শুভম দে সরকার
অমিতকে শেষ পর্যন্ত কাজটা করে ফেলতেই হল। লীনা এতটা চাপ সৃষ্টি করবে, সে ভাবতে পারেনি। প্রথমে ভেবেছিল অন্যান্য বারের মতো এর বেলাতেও প্রেম-প্রেম খেলাটা কিছু দিন চালিয়ে তার পর সুযোগ মতো পিঠটান দেবে। কিন্তু রীতিমতো ফাঁসানো হল তাকে। বুঝতে পারলেও আর ফেরার কোনও উপায় নেই। এর আগে বহু বার অনেকের সঙ্গে এ রকম খেলা খেলেছে সে, তাই আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি ছিল না। কিন্তু হঠাৎ হলটা কী? না কি কেউ আড়াল থেকে চোরাগোপ্তা কাঠিবাজি করে দিল? ঠিক বুঝে উঠতে পারল না অমিত।
লীনাকে দেখে কোনও দিনই তেমন চালাক-চতুর মনে হয়নি। অমিত নিশ্চিন্ত ছিল, এ জিনিস বিয়ে পর্যন্ত টানতে অত তাড়াতাড়ি সাহস পাবে না লীনা। কিন্তু সব ধারণা ভুল প্রমাণ করে দিয়ে গলায় উল্টোপাল্টা কিছু একটা ঢেলে কেস বাধাল, তার পর নার্সিং হোমের বেডে শুয়ে বলে বসল, “হয় রেজিস্ট্রি করো, নয়তো চললুম। জেলের ঘানি টানা কেউ ঠেকাতে পারবে না তোমার।”
লীনার মাসতুতো দাদা লইয়ার। কেস-টেস তেমন জোটে না। তবে এই কেসটা ভালই সামলাল। অমিতকে সামনে পেয়ে গড়গড় করে আইনের ধারা-উপধারাগুলো মুখস্থ ঝেড়ে দিয়ে বলল, “সহজে মেনে নেওয়াই তোমার পক্ষে মঙ্গল। কোনও নারীকে বিয়ের কথা দিয়ে বিয়ে না করা মস্ত বড় ক্রাইম। তা ছাড়া যত দূর শুনেছি তুমি ওকে ভালইবাসো। তবে শুধু শুধু মেয়েটাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছ কেন, সঙ্গে সঙ্গে নিজেই বা নিজের বিপদ ডেকে আনছ কেন?”
দশ দিন চোরের, এক দিন গৃহস্থের। কিন্তু এ রকম পচা শামুকে পা কাটল শেষ পর্যন্ত! মানতে কষ্ট হলেও মেনে নিতে হল অমিতকে। বিয়েটা করতেই হল।
ফুলশয্যার রাতে সব কাজকর্ম মিটতে মধ্যরাত পেরিয়ে গেল। অমিত ঘরে এসে খাটে বসার পর লীনা বলল, “তুমি খুশি হওনি?”
অমিত জোর করে হেসে বলল, “হয়েছি। তবে আমি একটু সময় চেয়েছিলাম, সেটা তুমি দিলে না… বিয়েটা আর কিছু দিন পরে হলে কোন মহাভারত অশুদ্ধ হত? আমি তো জাস্ট একটু গুছিয়ে নেওয়ার সময় চেয়েছিলাম… এমন কাণ্ড করে বসলে… ছিঃ ছিঃ।”
লীনা নির্বিকার গলায় বলল, “কী করব বলো, তোমার ব্যাকগ্রাউন্ড জানার পর আমি আর ঝুকি নিতে সাহস পাইনি।”
অমিত বাঁ হাতের তালুতে একটা ঘুসি মেরে বলল, “পথে এস! যা ভেবেছিলাম তাই! কেউ একটা ফোড়ন কেটেছে। তা এই শুভ কাজটা করল কে, শুনি একটু।”
“তোমার বাবা।”
“কী!” অমিত লাফ মেরে ছিটকে সরে গিয়ে বলল, “প্রথম রাত্তিরেই বাপ তুলছ! তোমার সাহস তো কম নয়! ফাজলামির একটা সীমা থাকে। তুমি আমাকে চেনো না লীনা, আমি কিন্তু মোটেও ভাল লোক নই।”
লীনা বলল, “ঠিক! ঠিক এই কথাটাই বলেছিল তোমার বাবা। কেমন করে যেন আমাদের প্রেম করার সংবাদটা পেয়ে গিয়েছিলেন তিনি। তার পর সটান এক দিন আমাদের বাড়িতে গিয়ে হাজির। সরাসরি বললেন, ‘আমি অমিতের বাবা, আমি বলছি, আমার ছেলে অমিত মোটেও ভাল ছেলে নয়… যা করার বুঝেশুনে কোরো।’ ”
“এ সব বাবা বলেছে?”
“বিশ্বাস না হলে শুনে দেখতে পারো… ডাকব?”
“আবার ফাজলামি হচ্ছে? এই ফুলশয্যার রাত্তিরে বাবাকে ডাকবে? আর কী বলেছে বাবা?” অমিত রেগে ফোঁসফোঁস করে ওঠে।
“বলেছিলেন, ‘আমার অমিতের একটু চরিত্রের দোষ আছে। তবে মনটা ভাল। যদি এ সব মেনে নিয়ে এক বার বিয়ের পিঁড়িতে বসাতে পারো, তা হলে দোষটা কেটেও যেতে পারে।’ বুদ্ধিটাও উনিই বাতলে দিলেন। সে দিন আমি বিষ খাইনি, ফেনসিডিল সিরাপ খেয়েছিলাম। একটু নেশার মতো হল, তুমি তো তাতেই ঘাবড়ে গেলে। ভুলুদা সে দিন তোমাকে যে আইনের ধারাগুলো মুখস্থ বলেছিল, তার সবগুলোই জমি সংক্রান্ত। ভুলুদা ও ছাড়া কিছু জানেই না।” ঠান্ডা গলায় কথাগুলো বলে লীনা।
“এ তো পুরোদস্তুর চিটিং!” অমিতের চোখ গোল গোল।
“আর তুমি যে আমার সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করেছ, সেটা চিটিং নয়? একটা মেয়ের ভালবাসার মূল্য, বিশ্বাসের মূল্য, এ সব তুমি বোঝো? আমি জেনেবুঝেই সুইসাইডের ভয় দেখিয়ে তোমাকে বিয়ে করেছি, কেন জানো? তোমাকে শিক্ষা দেব বলে। তোমার চরিত্র সম্পর্কে জেনে যে আঘাত আমি পেয়েছিলাম, সেই আঘাত আমি তোমায় ফিরিয়ে দেব… তবে অন্য ভাবে। তখন তুমি বুঝবে কেমন লাগে।”
“মানে? কী করতে চাও তুমি?” বিস্ময় কাটাতে পারছে না অমিত।
“ওটা অভিনয় ছিল, এ বার আমি সত্যি সত্যিই সুইসাইড করব। তুমি আমাকে ভাল না বাসলেও আমি কিন্তু তোমাকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালবেসেছিলাম, আজও বাসি। কারণ ভালবাসাটা আমার কাছে ঠুনকো ব্যাপার নয়। কিন্তু একতরফা ভালবাসার মূল্য তো আমি পাব না। তাই এই জীবন রেখে লাভ কী? তোমার সামনে মরে তোমাকে আমার ভালবাসার অঞ্জলি দিয়ে যাব। যদি মিনিমাম বিবেক থাকে… এক দিন আফসোস হবে… হবেই।”
“হুমকি দিচ্ছ… না অভিশাপ?” অমিত জোর করে হাসার চেষ্টা করে।
“কোনওটাই নয়। রিয়েলিটিটাই তোমাকে দেখিয়ে যাব। আমি হুমকি… অভিশাপ এ সবে বিশ্বাস করি না।”
লীনা জামায় গুঁজে রাখা একটা ছোট্ট শিশি বার করল। অমিত থমথমে গলায় বলল, “এ বার হোমিয়োপ্যাথি ওষুধ খেয়ে মরবে না কি?”
লীনা সে কথার জবাব না দিয়ে শিশির ছিপি খুলে পুরোটাই গলায় ঢেলে দিলে।
তার পর নিস্তেজ গলায় বলল, “যদিও কোনও জন্মে তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্ক থাকবে না, তবুও এক জন মানুষ হিসেবে বলছি, ভাল থেকো… আমি চললাম। ওপরে এসেও দেখা করার চেষ্টা কোরো না… ওখানেও এ রকমই ব্যবহার পাবে।”
ঢলে পড়েছে লীনা। অমিত পাশে গিয়ে ডাকার চেষ্টা করলে। কিন্তু কোনও সাড়াশব্দ নেই। এ তো মহাযন্ত্রণা! ফুলশয্যার রাত্তিরে এ ভাবে বৌয়ের মৃতদেহ আগলে বসে থাকতে হবে না কি সারা রাত? নিরুপায় হয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে এল অমিত। প্রাণপণে চেঁচামেচি করে ডেকে তুলল সবাইকে।
বাবা ঘুমচোখে হন্তদন্ত হয়ে এসে বললেন, “অমন ষাঁড়ের মতো চেঁচাচ্ছিস কেন হতভাগা? বলি বৌ মরেছে না কি? এমন করে কেউ বিয়ের প্রথম রাত্তিরে পাড়া মাথায় তোলে আপদ কোথাকার… ছি ছি… লোকে শুনলে কী বলবে বল তো!”
তার পর অমিতের ঘরের খোলা দরজার সামনে যেতেই দেখতে পেলেন, খাটের উপর লীনা শুয়ে। চোখ বন্ধ, হাতে একটা খালি শিশি। যা বোঝার বুঝেও গেলেন। বললেন, “অ্যাই… যা সন্দেহ করেছিলাম তা-ই হল। বৌ মরেছে…”
“তুমি জানলে কী করে? তখন তো ঢং করে বলতে গেছিলে আমার চরিত্র খারাপ… এ বার দেখে নাও কার চরিত্র খারাপ। এ ভাবে ফুলশয্যার রাতে স্বামীকে ধোঁকা দিয়ে যে বৌ মরতে পারে, তাকে কি তুমি সতীসাধ্বী ভাবতে পারো? যত দোষ আমার বেলায়… যত্তসব!”
অমিতের মা কোথা থেকে উদয় হয়ে বললেন, “আচ্ছা তোরা কী প্রথম রাতেই চরিত্তির বিশ্লেষণ করে কাটিয়ে দিবি? মেয়েটার হলটা কী?”
অমিত তেড়েফুঁড়ে বলল, “আর দেখার কিছু নেই। নেতিয়ে গেছে। বোধহয় ধড়ে প্রাণ নেই।”
অমিতের বাবা বললেন, “তুই কি ডাক্তার?”
“হওয়ার ইচ্ছে ছিল। চান্স পেলাম আর কই।”
“তবে সরে দাঁড়া। আমি কিছু দিন এক জন কোয়াক ডাক্তারের আন্ডারে কাজ করেছি। দেখি কিছু বুঝতে পারি কি না। তোরা বাইরে থাক।”
বাবা রোগী দেখার জন্য দরজা বন্ধ করে দিলে অমিত একটু অস্বস্তি বোধ করল। একটু বাদেই অবশ্য বাবা দরজা খুলে বেরিয়ে এসে বললেন, “সত্যিই তো মারা গেছে রে। তুই কি গলা টিপে ধরেছিলি?”
“না। বিষ খেয়ে নিল আমার সামনেই। কিছু বুঝে ওঠার আগেই।”
“কিন্তু পুলিশ এসে তো তোকেই ধরবে।” বললেন বাবা।
“পুলিশ! কিন্তু আমি তো কিছুই করিনি। আমাকে ধরবে কেন?” গলা শুকিয়ে আসে অমিতের।
“স্বামীকেই প্রথমে ধরে শুনেছি। তার পর শ্বশুর, শাশুড়ি, ননদ, দেওর… এ রকমই নিয়ম। খবরের কাগজে তো তেমনই লেখে। আমাকে ধরলে কিন্তু তোকেই দেখিয়ে দেব।”
অমিতের মা বললেন, “আমিও। এমনিতেও তুই আমাদের দেখবি বলে মনে হয় না। তোর জন্য আমরা শুধু শুধু জেল খাটতে যাব কেন?”
অমিত রেগে বলল, “তোমরা সবাই বেইমান। এখন দেখছি লীনা তোমাদের চেয়ে অনেক ভাল ছিল। এখন বুঝতে পারছি, ও সত্যি সত্যি আমাকে ভালবাসত। ভালবাসার জন্য জীবনটা পর্যন্ত দিয়ে দিল। আমি সত্যিই বোকা! আসল ভালবাসা চিনতে পারলাম না। ডাকো পুলিশ। আমাকে ধরিয়ে দাও। জেলে বসে আমি প্রায়শ্চিত্ত করব। তিল তিল করে আমি নিজেকে শেষ করে দেব।”
অমিত দু’হাতে মুখ ঢেকে ফুপিয়ে কেঁদে উঠল।
অমিতের বাবা এই সময় চুপিচুপি অমিতের ঘরে গিয়ে ঢুকলেন। তার পর লীনার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বললেন, “ও বৌমা, এ বার উঠে পড়ো মা। গতবার ফেনসিডিল দিয়ে ছিলাম, এ বার টেনাড্রিল। একটু বেশি কড়া। ব্যাটা ভীষণ ভয় পেয়েছে। আসলে তো ভিতুর ডিম। আর বেশি খেলায় প্যান্ট নষ্ট করে ফেলতে পারে। আমি ওদের বলে দিচ্ছি, বিষক্রিয়া কমে এসেছে, আর ভয়ের কিছু নেই। আমাদের প্রথম রাতেই বেড়াল মারার প্ল্যান সাকসেসফুল গো মা!”
কয়েকবার ডেকে সাড়া না পেয়ে অমিতের বাবার ভুরু কুঁচকে গেল। তিনি লীনার হাতে ধরা খালি শিশিটার দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠে বলল, “অ্যাই মরেছে… মেয়েটা করেছে কী! খেতে বলেছিলাম আধশিশি… ও তো দেখছি পুরোটাই গিলে বসে আছে।”
মৃদু হেসে লীনার মাথায় সস্নেহে হাত রাখলেন অমিতের বাবা। আপন মনেই বিড়বিড় করে বললেন, “আহা রে… সিনটাকে বোধহয় একটু বেশিই আবেগ দিয়ে ফেলেছিল মেয়েটা। অ্যাক্টো কি সহজ জিনিস রে মা? ভারসাম্য বজায় রেখে অ্যাক্টো করা খুব কঠিন। আবেগ, ওষুধ, অভিনয় সবেরই একটা মাপ আছে। এই যে ওভারঅ্যাক্টো করে ফেললি… এ বার দু’-তিন দিন অহেতুক ভুগতে হবে।”
জানলার বাইরে তখন আবছা আলো। রাত শেষ হয়ে আসছে।