ছবি: অমিতাভ চন্দ্র
অনেক কাল আগে, সেই চতুর্দশ শতকে, কাশ্মীর উপত্যকার কোনও এক জায়গায় এক মহিলা থাকতেন। সেই মহিলার একাধিক নাম ছিল, তবে ‘লাল দেদ’ নামটিই লোকের মনে ধরেছে। সকলের তিনি প্রিয় ঠাম্মা বা দিম্মা, সেই জন্য ‘দেদ’ তাঁর উপাধি। দিদার পেটটা একটু বড়, ঝোলা ও মোটা, তাই আদর করে লোকে ডাকত ‘লাল’, শরীরী স্মরণের একটু ছোঁয়া যেন ওই নামে আছে। দিদা গুণী, ছন্দোবদ্ধ বচন বানাতে দড়। তাঁর সুরেলা পদে ফুটে উঠত জীবনের কান্নাহাসির বোল, ওই বোলগুলিতে শোনা যেত নিজের স্ব-রূপের অনুসন্ধানে এক পরমকে চিনে ওঠার আর্তি। এই আর্তি পণ্ডিতবোধ্য সংস্কৃত ও দরবারি ফারসিতে উচ্চারিত হয়নি। দিদিমার মনের সব রকমের অনুভূতির প্রকাশ হয়েছিল উপত্যকার লোকগ্রাহ্য কথ্য ভাষায়— বাখ, বচন বা কথাগুলি মনে সরাসরি পৌঁছে যায়। কয়েক শতকের ব্যবধানে উচ্চারণে বিপর্যয় ঘটেছে, শব্দ দুর্বোধ্য হয়েছে, মুখফেরতায় অর্থ বদলে গিয়েছে। তবু কাশ্মীরি ভাষারূপের সাবেকি স্বাদগন্ধ লেগে আছে তাঁর কথন-সংগ্রহের অবয়বে, ‘লাল্লা বাক্যানি’ বা প্রাকৃত ঢঙে নামাঙ্কিত ‘লালবাখ্’-এর সঙ্কলনের নানা পদবন্ধে। উপত্যকার ভাষায় ‘বাখ’ শব্দটি একবচন বা বহুবচন দুই রূপেই প্রযুক্ত হয়। এ হেন ‘বাখ’-এর চতুর্ভুজী চরণগুলি মাঝে মাঝে ভেঙে লোকপ্রবাদের আকার নিয়েছিল। ওই সব চরণ জুতসই সময়ে আউড়ে, দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার উপর ফুট কাটা কাশ্মীরে লোকাভ্যাস ছিল। বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, হিন্দি দোহা, মরাঠি অভংগ, বীরশৈবদের কন্নড় বচন বা পঞ্জাবি ‘অলখ’ সাধকদের বলা পদের সমগোত্র লাল দেদ-এর ‘বাখ’, দেশজ ভাষায় উচ্চারিত, লোকশ্রুতিতে ধৃত, কয়েক শতকের কাশ্মীর উপত্যকানিবাসী জনসমাজের সামূহিক পোষকতায় লালিত ও বর্ধিত মৌখিক সাহিত্যের সোনালি ফসল।
চতুর্দশ শতক লাল দেদের সময়কাল, কাশ্মীরের ইতিহাসের ক্রান্তিলগ্ন। উপজাতি আক্রমণে ধ্বস্ত ও সামন্তদের অত্যাচারে জর্জরিত কাশ্মীরে ভাগ্যান্বেষী ধর্মান্তরিত খস উপজাতি সম্ভূত বিচক্ষণ রাজমন্ত্রী শাহ মীর ‘শামসুদ্দিন’ নামে মসনদ দখল করে সুলতানি সিলসিলার পত্তন করেন ও সুশৃঙ্খল শাসনব্যবস্থা গড়তে সক্ষম হন। ওই বংশেরই চতুর্থ শাসক শিহাবুদ্দিনের আমলে (১৩৫৫-৭০) কুবরিয়া সুফি সাধক সৈয়দ আলি হামদানি ও তাঁর মুরিদরা কাশ্মীরে আড্ডা গেড়েছিলেন। বৌদ্ধ চৈত্য ও শৈব মন্দিরের পাশেই সুফিদের আস্তানা ও খানকা গড়ে ওঠে। শতকের শেষে কাশ্মীরে নিজস্ব সুফি ঘরানা তথা নন্দ ঋষি বা নুরউদ্দিনের সিলসিলা দানা বাঁধে।
কলহনের যোগ্য উত্তরসূরি জোনরাজ ও শ্রীধর এই ঐতিহাসিক পট পরিবর্তনের কথা ভাল করেই লিখেছিলেন, পরে ফারসি ভাষায় এই বৃত্তান্ত নিয়ে নির্ভরযোগ্য তারিখও পাওয়া যায়। কিন্তু এদের বিশ্বস্ত অতীতচারণায় লাল দেদ একেবারে গরহাজির। সুফি জীবনীগ্রন্থে লাল দেদের অলৌকিক জীবনমাহাত্ম্য, সপ্তদশ শতকের মুঘল শাসনে এসে পাওয়া যায়। পরন্তু লাল দেদের শিষ্য-শিষ্যা পরম্পরা নেই, মকবরা বা সমাধির চিহ্নও বিলুপ্ত। লাল তো বলতেনই, ‘‘আমি কারও জন্য শোক করিনি, কেউ আমার জন্য শোক করবে না।’’
রাজবৃত্ত বা বড় ঘটনার ভারী ইতিহাসে লাল দেদ একেবারে প্রান্তিক, তাঁর জন্ম-মৃত্যুর সালের কোনও ঠিক-ঠিকানা নেই। ১৩০০-১৩২০ বা ১৩৩৪-৩৫ বা ১৩৪৬-৪৭ খ্রিস্টাব্দ— যা খুশি হতে পারে, সবই অনুমান। জন্মস্থান সেম্পোর বা পানদ্রেনথান, আর মৃত্যু নাকি ওই ১৩৭০ খ্রিস্টাব্দের কিছু আগে বা পরে, কেই বা জানে? দা-কাটা প্রামাণিক ইতিহাসের কোনও চরিত্র লাল নন, তাঁর অস্তিত্বের সাবুদ তাঁর ‘বাক্যানি’ আর একরাশ কিংবদন্তি ঠিক কি না, তাঁর জীবনের আবেদন তো তৃপ্ত করে থাকে লোকপ্রত্যাশা ও লোকঈপ্সাকে, শতকের পর শতক জুড়ে লোকসমাজেই তো তাঁর মান্যতা ও স্বীকৃতি। কিংবদন্তি ও বচনের অন্বয়ে গড়ে ওঠা ঐতিহ্যকে ছেনেই বার করতে হবে লাল্লার নানা পরিচিতি।
কষ্ট না করলে কেষ্ট মেলে না, এটিই লোকপ্রত্যাশা। ইষ্টপ্রাপ্তির জন্য লাল্লাও কম কষ্ট করেননি। কিংবদন্তি অনুসারে বামুন ঘরের নতুন বউ লালের শাশুড়ি বউ-কাঁটকি, সংসারের ঊনকোটি কাজ করেও লাল তাঁর মন পাননি, ঠিকমতো খাবারও জুটত না। ‘‘বাড়িতে পুরুষ্টু ভেড়া আর বাচ্চা ভেড়া, যার মাংসই কাটা হোক না কেন, লালের ভাগে আছে পাথর-শক্ত রুটি।’’ লালের জবানিতে বলা কথাটি নির্যাতিত কাশ্মীরি বধূদের মুখে মুখে ফেরে। প্রয়োজনে নির্যাতন-সহিষ্ণু ও অন্তর্মুখী লাল অবশ্য লক্ষ্মণরেখা পেরোতে দ্বিধা করেননি। সন্তানধারণে তাঁর অনীহা ছিল, আঁতুড়ঘর তো বন্দিশালা। খোদ স্ত্রীধর্ম পালনেই বিপর্যয়! যুবতী লাল ঘর ছাড়েন— গুরু সেদ বয়ু বা সিদ্ধ শ্রীকান্তের কাছে সর্বত্যাগী যোগিনী হওয়ার জন্য দীক্ষা নেন। লালের সমসাময়িক কাশ্মীরে শৈব সিদ্ধান্তের নানা সম্প্রদায়ের বোলবোলাও ছিল। লালের সাধনপথও শৈবযোগ ও তন্ত্র অনুমোদিত। ‘লালবাখ’-এর ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে আছে অনাহত রব, সহজ সাধনা ও প্রাণবায়ুর মতো যোগ সাধনার পারিভাষিক শব্দ, প্রাণায়াম সাধনের নানা ইঙ্গিত। এই সাধনা গুরুমুখী, গুরু ‘পরমেশ্বর’-এর নির্দেশে লাল্লা পদ্ধতি আয়ত্ত করেছিলেন। ‘বাখ’-এর চরণে বলা হয়েছে যে, লালের ইষ্টদেবতা ‘শ্যামগলা’ বা ‘নীলকণ্ঠ’, প্রিয় কাজ ‘শিবপূজন’, শিব-শক্তির যুগ্ম রূপকল্পনাই হৃদয়ের ধ্যানে ভেসে ওঠে। শৈব সাধিকা লাল অবশ্যই গোঁড়া নন, ভেদ তো আপাত, তাই বচনের একটি ছত্র ‘শিব কেশব, জিন বা কমলসম্ভূত প্রভু (ব্রহ্মা) যাই নাম তাঁর হোক না কেন... তিনিই সেই, সে সেই।’
লোককথানুসারে, লাল দেদ বেশ ঠোঁটকাটা ছিলেন, গুরুকেও রেয়াত করতেন না। সিদ্ধাইয়ের বুজরুকি ও বাহ্যিক শুদ্ধতার ভড়ংয়ের প্রতি তাঁর আত্যন্তিক অশ্রদ্ধা ছিল। নদীতে গুরু ভাল করে গা ধুচ্ছেন। আর পাশে লাল্লা হাতে-ধরা কলসির বাইরেটা মেজে যাচ্ছেন। গুরু বলে উঠলেন যে, ভেতরটা পরিষ্কার না করে, বাইরের গাটুকু ঘষলে ময়লা দূর হবে কী করে? হাজিরজবাব লাল্লা উত্তর দেন, অন্তর শুদ্ধ না হলে শুধু দেহটা পরিষ্কার করে লাভটাই বা কী? লাল্লার বচনে, ‘মন্দির সেরেফ পাথর, মূর্তিও তো পাথর।’ আনন্দ কাউল সংগৃহীত একটি লালকথা এই রকম, ‘গুরু পুঁথিপত্র খাঁচার ভেতরে নাম-জপা তোতাকে খাইয়ে দাও।’ কোনও গণ্ডিতে আটকে থাকার পাত্রী লাল্লা ছিলেন না। গুরুর আশ্রয় থেকে বার হয়ে, পথে বার হলেন। আত্মদীপ হওয়া ছাড়া আর গত্যন্তর নেই। তাঁর বাখ আত্মবিশ্বাসে ভরপুর, ‘শাস্ত্র যা শেখায় তা পালন করেছি, শাস্ত্রে যা নেই তা নিজেই শিখে ফেলেছি, যেন বনে গিয়ে সিংহের সঙ্গে কুস্তি করেছি।’ স্বশিক্ষিত হওয়ার পথে লাল্লা উদাসী, যত্রতত্র বিহারী এক পরিব্রাজিকা। আত্মবোধে মগ্ন হয়ে তিনি স্বগত কথায় মুখর হন, উন্মাদনার মুহূর্তে দিগম্বরী হয়ে নাচতেন। লোকে তো জানে যে লজ্জা, মান, ভয়, এ তিন থাকতে নয়। সমাজে নিন্দার ঝড় বয়ে যায়, লাল্লা নির্ভয়া। তাঁর বাখ ঝলসে ওঠে, ‘ওরা কত গালি দেয়, নানা শাপমন্যি করে। যার যা মনে চায়, তাই বলুক... ফুলডোর নিয়েও আসতে পারে, আমল দেব না। এই সব গায়ে না মেখেই আমি নিজেকে সাফসুতরো রাখি।’
কাশ্মীরের শৈব প্রত্যভিজ্ঞা দর্শনের কুলজিতেই লাল্লার জ্ঞানতত্ত্বের একটি গিঁট বাঁধা ছিল। বাখের সহজ ভাষায়, ‘শিবকে পাওয়া বড় শক্ত, দার্শনিক হওয়া সহজ।’ তবে জীবনে দ্বৈত-এর খেলা খেলতে হবে। সেই খেলার মাধ্যমে অদ্বৈত চেতনার দিকে ধীরে ধীরে উত্তরণই তো সাধনার লক্ষ্য। আত্ম-এর খেলায় পরমকে ফিরে চেনা, প্রতি-অভিমুখে এই স্মরণজ্ঞানই প্রত্যভিজ্ঞা। লালবাখের জ্ঞানকল্পে তিনটি ঝোঁক আছে। তার বেশ কিছু বাখ বিষয়ীর আত্মবোধকে কেন্দ্র করে উচ্চারিত। কোনও কোনও বাখে আছে আত্ম ও পরমের মধ্যে জৈবনিক ব্যবধানের স্বীকৃতি। কোনও কোনও বাখে শোনা যায় ব্যবধানকে অতিক্রম করার অভিজ্ঞতা, স্ব-অনুভবে ও আত্মদর্পণে যাবতীয় ভেদ-সংস্কারের মধ্যে ‘তাহা ইহাই’ এই অভেদবোধের স্মরণ, উদ্বোধন ও আস্বাদনের ঈপ্সা। এই আস্বাদনের মুহূর্তে অন্ধকার উপত্যকার গভীর গহন থেকে লাল্লা ফুকরে ওঠেন, ‘‘জ্যোৎস্না নিভে যেতে পাগলিকে ডাকলাম, ব্যথা মুছিয়ে দিলাম ঈশ্বরপ্রেমে। ‘লাল্লা, আমি লাল্লা’ এই বলে প্রিয়কে জাগালাম, তার সঙ্গে আমি এক হলাম, মনের কলুষ স্ফটিকজলে ধুয়ে গেল।’’
ঝিলমের স্রোত বয়ে যায়, সময় অতিবাহিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কথা-কণিকাও তৈরি হতে থাকে, নতুন নতুন বাখ ছড়িয়ে পড়ে। জীবনের শেষে লাল্লার সঙ্গে সুফি সাধক সৈয়দ হামদানির দেখা হয়, আলাপচারিতায় লাল-এর মনে জমে থাকা শেষ সন্দেহগুলির নিরসনও হয়। এ বার যোগেশ্বরী লাল দেদ লাল্লা আরিফা বা মজনুন-ই আকিলা লকব পেয়ে সুফি সিলসিলায় ঢুকে পড়েন। আল্লার জ্ঞানে সিদ্ধ ও প্রেমে উন্মত্ত লাল্লা, একেবারে রাবেয়াতুল্যা। কথিত আছে, বাল্যে নুরুদ্দিন বা নন্দঋষির মতো সাধক লাল্লার সাহচর্য পেয়েছিলেন, শতাধিক বছর বাদে লেখা ‘নুরনামা’র গোড়াতেই লাল্লাকে অবতার বলে বলা হয়েছে, তাঁর মার্গই তো সুফিদের মারেফৎ, তাঁর সিদ্ধিই তো একটি ‘মোকাম’। লাল্লার বচনে এ বার উঁকিঝুঁকি মারে তহশিলদার ও শিকারিরা, হিন্দু ও মুসলমান তো একেরই ভেদ মাত্র, ‘কারুর দেওয়া খাবার অস্পৃশ্য হতে পারে কখনও?’ বাখ অনুযায়ী, লাল্লার খিদে তো ‘হস্তিনী’র মতো।
সময়ের তালে উপত্যকার নির্বিশেষ জনগণ লাল্লার বচনে কণ্ঠ মেলান, দিদিমার কথ্য ‘বাখ’ই হয়ে ওঠে কাশ্মীরি সংস্কৃতির বিশিষ্ট অভিজ্ঞান। অষ্টাদশ শতকের কোনও এক সময়ে ভাস্কর রাজদান লাল্লার ষাটটি বাখ-এর সংস্কৃতে অনুবাদ করেন। লোকভাষা অনূদিত হচ্ছে দেবভাষায়, সে কালের অভিনব ঘটনা, কাশ্মীরি সংস্কৃতে দেশ থেকে মার্গে উজান বাওয়ার দুর্লভ নিদর্শন। উনিশ ও বিশ শতকে গেওর্ক ব্যুলার ও অরেল স্টাইন-এর (১৮৬২-১৯৪৩) মতো প্রাচ্যবিদ্যা বিশারদরা কলহন, অভিনবগুপ্ত ও ক্ষেমেন্দ্রের রচনার পাণ্ডুলিপির খোঁজে উপত্যকায় হাজির হন, স্টাইন তো একটি স্থায়ী আস্তানাও গাড়েন। সংস্কৃত পাণ্ডুলিপি খোঁজার ফাঁকে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের সঙ্গে আলাপচারিতায় লাল দেদ মাঝে মাঝেই উঁকিঝুঁকি মারতেন। তবে স্টাইনের মতো প্রাচ্যবিদ্যা বিশারদরা আগ্রহী মার্গসংস্কৃতিতে, লাল দেদ ঠিক তাঁদের কাছে কল্কে পান না। অবশেষে পাদরি রেভারেন্ড নোয়েলস-এর প্রবাদ সংগ্রহের (১৮৮৫) সুলুক ধরে ভারতীয় দেশজ ভাষার ঠিকুজি বিশারদ জর্জ আব্রাহাম গ্রিয়ারসন (১৮৫১-১৯৪১) ১৯১৪ সালে লাল বাখ-এ আগ্রহী হন। তাঁর মতে, কাশ্মীরি কথ্য ভাষাতেই আছে দর্দ ও পৈশাচী ভাষার ভাঙাচোরা রূপ, লাল বাখ তো অবশ্য অনুসন্ধানের যোগ্য। সারদা পীঠের কাছে গুস গ্রামে থাকতেন অতিবৃদ্ধ ধর্মদাস দরবেশ। আগ্রহী শ্রোতাদের কাছে লাল বাখ-এর সুরেলা আবৃত্তিই তাঁর বৃত্তি, ‘কুলপরম্পরা’ক্রমে সেই বৃত্তিতে তাঁর অধিকার। স্মৃতিনির্ভর কাজ, পুঁথির দরকার পড়ত না। ধর্মদাস দরবেশ আবৃত্তি করেন, গ্রিয়ারসনের নিয়োজিত সহকারী মুকুন্দরাম শাস্ত্রী আবৃত্তি অনুসারে অনুলিখন করেন ও ওই লিখনমাফিক গ্রিয়ারসনের করা ১০৯টি লাল বাখ-এর অনুবাদের সমন্বিত রূপ লন্ডনের এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে ১৯২০ সালে ছাপা হয়। স্টাইনের কাছ থেকে পাওয়া রাজানক ভাস্করের অনুবাদ ও ৪৯টি বাখের কাশ্মীরি পাণ্ডুলিপি, পণ্ডিত লিয়োনার্ড বার্নেটের টীকা আর গ্রিয়ারসনের নিজের শব্দতাত্ত্বিক, ছান্দসিক ও ঐতিহাসিক আলোচনা— সবই এই সংস্করণে জোড়া হয়। প্রাচ্যবিদ্যার জমকালো কাজ, সন্দেহ নেই। বইয়ের শিরোনামটি নজরকাড়া, ‘Lalla Vakyani or the Wise Sayings of Lal Ded, Mystic Poetess of Ancient Kashmir’। প্রাচ্যবিদ্যার পথ দিয়েই বইয়ের ছাপা অক্ষরে লাল দেদ উপত্যকার বাইরে হাজির হলেন, বিদেশি পণ্ডিত সমাজে ভাষান্তরে নতুন পরিচিতিও পেলেন। তিনি রহস্যবাদী ও মরমিয়া কবি, আর লালের অধ্যাত্মবাদের লক্ষণ মেলাতে কারও অসুবিধা হবে না। নিজের ভাষ্যে গ্রিয়ারসন মাঝে মাঝেই বাইবেলের উল্লেখ করেছেন, একটি লাল বাখের অধ্যাত্ম বার্তা তো এ বার বানিয়ানের ‘পিলগ্রিম’স প্রোগ্রেস’-এর সঙ্গে তুলনীয় উদাহরণ রূপে এসেছে।
‘ইন্ডিয়ান অ্যান্টিকোয়ারি’ পত্রিকার সম্পাদক, রিচার্ড কারনাক টেম্পল (১৮৫০-১৯৩১) আর এক কদম এগিয়ে গেলেন। গ্রিয়ারসনের সমকালেই তাঁর পত্রিকার পাতায় শ্রীনগর পৌর নিগমের সদস্য পণ্ডিত আনন্দ কাউল লাল দেদের উপর লোককথা ও ভিন্ন কিছু ‘লালবাখ’ জোগাড় করে ছাপিয়েছিলেন। তাঁর উদ্দেশ্য কাশ্মীরি ভাষার আদি উৎকৃষ্ট রূপ পেশ করা, ভাষাগৌরব তো জাতীয়তাবোধের উপাদান। এই বাখগুলি পড়ে টেম্পল মুগ্ধ। শৈব সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে লাল্লেশ্বরীর সাধনচিন্তা নিয়ে ১৯২৪-এ তিনি মোটা বই লিখলেন, প্রথম নামটি একেবারে বাইবেলগন্ধী, ‘The World of Lalla, the Prophetess’। লাল যেন ঈশ্বর-আদিষ্ট এক ত্রিকালজ্ঞা। বইয়ের শুরুতেই আছে লালের প্রতি নিবেদিত একটি দীর্ঘ অভিনন্দনগাথা। লাল্লা ও টেম্পল দুই ভিন্ন পথের রাহি, তবে দুই জনের লক্ষ্য তো সেই পরমেশ্বরের কৃপা প্রাপ্তি।
যোগেশ্বরী, আরিফা, প্রফেটেস— দিদিমা লাল এই সব উপাধিতে বিচলিত হতেন বলে মনে হয় না। ঐহিক সময়বিচারে লাল্লা তো ক্ষণভঙ্গবাদী, ক্ষণদর্শনে এই মুহূর্তের তিনি হয়ে উঠছেন পরের মুহূর্তের অন্য কেউ। তাঁর দৃষ্টিতে ক্ষণান্তরেই পঞ্চপাণ্ডবের মা রূপান্তরিত হন কুমোরবউয়ের খুড়িমায়, কোনও বাঁধাধরা পরিচিতিতে কাউকে বা কোনও কিছুকে জাপটে ধরা শক্ত। সময় তো অহরহ ভাঙে, ভাঙার সঙ্গে সঙ্গেই সব কিছুর বাহ্যরূপও যেন বিপরীত আকার নেয়। ‘লালবাক্যানি’র অতি সাম্প্রতিক কালের বাঙালি অনুবাদক জয়ন্ত ঘোষালের সুললিত অনুসৃজনের ভাষায় ‘শান্ত নদী বইছে এই মুহূর্তে... পরের মুহূর্তে দেখি সাঁকোটি বানের তোড়ে ভেসে গেছে। ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে জঙ্গল এখন, না গোলাপ না কাঁটা— মুহূর্তে দেখি কিছু নেই এখন।’
ভঙ্গবাদী সময়চেতনাতে লাল্লা উল্লসিত, রূপে রূপান্তরে তাঁর ব্যক্তিসত্তার নবায়ন হয়, ওই নবায়নেই তাঁর আত্মবোধে নিত্যকে আবাহন ও আত্মস্থ করার প্রস্তুতি চলে। বুঝদারিতে লাল কারও কৃপাপ্রার্থী নন, তিনি স্ব-উদ্যোগী ও স্ব-অনুভাবী। বাখগুলিতে লাল্লা নিজেই সব বলেন, নিজেই সব করেন। সবই ‘আমার কথা’ ও ‘আমার কাজ’। ক্রিয়াগুলি সকর্মক, উপত্যকার জনজীবনের নানা কাজের উপমায় লালকথা ভরপুর। লাল্লা বনে ছুটে বেড়ান, পথে নাচেন, পশুদের সঙ্গে কুস্তি করেন ও জলে ডুব দেন। হাপর চালিয়ে আগুনে তাঁকে লোহা পোড়াতে হয়। জাঁতা পেষা তাঁরই কাজ, খেতে সেচের জল দিতেও তিনি পিছপা নন। লাল্লা তো নারী, একগুচ্ছ সামাজিক প্রত্যাশা নারীকে মেটাতে হয়। মা হয়ে বাচ্চাকে দুধ খাওয়াতে হয়, বউ হয়ে আহ্লাদ দিতে হয় আর মোহিনী হয়ে গায়ে নাক ঘষতে হয়।
জীবনটা একেবারে কাপড়ের মতো, হয়ে ওঠাটা বড় যন্ত্রণাদীর্ণ। পূর্বাপর কয়েকটি বাখে কবি লাল বলেন যে লাল্লা যেন ফেটে যাওয়া শিমুলের তুলো, সাফাইওয়ালা ছিঁড়েছে আর ধুনুরি ধুনেছে, ধোপা আছাড় মেরেছে আর সাবান মাটিতে থুপিয়েছে। দর্জির কাঁচিতে তিনি ফালাফালা হয়েছেন, তবেই তো বয়নিত লাল্লা স্বর্গারোহী হওয়ার যোগ্যতা পেয়েছেন। যন্ত্রণাকে স্বীকৃতি দিয়েই জীবনসত্য থেকে
শিবসত্যে পৌঁছতে হয়, যন্ত্রণার বোধেই আত্ম প্রবোধিত হয়। তবে এই আত্মচৈতন্য স্বরাট হতে চায় না, চির-নিঃসঙ্গতা এই চৈতন্যের অবোধ্য। চৈতন্য তো সহ-জ, ভেতরেই থাকে, ওই সহ-জের টানেই বাইরেটা ঘরে আসে, চৈতন্য-প্রবুদ্ধ মন ‘স্বয়ংকে ভাবতে পারে অপর, অপরকে ভাবে স্বয়ং সে।’ এই সমন্বয়ও শেষে একাকার হয়, অন্বয়লুপ্ত একাকারী মিলনবোধই লাল্লার শিবসত্য, তাঁর জিকির, ‘শূন্য শূন্যে মিলিথ গয়ে।’ কেবল গোল্লাটাই শূন্য নয়। আত্মবোধ ও পরমবোধের সীমা মুছলেই তো যোগবিয়োগের দরকার পড়ে না, ওই শূন্যটাই পূর্ণ।
লাল দেদ শূন্য সাধিকা, তৎকাল তো ক্ষণিক। অথচ কোনও কোনও বাখে লাল দুঃসময়ের ইঙ্গিত দেন, বেতালা কালও ভাঙা সময়ের একটি ক্ষণ। সে হেন সময়ে বাগানের ফল নষ্ট হয়ে উপত্যকা উজাড় হয়ে যায়, পরিবার ধ্বংস হয়ে মা-মেয়ে পথে ঘুরে বেড়ায়। লোকে বলে যে ১৯৯০ সাল থেকে লাল আর সবার নির্বিশেষে দিদা নন, সেটাও দুঃসময়। কোনও না কোনও ইসলামি বা পণ্ডিতি গোষ্ঠীর ধর্মধ্বজীরা, বেছে বেছে বাখগুলি নিজের গোঠে নিয়ে যায় আর ব্যবহার করে। শুনেছি যে উপত্যকায় লাল্লার নামে চিকিৎসালয় আছে, ছররার গুলিতে চোখ জখম হওয়া অধিবাসীদের নিয়ে যাওয়া হয়, আলো কি ফেরে? সমন্বয়ী ও শমকামী সংস্কৃতি জঙ্গি রাষ্ট্র ও আগ্রাসী ধর্মধ্বজী নানা গোষ্ঠীর চোখের বালি, জবরদস্তিতে সাংস্কৃতিক অন্বয়ের তন্তুগুলো ছিঁড়ে ফেলাই তাদের লক্ষ্য। উপত্যকায় অমাবস্যা নামে, নদী ও অরণ্যের গহন গভীর থেকে লাল বাখ ধ্বনিত হয়, যাদের শোনার তারা নাকি শোনে। আর এক কালের প্রান্ত থেকে লালের কথা আমাদের আধুনিক কানে আসে, রাজনীতির কূটকচালি নয়, উপলব্ধির বাণী। ভয় তো আত্মক্ষয়। আত্ম ও অপরের চেনাশোনায় আত্মশক্তি বেড়ে যায়, ভেদের স্বীকৃতি অভেদকে মান্য করার প্রাকশর্ত, অভেদই অভয় জাগায়। হৃদয়ের গভীরে আমি লাল্লা বলছি, আমি লাল্লা, তোমাদের আর সকলের লাল্লা।