বিশ্বাস করতেন রাজা রামমোহন রায়। তাই পরমেশ্বরের আরাধনার জন্য রচনা করেছিলেন ব্রহ্মসঙ্গীত।
Raja Ram Mohan Roy

Raja Rammohan Roy: ধ্যান বা মন্ত্রের চেয়ে গানে মন স্পর্শ করা সহজ

নানা পরিচয়ের আড়ালে চাপা পড়ে গেছে রামমোহনের সঙ্গীতসাধক সত্তাটি। কিন্তু বাংলা গানের ইতিহাসে যুক্ত করেছে এক স্নিগ্ধ ধারা।

Advertisement

কৃষ্ণা রায়

শেষ আপডেট: ৩০ জানুয়ারি ২০২২ ০৮:০৫
Share:

বহু শতাব্দীর বাংলা গানের ইতিহাস সমৃদ্ধ হয়েছে বিভিন্ন যুগে বিচিত্র থেকে বিচিত্রতর গানের বৈশিষ্ট্য নিয়ে, আর অসংখ্য গুণী মানুষের অবদানে। সে ধারায় একটি প্রায় অনালোচিত নাম রাজা রামমোহন রায়। তিনি একাধারে বাংলার নবজাগরণের অগ্রদূত, বহুভাষাবিদ, চিন্তাবিদ, সমাজ-সংস্কারক, ধর্ম-সংস্কারক, প্রতিষ্ঠিত রাজকর্মচারী, ইউরোপে ভারতের রাজদূত, সাহিত্যসাধক, সম্পাদক এবং এমনই নানা পরিচয়ের আড়ালে হারিয়ে যাওয়া এক জন কৃতী গীতিকার ও সুরকার। তাঁর তীক্ষ্ণ মনীষার সন্ধান করেছেন কত গবেষক, অথচ বাংলা গানের ইতিহাসে এক স্নিগ্ধ, গম্ভীর, পরিশীলিত ধারার সংযোজন যে তিনি করে গেছেন, যা কিয়দংশে অনুপ্রাণিত করেছে উত্তরসূরি রবীন্দ্রনাথকেও, সে বিষয়ে খবর রাখেন না অনেকেই। বাংলা গানের ভুবনে আর একটু বেশি স্বীকৃতি তাঁর পাওনা।

Advertisement

রামমোহন কবে গান শিখলেন, সারা জীবনে ক’টি গান লিখলেন, কী ভাবে সে সবের সুর সংরক্ষিত হয়েছে এ সব নানা প্রশ্নে বাঙালি কৌতূহলী হতেই পারেন। বস্তুত তাঁর একষট্টি বছরের ব্যস্ত জীবনে নিশ্চিন্তে সঙ্গীতসাধনার অবকাশ কমই হয়েছে। চল্লিশোত্তর প্রৌঢ় রামমোহন সমসাময়িক ওস্তাদ গায়ক ধ্রুপদ ও টপ্পা বিশেষজ্ঞ কালী মির্জা তথা কালীপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের কাছে গানের চর্চা করেছিলেন। তার কিছু পর থেকেই তাঁর ভাবসমৃদ্ধ রাগাশ্রয়ী ব্রহ্মসঙ্গীত জনসমক্ষে নিয়ে আসেন। সেগুলো শ্রোতাদের মধ্যে মুগ্ধ বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছিল। ব্রহ্মসঙ্গীত নামটি রামমোহনেরই দেওয়া। অনুমান করা হয়, বৈষ্ণব মনোভাবাপন্ন পিতৃ-পরিবার এবং শাক্ত মাতৃ-পরিবারের উত্তরাধিকার বহনকারী রামমোহন আশৈশব কীর্তন, শ্যামাসঙ্গীত শুনেছেন, জমিদারবাড়ির পুরনো প্রথামাফিক ওস্তাদি ঘরানার মার্গসঙ্গীতের স্বাদ জেনেছেন। ভারতের বিস্তৃত অঞ্চলে পরিভ্রমণ কালে পটনা, বারাণসী, নেপাল, তিব্বত, ভাগলপুর, রংপুর, মুর্শিদাবাদ এবং শেষে কলকাতায়, অর্থাৎ বিভিন্ন আঞ্চলিক ঘরানার সংস্পর্শে এসেছেন। অসামান্য মেধাবী ও শ্রুতিধর রামমোহনের তাই ১৮১২ থেকে ১৮১৫ সালে কালী মির্জার সান্নিধ্যে এসে রাগাশ্রয়ী গানের চর্চা শুধু সময়েরই অপেক্ষা ছিল।

গবেষকদের মতে তাঁর প্রথম লেখা গান ১৮১৬ সালে, সিন্ধু ভৈরবী রাগে, ঠুংরি তালে রচিত গানটি হল ‘কে ভুলালো হায়’। ১৮১৬ সালে তাঁর প্রতিষ্ঠিত আত্মীয়সভার এক অধিবেশনে এই গান গাওয়া হয়। তাঁর দ্বিতীয় গান ‘ভয় করিলে যাঁরে না থাকে অন্যের ভয়’ সাহানা রাগে, ধামার তালে নিবদ্ধ। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ থেকে প্রকাশিত ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সজনীকান্ত দাস সম্পাদিত ‘রামমোহন গ্রন্থাবলী’তে ‘ব্রহ্ম-সঙ্গীত’ অধ্যায়ে স্থান পেয়েছে তাঁর রচিত বত্রিশটি গান। প্রতিটি গানের জন্য আধার রাগ এবং প্রযুক্ত তালের উল্লেখ আছে। জীবনের শেষ গানটি লিখেছিলেন ব্রিস্টলে, ১৮৩২ সালে। মৃত্যুর মাত্র পাঁচ দিন আগে ব্রাহ্মসমাজের জন্য লেখা এই গানটি জ্যেষ্ঠপুত্র রাধাপ্রসাদের কাছে পাঠিয়ে ছিলেন। প্রবাসে থেকেও বিস্মৃত হননি তাঁর উপাস্যকে— “কি স্বদেশে, কি বিদেশে/ যথায় তথায় থাকি— তোমার প্রভাব দেখি/ না থাকি একাকী।”

Advertisement

রামমোহনের লেখা গানের সংখ্যা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে মতান্তর যথেষ্ট। বিভিন্ন সঙ্কলনে ছড়িয়ে আছে তাঁর গান। অধুনা ব্রাহ্মসমাজের উপাসনায় অবশ্য তাঁর রচিত মাত্র কয়েকটির (‘নিত্য নিরঞ্জন’, ‘ভয় করিলে যারে’, ‘ভাব সে একই’) বেশি গান গাওয়া হয় না। যাঁরা তাঁর গান এখনও পরিবেশন করেন, তাঁরা জানেন স্বরলিপি সংগ্রহ অথবা পরিবেশন, দু’টিই কী ভীষণ রকম দুরূহ কাজ!

কিন্তু কেমন গান রামমোহনের ব্রহ্মসঙ্গীত? বেদান্ত-উপনিষদের অদ্বৈতবাদ আর ইসলাম ও খ্রিস্টধর্মের একেশ্বরবাদের সংশ্লেষে রামমোহনের মনে জগতের সৃষ্টিকর্তা বা পরমেশ্বর (নিরাকার ব্রহ্ম, যার রূপ নেই, কিন্তু মহিমা আছে) সম্বন্ধে যে অমূর্ত ধারণা গড়ে উঠেছিল, তিনি ভেবেছিলেন তাঁকে উপলব্ধির ও তাঁর উপাসনার জন্য ধ্যান বা মন্ত্রপাঠ যথেষ্ট নয়। বরং উপাসনা-সভায় অসাম্প্রদায়িক অথচ জ্ঞানসমৃদ্ধ গানের পরিবেশন অনেক কার্যকরী। গানের মাধ্যমে সহজেই বহু মানুষের মন স্পর্শ করা যায়। তাঁর গানের ভাষা যদিও বিবরণ অথবা উপদেশধর্মী, তবু লেখায় ছন্দ মিলিয়ে অন্ত্যমিল নিখুঁত করতে প্রয়াসী হয়েছেন বার বার। আর এ ভাবেই ভারতীয় রাগ-রাগিণীর আধারে ব্রহ্মবিষয়ক বাণী সংযুক্ত করে নির্মাণ করলেন এক নতুন ধারার গান বা ব্রহ্মসঙ্গীত। এরই মাধ্যমে তিনি জনমানসে ছড়িয়ে দিলেন এক বিশেষ সঙ্গীত-চেতনা। তাঁর সময়কালের কীর্তন, শ্যামাসঙ্গীত, রামপ্রসাদী অথবা তরজা, কবিগান, আঞ্চলিক লোকগীতি কিংবা লঘু চালের পক্ষীদলের গান, আখড়াই গান প্রভৃতি উপেক্ষা করে ব্রহ্মসঙ্গীতে আশ্রয় করলেন মূলত ধ্রুপদ এবং টপ্পা গানের চলন। কলকাতার পাথুরিয়াঘাটের জমিদার দর্পনারায়ণ ঠাকুরের পৌত্র গোপীমোহন ও গোপীমোহন ঠাকুরের পুত্র প্রসন্নকুমার ঠাকুর, সঙ্গীতশিল্পী রাহিম খাঁ এবং সমকালের অনেক সঙ্গীতশিল্পী ও সঙ্গীতগুণীদের নিয়ে সঙ্গীতের যে পরিমণ্ডল তিনি গড়ে তুলেছিলেন, সেই বৃত্তে, পরমেশ্বর-উপাসনায় জেগে উঠল প্রাচীন ভারতীয় আধ্যাত্মিকতায় পূর্ণ সাধনসঙ্গীত বা ব্রহ্মসঙ্গীতের ভুবন। ব্রহ্মসঙ্গীতের মাধ্যমে রামমোহন সমাজ সংস্কারের পথ ধরে মানুষের চিত্তশুদ্ধির জন্য চটুল গানের পরিবর্তে বাংলা গানেরও সংস্কার করলেন।

কিন্তু প্রাচ্য-পাশ্চাত্য বিষয়ে প্রাজ্ঞ রামমোহনের গানের জনপ্রিয়তা রামপ্রসাদ সেন বা নিধুবাবুর গানের মতো হয়নি। তাঁর সঙ্গীতপ্রাণ সত্তাটিকে বাঙালি বোঝেননি। বিষয়বস্তুর গাম্ভীর্য, ভারী রাগ-রাগিণী এবং কঠিন তালের কাঠামোয় রচিত গানগুলিকে সাধারণ গায়কের পক্ষে কণ্ঠধার্য করা সম্ভব হয়নি। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে, কথার মাধ্যমে ব্রহ্মের স্বরূপ বোঝানোর চেষ্টায় রামমোহনের আন্তরিকতা নিখাদ ছিল। ধরা যাক সেই গানটি, “ভাব সেই একে/ জলে স্থলে শূন্যে যে/ সমান ভাবে থাকে/ যে রচিল এ সংসার/ আদি নাহি অন্ত যার/ সে জানে সকল/ কেহ নাহি জানে তাকে...” ভাষার স্পষ্টতায় আরাধ্য ঈশ্বরের যে পরিচয় তিনি তুলে ধরেছেন, সেখানে অনুভূতির গভীরতা থাকলেও সাহিত্যরসের অভাব একটু হতাশ করে। তবে এ কথাও তো ঠিক, এর আগে নিরাকার ঈশ্বরকে নিয়ে আরাধনার গান বাংলা ভাষায় কেউ সে ভাবে লেখেননি। প্রচলিত প্রথায় ‘সাকার আরাধ্যকে’ নিয়ে গান লেখা বা সব স্তরের মানুষের কাছে তাকে পৌঁছে দেওয়া বরং অনেক সহজ হয়েছিল, যা অনায়াসে পেরেছিলেন তাঁর পূর্বসূরি রামপ্রসাদ সেন, কিংবা সমসাময়িক বাউল-সাধক লালন ফকির, তাঁর দেহতত্ত্বনির্ভর সরল ভাষার গানে। এ সব গান গ্রহণে বাঙালি কুণ্ঠিত হয়নি। কিন্তু অপরিচিত নিরাকার ঈশ্বরীয় তত্ত্ব প্রকাশের জন্য বাংলা ভাষাও তখন প্রস্তুত হয়ে ওঠেনি। বাংলা গদ্যের কুশলী শিল্পী রামমোহনের পক্ষেও সে ভাষাকে সে দিন অন্তরঙ্গ করে তোলা সম্ভব হয়নি। সে কাজ অনেক পরে পেরেছিলেন তাঁর উত্তরসূরি রবীন্দ্রনাথ। পরমেশ্বরের প্রকাশে তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন অনুপম এক অনুভব: “তার
অন্ত নাইগো যে আনন্দে গড়া আমার অঙ্গ/ তার অণু পরমাণু পেল কত আলোর সঙ্গ।”

সে দিনের সঙ্গীতসাধক রামমোহনের কৃতিত্ব এই যে, তিনি শুধু একা এ ধরনের গান লেখেননি, অনুপ্রাণিত করেছেন আরও অনেক সমকালীন মানুষকে, স্বয়ং রামনিধি গুপ্তকেও। ক্রমে ব্রাহ্মসমাজের চৌহদ্দি পেরিয়ে ব্রহ্মসঙ্গীত ছড়িয়ে পড়ে শিক্ষিত, দীক্ষিত জনমানসে, পরবর্তী কালে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতেও। যার অন্তর্লীন ভাববস্তুর চূড়ান্ত ও অসামান্য রূপান্তর ঘটেছে রবীন্দ্রনাথের অজস্র গানে।

ফিরে আসি রামমোহনের জীবনের গান রচনার পর্বে। ১৮১৬-১৮৩২, ষোলো বছর ব্যাপী এই সঙ্গীতরচনার প্রহরে তাঁর গানে ব্যবহৃত হয়েছে বাগেশ্রী, রামকেলী, বেহাগ, ভৈরবী, ঝিঁঝিট প্রভৃতি রাগ, তালের ক্ষেত্রে আড়াঠেকা, একতাল, তেওট ইত্যাদি। ধ্রুপদ বা টপ্পার চলনে ব্রহ্মসঙ্গীত বাংলা গানের ধারায় এক ভিন্নতর ঋজুতার জন্ম দিয়েছিল।

রামমোহনের কাল পেরিয়ে ব্রহ্মসঙ্গীত রবীন্দ্র-সান্নিধ্যে এসে অন্য মাত্রা পেয়েছে। কিন্তু উৎসের যে গন্ধ গানের গায়ে লেগে আছে, তাকে ছাড়ানো বড় কঠিন। যখন শুনি রবীন্দ্রনাথের ১৮৮২ সালে লেখা টপ্পা-অঙ্গের গান ‘অনন্ত সাগর মাঝে দাও তরী ভাসায়ে’ তার পরে যদি শুনি রামমোহনগীতি ‘স্মরো পরমেশ্বরে অনাদি কারণে/ বিবেক বৈরাগ্য দুই সাধনে,’ বুঝতে অসুবিধে হয় না, ভাষার ফারাক থাকলেও সুরের চলনে দুই গানে অনাবিল সাযুজ্য। অন্যমনস্ক শ্রোতার শ্রুতিতেও ধরা পড়বে। এ ভাবেই রামমোহনের সাঙ্গীতিক প্রয়াসের অনন্তধারা বয়ে গেছে।

‘রাজা রামমোহন’ নামের চলচ্চিত্রে তাঁর গান ব্যবহৃত হয়েছিল। তা ছাড়াও বাঙালি শ্রোতা স্মরণ করতেই পারেন, সত্যজিৎ রায়ের ‘চারুলতা’ ছবিতে বন্ধুদের সঙ্গে আলাপচারিতার একটি দৃশ্যে ব্যবহৃত বিশেষ সেই গান, ‘মনে কর শেষের সে দিন ভয়ংকর/ অন্যে বাক্য কবে কিন্তু তুমি রবে নিরুত্তর...’ এ গান সাধারণ শ্রোতার মনে বরাবর রামমোহন-গীতি সম্বন্ধে বিমুখতা সৃষ্টি করেছে। চলচ্চিত্রে সত্যজিৎ খুব স্বল্প-পরিসরে গানটি পরিবেশন করে কিসের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন? গানের মাধ্যমে উদারপন্থী রামমোহন রায়ের আজীবনের অভিজ্ঞতা-প্রসূত জীবনবেদ? সম্ভবত তাই।

ব্যক্তি রামমোহনের অজস্র গুণের সঙ্গে সেই অসামান্য সঙ্গীতসাধকের প্রতি বাঙালি আজও নিতান্ত উদাসীন। কালপ্রবাহে সে মূল্যায়ন যেন তাঁর দারিদ্র-লাঞ্ছিত অন্তিম জীবনের মতো করুণ না হয়ে ওঠে।

তথ্যঋণ: রীনা দোলন বন্দ্যোপাধ্যায়

বহু শতাব্দীর বাংলা গানের ইতিহাস সমৃদ্ধ হয়েছে বিভিন্ন যুগে বিচিত্র থেকে বিচিত্রতর গানের বৈশিষ্ট্য নিয়ে, আর অসংখ্য গুণী মানুষের অবদানে। সে ধারায় একটি প্রায় অনালোচিত নাম রাজা রামমোহন রায়। তিনি একাধারে বাংলার নবজাগরণের অগ্রদূত, বহুভাষাবিদ, চিন্তাবিদ, সমাজ-সংস্কারক, ধর্ম-সংস্কারক, প্রতিষ্ঠিত রাজকর্মচারী, ইউরোপে ভারতের রাজদূত, সাহিত্যসাধক, সম্পাদক এবং এমনই নানা পরিচয়ের আড়ালে হারিয়ে যাওয়া এক জন কৃতী গীতিকার ও সুরকার। তাঁর তীক্ষ্ণ মনীষার সন্ধান করেছেন কত গবেষক, অথচ বাংলা গানের ইতিহাসে এক স্নিগ্ধ, গম্ভীর, পরিশীলিত ধারার সংযোজন যে তিনি করে গেছেন, যা কিয়দংশে অনুপ্রাণিত করেছে উত্তরসূরি রবীন্দ্রনাথকেও, সে বিষয়ে খবর রাখেন না অনেকেই। বাংলা গানের ভুবনে আর একটু বেশি স্বীকৃতি তাঁর পাওনা।

রামমোহন কবে গান শিখলেন, সারা জীবনে ক’টি গান লিখলেন, কী ভাবে সে সবের সুর সংরক্ষিত হয়েছে এ সব নানা প্রশ্নে বাঙালি কৌতূহলী হতেই পারেন। বস্তুত তাঁর একষট্টি বছরের ব্যস্ত জীবনে নিশ্চিন্তে সঙ্গীতসাধনার অবকাশ কমই হয়েছে। চল্লিশোত্তর প্রৌঢ় রামমোহন সমসাময়িক ওস্তাদ গায়ক ধ্রুপদ ও টপ্পা বিশেষজ্ঞ কালী মির্জা তথা কালীপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের কাছে গানের চর্চা করেছিলেন। তার কিছু পর থেকেই তাঁর ভাবসমৃদ্ধ রাগাশ্রয়ী ব্রহ্মসঙ্গীত জনসমক্ষে নিয়ে আসেন। সেগুলো শ্রোতাদের মধ্যে মুগ্ধ বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছিল। ব্রহ্মসঙ্গীত নামটি রামমোহনেরই দেওয়া। অনুমান করা হয়, বৈষ্ণব মনোভাবাপন্ন পিতৃ-পরিবার এবং শাক্ত মাতৃ-পরিবারের উত্তরাধিকার বহনকারী রামমোহন আশৈশব কীর্তন, শ্যামাসঙ্গীত শুনেছেন, জমিদারবাড়ির পুরনো প্রথামাফিক ওস্তাদি ঘরানার মার্গসঙ্গীতের স্বাদ জেনেছেন। ভারতের বিস্তৃত অঞ্চলে পরিভ্রমণ কালে পটনা, বারাণসী, নেপাল, তিব্বত, ভাগলপুর, রংপুর, মুর্শিদাবাদ এবং শেষে কলকাতায়, অর্থাৎ বিভিন্ন আঞ্চলিক ঘরানার সংস্পর্শে এসেছেন। অসামান্য মেধাবী ও শ্রুতিধর রামমোহনের তাই ১৮১২ থেকে ১৮১৫ সালে কালী মির্জার সান্নিধ্যে এসে রাগাশ্রয়ী গানের চর্চা শুধু সময়েরই অপেক্ষা ছিল।

গবেষকদের মতে তাঁর প্রথম লেখা গান ১৮১৬ সালে, সিন্ধু ভৈরবী রাগে, ঠুংরি তালে রচিত গানটি হল ‘কে ভুলালো হায়’। ১৮১৬ সালে তাঁর প্রতিষ্ঠিত আত্মীয়সভার এক অধিবেশনে এই গান গাওয়া হয়। তাঁর দ্বিতীয় গান ‘ভয় করিলে যাঁরে না থাকে অন্যের ভয়’ সাহানা রাগে, ধামার তালে নিবদ্ধ। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ থেকে প্রকাশিত ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সজনীকান্ত দাস সম্পাদিত ‘রামমোহন গ্রন্থাবলী’তে ‘ব্রহ্ম-সঙ্গীত’ অধ্যায়ে স্থান পেয়েছে তাঁর রচিত বত্রিশটি গান। প্রতিটি গানের জন্য আধার রাগ এবং প্রযুক্ত তালের উল্লেখ আছে। জীবনের শেষ গানটি লিখেছিলেন ব্রিস্টলে, ১৮৩২ সালে। মৃত্যুর মাত্র পাঁচ দিন আগে ব্রাহ্মসমাজের জন্য লেখা এই গানটি জ্যেষ্ঠপুত্র রাধাপ্রসাদের কাছে পাঠিয়ে ছিলেন। প্রবাসে থেকেও বিস্মৃত হননি তাঁর উপাস্যকে— “কি স্বদেশে, কি বিদেশে/ যথায় তথায় থাকি— তোমার প্রভাব দেখি/ না থাকি একাকী।”

রামমোহনের লেখা গানের সংখ্যা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে মতান্তর যথেষ্ট। বিভিন্ন সঙ্কলনে ছড়িয়ে আছে তাঁর গান। অধুনা ব্রাহ্মসমাজের উপাসনায় অবশ্য তাঁর রচিত মাত্র কয়েকটির (‘নিত্য নিরঞ্জন’, ‘ভয় করিলে যারে’, ‘ভাব সে একই’) বেশি গান গাওয়া হয় না। যাঁরা তাঁর গান এখনও পরিবেশন করেন, তাঁরা জানেন স্বরলিপি সংগ্রহ অথবা পরিবেশন, দু’টিই কী ভীষণ রকম দুরূহ কাজ!

কিন্তু কেমন গান রামমোহনের ব্রহ্মসঙ্গীত? বেদান্ত-উপনিষদের অদ্বৈতবাদ আর ইসলাম ও খ্রিস্টধর্মের একেশ্বরবাদের সংশ্লেষে রামমোহনের মনে জগতের সৃষ্টিকর্তা বা পরমেশ্বর (নিরাকার ব্রহ্ম, যার রূপ নেই, কিন্তু মহিমা আছে) সম্বন্ধে যে অমূর্ত ধারণা গড়ে উঠেছিল, তিনি ভেবেছিলেন তাঁকে উপলব্ধির ও তাঁর উপাসনার জন্য ধ্যান বা মন্ত্রপাঠ যথেষ্ট নয়। বরং উপাসনা-সভায় অসাম্প্রদায়িক অথচ জ্ঞানসমৃদ্ধ গানের পরিবেশন অনেক কার্যকরী। গানের মাধ্যমে সহজেই বহু মানুষের মন স্পর্শ করা যায়। তাঁর গানের ভাষা যদিও বিবরণ অথবা উপদেশধর্মী, তবু লেখায় ছন্দ মিলিয়ে অন্ত্যমিল নিখুঁত করতে প্রয়াসী হয়েছেন বার বার। আর এ ভাবেই ভারতীয় রাগ-রাগিণীর আধারে ব্রহ্মবিষয়ক বাণী সংযুক্ত করে নির্মাণ করলেন এক নতুন ধারার গান বা ব্রহ্মসঙ্গীত। এরই মাধ্যমে তিনি জনমানসে ছড়িয়ে দিলেন এক বিশেষ সঙ্গীত-চেতনা। তাঁর সময়কালের কীর্তন, শ্যামাসঙ্গীত, রামপ্রসাদী অথবা তরজা, কবিগান, আঞ্চলিক লোকগীতি কিংবা লঘু চালের পক্ষীদলের গান, আখড়াই গান প্রভৃতি উপেক্ষা করে ব্রহ্মসঙ্গীতে আশ্রয় করলেন মূলত ধ্রুপদ এবং টপ্পা গানের চলন। কলকাতার পাথুরিয়াঘাটের জমিদার দর্পনারায়ণ ঠাকুরের পৌত্র গোপীমোহন ও গোপীমোহন ঠাকুরের পুত্র প্রসন্নকুমার ঠাকুর, সঙ্গীতশিল্পী রাহিম খাঁ এবং সমকালের অনেক সঙ্গীতশিল্পী ও সঙ্গীতগুণীদের নিয়ে সঙ্গীতের যে পরিমণ্ডল তিনি গড়ে তুলেছিলেন, সেই বৃত্তে, পরমেশ্বর-উপাসনায় জেগে উঠল প্রাচীন ভারতীয় আধ্যাত্মিকতায় পূর্ণ সাধনসঙ্গীত বা ব্রহ্মসঙ্গীতের ভুবন। ব্রহ্মসঙ্গীতের মাধ্যমে রামমোহন সমাজ সংস্কারের পথ ধরে মানুষের চিত্তশুদ্ধির জন্য চটুল গানের পরিবর্তে বাংলা গানেরও সংস্কার করলেন।

কিন্তু প্রাচ্য-পাশ্চাত্য বিষয়ে প্রাজ্ঞ রামমোহনের গানের জনপ্রিয়তা রামপ্রসাদ সেন বা নিধুবাবুর গানের মতো হয়নি। তাঁর সঙ্গীতপ্রাণ সত্তাটিকে বাঙালি বোঝেননি। বিষয়বস্তুর গাম্ভীর্য, ভারী রাগ-রাগিণী এবং কঠিন তালের কাঠামোয় রচিত গানগুলিকে সাধারণ গায়কের পক্ষে কণ্ঠধার্য করা সম্ভব হয়নি। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে, কথার মাধ্যমে ব্রহ্মের স্বরূপ বোঝানোর চেষ্টায় রামমোহনের আন্তরিকতা নিখাদ ছিল। ধরা যাক সেই গানটি, “ভাব সেই একে/ জলে স্থলে শূন্যে যে/ সমান ভাবে থাকে/ যে রচিল এ সংসার/ আদি নাহি অন্ত যার/ সে জানে সকল/ কেহ নাহি জানে তাকে...” ভাষার স্পষ্টতায় আরাধ্য ঈশ্বরের যে পরিচয় তিনি তুলে ধরেছেন, সেখানে অনুভূতির গভীরতা থাকলেও সাহিত্যরসের অভাব একটু হতাশ করে। তবে এ কথাও তো ঠিক, এর আগে নিরাকার ঈশ্বরকে নিয়ে আরাধনার গান বাংলা ভাষায় কেউ সে ভাবে লেখেননি। প্রচলিত প্রথায় ‘সাকার আরাধ্যকে’ নিয়ে গান লেখা বা সব স্তরের মানুষের কাছে তাকে পৌঁছে দেওয়া বরং অনেক সহজ হয়েছিল, যা অনায়াসে পেরেছিলেন তাঁর পূর্বসূরি রামপ্রসাদ সেন, কিংবা সমসাময়িক বাউল-সাধক লালন ফকির, তাঁর দেহতত্ত্বনির্ভর সরল ভাষার গানে। এ সব গান গ্রহণে বাঙালি কুণ্ঠিত হয়নি। কিন্তু অপরিচিত নিরাকার ঈশ্বরীয় তত্ত্ব প্রকাশের জন্য বাংলা ভাষাও তখন প্রস্তুত হয়ে ওঠেনি। বাংলা গদ্যের কুশলী শিল্পী রামমোহনের পক্ষেও সে ভাষাকে সে দিন অন্তরঙ্গ করে তোলা সম্ভব হয়নি। সে কাজ অনেক পরে পেরেছিলেন তাঁর উত্তরসূরি রবীন্দ্রনাথ। পরমেশ্বরের প্রকাশে তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন অনুপম এক অনুভব: “তার
অন্ত নাইগো যে আনন্দে গড়া আমার অঙ্গ/ তার অণু পরমাণু পেল কত আলোর সঙ্গ।”

সে দিনের সঙ্গীতসাধক রামমোহনের কৃতিত্ব এই যে, তিনি শুধু একা এ ধরনের গান লেখেননি, অনুপ্রাণিত করেছেন আরও অনেক সমকালীন মানুষকে, স্বয়ং রামনিধি গুপ্তকেও। ক্রমে ব্রাহ্মসমাজের চৌহদ্দি পেরিয়ে ব্রহ্মসঙ্গীত ছড়িয়ে পড়ে শিক্ষিত, দীক্ষিত জনমানসে, পরবর্তী কালে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতেও। যার অন্তর্লীন ভাববস্তুর চূড়ান্ত ও অসামান্য রূপান্তর ঘটেছে রবীন্দ্রনাথের অজস্র গানে।

ফিরে আসি রামমোহনের জীবনের গান রচনার পর্বে। ১৮১৬-১৮৩২, ষোলো বছর ব্যাপী এই সঙ্গীতরচনার প্রহরে তাঁর গানে ব্যবহৃত হয়েছে বাগেশ্রী, রামকেলী, বেহাগ, ভৈরবী, ঝিঁঝিট প্রভৃতি রাগ, তালের ক্ষেত্রে আড়াঠেকা, একতাল, তেওট ইত্যাদি। ধ্রুপদ বা টপ্পার চলনে ব্রহ্মসঙ্গীত বাংলা গানের ধারায় এক ভিন্নতর ঋজুতার জন্ম দিয়েছিল।

রামমোহনের কাল পেরিয়ে ব্রহ্মসঙ্গীত রবীন্দ্র-সান্নিধ্যে এসে অন্য মাত্রা পেয়েছে। কিন্তু উৎসের যে গন্ধ গানের গায়ে লেগে আছে, তাকে ছাড়ানো বড় কঠিন। যখন শুনি রবীন্দ্রনাথের ১৮৮২ সালে লেখা টপ্পা-অঙ্গের গান ‘অনন্ত সাগর মাঝে দাও তরী ভাসায়ে’ তার পরে যদি শুনি রামমোহনগীতি ‘স্মরো পরমেশ্বরে অনাদি কারণে/ বিবেক বৈরাগ্য দুই সাধনে,’ বুঝতে অসুবিধে হয় না, ভাষার ফারাক থাকলেও সুরের চলনে দুই গানে অনাবিল সাযুজ্য। অন্যমনস্ক শ্রোতার শ্রুতিতেও ধরা পড়বে। এ ভাবেই রামমোহনের সাঙ্গীতিক প্রয়াসের অনন্তধারা বয়ে গেছে।

‘রাজা রামমোহন’ নামের চলচ্চিত্রে তাঁর গান ব্যবহৃত হয়েছিল। তা ছাড়াও বাঙালি শ্রোতা স্মরণ করতেই পারেন, সত্যজিৎ রায়ের ‘চারুলতা’ ছবিতে বন্ধুদের সঙ্গে আলাপচারিতার একটি দৃশ্যে ব্যবহৃত বিশেষ সেই গান, ‘মনে কর শেষের সে দিন ভয়ংকর/ অন্যে বাক্য কবে কিন্তু তুমি রবে নিরুত্তর...’ এ গান সাধারণ শ্রোতার মনে বরাবর রামমোহন-গীতি সম্বন্ধে বিমুখতা সৃষ্টি করেছে। চলচ্চিত্রে সত্যজিৎ খুব স্বল্প-পরিসরে গানটি পরিবেশন করে কিসের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন? গানের মাধ্যমে উদারপন্থী রামমোহন রায়ের আজীবনের অভিজ্ঞতা-প্রসূত জীবনবেদ? সম্ভবত তাই।

ব্যক্তি রামমোহনের অজস্র গুণের সঙ্গে সেই অসামান্য সঙ্গীতসাধকের প্রতি বাঙালি আজও নিতান্ত উদাসীন। কালপ্রবাহে সে মূল্যায়ন যেন তাঁর দারিদ্র-লাঞ্ছিত অন্তিম জীবনের মতো করুণ না হয়ে ওঠে।

তথ্যঋণ: রীনা দোলন বন্দ্যোপাধ্যায়

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement