Short story

মুখোশ

ছেলের বয়স মাত্র সাড়ে চার। এখুনি যেন ওর মধ্যে চল্লিশের ব্যক্তিত্ব। অদ্ভুত  লাগে ব্রতর। এত ইনট্রোভার্ট, এত গম্ভীর ওর ছেলে!

Advertisement

রাজশ্রী বসু অধিকারী

শেষ আপডেট: ১১ জুলাই ২০২১ ০৭:০৯
Share:

ছবি: শুভম দে সরকার।

উর্জার মুখ লাল। কপালে ঘামের বিন্দু। বেশ রাত এখন। শোওয়ার সময় হয়ে গেছে, কিন্তু এখনও নৈশ প্রসাধন হয়নি। ব্রত খাটের ওপর। ম্যাগাজ়িনের আড়াল থেকে নাটক দেখছিল আড়চোখে। এ বার উর্জার ঝাঁঝ শুনে সরাসরি তাকায়। অতটুকু ছেলে ঠোঁট কামড়ে ঘাড় গুঁজে দাঁড়িয়ে কাঁপছে। উর্জা ওর ওপর হম্বিতম্বি করে যাচ্ছে, “এইটুকু একটা প্যারাগ্রাফ এত ক্ষণেও মুখস্থ করতে পারলে না! কিচ্ছু হবে না তোমার। পাতি বাংলা মিডিয়ামে পড়বে তুমি। কেরানির ছেলে কেরানি হয়ে লাইফ স্পয়েল করবে।”

Advertisement

এত বকুনিতেও পম কাঁদে না এতটুকু। ব্রত ভাল করে লক্ষ করে ছেলেকে। ছেলের বয়স মাত্র সাড়ে চার। এখুনি যেন ওর মধ্যে চল্লিশের ব্যক্তিত্ব। অদ্ভুত লাগে ব্রতর। এত ইনট্রোভার্ট, এত গম্ভীর ওর ছেলে! উর্জার লাল হয়ে যাওয়া মুখটা দেখে বেশ আনন্দ হয়। বেশ হয়েছে পম পারছে না প্যারাগ্রাফটা বলতে।

কিন্তু কী এমন প্যারাগ্রাফ যে, এতখানি রাত অবধি ছেলেটাকে এমন চূড়ান্ত মেন্টাল প্রেশার দিচ্ছে উর্জা? ব্রতর কৌতূহল হয়। কিন্তু জানতে চাইলেই মুশকিল। উর্জার সিদ্ধান্তে মাথা গলানো মানে নিজের মানসম্মান খুইয়ে বসা। ছেলের ব্যাপারে এ বাড়ির কারও কিছু বলার অধিকার নেই। ফ্রম ডে ওয়ান। ব্রতর মনে পড়ে যায়, নার্সিংহোমেও সিন ক্রিয়েট করেছিল উর্জা। ব্রতর মাকে বলে ব্লাড টেস্টের জন্য পমকে নিয়ে গিয়েছিল আয়া। তখন উর্জা বাথরুমে। উর্জা কেবিনে ফিরে অকথ্য ভাষায় মাকে অপমান করেছিল। কেন ওর জন্য অপেক্ষা করা হয়নি, ওর বাচ্চার ব্যাপারে কোনও ডিসিশন একমাত্র ও-ই নিতে পারে, আর কেউ নয়... ইত্যাদি। ব্রতর মা নাতিকে দেখে ফিরলেন চোখের জল চাপতে চাপতে। তার পর থেকে এই সাড়ে চার বছর ছেলের ওপর উর্জারই মনোপলি।

Advertisement

মা পুরনো ধ্যানধারণার মানুষ, প্রায়ই অভিজ্ঞতা থেকে বলতে গেছেন কোনটা নিউবর্ন বেবির পক্ষে ভাল, কোনটা মন্দ। সে সব উড়িয়ে দিয়ে উর্জা সারা ক্ষণ নিজের বইপড়া জ্ঞান ফলিয়ে নানা এক্সপেরিমেন্ট করেই চলেছে বাচ্চাটার ওপর। মা আর বৌয়ের হাজার মতানৈক্যের মাঝে পড়ে ব্রতর অবস্থা শোচনীয়। চুপচাপ শোনা ছাড়া ওর আর বিশেষ কিছু করার থাকে না। সুখের চেয়ে স্বস্তি ভাল মেনে ব্রত নীরব দর্শকের ভূমিকাতেই থেকে যায়।

মাত্র দু’বছরের দুধের শিশু ওর চোখের সামনে দিয়েই প্লে-স্কুলে ভর্তি হল। সঙ্গে সঙ্গে বাড়িতেও ওর ওপর চেপে গেল বয়সের চেয়ে অনেক বেশি পড়া, ম্যানার্স আর ডেকোরামের চাপ।

ব্রত চোখের সামনে দেখছে একটা বাচ্চা অতিরিক্ত চাপে কেমন বুড়োর মতো হয়ে ওঠে। পম ভীষণ গম্ভীর আর চুপচাপ। মাঝে মাঝে ওকে ছাদের সিঁড়ির তলায় একা একা কথা বলতে বা খেলতে দেখা যায়। যদি কখনও ব্রত বা ওর মায়ের কাছে এসে বসেছে পম, সঙ্গে সঙ্গেই উর্জা এসে ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে গেছে ছেলেকে। অনেক অশান্তি হয়েছে প্রথম প্রথম। তার পর ছেলের মানসিক শান্তির কথা ভেবে ব্রত হাল ছেড়ে দিয়েছে।

একটা রোবটিক ব্যাপার এসে গেছে ছেলেটার মধ্যে। হাত-পা নেড়ে ঠিক ঠিক বলে কঠিন কঠিন রাইমস। সমস্ত পড়া বলে দেয় যন্ত্রের মতো। আর ছেলের বকলমে নিজের কৃতিত্বে খুশি হয় উর্জা। যত খুশি হয় ততই ছেলের ওপর প্রেশার বাড়ায়।

কিন্তু আজ পম ওর আশা পূরণ করতে পারছে না। যত পারছে না ততই খেপে উঠছে উর্জা, “কী মুশকিল পম, এইটুকু একটা প্যাসেজ ঠিকমতো বলতে পারছ না?” উর্জা ছেলেকে ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলে।

ছেলে কাঁচুমাচু হয়ে বলে, “ট্রায়িং মাম্মা...”

“আচ্ছা আর এক বার বল। তার পর রেকর্ড করব...”

রেকর্ড করার কথায় ব্রত মনোযোগী হয় এ দিকে। দেখাই যাক ব্যাপারটা, কী রেকর্ড হতে চলেছে। শোনা যায় কচি গলায় বড় বড় বিটকেল ইংরেজি শব্দওয়ালা টিচার্স ডে সংক্রান্ত একখানা বক্তৃতা। উই স্টুডেন্টস আর সেলিব্রেটিং দিস ডে অ্যাজ় আওয়ার টিচার্স ডে। দিস ইজ় দ্য বার্থডে অফ ডক্টর সর্বপল্লী রাধা… রাধা কি কি…”

“হোঁচট খাচ্ছ কেন? নামটাও ঠিক করে বলতে পারছ না? এত বার করে বললাম...”

ব্রত বুঝতে পারে, ওইটুকু ছেলে নামটা উচ্চারণই করতে পারছে না। সবে তো স্কুলে গিয়ে এ ফর অ্যাপল বি ফর ব্যাট শুরু করেছে। ওর কাছে তো ‘টিচার’ শব্দটাই পরিষ্কার নয় এখনও। তার আবার টিচার্স ডে! মনে মনে ভীষণ বিরক্ত হয় ব্রত। উর্জার চেষ্টার ত্রুটি নেই। হাতে মোবাইল নিয়ে তাক করে বসে আছে ছেলের দিকে। ভিডিয়ো হচ্ছে পমের বক্তৃতা।

এক সময় আর থাকতে না পেরে ব্রত বলে ওঠে, “কিসের রেকর্ডিং? কী এমন দরকার যে, বাচ্চা ছেলেটা এখনও ঘুমোতে যেতে পারল না?”

যতটা রেগে যাওয়া উচিত ছিল উর্জার, তা হল না। বরং ব্রতকে অবাক করে দিয়ে সে হেসে ওঠে। হাতের মোবাইলে চোখ রেখে বলে, “এ বার শুভদীপের মা কী করে দেখব!”

ব্রত বোঝে, ওর কথার আগেই রেকর্ডিংটা শেষ হয়ে গেছিল। নইলে এত ক্ষণে তুলকালাম বেধে যেত। পম বুঝতে পারছে না ওর আরও কোনও টাস্ক আছে, না কি এবার শুতে যাবে। এই শোওয়ার সময়েই একমাত্র ও যেতে পারে ঠাম্মার কাছে। ওখানেই শোওয়ার ব্যবস্থা করেছে উর্জা।

মোবাইলটা দেখেশুনে সন্তুষ্ট উর্জা উঠে দাঁড়ায়। ছেলের দিকে ফিরে বলে, “গো টু ইয়োর বেড। গুডনাইট।”

বাবার দিকে একটু হাসির আভাসমাখা চোখে তাকিয়ে ঘর ছেড়ে চলে যায় পম। পাশের ঘরে ঠামি জেগেই আছে। ব্রত লক্ষ করে, যাওয়ার আগে মাকে গুডনাইট কেন, কিছুই বলল না পম।

মনটা খচখচ করে ব্রতর। ছেলেটা চোখের সামনে মেশিন হয়ে যাচ্ছে। একটা বাচ্চা ঘুমের আগে মাকে জড়িয়ে ধরে আদর করবে, এটাই তো স্বাভাবিক। সেই সম্পর্কটাই নেই ওদের মধ্যে। পমের মধ্যে কেমন একটা ভাবলেশহীন তটস্থ ভাব।

উর্জা যদি ছেলেকে এই কঠিন নিয়মে না বাঁধত, তা হলে কি অন্য রকম হত পম? ব্রত নিজেও কি অশান্তি এড়াতে চেয়ে উর্জার সব অন্যায় মেনে নিয়ে আরও বড় অন্যায় করছে না নিজের ছেলের প্রতি? এর চেয়ে যদি সারা ক্ষণ বাবা-মায়ের ঝগড়া দেখতে দেখতেই বড় হত পম, সেটা কি আরও খারাপ হত? অজস্র চিন্তার ঢেউ ব্রতকে জাগিয়ে রাখে।

উর্জার প্রসাধন শেষ। রাতপোশাক পরে খুশিমনে সে এসে মোবাইল হাতে নিয়ে ব্রতর পাশে বসে। ঠেলা মেরে মেরে ডাকে, “এই দেখো, এরই মধ্যে তিরিশটা লাইক আর বারোটা কমেন্ট পড়ে গেছে। কাল সকালে তো ঝড় বয়ে যাবে কমেন্টের… তবু তো এখনও শুভদীপের মা দেখেনি। শুনছ...”

“কিসের লাইক কমেন্ট? কী সব বলে যাচ্ছ?”

“এই দেখো, এইমাত্র আপলোড করলাম পমের রেকর্ডিংটা...”

ব্রত তাকিয়ে দেখে, আধো-আধো উচ্চারণে পম বলে যাচ্ছে টিচার্স ডে সংক্রান্ত সব অজানা তথ্য, যা ওকে বহু চেষ্টায় মুখস্থ করিয়েছে ওর মা। ব্রত দেখে, চোখ বুজে দমবন্ধ করে মুখস্থ প্যাসেজ উগরে দিচ্ছে ওর সাড়ে চার বছরের ছেলে। শেষের লাইনটায় এসে চোখ খুলে তাকিয়েছে, যেন ঠিকঠাক উগরে দিতে পেরে বাচ্চাটা একটা বড় চাপ থেকে মুক্তি পেল।

“কী গো? এ রকম প্যাঁচার মতো মুখ করে আছ কেন? সবাই কত অ্যাপ্রিশিয়েট করছে! তোমার ভাল লাগছে না?”

ব্রতর ঠোঁট বেঁকে যায়, “অ্যাপ্রিশিয়েট? কাকে?”

“পমকে! আমার… আমাদের ছেলেকে!”

“পম কী বোঝে এ সবের? এই অ্যাপ্রিশিয়েশনে ওর দরকারই বা কী? ও তো ওঁর নামটাই বলতে পারছে না এখনও! সবচেয়ে বড় কথা, আজ তো সবে পয়লা সেপ্টেম্বর। এখনই তুমি এই পোস্ট দিয়েছ?”

এত কথা চুপ করে হজম করার মেয়ে নয় উর্জা। ব্রতর শেষ লাইনটাকেই আক্রমণ করে সে, “রাখো তো তোমার যত ব্যাকডেটেড চিন্তাভাবনা! এখন অ্যাডভান্স চলার যুগ। দেখোনি সপ্তমীর দিন থেকেই সবাই বিজয়া দশমীর মেসেজ দিতে শুরু করে? যে কাজটা করতেই হবে, তা ফেলে রেখে কী লাভ? বরং সবার আগে করে ফেলাই তো ভাল।”

উর্জার যুক্তিতে হতবাক ব্রত শুয়ে পড়ার উপক্রম করে। কিন্তু উর্জার ভাষণ এখনও শেষ হয়নি। সে বলে যায়, “পমের ক্লাসমেট শুভদীপের মা কী করেছিল জানো? পঁচিশে বৈশাখের দিন ছেলেকে দিয়ে এক বারে বাইশে শ্রাবণ সম্বন্ধেও রেকর্ড করিয়ে পোস্ট করেছিল। তাই দেখে সবাই বলেছে কী মডার্ন কনসেপ্ট। তুমি যত মডার্ন হবে, ততই তোমার দাম বাড়বে— এটা কিছুতেই তোমার মাথায় ঢোকে না…”

পিছন ফিরে শুয়ে শুয়ে নিঃশ্বাস ফেলে ব্রত। কী দাম, কিসের দাম, কার কাছে দাম... ওর মাথায় ঢোকে না।

অনেক ক্ষণ নিজের মনে বকে এক সময় থেমে যায় উর্জা। ঘুমিয়ে পড়ে মোবাইল বুকে চেপে। ব্রতর আর ঘুম আসে না। পমের গম্ভীর মুখটা চোখে ভাসছে। ছেলেটা এত কম কথা বলে, কী যে ওর মনের ভেতর চলছে বোঝাই যায় না। এর চেয়ে ও যদি বায়না করত, কান্নাকাটি করত, লাফালাফি করত, তা হলে অনেক ভাল হত। কিন্তু উর্জা নিজের হাতে ছেলেকে মানুষ করতে গিয়ে রোবট করে তুলছে।

নিজের ওপর অপরিসীম বিরক্তি নিয়ে খাট থেকে উঠে পড়ে ও। পায়ে পায়ে মায়ের ঘরের সামনে এসে দাঁড়ায়। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ, কিন্তু বারান্দার দিকের জানলার পাল্লা খোলা। সেখান দিয়ে এসে পড়েছে সরু আলোর রেখা। এত রাতেও লাইট নেভায়নি মা? দেখতে পেলে তো উর্জা আবার অশান্তি করবে! ব্রত পা টিপে টিপে জানলার পাল্লা দিয়ে উঁকি মারে ভেতরে।

দেখতে পায় খাটের ওপর আসনপিঁড়ি হয়ে বসে আছে মা। আর পম পাউডারের কৌটো উপুড় করে ঢালছে মায়ের মাথায়। ঢালছে আর খিলখিল করে হাসছে। মায়ের চুল মুখ সব সাদা। এ বার পম বসল পা জোড়া করে। মা রঙের প্যালেটে তুলি ডুবিয়ে ডুবিয়ে ডোরা ডোরা দাগ এঁকে দিচ্ছে ওর মুখে। বেশ অনেক ক্ষণ কাটল ওদের পারস্পরিক সাজসজ্জায়। এ বার পম বলছে, “ঠামি, তুমি খরগোশ, আমি বাঘ। এ বার সেই গল্পটা বলো, বাঘ কী করে খরগোশের বুদ্ধির কাছে হেরে গেল… ওইটা আমি বন্ধুদের শেখাব কাল স্কুলে...”

“ওরে দুষ্টু! আমি তোকে বলব আর তুই সেগুলো সবাইকে শেখাবি?”

“হ্যাঁ তো। ওদের কারও তো ঠামি নেই। সবাই ওয়েট করে থাকে আমার গল্পের জন্য!” খিলখিল হাসিতে মুখ ভরিয়ে হালুম করে ডেকে ঠাকুমার ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে পম। সকলের অগোচরে শুরু হয় খরগোশ আর বাঘের এক প্রাণবন্ত লড়াই।

জানলায় দাঁড়িয়ে নিঃশ্বাস ফেলে ব্রত। সেই নিঃশ্বাসে একই সঙ্গে মিশে আছে আনন্দ আর দুঃখ। আনন্দ, কারণ ছেলেটা সত্যি সত্যি মেশিন হয়ে যায়নি এখনও। স্বাভাবিক বাচ্চাদের মতো ওর মধ্যেও আছে দুষ্টুমির মণিমুক্তো। দুঃখ এই জন্য যে, এইটুকু ছেলে এখন থেকেই মুখোশ পরতে শিখে গেছে। ছেলের আসল মুখটা উর্জা আর কোনও দিন দেখতেও পাবে না।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement