ছোটগল্প

গুরুভাইয়ের নিদান

নাহ্‌, এ ভাবে আর চলে না। একটাই তো জীবন, এমন হেলায় হারাতে পারবেন না অবনীবাবু। সারাটা সকাল-দুপুর-বিকেল শুধু দায়িত্ব-কর্তব্য আর উচিত-অনুচিতের হিসেব-নিকেশ করতে-করতে অমূল্য মানবজীবনের ঘড়ি কখন এসে সন্ধে ছুঁয়ে ফেলল।

Advertisement

রাজশ্রী বসু অধিকারী

শেষ আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২০১৭ ০০:০০
Share:

ছবি: সুমন চৌধুরী

নাহ্‌, এ ভাবে আর চলে না। একটাই তো জীবন, এমন হেলায় হারাতে পারবেন না অবনীবাবু। সারাটা সকাল-দুপুর-বিকেল শুধু দায়িত্ব-কর্তব্য আর উচিত-অনুচিতের হিসেব-নিকেশ করতে-করতে অমূল্য মানবজীবনের ঘড়ি কখন এসে সন্ধে ছুঁয়ে ফেলল। আর ক’টা দিনই বা সময় আছে হাতে! এই বেলা যদি একটু মনের মতো করে জীবন উপভোগ না করে নেন, তবে আর বেঁচে থেকে লাভ কী? উপরে গিয়ে কী বলবেন চিত্রগুপ্তকে? এপার-ওপার যেখানেই হোক, প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারাটা পরাজয়েরই নামান্তর। হারতে রাজি নন অবনীবাবু।

Advertisement

অবনীবিকাশ বিশ্বাস। বয়স একাত্তর। রিলিজিয়াস মর্নিংওয়াকারদের মতো মাথায় নেপালি টুপি, গায়ে ছাইরং হাফ সোয়েটার আর নেভি-ব্লু কর্ডুরয়ের প্যান্ট। হালকা-হালকা জগিংয়ের ভঙ্গিতে বাড়ি থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরের পার্কটার কাছে এসে দু’সেকেন্ড থামেন। সেখানে তখন অজস্র চেনামুখ নিত্যদিনের রুটিন ওয়াকে ব্যস্ত।

নাহ্‌, পার্কে নয়, পার্কে বড্ড বুড়োদের ভিড়। আজ একটু আলাদা জায়গায় বসার প্ল্যান আছে। যদিও সময় হয়নি এখনও, তা ঘণ্টা দুই আগে গেলেই বা ক্ষতি কী? নিজের সমবয়সি লোকগুলোকে তিনি বুড়ো বলেই ভাবেন। এদের জীবনে কোনও উত্থান-পতন নেই। তিনি এই একঘেয়েমির হাত থেকে মুক্তি চান। নতুন ভাবে বাঁচতে চান। সেই নতুন রাস্তা যে দেখাতে পারে, তার কাছে বসেই দু’দণ্ড বুদ্ধি পরামর্শ নেবেন। আটটায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট, না হয় দু’ঘণ্টা আগেই গেলেন। পা চালিয়ে পার্ক এরিয়া ছেড়ে আরও সোজা হাঁটেন অবনীবাবু।

Advertisement

অনেকটা আসার পর বড় রাস্তাটা যেখানে ডাইনে ঘুরেছে, সেইখানে শ্রবণকুমারের বাড়ি। এত সকালে সে উঠে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকবে, এতটা ভাবেননি তিনি। সহাস্যে এগিয়ে এসে ‘হাই ডার্লিং, হোয়াট আ সারপ্রাইজ...’ বলে হাত ধরে টেনে ঘরে ঢুকিয়ে নিল। স্মার্ট ভাবভঙ্গি দেখেই অর্ধেক মন ভাল হয়ে যায় অবনীবাবুর। সোফায় পা মেলে বসেন তিনি। আজ অনেকটা বেশি হেঁটেছেন। বসে আরাম হচ্ছে।

‘সারপ্রাইজ কেন? আমি তো কাল ফোনে জানালাম যে, আসব আজ..’

লীলায়িত ভঙ্গিতে সোফার হাতলে এসে বসে শ্রবণকুমার। হাত রাখে নেপালি টুপির ঘেরাটোপে। ‘ন...টি... কিইইইচ্ছু মনে রাখে না... কী বলেছিলাম? ইউ হ্যাভ টু বি অলওয়েজ সারপ্রাইজড... ঠিক
কি না?’

মাথা নাড়েন অবনীবাবু। হ্যাঁ, বলেছিল সে। বেশ অনেকগুলো লেস্‌ন ছিল প্রথম দিন। বুড়োটে পোশাক চলবে না, লেটেস্ট ট্রেন্ড ফলো করতে হবে, লুঙ্গি কদাপি নয়। সবেতেই কৌতূহলী দৃষ্টি রাখতে হবে, অতি ক্ষুদ্র ব্যাপারেও ‘এ আর এমন কী’ না ভেবে বিস্মিত হতে জানতে হবে, চোখ সব সময় রঙিন থাকবে, হাঁটাচলায় ছন্দ থাকবে, ঠোঁটের আগায় শিস বাজবে, কাঁধ ঝাঁকিয়ে অপছন্দের কথা নস্যাৎ করে দিতে হবে, ইত্যাদি অনেক অনেক কথা।

খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে নিজেই শ্রবণকুমারকে খুঁজে বের করেছিলেন অবনীবাবু। ভিতরের পাতায় খুদি-খুদি করে লেখা ছিল, ‘জয়েন লাইফ এক্সপার্ট শ্রবণকুমার, লিভ আ নিউ লাইফ।’ ঠিক একেই তো চান তিনি। মনটা খুশিতে ভরে গিয়েছিল। ঠিকানা খুঁজে চলে আসতে দেরি হয়নি। এসে সব দেখেশুনে বেশ পছন্দই হয়েছিল। ওরাল অ্যান্ড প্র্যাক্টিকাল মিলিয়ে দশ দিনের ট্রেনিং। দশ হাজার টাকার প্যাকেজ। এর মধ্যে ও শিখিয়ে দেবে, জীবনকে কী ভাবে এনজয় করতে হয়। কথা বলার স্টাইল, হাঁটাচলা, ভাবনাচিন্তা সব পালটে ফেলে কী করে এক জন নতুন মানুষ হয়ে উঠতে হয়। প্রথম তিন দিন ওরাল ক্লাস হয়েছে। অনেকগুলো লেস্‌ন দিয়েছে শ্রবণকুমার। কিন্তু সেগুলো অ্যাপ্লাই করতে গিয়ে বেশ ভালমত সমস্যার সামনে পড়তে হয়েছে অবনীবাবুকে। সেগুলোই একটু আলোচনা করে নেওয়া দরকার। কাল ফোন করে সেই ব্যাপারেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে রেখেছিলেন।

‘আই থিঙ্ক ইউ নিড আ কফি... ডোন্ট সে নোওওও,’ হালকা পায়ে এক কাপ কালো তিতকুটে দেখতে কফি নিয়ে এসে ধরিয়ে দিয়ে সামনের সোফায় ক্রস-লেগ্‌ড হয়ে বসে শ্রবণকুমার। যদিও এই কেলে চা-কফি দু’চক্ষের বিষ, তবু নাকি আজকাল এটা খাওয়াই দস্তুর। আর স্মার্ট ওই বসে থাকার ভঙ্গিটা দেখেও মনে-মনে লজ্জাবোধ হয় অবনীর। নিজের ছ্যাদড়ানো পা দু’খানা এক জায়গায় নিয়ে আসেন। যতটা সম্ভব মুখ অবিকৃত রেখে চুকচুক চুমুক দেন কফিতে। গলাখাঁকারি দিয়ে শুরু করতে যাবেন, এমন সময় মোবাইলে বেজে ওঠে ‘চাই না মাগো রাজা হতে...’। উফ, এই রিংটোনের জন্যও লজ্জা হয়। ছেলের বউ লাগিয়ে দিয়েছে। উনি কায়দা জানেন না যে পালটে নেবেন। এটা শুনলেই নিজেকে আরও বুড়ো মনে হয়। ফোন করেছে ছেলের মা লাবণ্য। ট্রেনারের শেখানো মতো চিরকালীন হ্যালো না বলে গলায় তরঙ্গ তুলে অবনী বলেন, ‘হা আআই...।’

‘মরণ... ও সব হাই-মাই ছাড়ো। সাতসকালে কোথায় গিয়ে বসে আছ? শুনলুম পার্কে যাওনি?’

‘হ্যাঁ... মানে... না... মানে ওই আর কী...’ কী বলবেন ঠিক করতে পারেন না অবনীবাবু। সক্কালবেলাতেও পিছনে স্পাই। কী জীবন তার! শ্রবণকুমার হাতের তেলোয় থুতনি ঠেকিয়ে মন দিয়ে তাকিয়ে আছে।

‘আচ্ছা শোনো... ফেরার সময় বাজার ঘুরে সজনেফুল আনবে। বউমা চচ্চড়ি খেতে চেয়েছে। আর তোমার জিওল মাছ শেষ। ওটাও নাদুকে বলে আসবে যেন দিয়ে যায়। আমার পান শেষ হয়েছে, মনে করে এনো...।’ একের পর এক ফিরিস্তি দিয়ে যেতে থাকে লাবণ্য। এই সব পান, সজনেফুল, জিওল মাছ দিয়েই সে ক্রমশ ধ্বংস করে ফেলল অবনীবাবুর একটা মাত্র জীবন! কিন্তু হতাশ হয়ে হাল ছাড়বেন না বলেই তো শ্রবণকুমারের কাছে আসা। ট্রেনারের শেখানো মতো লাবণ্যর কথার স্রোত মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বেশ নাটকীয় ভাবে হেসে ওঠেন তিনি। সঙ্গে-সঙ্গে ধমক, ‘মরণ নাকি? ডাকাতের মত হাসছ কেন? দিলে সব গুলিয়ে ... কোথায় আছটা কোথায় বল দেখি?’

খোলা গলায় হাসির পর এ বার অত্যন্ত নীচে কোমল নিখাদে স্বরগ্রাম আনেন অবনীবাবু, ‘আজ এক বার বেরোতে হবে যে আমার সঙ্গে... গেট রেডি ডার্লিং... বারোটা নাগাদ রেডি থেকো...’ কথা শেষ হতে পায় না। তার আগেই চিল চিৎকার ভেসে আসে ফোনের ভিতর দিয়ে, ‘কীইইই! ভরদুপুরে আমি বেড়াতে যাব? তোমার সঙ্গে? কবে থেকে বলছি এক বার গুরুভাইয়ের কাছে নিয়ে চলো!’

‘আচ্ছা-আচ্ছা, আমি রাখছি এখন,’ কোনও মতে ফোনটা রেখে দেন তিনি। শেষ বেলায় ফ্লায়িং কিসটা আর ছোড়া হয় না।

‘আচ্ছা... এ বার শুনি, কী তোমার প্রবলেম?’ ঝোলা পাজামা আর টাইট গেঞ্জি পরা শ্রবণকুমার সিরিয়াস মুখে বলে। নিজের সমস্যার কথা বিশদে বলতে থাকেন অবনীবাবু। প্রথম দিন একটু কায়দা করে কোমর বেঁকিয়ে বারান্দা দিয়ে হাঁটা অভ্যেস করছিলেন। বুলটি ন্যাতা-বালতি নিয়ে মেঝে মুছছিল। হঠাৎ দেখলেন, সে মোছা থামিয়ে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। চায়ের কাপ হাতে বউমা মিলি কখন পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করেননি। গোড়ালিতে ভর দিয়ে এক পাক ঘুরে নিজের ঘরে ঢুকতে যাবেন, এমন সময় ধাক্কা লেগে কাপ-প্লেট পড়ে গিয়ে একাকার কাণ্ড। লাবণ্য এসে সব দেখেশুনে বলল, বুড়ো বয়সে মানুষ সুস্থির হয়। তার বদলে এমন ছটফটানি বেড়ে গেলে বুঝতে হবে, বাতাস লেগেছে। সে পারলে তখনই তার গুরুভাইয়ের কাছে ফোনে নিদান নেয়। সমস্যা হল পোশাক নিয়ে। স্বাভাবিক ভাবেই এত দিনের জামাকাপড়গুলো সব অবনীবাবুর কাছে ব্যাকওয়ার্ড ঠেকছে। তিনি নতুন রকম কিছু চাইছিলেন। তাই ছেলের ওয়াড্রোব ঘেঁটে সেদিন একটা জাম্পস্যুট না কী যেন বলে, তাই পরে ফেলেছিলেন। বেশ লালের ওপর কালো ডোরাকাটা, পা দিয়ে গলালে হাত দিয়ে বেরিয়ে আসে। একবারে সবটা ঢাকা পড়ে যায়। দেখেশুনে ভারী পছন্দ হয়েছিল। চারপাশে কেউ ছিল না। স্নান করে উঠে ওটা পরেই ডাইনিংয়ে খেতে গিয়েছিলেন। খাবার টেবিলে কাউকে না দেখে নিজেই সব বেড়ে নিয়েছিলেন। মিলি ভারী গোছানো মেয়ে। ক্যাসারোলে সব ভরেই রেখেছিল।

খাওয়ার পর লাবণ্যর ঘরে তাকে অসময়ে চাদর চাপা দিয়ে শুয়ে থাকতে দেখে রোম্যান্টিক হতে সাধ হয়েছিল অবনীবাবুর। পিছন থেকে ভাল করে জাপটে ধরে শুয়ে পড়তেই সে এক কাণ্ড। লাফ মেরে উঠে বসল মাসতুতো শালি নমিতা। সে যে বাড়িতে এসেছে, আবার লাবণ্যর ঘরে শুয়েও আছে, এ সব কিছুই জানতেন না তিনি। নমিতা প্রথমে চেঁচাল, তার পরে জামাইবাবুকে দেখে হেসে কুটিপাটি। সেই হাসি আর তার থামে না। অবনী ভড়কে গেলেও সেটা সামলে নিয়ে স্মার্ট হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। চেয়ার টেনে পাশে বসে পা নাচাতে-নাচাতে বলেছিলেন, ‘এত হাসির কী হল? শালিকে না হয় এক বার জড়িয়ে ধরেছি... বাট ইট ওয়াজ অ্যান এরর। এস আর এক বার হয়ে যাক। এ বারে ওরিজিনাল...’

এর মধ্যেই গাদাখানেক প্যাকেট নিয়ে ঘরে ঢুকেছে লাবণ্য আর মিলি। ‘দেখো, কী সুন্দর সব দানের বাসনপত্র আর প্রণামীর শাড়ি-জামা কিনেছি...’ বলতে-বলতে ঘরে পা রেখেই অবনীকে দেখে চোখ কপালে তুলে দাঁড়িয়ে যায় লাবণ্য।

‘এ কী পরেছ বাবা?’ হেসে গড়িয়ে যায় মিলি। লাবণ্য তার মাসতুতো বোনের হাউসমেডের বিয়ের জন্য কেনা জিনিসপত্রের প্যাকেট হাতে নিয়ে অবনীর চার পাশে প্রদক্ষিণ করে-করে দেখতে থাকে।

অবনী স্মার্ট গলায় বলেন, ‘কেন? হোয়াট’স রং ইন ইট?’

‘আরে... এটা তো আমার!’

‘তোমার? মন্টুর ওয়াড্রোবে ছিল যে?’ স্মার্টনেসে ভাটা পড়ে।

‘হ্যাঁ ছিল... কিন্তু ড্রেসটা তো আমার...’ মিলি মুখে ওড়না চাপা দেয়। এ হে হে, এটা তো বড় বিচ্ছিরি ব্যাপার হল। মনে-মনে লজ্জা পান অবনীবাবু। আফটার অল ডটার-ইন-ল’র ড্রেস পরা কোনও কাজের কথা নয়। ছেলেরটা পরা যায়। কিন্তু চিনবেনই বা কী করে! মানে-মানে ও ঘর থেকে কেটে পড়ার তালে ছিলেন তিনি।

ইতিমধ্যে জিনিসপত্র সব নামিয়ে রেখে মোবাইল ফোন কানে দিয়েছেন লাবণ্য। বিপদে-আপদে তার ওই একটি মাত্র ভরসা, গুরুভাই। অবনীবিকাশ অস্বাভাবিক আচরণ করছেন, এ কথা ঢাকঢোল সহযোগে বর্ণনা করে, তার নিদান নিয়ে তবে জল খেয়েছিল সে।

সেই নিদান ঠিক কী, তা জানেন না অবনী। তবে এটা লক্ষ করেছেন, মিলি তার পর থেকে তাকে দেখলেই ফিকফিক করে হেসে ফেলছে, হাসি চাপতে না পেরে ঘরে চলে যাচ্ছে। কাল রাত্রে খেতে বসে মন্টুও হাসছিল। সব মিলিয়ে কেমন একটা অস্বস্তিজনক অবস্থা। ‘বেশ করেছি, আবার করব’ এই ভাবটা আনাই যাচ্ছে না মনের মধ্যে। অথচ এটাই ছিল শ্রবণকুমারের এক নম্বর লেস্‌ন।

এ রকম ছোট-বড় হাজারটা সমস্যা হচ্ছে প্রতি পদে। কাল যেমন কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনতে চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু বহু ক্ষণ চেষ্টা করেও অবনীবিকাশ ঠিকমত শুনতে পেলেন না। কেবল কানের ভিতর ভোঁ ভোঁ। তিনি হাল ছাড়ার পাত্র নন।

এক সময় বেজে ঊঠল নাজিয়া হাসানের মধুরকণ্ঠ... ‘আপ জ্যায়সা কোই মেরি জিন্দেগি মে আয়ে...’ গানের কথা অবনীবাবুও বোধহয় উচ্চারণ করে ফেলেছিলেন, এবং তা বেশ জোরে জোরেই হবে। সুর বা কণ্ঠ যেমনই হোক, কথাগুলো তো সাংঘাতিক।

হঠাৎ দেখলেন, হাতে করে নিয়ে আসা চায়ের কাপটা ঠক করে সামনে নামিয়ে রেখে গম্ভীর মুখে চলে গেল লাবণ্য। গেল তো গেল, সারা দিন আর সামনেও এল না, কথাও বলল না। কিছু বলতে গেলেই সরে যায়। কুড়ি ঘণ্টা পর এই যে ফোনে কথা হল, সেও সজনেফুল দরকার তাই। এ রকম চলতে থাকলে কি আর সুস্থ মনে কোনও গঠনমূলক কাজ করা যায়? তাই তিনি সাতসকালে ছুটে এসেছেন শ্রবণকুমারের কাছে, ক্লাসের বাইরেও যদি কিছু স্পেশাল পরামর্শ পাওয়া যায়।

শ্রবণকুমার গম্ভীর মুখে সবটা শুনল। শুনতে-শুনতে দাঁত দিয়ে নখ কাটল, বার তিনেক লম্বা চুল হাত দিয়ে সেট করল, পেন দিয়ে প্যাডের ওপর আঁকিবুঁকি কাটল। তার পর চিন্তিত মুখে যা-যা বলল তার সার কথা হল, অবনীবিকাশের প্রবলেমগুলো বেশ ক্রিটিকাল। এগুলোর সব উপায়ই তার জানা আছে, কিন্তু সেটা এই শর্ট জেনারেল প্যাকেজে হবে না। তাকে একটা স্পেশাল প্যাকেজ নিতে হবে পনেরো দিনের। যার চার্জ পনেরো হাজার! অবনী যেহেতু তার ‘ভীষষওওওণ ফ্যাভ চ্যাপ’, তাই ডিসকাউন্ট করে মাত্র তেরো হাজারেই করে দেবে।

অবনীবাবু একটু থমকে গিয়েছিলেন টাকার অঙ্ক শুনে। জেনারেলের জন্য দশ হাজার দিতেই মনটা খিচখিচ করেছিল। সারা জীবন হিসেব করে চলেছেন। দুমদাম টাকা ওড়ানোর অভ্যাস কোনও দিনই ছিল না। এখন আবার তেরো হাজার দিতে হবে শুনে নিজেকে চুপসানো বেলুনের মত লাগছে।

‘ডোন্ট ওরি ডার্লিং... আমি আছি তোমার জন্য। রিমেম্বার... মানি হ্যাজ নো ভ্যালু... আনলেস ইউজ্‌ড প্রপারলি...’ চলে আসার সময় অবনীবিকাশের নাকের ডগায় আঙুল নাচিয়ে বলেছিল শ্রবণকুমার।

আনমনা হয়ে তপনের সবজির দোকানের সামনে থেমে যান অবনী। ঝুড়িতে সাজানোই আছে টাটকা সজনেফুল। প্রায় কেজি খানেক নিয়ে নেন। এটা নিশ্চয়ই কোনও বুড়োটে ব্যাপার হল না। সব বয়সেই সজনেফুল খাওয়া ভাল।

মিলিদের ঘর এখনও বন্ধ। এতখানি বেলা হল। বিরক্ত হলেও না ডেকে নিজের ঘরে ঢোকেন অবনী। ড্রেসিং টেবিলের সামনে ওটা কে বসে আছে? নিজের চোখকেই বিশ্বাস হয় না যেন। লাবণ্য! একটা হাঁটু অবধি বেগুনি ফ্রক পরে, চোখে গাঢ় কাজল, ঠোঁটে বেগুনি লিপস্টিক। বড়িখোঁপা খুলে লাল প্রজাপতি ক্লিপ আটকেছে।

নিজের চিরচেনা বউকে এ রকম উদ্ভট সাজে দেখে আঁতকে ওঠেন অবনীবাবু। হাতে সজনেফুলের প্যাকেট দুলিয়ে হেঁকে উঠেন, ‘এ সব কী হচ্ছে? তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেল? ছেলে, ছেলের বউ
দেখলে কী বলবে?’

একটুও লজ্জা পায় না লাবণ্য। বাষট্টি বছর বয়সে বাইশের ভ্রুকুটি হেনে বলে, ‘আহা! ওরা কি আছে নাকি? আজ মিলির অফিস-পিকনিকে গেল তো দুজনে। সেই জন্যই তো আমি...’

‘সেই জন্যই তুমি নিজস্বতা ত্যাগ করে এই উদ্ভট সেজেছ?’

লাবণ্যর মুখটা একটু করুণ দেখায়। ‘বা রে... আমাকে ভাল লাগছে না?’

‘না... একটুও না...’ স্বামীসুলভ ধমক দেন অবনীবাবু, ‘যাও... মুখ ধুয়ে পোশাক পালটে এস... আর এই নাও তোমার সজনেফুল...’

খবরের কাগজটা বগলে করে যেতে গিয়েও আবার ঘরে উঁকি মারেন তিনি, ‘আর হ্যাঁ... আমার লুঙ্গিটা কোথায় আছে, একটু দেখে দিও তো!’

ঘরের মধ্যে লাবণ্য তখন হাসিমুখে নিজের মোবাইলে গুরুভাইয়ের নম্বর টিপেছে। গুরুভাইয়ের দেওয়া নিদানে যে এত তাড়াতাড়ি ফল পাওয়া যাবে, ভাবেইনি সে!

‘রবিবাসরীয়’ বিভাগে ছোটগল্প পাঠান, অনধিক ১৫০০ শব্দে।
ইমেল: rabibasariya@abp.in সাবজেক্ট: rabibasariya galpa

ডাকে পাঠানোর ঠিকানা:

‘রবিবাসরীয় গল্প’,

আনন্দবাজার পত্রিকা,

৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,

কলকাতা ৭০০০০১

যে কোনও একটি মাধ্যমে গল্প পাঠান। একই গল্প ডাকে ও ইমেলে পাঠাবেন না। পাণ্ডুলিপিতে ফোন নম্বর বা ইমেল আইডি জানাবেন। ইউনিকোড ব্যবহার করা বাঞ্ছনীয়।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement