ছবি: মহেশ্বর মণ্ডল
জিরের কৌটোটা থাকছে প্রথম তাকে চিনির বড় কৌটোটা ঠিক তার নীচের তাকে। ডান দিকে একেবারে ধারে আছে মসুরডাল। মুগডাল তৃতীয় তাকে। হলুদগুঁড়োর...
না বাবা, এই পর্যন্ত থাক। বেশি বাড়াবাড়ি করলে বিপদ হতে পারে। কৌটোগুলোর অবস্থান মনে মনে আবার ঝালিয়ে নিতে থাকে সে। মুগ-মসুর মিশিয়ে পেটকোঁচড়ে, জিরে একটা ঠোঙা বা কাগজে মুড়ে ডালের সঙ্গে রাখলেই হবে। চিনিটা? ওগুলোর সঙ্গে চিনিটাও পেটকোঁচড়ে ঢোকালে চার মাসের পোয়াতি মনে হবে। না, চিনিটা বরং আজ থাক। কিন্তু ছোট ছেলেটা চিঁড়ে ভিজিয়ে চিনি দিয়ে খাবে বলে বায়না করছে। চিঁড়েটা পরশু সরানো হয়েছে!
গতকাল বউদি রান্নাঘর ছেড়ে এক বারও নড়েনি। সে জন্য কিছু করা যায়নি। বউদি কিছু বাসি আনাজ দিয়েছে। ওগুলোর জন্য একটা রঙিন পলিব্যাগ জোগাড় করে নিতে পারলে চিনিটা সেটার মধ্যেই ঢেলে নেওয়া যাবে। ইতিউতি তাকাতে নর্দমার কাছে একটা পলিব্যাগ নজরে পড়ে গেল। ওর ভিতরে চিনি ঢেলে উপরে আনাজগুলো নিতে হবে। পুরো ব্যাপারটার প্ল্যান হওয়ার পর একটু নিশ্চিন্ত হয়ে কল্পির মা বলে, ‘‘বউদি, তোমার শাড়ি-বেলাউজ কখন ধুয়ে রেখিচি। ছাতে গিয়ে মেলে দিয়ে এস।’’ রান্নাঘর থেকে বউদিকে পাঁচ মিনিটের জন্য সরাতে পারলেই কেল্লাফতে। সফল অপারেশন সেরে কল্পির মা এখন বাড়ির পথে। বেলা প্রায় সাড়ে দশটা। এখন গিয়ে উনুন ধরাতে হবে। ঘরে যে কাঠ আছে তা দিয়ে হবে না কিছুতেই।
গোপেশ দলুইয়ের বাড়ি পেরোতে গিয়ে থমকে যায় কল্পির মা। চোত-বোশেখে তালের রস জ্বাল দিয়ে গুড় আর পাটালি বানায় গোপেশ। প্রচুর কাঠ লাগে। বাড়ির পিছনে থাকে-থাকে সাজানো আছে শুকনো কাঠ। মোটা দেখে দু’খানা সরাতে পারলেই হবে। লুকিয়ে গোয়ালের পাশ দিয়ে যেতে গিয়ে পচা গোবরের মধ্যে পা ডুবে গেল তার। অনেক কষ্টে মোটাসোটা দেখে দু’খানা কাঠ টেনে বার করতে গিয়ে আওয়াজ হল। গোপেশের বউ বলে উঠল, ‘‘শুনছ? কাঠমাচায় শব্দ হচ্ছে বোধহয়। খটাশ ঢুকেছে কি না দেখো।’’
দ্রুত পিছু হটে কাঠ বগলদাবা করে গুঁড়ি মেরে ফিরতে থাকে সে। শাঁখারিপাড়া ঢোকার মুখে একটা পুকুর আছে। পা দুটো সেখানেই ধুয়ে নিতে হবে। খানিকটা এগোবার পর পিছন থেকে কে যেন বলে উঠল, ‘‘হেই!’’ পিছন দিকে তাকিয়ে সময় নষ্ট না করে দৌড় দিল কল্পির মা। গোবরে মাখা পা পিছলে পড়ে যায় সে। কোঁচড়ের বামাল অক্ষত থাকলেও পলিব্যাগটা সামলাতে পারে না। বাসি আনাজের সঙ্গে বেশ খানিকটা চিনিও ছড়িয়ে পড়ে রাস্তায়।
খুব বিপন্নবোধ করে কল্পির মা। কাঠের খোঁচা লেগেছে পাঁজরে। ও দিকে ইটের ঘষায় ডান হাঁটুর চামড়া ছড়ে গিয়েছে। ব্যথা-যন্ত্রণায় ভয়ে দম আটকে আসে তার। চোখ জলে ভরে যায়। তবু পিছন দিকে তাকিয়ে দেখে। কেউ কোথাও নেই।
রাস্তার উপর থেকে ছড়ানো চিনি ও আনাজগুলো দ্রুত তুলে নিয়ে আবার ঢুকিয়ে নেয়। কাঠদু’টো নিয়ে অতি কষ্টে খোঁড়াতে খোঁড়াতে এগোয়। ‘‘অ কল্পির মা, রাস্তায় এত চিনি ছইড়ে চললি যে? তোর কেনা চিনা না কি রে,’’ পিছন থেকে প্রশ্ন ভেসে আসে। ‘‘না রে, তোর ভাতারের কেনা চিনি, আমায় দেছেলো,’’ জবাব দিয়ে হাঁটতে থাকে কল্পির মা, ফিরেও তাকায় না প্রশ্নকর্ত্রীর দিকে।
******
দুই ছেলে মানিক আর গোলাপ, এক মেয়ে কল্পনাকে নিয়ে মোট চার জনের সংসার কল্পনার মায়ের। কল্পনা প্রথম সন্তান। প্রথম সন্তানের নামের সঙ্গে ‘মা’ জুড়ে ডাকার রীতি প্রচলিত। সেই হিসেবে হওয়া উচিত ছিল ‘কল্পনার মা’। কিন্তু অপভ্রংশে কল্পনা কল্পি, আর তার মা কল্পির মা। কল্পির বাপ কলকাতায় ঠিকে কাজ করতে যেত। দেড়-দু’মাস অন্তর বাড়ি আসত। কোনও মতে কষ্টের মধ্যে চলছিল সংসার। আস্তে আস্তে কল্পির বাপের আসা কমতে লাগল। টাকার পরিমাণও। এক সময় আসাই বন্ধ করে দিল। কিছু কিছু টাকা পাঠাত, এক সময় তা-ও বন্ধ হয়ে গেল। পরে জানা গেল, সে আর ফিরবে না। কলকাতায় আবার বিয়ে করেছে।
কল্পির মা খবরটা শুনে অবাক হল। তবে সেটা ভালবাসার জন্য নয়। ও রকম কোনও সম্পর্ক তাদের মধ্যে ছিলই না। শুধু সম্পূর্ণ যান্ত্রিক এক দেহ-সম্পর্ক। কল্পির মা ভেবেই পাচ্ছিল না, অন্য মেয়ে ধরে কল্পির বাপ কী সুবিধা পেল? তার মধ্যে যা যা আছে, সেই মেয়েটার মধ্যেও তো তা-ই আছে। তা হলে? প্রতিবেশিনী পুঁটের মা সব শুনে মন্তব্য করেছিল, ‘‘নতুনের ঝোঁক। মদ্দরা নতুন পেলিই আগেরটাকে বাতিল করতে চায়। তাই তুই এখন বাতিল।’’ বোঝেনি কল্পির মা, ‘‘তুই থাম তো পুঁটের মা। মেয়েছেলে আবার নতুন পুরনো কী শুনি? তারও যা আছে, আমারও তা-ই আছে। আসলে সে মাগি ইনকাম করে মনে হয়। দু’জনে মিলে ইনকাম করে সুখে-স্বচ্ছন্দে থাকবে, এটাই আসল কথা!’’ সে যা-ই হোক, কল্পির মা বড় আতান্তরে পড়ল চার-চারটে পেট নিয়ে। প্রথমেই মেয়েকে স্কুল ছাড়িয়ে গৃহস্থ বাড়ির ঠিকে কাজে লাগিয়ে দিল। লেখাপড়া শিখে করবেই বা কী? সেই তো ভাতার দরকার মতো নিয়ে শোবে, আর একটু এদিক-ওদিক হলেই কিল-চড় মারবে। বড় ছেলেটাকেও স্কুল ছাড়িয়ে আনাজ ব্যবসায় লাগিয়ে দেওয়া হল। নিজেও দু’তিন বাড়ির কাজ বেশি করে ধরে নিল। ছোট ছেলেটা স্কুলে পড়ছে, পড়ুক। একটু বড় হলে ওকেও লাগিয়ে দেওয়া হবে কোনও কাজে। থাকুক মিনসেটা নতুন মেয়েমানুষ নিয়ে। কিন্তু সে কি সত্যিই এই বয়সেই এত পুরনো হয়েছে যে একেবারে বাতিল হয়ে গেল? নতুন আর পুরনোর ধন্দটা খানিকটা রয়েই গেল কল্পির মা’র মনে।
প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে না হলেও এলাকাটা গ্রাম তো বটেই। একটা চওড়া পাকা রাস্তা, বিদ্যুৎ সংযোগ থাকলে গ্রাম মফস্সল হয়ে যায় না। ঘন বসতিও নেই। বাড়িতে বাড়িতে কাজের লোকের চাহিদা তেমন বেশি নয়। মাস-মাইনের হারও বেশ কম। ফলে কল্পির মা’র পরিবারের তিন সদস্য কাজে নামলেও মোট রোজগারের পরিমাণ যা দাঁড়াল তা যথেষ্ট ছিল না। অতএব কল্পির মা অন্য রোজগারে মন দিল।
প্রথমে অন্যের বাগানের কলাটা মুলোটা চুরি করা ধরল। বুক ঢিপঢিপ করলেও দিব্যি আনাজের খরচটা বেঁচে যেতে লাগল। বেশ ক’দিন পর বুকের ঢিপঢিপানি যখন আর তেমন ভাবে টের পেল না, তখন কাজের বাড়ির রান্নাঘরের জিনিসের দিকে নজর যেতে লাগল। নুন, তেল, হলুদ, মশলাপাতি, আস্তে আস্তে সব কিছুই জোগাড় হয়ে যেতে লাগল। সমস্যা থেকে গেল চাল আর কাপড়চোপড় নিয়ে। স্বল্প রোজগার, দয়াদাক্ষিণ্য আর হাতসাফাই, সব মিলিয়ে অর্ধাহার থেকে না বাঁচলেও অনাহার এড়ানো সম্ভব হয়েছিল।
যত দিন যেতে লাগল, ততই কল্পির মা হাতসাফাইকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেল। কাজের বাড়ি ঢুকলেই তার চোখদু’টো আপনা থেকেই সন্ধানী, সতর্ক, ক্ষিপ্র হয়ে উঠত। কিন্তু এক আশ্চর্য ব্যতিক্রমে, সুযোগ পেলেও কল্পির মা কখনও টাকাপয়সা, সোনাদানা বা বাসনপত্রে হাত দিত না। শুধুমাত্র আহার্য বস্তুই তাকে টানত।
প্রথম প্রথম এক বেলা বা দু’বেলা চলার মতো আনাজ চুরি করে সরে পড়ত সে। ক্রমশ সাহস বাড়তে তিন-চার দিনের মতো আনাজপাতি ‘সংগ্রহ’ করতে শুরু করেছিল। ধীরে ধীরে তার চুরির ক্ষেত্র প্রসারিত হল। আনাজপাতির সঙ্গে ফলও যোগ হল। উত্তরপাড়ার রতন পালের বাগানে বড় বড় কলার ঝাড় আছে। গত মাস দুয়েকের মধ্যে বার-তিনেক সফল হানাদারির পর সে আবার আজ দুপুরের কাঠপাতা কুড়নোর ছলে সে দিকে গিয়েছিল। সুপুষ্ট একটা মর্তমান কলার কাঁদি তার দিকেই তাকিয়ে আছে। গাছটা খুব বেশি লম্বাও নয়। আজ রাতে সরাতেই হবে ওটা। উত্তেজনায় খেয়ালই করল না সে, কলাঝাড়ের আড়ালে বসে রতন তাকে একদৃষ্টে লক্ষ করছে।
******
শরতের চাঁদনি রাত। চারদিক নিঝুম হতে কল্পির মা বেরল। হাতে ধারালো হেঁসো। শায়া-ব্লাউজের বালাই নেই। শাড়িটা ভাল করে জড়িয়ে উঁচু করে পরা। চাঁদের আলো গভীর রাতে চড়া হয়। তাতে আলোছায়ার নানা খেলা থাকে। কল্পির মা এই আলোছায়ার খেলাকে কাজে লাগিয়ে আলতো পায়ে রতনের বাগানে সেই ঝাড়টার কাছে নিঃশব্দে পৌঁছে গেল। কাঁদির দিকে লোভাতুর দৃষ্টি রেখে শেষ বারের মতো শাড়ির আঁচলের প্রান্ত আরও আঁটোসাঁটো করে নিচ্ছিল সে। সে জন্যই হয়তো রতন চুপিসারে যখন তার তিন ফুটের মধ্যে পৌঁছে গিয়েছে, তখনও টের পায়নি।
আচমকা রতন তাকে পিছন থেকে তার হেঁসো-ধরা হাত সমেত জড়িয়ে ধরল। আঁক করে একটা শব্দ গলা দিয়ে বেরোতে গিয়েও শেষ পর্যন্ত আর বেরল না। ধারালো হেঁসোটা সে রতনের হাতে বসিয়ে দিয়ে হাতের বাঁধন আলগা করার প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগল। মধ্য তিরিশের জোয়ান রতন। প্রায় সমবয়সি কল্পির মা তার সঙ্গে গায়ের জোরে এঁটে উঠতে পারছিল না। রতন হিসহিসিয়ে বলে উঠল, ‘‘হেঁসোটা ফেলে দে। নইলে ওটা তোর গলায় বসাব।’’
কোনও উপায় না দেখে অগত্যা হেঁসোটা ফেলে দিল সে। তাকে জড়িয়ে ধরা অবস্থাতেই এক লাথি মেরে সেটাকে দূরে সরিয়ে দিল রতন। তার পর বলে উঠল, ‘‘সব সুদ্ধু পাঁচ কাঁদি কলা তা হলে তুই কেটেছিস?’’
‘‘না, আমি এর আগে মাত্র এক কাঁদি নিইছি, ছাড় আমাকে।’’
‘‘বাকিগুলো তা হলে কি ভূতে নিয়েছে, অ্যঁা!’’
কল্পির মা উত্তর দিতে গিয়ে সহসাই অনুভব করে, রতনের দু’হাতের মুঠো কখন তার ভরাট দুই বুকের ওপর চেপে বসেছে। গলা শুকিয়ে ওঠে তার। ফ্যঁাসফেঁসে গলায় বলে, ‘‘ছাড় রতন, আমাকে ছাড়।’’
‘‘ছাড়ছি ছাড়ছি, আমার কথা শোন একটু।’’
রতনের গলাও পালটে গিয়েছে। একটু আগের কাঠিন্য মোলায়েম হয়েছে, ‘‘আমি নিজের কলার কাঁদি কেটে তোর বাড়িতে দিয়ে আসব। এখন ও পাশে চল।’’ রতন পাঁজাকোলা করে তুলে নেয় তাকে। অসহায় ভাবে কল্পির মা শুধু বলতে পেরেছিল, ‘‘তোর পায়ে পড়ি রতন...’’ বাকি কথা তার হারিয়ে গেল এক উগ্র চুম্বনে। তার মনে হতে থাকে, সে নাকি পুরো বাতিল হয়ে গিয়েছে! তা হলে তার চেয়ে একটু কমবয়সি রতন তাকে নিয়ে এমন উথাল-পাথাল কাণ্ড করছে কেন!
রতন তত ক্ষণে তাকে খড়ের উপর নামিয়েছে। পাগলের মতো তার উপর হামলে পড়েছে। পাগলামি করছে বটে, কিন্তু গুন্ডামি নয়। কল্পির মা বাধা দেবে ভেবেছিল, কিন্তু বাধা দেওয়া হল না। হঠাৎ সে অনুভব করে, সে এখনও পুরনো বা বাতিল হয়ে যায়নি। একদম নতুন এক অচেনা আনন্দ, যা আগে পায়নি কখনও, তা ছড়িয়ে যাচ্ছে তার শরীর মনের সর্বত্র। শিথিল হাতদু’টো দিয়ে এ বার রতনের ঘাড়-পিঠ সে সাপটে ধরে সাপিনীর মতো।
রতন কথা রেখেছিল সে রাতে। মর্তমান কলার ভারী কাঁদিটা নিজে কেটে তার বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছিল। তবে শুধু সে রাতের জন্য নয়, তার পরেও রতন তার পাশে থেকেই গেল। সে বিপত্নীক। মাতৃহারা এক কন্যাকে নিয়ে তার অপূর্ণ, ছোট সংসার। পিছুটান কম। বড় বড় দু-দুটো বাগান আছে। কঠিন পরিশ্রমী সে। কল্পির মা রতনকে পাশে পেয়ে পায়ের তলায় শক্ত জমি পেয়ে গেল। দু’বছরের মধ্যে কল্পির বিয়ে দিয়ে দিল। বড় ছেলে মানিককে মোটর গ্যারেজের কাজে ভাল মাইনেতে ঢুকিয়ে দিল, সে-ও রতনের দৌলতে।
জ্যোৎস্নামাখা রাতগুলোতে রতনের বাগান তাকে নিশির ডাকের মতো টানত। দিনের বেলায় মাঝেমধ্যে গেলেও রাতে রতন কখনও তার বাড়িতে আসত না। বাগান পাহারার জন্য মদন একটা দোচালা কুঁড়ে তৈরি করেছিল। রাতে সেখানেই তারা নিশ্চিন্তে ঘনিষ্ঠ সময় কাটাত। দেখা-হওয়া সব রাতেই যে তারা শরীর দেওয়া-নেওয়া করত তা নয়। দেহের দরজা দিয়ে ঢুকলেও তারা পরস্পরের মনের গহন সঙ্গী হয়ে পড়েছিল। না-বলা, জমে থাকা অনেক পুরনো কথা, আপাত-মূল্যহীন অনেক কথা তারা দু’জন দু’জনকে বলত গোটা রাত ধরে।
******
কল্পির মা’র এখন সুখের সংসার। ছেলে ভাল রোজগেরে। মেয়ের বিয়ে হয়ে পরিবারের সদস্য কমে গিয়েছে। জামাই ভাল রোজগার করে। সে-ও মাঝে মধ্যে সাহায্য করে। আর রতন তো আছেই। বাগানে যা যা আনাজ হয়, সেগুলো প্রয়োজন মতো তার বাড়িতে পৌঁছে যায়। কল্পির মা এখন সুখে ভরন্ত। পরিশ্রম কমাতে দু-এক বাড়িতে কাজ ছেড়ে দেবে কি না, ভাবছে। অবশ্য ভবেন বিশ্বাসের বাড়ির কাজটা বোধহয় যাবে। বিশ্বাসগিন্নির হাবভাব অনেকটা সেই রকম। বিশ্বাসদের রান্নাঘরের পিছনের বাগানের কোনাতে উনুনের ছাই, আনাজপাতির খোসা, ভাতের ফ্যান, এ সব ফেলা হয়। সেখানে এক পাশে একটা মানকচুর গাছ হয়েছে। গোড়াটা ইয়া মোটা। খুব ভাল জাতের। দেখা ইস্তক তার চোখ হয়ে উঠল ব্যগ্র। কেমন করে, কোন পথ দিয়ে সে ঢুকবে এবং বামাল সমেত কোন দিক দিয়ে বেরোবে, দ্রুত চলতে থাকে সেই সব বিচার-বিবেচনা। কাজ করার ফাঁকে বিশ্বাসগিন্নিকে বলে, ‘‘বউদি, তোমাদের মানকচুটা বড় হয়ে গিয়েছে। এই বেলা তুলে নাও। কে যে কখন চুপিসারে তুলে নেবে তার কোনও ঠিক আছে?’’ তার পর একটু থেমে, যথেষ্ট হয়নি ভেবে আরও একটু যোগ করে, ‘‘কচুটা তুললে আমাকে একটু দিও বউদি। ভাতে দিয়ে খেতে খুব ভাল লাগে।’’ বিশ্বাসগিন্নি বলেছিল, ‘‘ঠিক আছে, তুললে তোমাকে দেব।’’
বিশ্বাসগিন্নিকে যে ভাবে বলা হল, তার পর আর সন্দেহ থাকার কথা নয়। তবু আরও নিরাপদ হবে ভেবে দু’টো রাত অতি কষ্টে নিজেকে সামলে তৃতীয় রাতে সে মানকচুটা সরিয়েছিল। তবুও বোধহয় শেষরক্ষা হবে না। বিশ্বাসগিন্নি অস্বাভাবিক রকমের গম্ভীর হয়ে আছে। মুটকিটা ঠিক সন্দেহ করেছে তাকে, করুকগে।
মানকচুটা সত্যিই ভাল। ভাতে দিয়েছিল। তা ছাড়া আলু দিয়ে ঝাল ঝাল ডালনা। এ সব জিনিস দুষ্প্রাপ্য। সে রাতে রতনের কুঁড়েঘরে যাওয়ার সময় খানিকটা ডালনা নিয়ে গিয়েছিল তার জন্য। বাড়িতে ভালমন্দ কিছু হলে রতনের জন্য নিয়ে যায়। বউ নেই। হাত পুড়িয়ে কী খায় না খায় তার ঠিক নেই। খেয়ে রতন বলেছিল, ‘‘দারুণ রেঁধেছিস ডালনাটা। কিন্তু একটা কথা বলি, এ বার এসব ছাড়। তোর তো এখন আর সে রকম অভাব নেই যে চুরিচামারি করে চালাতে হবে। এ সব একেবারে ছেড়ে দে এ বার। সারা পাড়ায় খুব দুর্নাম তোর। আমার বড্ড খারাপ লাগে। রতনের গলার স্বরে কষ্ট চুঁইয়ে আসে। একটু চুপ করে থেকে বলে, ‘‘তোর এই স্বভাবের জন্যই মাঝে মাঝে ভাবি তোর কাছ থেকে একেবারে সরে যাব।’’
প্রবল ভাবে শঙ্কিত হয় কল্পির মা। কেঁপে ওঠে তার সবটা, ‘‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। সত্যি বলছি, তোকে কথা দিচ্ছি, এ সব এ বার ঠিক ছেড়ে দেব। কিন্তু তুই আমাকে ছেড়ে যাবি না রতন। আমি মরে যাব তা হলে। এখন একটু কাছে আয়। সেই তখন থেকে কত দূরে বসে বসে শুধু ঝগড়া করছিস।’’
সে রাতে মনে মনে এক কঠোর প্রতিজ্ঞা করে ফেলে কল্পির মা। চুরি সে আর করবে না। মানিকও সে দিন খুব রাগ করে যা-তা বলেছে। রতনকে সে হারাতে পারবে না কিছুতেই। এ সব কথা নিজের মনে মনে ভাবলে যথেষ্ট জোর পায় সে। নিজেকে বেশ খুশি আর মুক্ত
লাগে তার।
******
দিন পনেরো পর। দাসবাড়িতে কাজে এসেছে কল্পির মা। দাসগিন্নি অনেকগুলো মাছভাজা একটা গামলায় তুলে রেখেছে। কল্পির মা ঝোলের আনাজ কুটে ধুয়ে দিয়েছে। দাসগিন্নি ঝোলটা বসাতে যাবে, এমন সময় বড় ছেলে ডাক দিল।
দাসগিন্নি তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেল রান্নাঘর থেকে। এখন কল্পির মার সামনে সোনার সুযোগ। অত মাছের মধ্যে আট-দশ টুকরো মাছ সরালে টেরই পাওয়া যাবে না। পলিথিনে মুড়ে পেটকোঁচড়ে চালান করা তার কাছে ঠিক দেড় মিনিটের ব্যাপার। কিন্তু না। সে রতনকে কথা দিয়েছে, নিজে দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আর এ সব কাজ সে করবে না। দাঁতে দাঁত চেপে কল্পির মা অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে চুপচাপ বসে থাকল, শেষ পর্যন্ত।
মহাদেব চৌধুরী বেশ দিলদরিয়া লোক। পানের ব্যবসা আছে জয়নগরে। রোজগার যেমন করে, খরচও তেমন করে। মাসে দু’বার বাড়ি আসে, আর আসার সময় বাড়ির লোকজনের জন্য নানা রকমের খাবার জিনিস নিয়ে আসে। তা ছাড়া ভাল মাছ পেলেও নিয়ে আসে। গত বর্ষায় এক সঙ্গে পাঁচ-পাঁচটা বড় ইলিশ এনেছিল। অথচ খেল মাত্র সাত জন। চৌধুরীগিন্নি কল্পির মা’কে শুধু দুটো ল্যাজা, একটা গাদার দিকের দাগা আর আধখানা মুড়ো দিয়েছিল। এ ছাড়া বড় গামলা-ভর্তি কুটে রাখা মাছের থেকে সাত-আট টুকরো মতো মাছ সরিয়েছিল সে। ইলিশ কিনে খাওয়ার মতো সামর্থ্য তার ছিল না। কিন্তু সে সব আগেকার কথা।
চৌধুরীবাবু এই গত মাসেই নিয়ে এসেছিল খুব বড় বড় দু’টো ভেটকি মাছ। এত বড় ভেটকি মাছ সে কখনও চোখেই দেখেনি। সে বারেও চমৎকার একটা সুযোগ পাওয়া গিয়েছিল। কল্পির মার খুব উসখুস ভাব হয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত রতনের কথা ভেবে মাছে হাত দেওয়ার চেষ্টা করেনি।
এ বার একটু তাড়াতাড়ি শীত পড়ল। অঘ্রানেই গায়ে চাদর সোয়েটার উঠল। সে দিন সকালে কল্পির মা একটা সস্তার চাদর গায়ে জড়িয়ে চৌধুরীবাড়িতে কাজে আসছিল। বাড়ির কাছাকাছি এসে সে দেখল, চৌধুরীবাবু ভিতর থেকে বেরিয়ে এল। তার মানে বাবু গতকাল রাতের দিকে বাড়ি ফিরেছে।
ভিতরবাড়ির উঠোনে পা দিতেই কল্পির মা’র তৃতীয় ইন্দ্রিয় সাড়া দিল। নলেনগুড়ের পাটালি... এক্ষুনি ব্যাগ থেকে বের করা হয়েছে মনে হয়। গন্ধে ভুরভুর করছে! এ কিন্তু মোয়া নয়। মোয়াতে গুড়ের সঙ্গে ঘিয়ের গন্ধ থাকে। তার চেয়ে অনেক লোভনীয় এই খাঁটি নলেনগুড়ের পাটালি। এই গুড়ে তৈরি পিঠে বা পায়েস যে খেয়েছে, সে কোনও দিন এর স্বাদ ভুলতে পারবে না। গত বছরেও দু’তিন বার এনেছিল চৌধুরীবাবু। আনার সঙ্গে সঙ্গেই পিঠে-পায়েস তৈরি হয়ে গিয়েছিল। কোনও বারে কল্পির মা ছিটেফোঁটা পেয়েছিল, কোনও বারে একদম পায়নি।
এ বার নিশ্চয়ই কাল রাতে ও সব করা হয়নি, তাই সকাল পর্যন্ত রয়ে গিয়েছে। জীবনে ও সব নিজের মতো করে কোনও দিন বানাতে বা খেতে পায়নি, ছেলেমেয়েদেরও খাওয়াতে পারেনি। এই পাটালি খানিকটা জোগাড় করতে পারলে অন্তত পায়েস বানিয়ে এক বার ছেলেমেয়েদের সাধ মিটিয়ে খাওয়াতে পারবে, নিজেও একটু তৃপ্তি করে খেতে পারবে, রতনকেও খানিকটা। কিন্তু সে তো প্রতিজ্ঞা করেছে যে এ সব কাজ আর কখনও করবে না!
আচ্ছা, ঠিক আছে। করবে না সে আর, তবে এটাই একেবারে শেষ বার! এর পরে যত ভাল, যত দামি জিনিসই হোক, যত লোভের জিনিস হোক না কেন, তাতে সে হাত দেবেই না! কক্ষনও না, জীবনেও না! আত্মসমর্থনটা এ ভাবে বেশ গোছানো আর খুব জোরালো হয়ে উঠতে থাকে। তার পর মনস্থির হয়ে যায়।
নিমেষের মধ্যে প্রথম ইন্দ্রিয় ধূর্ত সতর্কতায়, অভ্যস্ত ক্ষিপ্রতায় অন্য রকম ভাবে জেগে উঠল। কোথায় আছে? প্রথম সম্ভাব্য জায়গা রান্নাঘর। উঠোনের এক পাশে একটা দোমড়ানো ময়লাটে পলিব্যাগ পড়ে আছে। ওতেই হবে। অভ্যস্ত দক্ষ হাতের ছোঁয়ায় হাঁটতে হাঁটতেই তৈরি হয়ে যায় গোপন পেটকোঁচড়, ওপরে শাড়ি আর চাদরের অভেদ্য আবরণ।
রান্নাঘরের কাছাকাছি এসে সামান্য থমকায় সে। দ্বিতীয় ইন্দ্রিয় তাকে আশ্বস্ত করে, এখন এই মুহূর্তে রান্নাঘরে কেউ নেই। ভিতরে ঢুকতেই প্রথম ইন্দ্রিয় জানান দেয়, তৃতীয় ইন্দ্রিয় সমর্থন করে, মিটসেফের উপর একটা বড় গামলা, ওপরে একটা থালা চাপা দেওয়া আছে। ওটাতেই, নিশ্চিত ভাবে ওটাতেই আছে!
দ্বিতীয় ইন্দ্রিয় রান্নাঘরের দরজার বাইরের দিকে পাহারা দেয়। প্রথম ও তৃতীয় ইন্দ্রিয় স্বয়ংক্রিয় ভাবে একসঙ্গে কাজ করতে থাকে। উবু হয়ে বসে দু’হাত গামলাটার দিকে বাড়িয়ে দেয় কল্পির মা...
আচম্বিতে দ্বিতীয় ইন্দ্রিয় তার অবাধ্য হয়ে গেল। একাগ্রতায় ছেদ ঘটিয়ে ফেলল। চৌধুরীবাড়ির লোকজনের, বিশেষত গিন্নির পায়ের আওয়াজ, গলার শব্দ ঠিকঠাক শোনার আগাম চেষ্টার বদলে টেনে আনল সম্পূর্ণ অন্য এক জনের গলার শব্দ। সেটা রতনের। ‘‘তোর এই স্বভাবের জন্যই মাঝে মাঝে ভাবি, তোর কাছ থেকে সরে যাব...’’
সে দিনের মতোই কেঁপে ওঠে কল্পির মা। রতনকে এ সব কথা গোপন করতে সে পারবেই না। স্বভাবে একবগ্গা রতন যদি তার পর তার চওড়া বুক থেকে উপড়ে ফেলে দেয় তাকে? সেই ভয়ানক একাকী পৃথিবীকে সে কী করে সহ্য করবে?
উদ্যত ফণার মতো তার হাতদু’টো শক্তি হারিয়ে ফেলে। দু’চোখে চমকাতে থাকা ধূর্ত সতর্কতা অবাধ্য অকারণ অশ্রুতে ধুয়ে যেতে থাকে। গোড়ালির উপর নিজের শরীরটাকে ভীষণ ভারী বোধ হতে থাকে। আস্তে আস্তে রান্নাঘরের মেঝের উপর শিথিল ভাবে বসে পড়ে প্রেমাহত এক ভ্রষ্ট অবহারিকা।
‘রবিবাসরীয়’ বিভাগে ছোটগল্প পাঠান, অনধিক ১৫০০ শব্দে।
ইমেল: rabibasariya@abp.in সাবজেক্ট: rabibasariya galpa
ডাকে পাঠানোর ঠিকানা:
‘রবিবাসরীয় গল্প’,
আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা ৭০০০০১
যে কোনও একটি মাধ্যমে গল্প পাঠান। একই গল্প ডাকে ও ইমেলে পাঠাবেন না। পাণ্ডুলিপিতে ফোন নম্বর বা ইমেল আইডি জানাবেন। ইউনিকোড ব্যবহার করা বাঞ্ছনীয়।