বাড়ির অঙ্কখাতায় খান বারো পাতা ফাঁকা ছিল। সে ক’টা কম্পাস দিয়ে বৃত্ত এঁকে ভরাতে বেশি সময় লাগেনি। পুরনো খাতাগুলো টেনে বার করে, ফাঁকা পাতাগুলোও বৃত্তে ভরানো হয়ে গিয়েছে। এ বার চলছে সকালে খবরের কাগজের উপর অনুশীলন।
“আর কত বৃত্ত আঁকবি তুই? অনুশীলন থামা এ বার!” সুধন্য অপ্রসন্ন মুখে পিপুলের দিকে তাকায়।
“এমন জানলে তোকে জ্যামিতি বক্সই কিনে দিতাম না! ভারী তো স্কুলে গিয়ে ভূগোলের প্রজেক্ট খাতায় একটা সূর্য আর একটা পৃথিবী আঁকা! সেটার জন্য দু’সাইজ়ের দুটো কৌটোর মুখই ধরিয়ে দিতাম!” পলা গজগজ করে।
এই সব কথাবার্তার মাঝখানে সায়ন বেরিয়ে এল ওর পড়ার ঘর থেকে। হাতে একটা খাতা। “দেখো মা পিপুল কী করেছে আমার স্কুলের খাতায়! খাতার টপ পেজটা বৃত্ত এঁকে একেবারে ভরিয়ে দিয়েছে! এত ডিপ দাগ এক-এক জায়গায় যে রবার দিয়ে মুছলেও পুরোটা যাবে না।”
“স্কুলে গিয়ে দুটো বৃত্ত আঁকতে হবে। তার জন্য এত বার প্র্যাকটিস করতে হয়!” সুধন্যর রাগী গলা।
“তোমরা বড়, সহজে বৃত্ত আঁকতে পারো, আমি বার বার প্র্যাকটিস না করলে কি স্কুলে গিয়ে আঁকতে পারব?” চার দিকের আক্রমণে পিপুল মুখ খোলে এত ক্ষণে। তবে সম্মিলিত আক্রমণের অভিঘাতে গলাটা বেশ মিইয়ে যাওয়া। কিন্তু তাতে ওর অপরাধ লঘু হয় না।
সুধন্য ধমকে ওঠে আগের কথার রেশ ধরে, “সহজে বৃত্ত আঁকতে পারো না বলে দাদার স্কুলের খাতাতেও প্র্যাকটিস চালাতে হবে?”
“ফোরেই পাকা পাকা কথা তো বেশ বলিস, দাদার স্কুলের অঙ্ক খাতায় কিছু করলে যে দাদার ক্ষতি হবে, সে বুদ্ধি নেই!” পলাও সুধন্যর কথায় তাল দেয়।
প্রবল আক্রমণে পিপুল একেবারে চুপসে যায়।
পিপুল এমনিতে লেখাপড়ায় মন্দ নয়। কিন্তু পড়তে চায় না মোটেই। শুধু প্রজেক্টের খাতা, কম্পিউটার, আঁকা জাতীয় বিষয়গুলো নিয়ে পড়ে থাকে। এগুলোর মধ্যে কম্পিউটার, আঁকা, এগুলোর নম্বর যোগও হয় না পরীক্ষায়। তবু এগুলোতেই ওর বেশি উৎসাহ। সে কারণে মা-বাবার কাছে বকুনিও খায় খুব। দাদার তুলনা তো হরদম চলে আসে। একটু দুষ্টুমি করলেই ওকে শুনতে হয়, ‘দাদাকে দেখে শেখো’,‘দাদার মতো হও’ জাতীয় উপদেশ।
সায়নকে নিয়ে বাবা-মায়ের গর্বের শেষ নেই। সায়ন ছোট থেকেই মেধাবী। লেখাপড়া নিয়েই থাকে। স্কুল আর টিউশনে যাওয়ার সময় ছাড়া সব সময়েই ডুবে থাকে পড়ায়। ওর আরও উন্নতির জন্য সুধন্য একটা অনলাইন কোচিংয়েও ওকে ভর্তি করে দিয়েছে।
পিপুলের কিন্তু সায়নের সঙ্গে তেমন জমে না। সায়ন একটু বেশিই দাদা-দাদা যেন। সায়ন না থাকলে মাঝে মাঝে ওর ঘরে যায়। কী সুন্দর পরিপাটি বইয়ের তাক। সব বই-খাতা মলাট দেওয়া! পিপুলের বইয়ের তাক নেই। পড়ার টেবিলেই সব রাখতে হয়। আর খাতা-বইয়ে বাবা বছরের শুরুতে মলাট দিয়ে দিলেও তা খুলতে বা ছিঁড়তে দেরি হয় না।
স্বাভাবিক ভাবেই দাদার বইপত্র একটু নেড়েচেড়ে না দেখে পারে না। আর এর ফলে যা হওয়ার তাই হয়। একটা না একটা অনর্থ ঘটিয়ে ফেলে। এখন ওর বৃত্ত আঁকার ঝোঁক চেপেছে। কম্পাস দিয়ে অনর্গল বৃত্ত আঁকতে বেশ মজা পাচ্ছে ও। সেই মজার কিছু ছাপ যে সায়নের প্রয়োজনীয় খাতাপত্রেও পড়বে, এ আর বেশি কথা কী!
