ছোটগল্প

অনিরুদ্ধর বাবা

বাইরে কিসের যেন চিৎকার। আমার দু’টো কান টানটান হয়ে ওঠে। এক ঝটকায় জানালার পাল্লা দু’টো খুলে ফেলি। ‘অনিরুদ্ধর বাবা জিন্দাবাদ, অনিরুদ্ধর বাবা অমর রহে  অমর রহে’... চেয়ে দেখি, শ’খানেক মানুষ।

Advertisement

শ্যামল মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৩ ডিসেম্বর ২০১৭ ০৭:১০
Share:

অনিরুদ্ধর বাবা চলে গেলেন। সূর্য ওঠার আগেই। না, কেউ আমাকে খবর দেয়নি। তবু জেনে গেলাম। আসলে প্রাত্যহিক হিসেবখানায় আজ কেমন যেন গরমিল। বাতাসখানা উলটপালট। আকাশপটে পাগলপারা আঁকিবুঁকি। পাখিদের সকালের কলতান আজ স্তব্ধ হয়ে আছে।

Advertisement

বাইরে কিসের যেন চিৎকার। আমার দু’টো কান টানটান হয়ে ওঠে। এক ঝটকায় জানালার পাল্লা দু’টো খুলে ফেলি। ‘অনিরুদ্ধর বাবা জিন্দাবাদ, অনিরুদ্ধর বাবা অমর রহে অমর রহে’... চেয়ে দেখি, শ’খানেক মানুষ। বুঝতে পারলাম, এ আর কিছু নয়, পার্টি নম্বর ওয়ানের মিছিল। এর পর একই নিয়মে এগিয়ে আসবে পার্টি নম্বর টু, থ্রি’র পদযাত্রা। সবাই বোঝাতে চাইবে, তিনি ছিলেন তাদেরই লোক।

অনিরুদ্ধর বাবা কোনও পার্টি করতেন না। ওকে আমি ‘অনিরুদ্ধর বাবা’ বলেই জানতাম। শুধু আমি কেন, ওঁর আসল নামটা বোধহয় কেউই জানত না। আসলে অনিরুদ্ধর চাপে ওঁর পিতৃদত্ত নামটা কোথায় যেন উবে গিয়েছে।

Advertisement

বছর দুই আগের ঘটনা। অনিরুদ্ধকে প্রকাশ্য রাস্তায় ফেলে পিটিয়ে হত্যা করেছিল দুষ্কৃতীর দল। কিছুই করেনি অনিরুদ্ধ। শব্দ দূষণের প্রতিবাদ করেছিল মাত্র। সরস্বতী পুজোকে কেন্দ্র করে মেতে উঠেছিল ক্লাবের ছেলেরা। সঙ্গে ছিল ডিজে বক্সের ঢিপঢিপ ঢিপঢিপ তীব্র আওয়াজ। মধ্যরাত পর্যন্ত বিছানার চাদর আঁকড়ে দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করেছিল অনিরুদ্ধ। তার পর আর পারেনি। তত ক্ষণে বারান্দায় শুয়ে থাকা বৃদ্ধ মানুষটির আর্ত চিৎকার থেমে গিয়েছে। দাদুর এই অসহায় মৃত্যুকে মেনে নিতে পারেনি অনিরুদ্ধ। চিৎকার করতে করতে ছুটে গিয়েছিল আকণ্ঠ গিলে-থাকা ছেলেদের মাঝে। আর তার পর...

কালো পিচের রাস্তা বেয়ে একটা ছোট্ট রক্তনদী। চারপাশে পুলিশের ব্যারিকেড। কাগজে কাগজে ছবি। ও দিকে অনিরুদ্ধর বাবা তখন নির্বাক।

অনিরুদ্ধদের বাড়িটা আমাদের বাড়ি থেকে খানিকটা দূরে। শহরের এই পাড়াটা সাবেকি পাড়া। বেশ কৌলীন্য আছে। ওঁর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল নিবেদিতা নার্সারি স্কুলে। আমার ছেলে ওখানে ক্লাস ফোরে পড়ে। সে দিন স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান ছিল। ছেলেকে নিয়ে আমি স্কুলে গিয়েছিলাম। হঠাৎ ঘোষণা শুনে বেশ উৎসাহিত হয়ে উঠি। ‘‘এ বার আপনাদের সামনে অনিরুদ্ধর বাবা কিছু বলবেন।’’ এই প্রথম আমি অনিরুদ্ধর বাবাকে সামনে থেকে দেখলাম। লম্বা দোহারা চেহারা। গায়ের রং সাদা। বয়স পঞ্চান্ন থেকে ষাটের মধ্যে। লম্বা লম্বা পা ফেলে তত ক্ষণে উনি মঞ্চে গিয়ে উঠেছেন। চারপাশে একটা ফিনফিনে গুঞ্জন, ‘‘ওই দেখ, অনিরুদ্ধর বাবা। মানুষটাকে দেখ।’’ আমি বেশ আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় ছিলাম। অন্য কিছু না। শুধুমাত্র মানুষটির কথা শোনার জন্য। অবশ্য তেমন কিছু বললেন না তিনি। আবেগতাড়িত গলায় দু’-একটা কথা বললেন মাত্র, ‘‘আমাদের স্বাধীনতাকে তোমরা তোমাদের স্কুলব্যাগের মতো আঁকড়ে থাকো। তবেই আমাদের দেশ এগিয়ে যাবে।’’

ওই দু’-একটি কথাই মানুষটিকে যেন বেশি করে চিনিয়ে দিল। কোনও উচ্ছ্বাস নেই। অথচ যেন হৃদয় ছিঁড়ে বেরিয়ে আসা আগুনের হলকা।

জানলার শিক বেয়ে দুই চোখ বাইরে আসে। চেয়ে দেখলাম, পার্টি নম্বর টু-এর খণ্ডিত মিছিল। সমবেত পদক্ষেপে এগিয়ে আসছে ওরা। রাস্তাটা কিছুটা গিয়েই দিক পরিবর্তনের বাঁক নিয়েছে। তবু মিছিল থেকে ঠিকরে আসা স্লোগানের দশমিক অংশ কানে এসে ছ্যাঁকা দেয়। ‘‘কমরেড অনিরুদ্ধের বাবা লাল সেলাম... লাল সেলাম। কমরেড অনিরুদ্ধের বাবা তোমায় আমরা ভুলছি না ভুলব না।’’ এত ক্ষণে আপাদমস্তক মিছিলটা আমি দেখতে পেলাম। বেশ কয়েক ডজন কালো মাথার আন্দোলিত স্লোগান। আর একেবারে সামনে অনিরুদ্ধর বাবার বেশ কয়েকখানা স্কেচ, কাট-আউট। এরই মধ্যে এত সব কখন আঁকা হল কে জানে! তবে কি রাম জন্মাবার আগেই রামায়ণ লেখা হয়ে গেল?

মিছিল থেকে চোখ সরিয়ে নিলাম। অন্য একটা দিনের কথা মনে পড়ল। কী কারণে সে দিন স্কুল ছুটি হয়ে গেল। প্রতিদিনের রুটিনমাফিক বাস ছেড়ে অন্য একটা বাসে চড়ে বসলাম। একেবারে ড্রাইভারের পাশেই। ড্রাইভারের মুখখানা চোখে পড়তেই চমকে উঠলাম। আরে! এ তো আমাদের সেই অনিরুদ্ধের বাবা। জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, ‘‘আপনি তো অনিরুদ্ধর বাবা? আপনাকে আমি চিনি।’’

‘‘আপনাকেও আমি চিনি। আপনি তো অশোকবাবু?’’ চোখের স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে কথাগুলো বললেন অনিরুদ্ধর বাবা। এ বার আমার অবাক হওয়ার পালা। দুই চোখ কপালে ঠেলে বললাম, ‘‘আমাকে আপনি চেনেন?’’

‘‘হ্যাঁ, চিনি। আপনি তো আমাদের পাড়াতেই থাকেন, নিউ আবাসন। কবিতা লেখেন। ছেলে পড়ান।’’

বুঝতে পারলাম, মানুষটি আমার সম্পর্কে অনেকখানি জানেন। তবু বেআদব ছাত্রের মতো প্রশ্ন করি, ‘‘এত সব খবর পেলেন কোথায়?’’

অনিরুদ্ধর বাবা বেশ জোরে বাসের হর্ন বাজালেন। মনে হল, বুঝি আমাকেই সাবধান করে বললেন, সামলে থেকো, আমি সব জানি। তার পর আলতো গলায় বললেন, ‘‘এ সব খবর সবাই জানে। আপনারা পত্রিকা ছাপেন, গল্প লেখেন, কবিতা লেখেন।’’

‘‘আপনি বুঝি লেখালেখি করেন?’’

মানুষটি হাসলেন। বেদনায় ভাসা-ভাসা মুখ। বাস যেন কোথায় এসে থামল। বিক্রমপুর। আমাকে হালকা ভাবে আড়চোখে এক বার দেখে নিলেন অনিরুদ্ধর বাবা। তার পর বললেন, ‘‘কবিতা? হ্যাঁ লিখি তো। জীবন যখন আছে তখন কবিতা তো লিখতেই হবে।’’

এত ক্ষণে যেন কথা বলার জন্য কিছু কথা খুঁজে পেলাম। হড়হড় করে কথা বেরিয়ে আসছে। বান ডেকেছে। তবু রাশ টেনে বলি, ‘‘আসুন না। আমাদের আসরে।’’

অনিরুদ্ধর বাবা সংযত হয়ে বললেন, ‘‘আমার কবিতা তো সব অন্ধকারে লেখা স্যর। পড়বার মতো নয়, বলবার মতো নয়।’’

‘‘অন্ধকারে লেখা?’’

‘‘হ্যাঁ। রাতের বেলা যখন চারিদিক শুনশান, নিঝুম। ঘরের মধ্যে আবছা নীলাভ মৃদু বাতি। মনটা কেমন যেন হুহু করে ওঠে। কান্না আসে। আপনা থেকেই বুকের ভিতর কবিতা লেখা হয়ে যায়। অনেক, অনেক কবিতা, একটার পর একটা...’’

ভাবনার বেড়া ভেঙে জানালার দিকে তাকাই। এত ক্ষণ খেয়াল করিনি। পার্টি নম্বর থ্রি-র মিছিল তত ক্ষণে বাঁক পার হয়ে অনেকখানি এগিয়ে এসেছে। শব্দ নেই। মৌন মিছিল। অন্যদের টেক্কা দেওয়ার প্রচেষ্টা। ও তো আমাদেরই লোক।

মনে মনে ভাবলাম, আর দেরি করা ঠিক নয়। এ বার যেতে হবে। ঘরের দিকে চেয়ে দেখি, সুতপার গুরুপ্রণাম সারা। আমাকে সামনে পেয়ে উৎকণ্ঠিত হয়ে প্রশ্ন করে, ‘‘হ্যাঁ গো, সকাল থেকে এত মিছিল কেন?’’

‘‘অনিরুদ্ধর বাবা মারা গিয়েছেন।’’

‘‘সে কী! কখন?’’

‘‘এই তো, সূর্য ওঠার আগে।’’

‘‘আহা রে! ছেলেটা গেল, বাপটা গেল। বড্ড একা হয়ে গেল ওর মা।’’

কথার মাঝখানে প্যান্টটা গলিয়ে নিলাম। জামাটা গায়ে চড়িয়ে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ফুলের দোকানে কিছু ফুল নিতে হবে। এত সকালে কি দোকান খুলবে? রাস্তা দিয়ে অনেকে তখন হেঁটে চলেছে।

পিন্টুর দোকানের সামনে দাঁড়ালাম। ‘‘একটা মালা দে তো,’’ বলেই পকেটে হাত দিলাম। মালার দাম দিতে হবে।

‘‘মালা তো আর নেই কাকু,’’ পিন্টু বলে।

‘‘সে কী রে!’’

‘‘পার্টির বাবুরা তো সব ফুল-মালা কিনে নিল সেই কোন সকালে।’’

‘‘ওই মালাটা?’’

‘‘ওটা কাকু লালুবাবুর জন্য রাখা আছে। ফোন করেছিলেন, একটা মালা রাখার জন্য। বুঝতেই তো পারছেন।’’

লালুবাবু হলেন লালমোহন দস্তিদার, দ্য গ্রেটেস্ট কিং-মেকার। নেতার নেতা তস্য নেতা!

ফুলের আশা ছেড়ে প্যাডেলে পা দিলাম। অনিরুদ্ধর বাড়িতে যখন এলাম, তখন ঘড়িতে ন’টা পাঁচ। গোটা উঠোন জুড়ে লোক গিজগিজ করছে। ভিড় কাটিয়ে প্রথমে অনিরুদ্ধর মা’কে চিনলাম। দুই চোখের পার ফোলা ফোলা। কান্নার বন্যা। যেন পলি পড়েছে। বিজয়বাবুর সঙ্গে কী একটা বিষয় নিয়ে চাপানউতোর চলছে। বিজয়বাবু রাজনীতি করেন। ম্যাডামকে কী যেন বোঝাতে চাইছেন।

নিজের পরিচয় দিয়ে সামনে দাঁড়ালাম, ‘‘আমি অশোক। অশোক সামন্ত।’’

‘‘আপনিই অশোক সামন্ত? আপনার কথা উনি খুব বলতেন। খুব ভাল কবিতা লেখেন।’’

লজ্জা পেলাম। বললাম, ‘‘না, তেমন কিছু না। ওই আর কী।’’

‘‘আপনাকেই আমি চাইছিলাম। এইটা আপনি রাখুন তো। কী করা যায় একটু ভাবুন।’’

বলেই ম্যাডাম একটা লাল রঙের খাতা আমার হাতে দিলেন। বললাম, ‘‘কী এটা?’’

ম্যাডামের চোখের কোণে একটা টাটকা জলের দানা। একটু সামলে নিয়ে বলেন, ‘‘মৃত্যুর আগে উনি প্রায়ই বলতেন, এই খাতাটা যেন ওঁর চিতার উপর সাজিয়ে দেওয়া হয়।’’

ম্যাডামের কথা শেষ হতেই বিজয়বাবু আমাকে ছোঁ মেরে এক পাশে টেনে নিয়ে গেলেন। কানের কাছে মুখ নামিয়ে ফিসফিস করে বললেন, ‘‘ওটা অনিরুদ্ধর বাবার কবিতার খাতা। ভদ্রলোক কবিতা লিখতেন। তা ওটা আগুনে পুড়িয়ে কী লাভ বলুন তো? তার চেয়ে বরং একটা কাজ করলে হয় না?’’

‘‘কী কাজ?’’ বিজয়বাবুর লোভে উপচে-পড়া মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করি।

‘‘খাতাটা আমাদেরকে দিয়ে দিন। পার্টির তরফে ওটা আমরা প্রকাশ করব। অনেক লাভ হবে মশাই। আপনাকেও দেব লাভের অংশ। এই সুযোগ ছাড়বেন না।’’

একটু পাশে সরে গিয়ে খাতাটা খুলে ফেললাম। সুন্দর হাতের লেখায় একটা লাইন, ‘কবিতাই সঙ্গে যাবে হরিনামের মতো’। তার নীচে ছোট্ট করে লেখা, ‘আমার অ-ছাপা বইয়ের পাণ্ডুলিপি।’ উৎসাহ ভরে আরও একটা পাতা ওলটালাম। ছোট্ট একটা কবিতা,

পৃথিবীর মাটি ছেড়ে চলে যাব। কোনও এক দিন। সব কিছু শূন্য হবে, এই ঘাস এই মাটি এই সবুজের সমারোহ... শুধু কবিতাই সঙ্গে যাবে হরিনামের মতো।

চমকে উঠলাম। ছবির মতো চোখের সামনে ভেসে উঠল স্টিয়ারিঙে রাখা একটা হাত। ভীষণ ধন্দে পড়লাম। এই প্রাণবন্ত জড়পিণ্ডকে নিয়ে কী করব এখন! তবে কি বিজয়বাবুর হাতে তুলে দেব?

ও দিকে তখন দাউদাউ করে জ্বলে উঠেছে চিতা। অনিরুদ্ধর বাবা পুড়ছেন। ঘাস, মাটি সব কিছু শূন্য করে তিনি পুড়ছেন। স্থাণুবৎ দাঁড়িয়ে আছি আমি। আমার চারপাশে যেন অসংখ্য কত্তাল আর খোল-বাদ্যের সম্মিলিত ধ্বনি বেজে চলেছে। “কবিতাই সঙ্গে যাবে হরিনামের মতো”।

আর থাকতে পারলাম না। ধীর পায়ে এগিয়ে সেই খাতাটিকে আমি জ্বলন্ত চিতার উপর রেখে দিলাম। মনে মনে বললাম, তোমায় নিয়ে সবটুকু রাজনীতির অবসান হোক।


‘রবিবাসরীয়’ বিভাগে ছোটগল্প পাঠান, অনধিক ১৫০০ শব্দে।
ইমেল: rabibasariya@abp.in সাবজেক্ট: rabibasariya galpa

ডাকে পাঠানোর ঠিকানা:

‘রবিবাসরীয় গল্প’,

আনন্দবাজার পত্রিকা,

৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,

কলকাতা ৭০০০০১

যে কোনও একটি মাধ্যমে গল্প পাঠান। একই গল্প ডাকে ও ইমেলে পাঠাবেন না। পাণ্ডুলিপিতে ফোন নম্বর বা ইমেল আইডি জানাবেন। ইউনিকোড ব্যবহার করা বাঞ্ছনীয়।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement