ছবি: মহেশ্বর মণ্ডল
বাপি, ওই যে মোটাটা আন্টির সঙ্গে এদিকে আসছে, ওর নাম লাল।’’
‘‘‘চিনিস ওকে!’’ পরমেশের গলায় ছদ্ম-বিস্ময়।
‘‘চিনব না? আমাদের ক্লাসেই তো পড়ে। এক নম্বরের পাজি।’’ দুলে দুলে বলে হলুদ।
‘‘ও ভাবে কারও সম্পর্কে বলতে নেই মামণি!’’ পরমেশ হলুদের মাথায় হাত বোলায়।
‘‘তুমি জানো না বাপি, ও সবার টিফিন কেড়ে খায়। দু’দিন আমার থেকেও কেড়ে খেয়েছে।’’
হলুদের কথায় পরমেশকে এ বার একটু চিন্তিত লাগে। মেয়ের এত বিরূপতা থাকলে তো খুব সমস্যা! পরমেশ হলুদকে কোলে তুলে নিয়ে বলে, ‘‘সবাই কি তোমার মতো শান্ত হবে মামণি? তুমি বরং এ বার থেকে তোমার টিফিনের কিছুটা ওকে আগেই দিয়ে দিয়ো।’’ শুনে হলুদ রুক্ষ স্বরে বলে ওঠে, ‘‘আমার বয়েই গিয়েছে।’’
পরমেশ চিন্তায় পড়েছিল। এ বার গাড্ডায় পড়ে। এই পার্কেই কোথাও না কোথাও বেশ কিছুটা সময় হলুদকে লালের সঙ্গে আজ কাটাতে হবে। না হলে ছুটির এই দিনটাই বৃথা যাবে। কিন্তু এ মেয়েকে লালের সঙ্গে ভেড়ানো তো মনে হচ্ছে সহজ হবে না!
ও দিকে মিতুল এমন ভাবে পায়চারি করছে যে মনে হচ্ছে পরমেশদের চেনেই না। ওর এ রকম আচরণই অবশ্য করার কথা, এবং পরমেশেরও। না হলে লাল বা হলুদ বাড়ি গিয়ে তো বলে দিতেই পারে যে পার্কে আজ ওদের সঙ্গে এক জন চেনা মানুষের দেখা হয়েছে। তখন? কে চেনা মানুষ? কী রকম চেনা মানুষ? কমবেশি এই সব জেরার মুখোমুখি দু’জনকেই পড়তে হবে। সত্যি, কী ফ্যাসাদেই না পড়া গিয়েছে!
অথচ, কত প্ল্যান করেছিল দিনটাকে নিয়ে! এমনিতে স্কুলে তো কেবল দেখাই হয়, সে ভাবে কথা হয় না। কলিগদের যা শ্যেনচক্ষু! ও দিকে ছুটির দিনগুলো বেশির ভাগ ছুটতেই চলে যায়। বাড়িতে হাজারও কাজ। মিতুলের আবার ছুটির দিনের স্পেশাল রান্না থাকে। এরই মধ্যে এক-আধটা ছুটির দিন ঘিরে মিতুলের সঙ্গে লুকনো ফোনাফোনি হয়। তার পর দু’জনেরই চলে ছুটির দিনের কাজ আগেভাগে সেরে নিয়ে বাড়ি থেকে ছাড়া পাওয়ার অজুহাত খাড়া করতে। কখনও অজুহাত সফল হয়, আবার কখনও বিফলও। এ বারে কী হবে কেউ জানে না।
মিতুল বলেছিল, ‘‘বাইরে আসার সলিড বাহানা তৈরি করে ফেলেছি।’’
‘‘কী রকম?’’
‘‘অলকেশকে বলেছি, সহকর্মীর মেয়ের জন্মদিন। খাব না কিন্তু দুপুরের পর যেতে হবে এক বার। তুমি লালকে সামলাবে।’’
‘‘আমি কী বলব?’’ শুধিয়েছিল পরমেশ।
‘‘ভাবো কিছু।’’
পরমেশ বলেছিল, ‘‘আমিও সহকর্মীর ছেলের জন্মদিন-টন্মদিন কিছু বলে দেব।’’
‘‘শুভ্রা জানতে চাইবে না, কোন সহকর্মী?’’
‘‘সে সমস্যা তো তোমার অলকেশকে নিয়েও আছে।’’
‘‘না, অলকেশকে নিয়ে অতটা সমস্যা নেই। ও হয়তো নামটাই জানবে। কিন্তু তোমার মুখ থেকে শুভ্রা সম্পর্কে যা জেনেছি, তাতে মনে হয় শুভ্রা তোমার কাছ থেকে সহকর্মীর নাম জেনে, তোমার অন্য সহকর্মীকে ফোন করে ব্যাপারটা সম্পর্কে কনফার্মড হতে চাইবে। কী, ঠিক কি না?’’
‘‘ঠিক। কিন্তু তা হলে কী বলব, সেটা তো মাথায় আসছে না!’’
একটু ভেবেছিল মিতুল। তার পর বলেছিল, ‘‘ব্যাপারটা তোমার ছাত্রদের উপর চাপালে কেমন হয়? শুভ্রা অত দূর নিশ্চয়ই যেতে পারবে না।’’
‘‘তা না হয় চালালাম। কিন্তু কী চালাব?’’ পরমেশ যেন নিজের মনেই উত্তরটা খুঁজছিল। তার পর হঠাত্ ‘ইউরেকা’ বলে লাফিয়ে উঠেছিল। ‘‘কয়েকটা ছেলে প্রোজেক্টের মাল কিনতে আসবে। ওদের একটু হেল্প করতে হবে। কী, চলবে না ঢপটা?’’
মিতুল হেসে বলেছিল, ‘‘চলতে পারে।’’
ঢপটা কিন্তু শেষ অব্দি চলেনি। মিতুলেরটাও নয়। না, অবিশ্বাস থেকে নয়। অলকেশের মাছ ধরার শখ। হঠাত্ ওর মাছ ধরার সঙ্গী চণ্ডীদা নাকি খবর পাঠিয়েছে কোথায় মাছ ধরতে যাবে। আর অলকেশকে কে বাড়িতে রাখে! অতএব লালের দায়িত্ব নিতে হয়েছে মিতুলকে। ও দিকে শুভ্রার খুড়তুতো দিদি হঠাত্ করে অসুস্থ হয়ে পড়ল। প্রেগন্যান্ট ছিল। ডেট ছিল বেশ কয়েকটা দিন পরে। কিন্তু এ অবস্থায় অসুস্থ হয়ে পড়লে যা হয়। ডাক্তার রিস্ক নিতে চাইল না। নার্সিংহোমে আজ সকালেই ভর্তি করাতে হল। দুপুরের পর ওটি। সব কিছু ফেলে শুভ্রাকেও তাই যেতে হয়েছে ওখানে। হলুদকে ও সব জায়গায় নিয়ে যাওয়ার পক্ষপাতী নয় শুভ্রা। সুতরাং পরমেশের উপর দিয়ে গেল হলুদের ভার। শেষ মুহূর্তে ফোনে তাই আবার কিছুটা পরিকল্পনা বদল করতে হল।
লাল একটা বল নিয়ে এসেছে। মিতুল কিছু বলে থাকবে। লাল ডাকল হলুদকে, ‘‘খেলবি?’’
দু’দিকে ঘাড় বেঁকাল হলুদ। পরমেশ হলুদকে কোল থেকে নামিয়ে বলল, ‘‘যাও না! একই ক্লাসে পড়ো যখন, তখন তো বন্ধু। খেলো ওর সঙ্গে!’’
হলুদ এ বার ভয়ে ভয়ে এগিয়ে গেল। তার পর দু’জনে মেতে উঠল খেলায়।
পরমেশ নিশ্চিন্ত। এ বার বসতে হবে। বসার জন্য পরমেশ এমন একটা বেঞ্চ বাছল, যেখান থেকে লাল-হলুদের খেলাটাও দেখা যায় আবার একটু আড়ালও হয়।
মিতুল বেঞ্চে বসেই বলল, ‘‘খেয়েছ কখন? একটু চা খেলে হয় না!’’
‘‘চা! মেঘলা মেঘলা দিন, কফি কেন নয়?’’
‘‘বেশ, কফিই হোক।’’
কফিওলার কাছ থেকে মিতুল দু’কাপ কফি নিল। পরমেশ কফিতে চুমুক দিয়ে বলল, ‘‘এই নতুন জামাটা পরে কেমন লাগছে কিছু বললে না তো!’’
মিতুল বলল ‘‘মেরুন রঙে তোমাকে কিন্তু বেশ মানায়। কলেজে পড়ার সময় তোমার মেরুন রঙের একটা শার্ট ছিল। মনে আছে?’’
‘‘তা আর মনে থাকবে না! নাম না লিখে প্রথম প্রেমপত্রে তো তুমি ‘মেরুন যুবক’ বলে সম্বোধন করেছিলে।’’
‘‘আর তার উত্তরে?’’
পরমেশ হেসে ওঠে বলে, ‘‘সবুজ কন্যা।’’
‘‘সেও তো একটা সবুজ শাড়ির জন্যই।’’
‘‘তুমি আজকেও সেই সবুজ শাড়িই পরে এসেছ।’’
একটা ভারী নিশ্বাস পড়ল পরমেশের। মিতুল ঝাউগাছটার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘‘সব প্রেম সফল হয় না, আমাদেরটাও হয়নি। চুকেবুকেই তো গিয়েছিল। কেন যে আবার তোমার সঙ্গে...’’
পরমেশ হাসে। বলে, ‘‘বিধাতার ইচ্ছে বোধহয় অন্য রকম। তাই তুমিও চাকরি পেলে আমারই স্কুলে। কী অদ্ভুত, না! ’’
‘‘আগে যদি জানতাম তুমি এখানে আছ, তা হলে নিশ্চয়ই পুরনো স্কুল ছেড়ে এখানে আসতাম না, যতই যাতায়াতের সুবিধা হোক।’’
‘‘বললাম তো, সবই পূর্বনির্ধারিত!’’
মিতুল হঠাত্ রেগে যায়। বলে, ‘‘খুব তো কৃষ্ণের বাণী দিচ্ছ। আর কিছু কি পূর্বনির্ধারিত আছে?’’
‘‘হয়তো আছে।’’
‘‘কী আছে?’’
পরমেশ এক মিনিট ভাবে। উষ্ণতাহীন দাম্পত্য আর কত দিন বয়ে নিয়ে যাবে! যত কঠিনই হোক, শুভ্রার মোকাবিলা ওকে করতেই হবে। গা ঝাড়া দিয়ে পরমেশ বলে, ‘‘আমি রাজি।’’
মিতুল বলে, ‘‘অলকেশ তো অফিসের সময়টুকু বাদে বন্ধুবান্ধব, মদ, মাছ ধরা... এ সব নিয়েই আছে। মনে হয়, আমি ওকে ছাড়লে, কোনও আপত্তি করবে না।’’
‘‘তবে সবার আগে আমাদের এক জনকে স্কুলটা চেঞ্জ করতে হবে। দু’জনে এক স্কুলে থেকে এ সব করা যাবে না। তুমি অবশ্য এখনই স্কুল চেঞ্জ করতে পারবে না। সদ্য এসেছ। আমার দশ বছর হয়ে গিয়েছে। মিউচুয়ালে পারব। দেখতে হবে, ট্রেন বা বাসে এক-দু’ঘণ্টার দূরত্বে কাউকে পাই কি না।’’
পরমেশের এই কথার পরেই একটা কান্নার আওয়াজ। তাকিয়ে দেখে, একটু দূরে মাটিতে পড়ে লুটোপুটি খাচ্ছে হলুদ।
‘‘কী হল?’’ আশ্চর্য, লাল-হলুদের কথা মনেই ছিল না কারও! এত পরিকল্পনায় এক বারও উঁকি দেয়নি কেউ। এ বার দৌড়ে গেল দু’জনেই। লাল বলল, ‘‘ও বলটা আমার পা থেকে কাড়তে গিয়ে পড়ে গিয়েছে।’’
হলুদ গোঙাতে গোঙাতে বলল, ‘‘মিথ্যে কথা। বলটা ধরার আগেই আমাকে ও ধাক্কা দিয়েছে।’’
লাল এবার বড় ছেলের মতো গম্ভীর গলায় বলে, ‘‘বেশ করেছি! আমার বলে খেলছে আর আমাকেই সমানে ‘মোটা’ ‘মোটা’ করে বলে যাচ্ছে!’’
‘‘তুইও তো আমাকে ‘তালপাতার সেপাই’ বলে ডাকছিস বারবার।’’
হলুদকে মাটি থেকে তোলে পরমেশ। হাঁটু ছড়ে গিয়েছে। এক্ষুনি ওষুধ লাগাতে হবে।
মিতুল লালকে বকুনি দেয়। ‘‘তোমাকে বলেছিলাম না, পার্কে শান্ত ভাবে খেলবে! তবু তুমি...’’
মিতুল লালকে এ সব বললেও হলুদের কাছে এগিয়ে এসে কোনও কিছু বলে না। পরমেশ কিন্তু এই অবস্থায় ওর কাছ থেকে হলুদের জন্য আর কিছু না হোক একটু সহানুভূতিসূচক কথা আশা করেছিল।
পরমেশ দেখল, হলুদের শুধু হাঁটুই ছড়ে যায়নি, ফ্রকও ছিঁড়েছে। হলুদের কথাই ঠিক। ছেলেটা মহা পাজি। পরমেশ মুখে কিছু বলে না, কটমট করে তাকায় লালের দিকে।
পরমেশের ক্রুদ্ধ ভাবে তাকানোটা মিতুলও লক্ষ করেছে। ও আর কথা বলল না। লালকে নিয়ে সোজা হাঁটা দিল বাড়ির দিকে। লালের প্রতি পরমেশের দৃষ্টিটা হয়তো ও আশা করেনি।
পরমেশ হলুদকে কোলে নিয়ে ওষুধের দোকানের দিকে এগোল।
আজ কি কলকাতায় দুই প্রধানের মধ্যে লিগের কোনও খেলা ছিল? পরমেশ শুনতে পেল, রাস্তার পাশে চায়ের দোকানে কারা বলাবলি করছে, ‘‘মোহনবাগানকে জোর ধাক্কা দিয়েছে ইস্টবেঙ্গল।’’
কোন কথা যে কোথায় লাগে! হলুদের হাঁটুটা আর এক বার নিরীক্ষণ করে করুণ হাসল পরমেশ।
‘রবিবাসরীয়’ বিভাগে ছোটগল্প পাঠান, অনধিক ১৫০০ শব্দে।
ইমেল: rabibasariya@abp.in সাবজেক্ট: rabibasariya galpa
ডাকে পাঠানোর ঠিকানা:
‘রবিবাসরীয় গল্প’,
আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা ৭০০০০১
যে কোনও একটি মাধ্যমে গল্প পাঠান। একই গল্প ডাকে ও ইমেলে পাঠাবেন না। পাণ্ডুলিপিতে ফোন নম্বর বা ইমেল আইডি জানাবেন। ইউনিকোড ব্যবহার করা বাঞ্ছনীয়।