? কিন্তু তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়াটুকু সরিয়ে সেই সময়ের আয়নার সামনে দাঁড়ালে অনুমান করা যায় প্রত্যাখ্যানের কারণও: ‘হলোকস্ট’ ঠিক কী, ঠিক কী হয়ে গিয়েছে কয়েকটা বছর আগে ইউরোপের দেশগুলোয়, আমেরিকা-সহ বাকি বিশ্ব তার খবরটুকুই জানে তখন, অভিঘাতটা জানে না। একটা মেয়ে ঘরের মধ্যে লুকিয়ে থেকে ডায়েরি লিখছে, তাতে বাইরে যা ঘটছে তা বোঝা যাচ্ছে বটে কিন্তু তত বোঝা যাচ্ছে না কারণ এতে রক্ত-হত্যা-অত্যাচারের বীভৎসতা নেই, আশঙ্কা আতঙ্ক আছে বটে তবে খুল্লমখুল্লা নয় বরং লেখার মধ্যে মজা হাসি খেলা খুনসুটির বর্ণনা মায় প্রেম-প্রেম রেশও পাওয়া যাচ্ছে— এমন বইয়ের গুরুত্ব ১৯৫২-র আমেরিকান প্রকাশকের বুঝে ওঠা কঠিন ছিল।
বইয়ের কাজটা সহজ করে দিয়েছিল ব্রডওয়ের থিয়েটার— ‘দ্য ডায়েরি অব অানে ফ্রাঙ্ক’। ১৯৫৫-৫৭, দু’বছরে ৭১৭ অভিনয় হয়েছিল, গোটা আমেরিকা সফর করেছিল এ নাটক, পেয়েছিল পুলিৎজ়ার, টোনি অ্যাওয়ার্ড, নিউ ইয়র্ক ড্রামা ক্রিটিক সার্কল অ্যাওয়ার্ড। নাটকের গুণে প্রবল জনপ্রিয়, ‘বেস্টসেলার’ হয়ে উঠেছিল ইংরেজি বইটা। এই নাটক ভিত্তি করেই ১৯৫৯-এ জর্জ স্টিভেন্স ছবি বানালেন হলিউডে। মিলি পারকিন্স অভিনয় করেছিলেন আনের চরিত্রে, গোড়ায় কথা হয়েছিল অড্রে হেপবার্ন করবেন (অড্রে ও আনে সমবয়সিও, আর অদ্ভুত সমাপতন, দুজনেরই কৈশোর কেটেছিল নাৎসি-অধিকৃত নেদারল্যান্ডসে)। তিনটে অস্কার জিতেছিল ছবিটা, ছিল কান ফিল্মোৎসবের পাম দ’র মনোনয়নেও।
সৌজন্য: উইকিমিডিয়া কমন্স
আজ আমরা ‘দ্য ডায়েরি অব আ ইয়ং গার্ল’ নামের ইংরেজি বইটা পড়ি বটে, কিন্তু খবর রাখি না, ওটাই আনে ফ্রাঙ্কের মূল লেখার ভিত্তিতে প্রকাশিত বই নয়। তার মানে কী? আনে প্রথম লেখা শুরু করেছিল উপহার পাওয়া লাল হার্ডব্যাক ডায়েরিটায়, তাতে ধরা আছে ১৯৪২-এর ১২ জুন থেকে ৫ ডিসেম্বর অবধি লেখা। একটা ডায়েরি তো যথেষ্ট নয়, আনে তার পর লেখে স্কুলের দুটো খাতায়, তাতে ধরা আছে যথাক্রমে ১৯৪৩-এর ২২ ডিসেম্বর থেকে ১৯৪৪-এর ১৭ এপ্রিল, আবার ১৯৪৪-এর ১৭ এপ্রিল থেকে ১ অগস্ট পর্যন্ত লেখা। এ ছাড়াও বিস্তর লেখালিখি আছে, স্রেফ সাদা কাগজে, যাকে আমরা ‘লুজ় শিট’ বলি। সেটা কী ব্যাপার? লুকিয়ে শোনা রেডিয়োয় আনের কানে এসেছিল লন্ডন থেকে নেদারল্যান্ডসের মন্ত্রীর আহ্বান, তিনি বলেছিলেন যুদ্ধের সময় ডাচ নাগরিকদের যা কিছু লেখা সব গুছিয়ে রাখতে, তা থেকে পরে বোঝা যাবে সময়টা আসলে কেমন ছিল। খবর শুনে দারুণ উদ্বুদ্ধ হয় আনে, নিজেরই লেখা লাল ডায়েরি আর দুটো স্কুলের খাতার অনেক লেখা নিজেই ‘এডিট’ করা শুরু করে। সেই অংশগুলোই সে লিখেছিল ওই সাদা কাগজে। চোদ্দো বছরের একটা মেয়ে কী যে অনবদ্য কাজ করেছে! নিজেরই পুরনো লেখা নিয়ে বসে সাজিয়েছে নতুন করে, বিভিন্ন তারিখের বিভিন্ন লেখা কখনও নিয়ে এসেছে একটা লেখার মধ্যে, কখনও ছোট করেছে, কখনও বাদ দিয়েছে কোনও অংশ। নিজেই তৈরি করেছে নিজের ডায়েরির ‘সম্পাদিত’, ‘দ্বিতীয়’ রূপ। জরুরি তথ্য: ১৯৪৩-এর ডায়েরি অংশটা লেখা ছিল যে স্কুলের খাতায়, ফ্রাঙ্ক পরিবার গ্রেফতার হওয়ার পর তালেগোলে সেটা হারিয়ে যায়, খুঁজে পাওয়া যায়নি। কিন্তু ওই অংশেরই সম্পাদিত রূপ, যা আনে সেই সাদা কাগজে লিখে রেখেছিল, সেগুলো অক্ষত ছিল। সে কারণেই ইংরেজি বা বাংলা বইয়ে আমরা ১৯৪৩-এর অংশটুকুও পড়তে পারছি আজ।
