জায়গাটা ইন্দোনেশিয়ার সুলাওয়েসি। দ্বীপের মধ্যে চারদিকে চুনাপাথরের পাহাড়। তার মধ্যে এক গুহা। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে ওখানে চলছিল প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান। হামরুল্লা নামে সরকারি এক গবেষক হঠাৎ লক্ষ করেন, গুহার সিলিংয়ে রয়েছে এক বিশাল গর্ত। যেন সেটা অন্য কোথাও যাওয়ার রাস্তা। দেখামাত্র হামরুল্লা মই বেয়ে ওঠেন সেই গর্তে। সত্যিই তা আর এক গুহায় যাওয়ার পথ! ওই গুহায় ঢুকে হামরুল্লা থ’। দেওয়াল জুড়ে আঁকা এক ছবি। সাড়ে চার মিটার লম্বা।
ছবির বিষয়? সংক্ষেপে বললে, শিকারদৃশ্য। দু’টো শুয়োর আর চারটে বেঁটে মোষকে তাড়া করছে আটটা মানুষ। নাহ্, পুরো মানুষ নয় ওরা। ধড় মানুষের, এ দিকে মুন্ডু পশুর। নৃতত্ত্বের পরিভাষায় ওদের নাম ‘থেরিয়ানথ্রোপ’।
লুকনো গুহায় যেন গুপ্তধন! সন্ধান পাওয়ার পর থেকেই প্রত্নতাত্ত্বিকেরা নেমে পড়েন কাজে। প্রথম কাজ প্রাচীনত্ব জানা। কত কাল আগে আঁকা হয়েছিল ওই ছবি? আঁকা যে ক্যালসাইট পাথরে, তার মধ্যে ছিল মৌল ইউরেনিয়াম। যা ক্ষয়ে যায়। কত বছরে কী পরিমাণ ক্ষয় হতে পারে, তা জানা আছে। তাই কোনও কিছুর মধ্যে ইউরেনিয়াম থাকলে, তার বয়স গণনা সহজ। এ ক্ষেত্রে আঁকা ওই ছবির বয়স দেখা গেল ৪৩,৯০০ বছর। এর আগে শিকারদৃশ্যের আঁকা ছবি পাওয়া গিয়েছিল ফ্রান্সের লাকাঁ গুহায়। সে ছবির থেকে ২০,০০০ বছর পুরনো ইন্দোনেশিয়ার ওই ছবি। আর মানুষের ধড় আর পশুর মুন্ডু মিশিয়ে আঁকা ছবি যদি ধরা হয়, তবে তা আগে পাওয়া গিয়েছিল জার্মানির এক গুহায়। সে ছবির চেয়েও অন্তত ৪,০০০ বছরের পুরনো ওই থেরিয়ানথ্রোপ।
ইন্দোনেশিয়ার গুহায় গুপ্তধনের সন্ধান যাঁরা পেলেন, অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেন শহরে গ্রিফিথ ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানী অ্যাডাম ব্রুস, ম্যাক্সিম অবার্ট এবং তাঁদের সাঙ্গোপাঙ্গরা। গুপ্তধন শুধু ছবির প্রাচীনত্বে নয়। উপজীব্যেও। ছবিতে শুধুই কি শিকারদৃশ্য? শিকার তো মানুষ করে। তা হলে মানুষের ধড় আর পশুর মুন্ডুবিশিষ্ট ওই জীব কারা? বোঝাই যাচ্ছে, ওই পেন্টিং আসলে বাস্তবের শিকারদৃশ্য নয়। ব্রুস, অবার্ট ও ওঁদের সহযোগীরা পেপার লিখেছেন ‘নেচার’ জার্নালে। ‘আর্লিয়েস্ট হান্টিং সিন ইন প্রিহিস্টরিক আর্ট’। চার পৃষ্ঠা জুড়ে ছাপা পেপারে ওঁদের দাবি স্পষ্ট। যে কোনও গুহাচিত্রই কোনও না কোনও বর্ণনা দেয়। ঘটনার বর্ণনা। শিকার-কেন্দ্রিক জীবনযাপনে শিকারের দৃশ্য ছবিতে আঁকা স্বাভাবিক। তবে, সুলাওয়েসির ওই ছবি নেহাত সাদামাটা বর্ণনা নয়। অবার্ট মন্তব্য করেছেন, ‘ইট’স আ ন্যারেটিভ সিন।’ ঠিক। সাদামাটা বর্ণনা হলে, শিকারিরা কেন মানুষের ধড় আর পশুর মুন্ডুওয়ালা হবে? প্রাগৈতিহাসিক মানুষ কখনও ও রকম দেখতে ছিল না কি? আসলে ওই ছবি কল্পনাশ্রয়ী। কল্পনার পাখায় ভর করে আঁকা হয়েছিল। কল্পনা কিসে লাগে? ন্যারেটিভে, গল্পে। কাহিনি নিছক ঘটনা বর্ণনা নয়, তার অতিরিক্ত কিছু। হ্যাঁ, ওই ছবি আসলে গল্প। মানুষের বলা প্রথম গল্প।
প্রায় ৪৪,০০০ বছর আগের ওই ছবি এবং তা ঘিরে গল্প, আমাদের মনে অনেক প্রশ্ন উস্কে দেয়। মানুষ ছবি আঁকে কেন? গল্প বলে কেন? ছবি, গল্প বা গান— এ সব তো ‘ইস্থেটিক্স’ বা নান্দনিক ব্যাপার-স্যাপার। মানুষের মন কেন ও সব দিকে ধায়? সংক্ষেপে: কেন ‘ইস্থেটিক্স’?
প্রশ্নটার উত্তর বিবিধ। প্রধান উত্তর দেন যিনি, তাঁর নাম চার্লস রবার্ট ডারউইন। হ্যাঁ, যিনি বিবর্তনতত্ত্বের অন্যতম প্রণেতা। তাঁর জগদ্বিখ্যাত বই ‘অন দি ওরিজিন অব স্পিশিস বাই মিনস অব ন্যাচারাল সিলেকশন, অর দি প্রিজ়ার্ভেশন অব ফেভার্ড রেসেস ইন দ্য স্ট্রাগল ফর লাইফ’ প্রকাশিত হল ১৮৫৯ সালে। যে আইডিয়া ওই বইতে প্রচারিত হল, তা ওঁর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল কুড়ি বছর ধরে। কী আইডিয়া? ‘ন্যাচারাল সিলেকশন’। কী তা? জীবের ধর্ম বংশবৃদ্ধি। সবার সব সন্তানসন্ততি বেঁচে থাকলে সংখ্যা মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি। এ দিকে নেচার বা প্রকৃতি বিশাল আহার্য কিংবা অন্যান্য উপকরণের জোগান দিতে অপারগ। সুতরাং, অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। এই যুদ্ধে টিকে থাকবে— এবং বংশবৃদ্ধি করবে— কে? অবশ্যই সে সব সন্তানসন্ততি, যারা প্রকৃতিতে মানিয়ে-গুছিয়ে চলতে পারবে। অতএব, প্রকৃতি ওই টিকে থাকার লড়াইয়ে নির্বাচকের ভূমিকায়। ন্যাচারাল সিলেকশন।
এখন, এই বর্ণনায় খুঁত আছে। মানে, এটা প্রাণীর বিবর্তনের পুরো কাহিনি হতে পারে না। সন্তান উৎপাদনের জন্য জীবের যৌন সংসর্গ প্রয়োজন। পুরুষ এবং স্ত্রীর মিলন চাই। ক’টা জীব আর নিজে নিজে ভাগ হয়ে সন্তান উৎপাদন করতে পারে? জন্তু তো পারেই না। সন্তান জন্মাতে তার চাই সেক্স। অর্থাৎ বিবর্তনে এক বড় ফ্যাক্টর হল সেক্স।
কিন্তু সাহস করে সে ব্যাপারটা ‘ওরিজিন’ বইতে ফলাও করে বলতে পারলেন না ডারউইন। বললেন ঠারেঠোরে। ভয়ে। তা অসঙ্গতও নয়। ‘ওরিজিন’ যে নিন্দার শিকার হবে, তা বই ছাপার আগেই অনুমান করেছিলেন ডারউইন। হলও তাই। চার্চ, বা ধর্মভীরু মানুষরা গাল পাড়তে শুরু করলেন। এক জীব থেকে অন্য জীবের আবির্ভাব? মানুষ জন্তু বই কিছু নয়? ও সব কি মানা যায়? ডারউইনের স্ত্রী এমা ডারউইন বিশেষ কষ্ট পেলেন ভূতাত্ত্বিক অ্যাডাম সেজউইক-এর মন্তব্যে। ওই বিজ্ঞানী ‘ওরিজিন’কে বললেন ‘আটারলি ফল্স অ্যান্ড গ্রিভাসলি মিসচিভাস’। নিন্দায় বিদীর্ণ হলেন তাঁর স্বামী এবং স্বয়ং লেখক।
সে কারণে ওই সেক্স-এর ব্যাপারে মুখ খুললেন না তক্ষুনি। যদিও ঠারেঠোরে তা উল্লেখ করেছিলেন ‘ওরিজিন’-এই। ঠারেঠোরে বলতে, মাত্র তিন পৃষ্ঠায়, একটা অধ্যায় জুড়েও নয়। প্রায় সাড়ে চারশো পৃষ্ঠার বইতে মাত্র তিন পৃষ্ঠা! অতিসাবধানী ডারউইন সেই বইতে ঘুণাক্ষরেও জানালেন না, বিবর্তনে মানুষের আবির্ভাব নিয়ে তিনি কী ভাবেন।
তা তিনি জানালেন বারো বছর পরে। ১৮৭১ সালে। আর একখানি বই লিখে। বইয়ের নাম ‘দ্য ডিসেন্ট অব ম্যান, অ্যান্ড সিলেকশন ইন রিলেশন টু সেক্স’। বইখানির উপজীব্য ‘ওরিজিন’-এর চেয়েও মারাত্মক। মানুষের পূর্বপুরুষ যে বাঁদরজাতীয় এক পশু, তা এই বইতে স্পষ্ট জানালেন ডারউইন। আর বিশদে লিখলেন ‘সেক্সুয়াল সিলেকশন থ্রু মেট চয়েস’। প্রকৃতির নির্বাচনই বিবর্তন-যুদ্ধে টিকে-থাকার শেষ কথা নয়। ন্যাচারাল সিলেকশন-এর সঙ্গে সমান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় ওই সেক্সুয়াল সিলেকশন। ন্যাচারাল সিলেকশন হল টিকে থাকার চাবিকাঠি; সেক্সুয়াল সিলেকশন সন্তান উৎপাদনের চাবিকাঠি।
‘ডিসেন্ট’-এ ডারউইন লিখলেন, ‘প্রাণিরাজ্যে এক প্রজাতির সদস্য দেখতে হুবহু এক নয়। মানুষ যেমন পোষা পাখিকে পছন্দসই সুন্দর করে ফেলতে পারে স্ত্রী এবং পুরুষ নির্বাচন করে, স্ত্রী পাখিরাও তেমনই নিজেরা আকর্ষণীয় পুরুষ সঙ্গী নির্বাচন করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বদলে ফেলতে পারে।’ ওই বইতেই অন্যত্র লিখলেন, ‘যাঁরা যৌন নির্বাচনের এই ব্যাপার মেনে নেবে, তাঁরা একটা চমৎকার সিদ্ধান্তে পৌঁছবে। মস্তিষ্ক শুধু দেহের চালু প্রক্রিয়াগুলোই নিয়ন্ত্রণ করে না, পরোক্ষে অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বিকাশ এবং কিছু মানসিক গুণ উদ্ভবেও ভূমিকা নেয়।
সাহস, রিরংসা, দেহের আকার এবং শক্তি, দেহের অস্ত্র, সঙ্গীত-সৃষ্টিকারী অঙ্গ, উজ্জ্বল রং, ডোরাকাটা দাগ, বাহারি লেজ ইত্যাদি ওই ভূমিকার পরিণাম। আওয়াজ, রং বা দেহসৌষ্ঠব বাছাবাছির ফল ওগুলো।’ প্রকাশকালে ‘ডিসেন্ট’ দু’খণ্ড মিলিয়ে ৯০০ পৃষ্ঠার বই। তার মধ্যে ২৫০ পৃষ্ঠা জুড়ে বানর-জাতীয় প্রাণী থেকে মানুষের আবির্ভাব-কাহিনি। মানুষের মধ্যে সেক্সুয়াল সিলেকশন কিস্সা যেখানে মাত্র ৭০ পৃষ্ঠার, সেখানে প্রায় ৫০০ পৃষ্ঠাব্যাপী অন্য প্রাণীর সেক্সুয়াল সিলেকশন।
বন্ধু আমেরিকান উদ্ভিদবিজ্ঞানী আসা গ্রে-র উদ্দেশে এক চিঠিতে ডারউইন লিখেছিলেন, ‘ময়ূরের পাখা, যখনই তাকিয়ে দেখি, প্রচণ্ড বিরক্ত হই।’ একদম ঠিক। ওই প্রাণীর পাখার বর্ণাঢ্য বিস্তৃত আকার টিকে থাকার লড়াইয়ে মোটেই সাহায্যকারী বস্তু নয়। বরং ওটা একটা বোঝা। ওটা বানাতে এবং বয়ে বেড়াতে ময়ূরের এনার্জি খরচ। বাঘ-সিংহ তাড়া করলে ওই বোঝা নিয়ে দৌড়নো যায় না। সুতরাং, ‘ওরিজিন’-এ যা-যা লিখেছেন ডারউইন, ময়ূরের পাখা তার সব নস্যাৎ করে। তা সত্ত্বেও কেন ময়ূর ও রকম পাখা সমেত টিকে রইল? এর উত্তর দেয় সেক্সুয়াল সিলেকশন। বলে, বিস্তৃত ও বর্ণাঢ্য পাখা দেখেই ময়ূরী ময়ূরের প্রতি আকৃষ্ট হয়। বোঝা হলেও, ওই পাখা ময়ূরকে সন্তান উৎপাদনে সাহায্য করে। আধুনিক পরিভাষায় বললে, পাখা ময়ূরকে তার জিন টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করে।
‘ডিসেন্ট’ পড়ে অনেকে বিরক্ত। আশ্চর্যের কথা, ওঁদের দলে কিনা শেষে আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেসও! এই ওয়ালেস একদা ডারউইনের পাশাপাশি আলাদা ভাবে আবিষ্কার করেছিলেন ন্যাচারাল সিলেকশন। সেক্সুয়াল সিলেকশন নিয়ে ওঁদের ঝগড়া চলল ১৮৮২ সালে ডারউইনের মৃত্যু— অথবা, বলা ভাল, ১৯১৩ সালে ওয়ালেসের মৃত্যু— পর্যন্ত। মৃত্যুর বছরেও এক প্রবন্ধে ডারউইন লিখলেন, ‘আমাকে এখানে বলার অনুমতি দেওয়া হোক যে, সেক্সুয়াল সিলেকশন নীতির বিরুদ্ধে ওঠা তর্কগুলো আমার সাধ্যমতো যত্ন সহকারে বিচার করেও আমি ও নীতির সত্যতা সম্পর্কে নিঃসন্দেহ।’ পণ্ডিতেরা বলেন, এ ব্যাপারে ওঁর সঙ্গে ওয়ালেসের বিরোধ নাকি মূলত রাজনীতির। পরের দিকে অধ্যাত্মবাদী বনে গিয়েছিলেন ওয়ালেস। মানুষ যে রূপান্তরিত পশু, তা মানতে পারেননি। মানুষ পশুর থেকে আলাদা। অথবা, পশু নিম্নতর জীব। সৌন্দর্যচেতনা— রূপে মুগ্ধতাবোধ— পশুর থেকে আশা করা যায় কি? ময়ূরী কি ময়ূরকে সঙ্গী নির্বাচনের আগে তার পেখমের প্রতি ইঞ্চি জরিপ করে? ডারউইন জবাব দিলেন: ‘একটি মেয়ে কন্দর্পকান্তি এক পুরুষকে দেখল; পুরুষটির নাক বা গোঁফ অন্যদের তুলনায় ইঞ্চির এক-দশমাংশ ছোট না বড়, তা বিচার করতে বসল না; বলল, ও দেখতে ভাল, আমি ওকে বিয়ে করব। ময়ূরীর ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তেমনই।’
ডারউইন যা-ই বলুন, অপছন্দের কারণে সেক্সুয়াল সিলেকশন আইডিয়া চাপা পড়ে থাকে দীর্ঘকাল। বায়োলজিতে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত, সাইকোলজিতে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত। এখন অবশ্য ওই আইডিয়ার বাড়বাড়ন্ত। ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের অধ্যাপক জিওফ্রে মিলার-এর কথায় ‘আপনার প্রতিটি পূর্বপুরুষ শুধু প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া অব্দি টিকে থাকেনি, একজন ইচ্ছুক যৌনসঙ্গীও যোগাড় করেছে। আপনার দেহের ৩০,০০০ জিনের প্রতিটি হাজার হাজার প্রেম, সঙ্গম এবং অভিভাবকত্বের প্রজন্মের মধ্যে দিয়ে গেছে।’ পণ্ডিতেরা আজ মেনে নেন যে, ময়ূরের পাখার মতো কোকিলের গান, ব্যাঙের আওয়াজ, স্ত্রী-বেবুনের লাল নিতম্ব সঙ্গী প্রলোভনের পাথেয়। আর হরিণের শিং, গরিলার মাংসপেশি কিংবা পুরুষ বেবুনের ধারালো দাঁত হল সঙ্গী নির্বাচনে মারামারির অস্ত্র। মানুষের মধ্যে? সেখানেও সেক্সুয়াল সিলেকশনের উপহার প্রকট। (১) নারীর স্তন কিংবা নিতম্ব, পুরুষের দাড়িগোঁফ ; (২) সঙ্গীর রূপ, বুদ্ধি, স্টেটাস ইত্যাদি মাপার ক্ষমতা; (৩) লোভ, ঈর্ষা, ক্রোধ, উচ্চাশার মতো প্রবৃত্তি।
স্তন্যপায়ী প্রাণীর জগতে পুরুষকে স্ত্রীর মনোরঞ্জন করতেই হয়। কারণটা আর কিছু নয়, বায়োলজি। পুরুষ যেখানে কয়েক মিনিটের যৌন সংসর্গেই সন্তান উৎপাদনের সুযোগ পায়, স্ত্রীকে সেখানে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় অনেক দিন কাটাতে হয়। শুধু তাই নয়, প্রসবের পরেও সন্তানকে বেশ কিছু দিন লালন পালন করতে হয়। সন্তান নিজের খাদ্য নিজে জোগাড় করলে মায়ের ছুটি। সন্তান উৎপাদনে পুরুষের তুলনায় স্ত্রীর বিনিয়োগ অনেক বেশি। সঙ্গী নির্বাচনে তাই স্ত্রীকে অনেক বাছবিচার করতে হয়। এই যে প্রজনন প্রক্রিয়ায় পার্থক্য— পুরুষের সুযোগ আছে বহু সন্তান উৎপাদনের, স্ত্রীর তা নেই— এর ফলে যত গোলমাল। পুরুষ স্ত্রীর মনোরঞ্জনের মুখাপেক্ষী। ডারউইনবাদী এই দৃষ্টিভঙ্গিতে সেক্সুয়াল সিলেকশনের চতুর্থ উপহার: পুরুষের তরফে নিজেকে জাহির করার প্রবৃত্তি। ভাষা, শিল্প, সঙ্গীত। সোজা কথায়, ইস্থেটিক্স।
ইস্থেটিক্সকে অনেক সময় প্র্যাগম্যাটিক্স-এর বিপরীত হিসেবে দেখা হয়। সত্যি, শিল্পকলা দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটায় না। তার পিছনে অযথা সময় এবং পরিশ্রম ব্যয়। তা সত্ত্বেও কেন শিল্পকলা টিকে থাকল? প্রশ্নটা ভাবিয়েছিল জার্মান প্রাণিবিজ্ঞানী আর্নস্ট গ্রসকে। ১৮৯৭ সালে গ্রস ছেপেছিলেন একখানি বই। ‘দ্য বিগিনিংস অব আর্ট’। প্রশ্নের কোনও জবাব দিতে পারেননি তিনি। লিখেছিলেন, শিল্পকলার পিছনে যারা সময় দেয়, প্রাকৃতিক নির্বাচনে তাদের লুপ্ত হওয়ার কথা। শিল্পকলার উদ্ভব নিয়ে সাম্প্রতিক কালে যিনি যথেষ্ট গবেষণা করেছেন, তিনি আমেরিকান নৃতাত্ত্বিক এলেন দিসানায়েকে। ১৯৮৮ এবং ১৯৯২ সালে দু’টো বইও লিখেছেন তিনি। যথাক্রমে ‘হোয়াট ইজ় আর্ট ফর?’ এবং ‘হোমো ইস্থেটিক্স’। ওঁর মতে, শিল্পকলার তিন লক্ষণ প্রকট। এক, তা মানুষের এক জাতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, শিল্পচর্চা পৃথিবীর সবখানে দেখা যায়। দুই, শিল্প শুধু শিল্পীর কাছে আনন্দদায়ক কাজ নয়, দর্শকের কাছেও সুখের উপলব্ধি। তিন, শিল্প আয়াসসাধ্য ব্যাপার। এতগুলো লক্ষণ-সম্পৃক্ত প্রয়াস বিনা কারণে আসতে পারে না। বিবর্তনে এর মূল্য অনস্বীকার্য।
আর্ট কী করে? অনেক ব্যাখ্যা দেন বিশেষজ্ঞেরা। আর্ট গোষ্ঠীর সদস্যদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন বাড়ায়, জগৎকে নতুন চোখে দেখতে শেখায়, প্রকৃতির সঙ্গে এক তারে বাঁধে, নিরাকারকে দেখায় ইত্যাদি ইত্যাদি। ও সবই ঠিক। তবে, আর্ট আর একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজও করে। কী, তা সবিস্তার লিখেছেন অধ্যাপক জিয়োফ্রে মিলার তাঁর লেখা বইতে। ‘দ্য সেটিং মাইন্ড : হাউ সেক্সুয়াল চয়েস শেপ্ড দ্য ইভল্যুশন অব হিউম্যান নেচার’-এ মিলার বিশদে জানিয়েছেন কোনও কোনও পুরুষ-পাখির লতাপাতা সংগ্রহ করে বাহারি বাসা তৈরির ব্যাপারটা। লক্ষ করার মতো ব্যাপার এই যে, স্ত্রী-পাখি কিন্তু কখনও ওই বাসা তৈরিতে পরিশ্রম করে না। তা করে কেবল পুরুষ-পাখি। মনোরম বাসা সাজিয়ে প্রতীক্ষায় থাকে ক’টা সঙ্গিনীকে আকৃষ্ট করবে ওই বাসার সৌন্দর্যে। সঙ্গিনীদের কাজ কেবল তার মন-পসন্দ বাসায় ডিম পাড়া। মিলার এর পর চলে গিয়েছেন তিন জগদ্বিখ্যাত পেন্টারের কাহিনিতে। আমেদেও মোদিগ্লিয়ানি, যিনি কোকেনের নেশায় প্রায় প্রতিটি মডেলকেই নিজের শয্যাসঙ্গী করতেন; পল গঁগা, যিনি প্রচুর সঙ্গিনীকে নিজের সিফিলিসে আক্রান্ত করেছিলেন। তৃতীয় শিল্পী? অবশ্যই পাবলো পিকাসো। যিনি সারা জীবনে অসংখ্য মহিলাকে শয্যাসঙ্গী করেছেন। ওলগা কোকলোভা তাঁর প্রথম স্ত্রী। ওঁর গর্ভে পিকাসোর প্রথম সন্তান। প্রেমিকা মারি থেরেস ওয়াল্টারের গর্ভে আর-এক সন্তান। এ ছাড়া আর-এক প্রেমিকা ফ্রাসোঁয়া গিলো-র গর্ভে দুই সন্তান। ৯১ বছর বেঁচেছিলেন পিকাসো। ১৯৭৩ সালে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত ১৪,০০০ পেন্টিং, ৩৪,০০০ ইলাস্ট্রেশন এবং ১,০০,০০০ এনগ্রেভিং তাঁর সৃষ্টি। আর বিত্ত? মৃত্যুকালেই তার পরিমাণ ১০০ কোটি ডলার। মিলার লিখেছেন, পিকাসো সম্পর্কে ‘পাংক’দের বাঁধা গান ‘হি ওয়জ় অনলি ফাইভ ফিট থ্রি, বাট গার্লস কুড নট রেজ়িস্ট হিজ় স্টেয়ার’ অক্ষরে অক্ষরে ঠিক। কিছু কিছু পাখির মতো পিকাসোর আর্টও ‘ফিটনেস ইন্ডিকেটর’! এবং এক ‘কোর্টশিপ টুল’।
আর গল্প বলা? তার উৎস ব্যাখ্যা করতে আর এক গল্প উদাহরণ হিসেবে ধার করেছেন মিলার। ‘সহস্র এক আরব্য রজনী’। দোর্দণ্ডপ্রতাপ সম্রাট শাহরিয়ার আবিষ্কার করলেন, সম্রাজ্ঞী এক দাসের সঙ্গে যৌনসংসর্গে লিপ্ত। তিনি ক্রোধে অগ্নিশর্মা। কোতল করলেন সম্রাজ্ঞী এবং সেই দাসকে। আর হুকুম দিলেন, প্রতি রাতে তাঁর শয্যাসঙ্গী হিসেবে নতুন এক জন কুমারী মেয়ে চাই। রাত কাটলেই সেই মেয়ের গর্দান যাবে। প্রাসাদের বাইরে এসে যাতে সে অন্য পুরুষের ঘরনি হতে না পারে। সম্রাটের কামনা চরিতার্থ করতে গিয়ে রাজ্যে কুমারী মেয়ে শেষ। পড়ে আছে উজিরের দুই কন্যা শেহেরজাদে এবং দুনিয়াজাদ। সম্রাটের তাদেরও চাই। অনিচ্ছুক উজির শেহেরজাদেকে পাঠাতে বাধ্য হলেন সম্রাটের কাছে। শেহেরজাদে শয্যাসঙ্গী হলেন তাঁর। সকালে গর্দান যাবে শেহেরজাদের। তার আগে তিনি শেষ দেখা করতে গেলেন দুনিয়াজাদের সঙ্গে। তিনি দিলেন বুদ্ধি, সম্রাট শাহরিয়ারকে গল্প শোনানোর। ফন্দি অনুযায়ী, শেহেরজাদে গল্প বলতে শুরু করলেন শাহরিয়ারকে। বিশেষ কায়দায়। এক গল্পের রেশ ধরে আর-এক গল্প। এ ভাবে পর পর। সম্রাটও কৌতূহলী— তার পর? তার পর? গল্পে মজে শাহরিয়ার ভুলে গেলেন নিজের হুকুম। গর্দান নিলেন না শেহেরজাদের। এ ভাবে কেটে গেল সহস্র এক রজনী। তত দিনে শেহেরজাদে তিন সন্তানের জননী। তিনি সন্তানদের আনলেন সম্রাটের সামনে। দেখে শাহরিয়ার উৎফুল্ল। সন্তানদের কারণে প্রাণভিক্ষা চাইলেন শেহেরজাদে। মা ছাড়া কে দেখবে ওদের? আর্জি মঞ্জুর। সম্রাজ্ঞী হিসেবে বাকি জীবন বাঁচলেন শেহেরজাদে। গল্পের কী মহিমা!
কাহিনি আমাদের সকলের মন মজায়। মিলার লিখেছেন, এমন কোনও সভ্যতা নেই, যাদের গল্প নেই। ওঁর মতে, ‘সহস্র এক আরব্য রজনী’ আমাদের জীবনে গল্পের প্রয়োজনীয়তা চমৎকার বুঝিয়ে দেয়। শেহেরজাদে কাহিনি বুনতে পারেন একের পর এক। এই দক্ষতা তাঁর ‘ফিটনেস ইন্ডিকেটর’। শাহরিয়ার বুঝলেন, তাঁর ঔরসে শেহেরজাদের সন্তান ভাল জিন পাবে।
হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক স্টিভেন পিংকার লিখেছেন, গল্প মানে যে হেতু কল্পনার অবাস্তব জগৎ নিয়ে নাড়াচাড়া, তাই ন্যাচারাল সিলেকশনে এর মুছে যাওয়ার কথা। তা তো হয়ইনি, বরং উল্টে ব্যাপারটা ফুলেফেঁপে উঠেছে। কারণ সম্ভবত এই যে, গল্প আমাদের যূথবদ্ধ জীবন গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে। যার শুরুটা হয়েছিল ভাষা দিয়ে। গল্প আমাদের সমাজ-জীবনে সম্পর্ক গড়ে তুলতে সাহায্য করে।
নিউজ়িল্যান্ডে অকল্যান্ড ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক এবং ‘অন দি অরিজিন অব স্টোরিজ় : ইভল্যুশন, কগনিশন অ্যান্ড ফিকশন’ বইয়ের লেখক ব্রায়ান বয়েড একটা নতুন শব্দ চালু করেছেন। ইভোক্রিটিসিজ়ম। ইভল্যুশনারি ক্রিটিসিজ়ম। ওঁর মতে, সাহিত্য সমালোচনার যে ধারা চালু আছে কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ে (আর্থসামাজিক, নারীবাদী, উত্তরাধুনিকতাবাদী), তা থেকে বেরিয়ে আসা উচিত। সাহিত্যকে সমালোচনা করা উচিত নতুন আঙ্গিকে। বিচার করা উচিত বিবর্তনবাদী দৃষ্টিতে। প্লট কাটাছেঁড়া করে দেখা হোক, তাতে বিবর্তনের সুর খুঁজে পাওয়া যায় কি না। বয়েড-কথিত এই নিদান যে সব গবেষক মানছেন, তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য আমেরিকায় ওয়াশিংটন অ্যান্ড জেফারসন কলেজের ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক জোনাথন গটস্কাল। তিনি লিখেছেন এক বই। ‘দ্য স্টোরিটেলিং অ্যানিম্যাল: হাউ স্টোরিজ় মেক আস হিউম্যান’। তিনি দেখিয়েছেন, উপন্যাস, চলচ্চিত্র, নাটক তো বটেই, এমনকি খেলা কিংবা আদালতে অপরাধের বিচারপর্বও এক-একটা গল্প। মানুষ এ সব ভালবাসে, কারণ সে এ সব থেকে শেখে— সমস্যায় পড়লে কখন কী করতে হয়। যেমন শিক্ষানবিশ পাইলটেরা ফ্লাইট সিমুলেটরে শেখে, বিপদে কী করণীয়। আর-পাঁচটা আচরণের মতো গল্প বলা এবং
শোনা মানুষের মধ্যে এসেছে বেঁচে থাকার তাগিদে।
ঠিকই বলেছিলেন ইংরেজ লেখক গ্রাহাম সুইফ্ট। তাঁর ‘ওয়াটারল্যান্ড’ উপন্যাসে লিখেছিলেন, ‘মানুষ— দাঁড়ান, আগে তার সংজ্ঞা দিই— হচ্ছে একটা গল্প-বলিয়ে জীব। তাকে গল্প বানিয়ে যেতে হয়। গল্প থাকলে সব ঠিকঠাক। জীবনের শেষ মুহূর্তে, মৃত্যু যখন হাতছানি দিচ্ছে, অথবা ডুবে যাওয়ার আগে, সে দেখে— তার সামনে বয়ে চলেছে পুরো জীবনের গল্প।’