আনে চেয়েছিল যুদ্ধের পরে তার ডায়েরির উপর ভিত্তি করে একটা বই বার করবে, সেটারই নাম সে দিয়েছিল ‘হেট আখ্ট্যারহ্যাইস্’। ওটো যখন ওই নামে ডাচ বইটি বার করলেন, তাতে নিজে অনেকটা সম্পাদনা করেছিলেন, লাল ডায়েরির কিছু, খাতার কিছু, আবার সাদা কাগজের কিছু অংশ, এই ভাবে। তাঁর এক বন্ধুও হাত লাগিয়েছিলেন এ কাজে, আর ডাচ প্রকাশক তো অবশ্যই। আজকের ‘দ্য ডায়েরি অব আ ইয়ং গার্ল’ ডাচ ফরাসি ইংরেজি নানা ভাষা, নানা প্রকাশক আর তারও আগে নানা হাত ঘুরে পাল্টে গিয়েছে মূলের ডায়েরি থেকে। ১৯৮৬ সালে ‘ডাচ ইনস্টিটিউট ফর ওয়ার ডকুমেন্টেশন’ (এনআইওডি) একটি সংস্করণ প্রকাশ করে, সেখানে আনের ডায়েরি, স্কুলের খাতা, সাদা কাগজের লেখা যেমন আছে, তেমনই আছে ওটোর সম্পাদিত রূপ, এবং প্রথম ডাচ সংস্করণে প্রকাশিত রূপ— তিনটিই। আমরা যারা ডাচ ভাষা জানি না, তারা পড়তে পারি ‘দ্য ডায়েরি অব আনে ফ্রাঙ্ক: দ্য রিভাইজ়ড ক্রিটিক্যাল এডিশন’— মূল ও প্রধান পাঠগুলির পাশাপাশি আনের লেখা ছোটগল্প, তার অসমাপ্ত উপন্যাস ‘ক্যাডি’স লাইফ’-সহ এ কালে আনে ফ্রাঙ্ক-চর্চার বিশদ তথ্য ও বিশ্লেষণ মিলবে সেখানে। ফ্রাঙ্কদের ধরিয়ে দিয়েছিলেন আর্নল্ড ফান ডেন বার্গ নামে এক ইহুদি প্রতিবেশীই, এফবিআই-ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ-পুলিশ ও আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স-এর সম্মিলিত ও দীর্ঘ এক অনুসন্ধানের পর এ তথ্য উঠে আসে এ বছর জানুয়ারিতে। এ নিয়েও লেখা হয়েছিল একটি বই, ‘দ্য বিট্রেয়াল অব আনে ফ্রাঙ্ক’। তার পরেই এ বছর মার্চে এনআইওডি-র অধীনে এক দল ইতিহাসবিদ-গবেষক বই পড়ে ও বিবেচনা করে মতামত জানিয়েছেন: আনর্ল্ডই যে দোষী তার কোনও নির্দিষ্ট প্রমাণ নেই, তদন্তকারীরা কিছু অনুমান ও পূর্বধারণার বশে এ সিদ্ধান্তে এসেছেন, ওই সময়ের পরিপ্রেক্ষিত ও ইতিহাসের বোধ তাঁদের নেই। এর পরেই বাজার থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে বইটি। প্রকাশক দুঃখপ্রকাশ করেছেন বিজ্ঞপ্তি দিয়ে।
আনে ফ্রাঙ্কের মৃত্যুদিন জানা যায় না। রেড ক্রস বলেছিল মার্চ ১৯৪৫, ডাচ সরকার ৩১ মার্চ দিনটা ধার্য করেছিল। গবেষণা দেখিয়েছে, মার্গট আর আনে ১৯৪৫-এর ফেব্রুয়ারির শেষ বা মার্চের শুরুর দিকে মারা গিয়ে থাকবে। আনে নেই, বইটা আছে। গতকাল সেই বই ৭৫ পেরোল, গতকাল জন্ম নেওয়া কোনও শিশু আজ থেকে পঁচিশ বছর পরে এই বইয়ের শতবর্ষ পালন করবে মুগ্ধ বিস্ময়ে। আমরা কেউ থাকব, কেউ থাকব না। বইটা থাকবে।