সায়ন ওর অঙ্কখাতাটা বগলে নিয়ে বলে, “পিপুল, বৃত্ত আর প্র্যাকটিস করিস না। ঠিক পারবি আঁকতে। আর যদি না-ও পারিস, কী হবে? প্রজেক্টে তো মাত্র পাঁচ নম্বর। এমনিতেই তুই মোট নম্বরের থেকে অনেক কম পাস। আরও পাঁচ নম্বর কম পেলে কী আর এমন ক্ষতি হবে!”
সায়নের এমন নিষ্ঠুরের মতো কথায় পিপুল ভিতরে ভিতরে রেগে ওঠে রীতিমতো। কিন্তু এখন রাগ দেখানো যাবে না। পরিবেশ ওর বিরুদ্ধে। তাই হজম করে যায় কথাটা।
বৃত্ত নিয়ে ঘরের এমন গুমোট আবহাওয়ার মাঝখানে সুধন্যর ফোন বেজে ওঠে। অচেনা নম্বর।
“কে আবার ফোন করল?” সুধন্য ফোনটা ধরে ‘হ্যালো’ বলেই ফোনটাকে হাতে চেপে পলার দিকে ফিরে বলল, “সোনামাসি।”
“হঠাৎ সোনামাসি! কী হল আবার?” পলা কৌতূহলী।
‘ও’, ‘আচ্ছা’, ‘বেশ’— এই কথা তিনটে ছাড়া সুধন্যর মুখ থেকে অবশ্য ফোন করার সময়ে আর কিছু বেরোল না। সুধন্য ফোনটা কেটে বেশ গম্ভীর হয়ে গেল।
“কী বলছে সোনামাসি? কারও কিছু হল না কি!”
“না, কারও কিছু হয়নি।”
“তবে?”
সুধন্য ঢোঁক গিলল। বোধহয় পলাকে কথাটা বলার জন্য সাহস সঞ্চয় করল। তার পর বলল, “এইটুকু ফ্ল্যাট। কেউ এলে সত্যিই সমস্যা!”
“কে আসবে?” পলার গলা তীক্ষ্ণ।
“লাটাই। ওর নিট-এর সিট পড়েছে এখানে।”
“তা বলে দিলে না কেন যে এখানে জায়গা কম, লাটাইয়ের অসুবিধে হবে!”
“সেটা কি বলা যায়?”
“তুমি লাটাইকে একটা হোটেল ঠিক করে দাও।”
“সেটা ভাল দেখাবে না। একটা দিনের ব্যাপার। যে ভাবেই হোক ম্যানেজ করে নিতে হবে।”
“নিট-এর পরীক্ষা মানে তো লাটাইকে পড়তেও হবে। কিন্তু পড়বেটা কোথায়?”
সুধন্য সায়নের দিকে তাকিয়ে বলল, “সায়নের ঘরে ছাড়া আর কোথায় পড়বে?”
“আমি ঘর ছাড়তে পারব না! আমার কোচিংয়ের এগজ়াম চলছে...” চেঁচিয়ে উঠল সায়ন।
“ঘর ছাড়তে হবে কেন? তুই তোর জায়গায় পড়বি। আর লাটাই তোর বিছানায়। অসুবিধে হবে?”
কথাটায় সায়ন খুশি হল না। মুখটা বেজার করেই থাকল। সে ঘরে একা পড়ে অভ্যস্ত। তার উপর অনলাইন পরীক্ষা। ঘরে অন্য কারও উপস্থিতি মানেই মনোযোগ নষ্ট।
পলাকে চিন্তিত দেখায়, “কী ঝামেলা বলো তো! দুটো ঘর, একটা ড্রয়িংরুম। এমনিতেই চার জনের হাঁসফাঁস অবস্থা। এর মধ্যে আবার এসে জুটবে এক জন নিট পরীক্ষার্থী... কবে আসবে বলল?”
“আগামী কাল,” বলল সুধন্য।
“আচ্ছা মা, আমার পড়ার চেয়ার-টেবিলটাতেও তো লাটাইদা বসে পড়তে পারে! আমি একটা দিন এই ড্রয়িংরুমের মেঝেয় বসে...” পিপুল বিচক্ষণের মতো একটা প্রস্তাব দিল।
“কাল সন্ধেয় তোর স্যর আসবেন, তখন কী করবি?” পলা ভুরু কুঁচকে তাকাল পিপুলের দিকে।
পিপুল বলল, “কেন? টেবিলের পাশ থেকে একস্ট্রা চেয়ারটা স্যরকে এখানে এনে দেব!”
সুধন্য চিন্তিত মুখে বলল, “পড়াটা যেমন তেমন, লাটাই শোবে কোথায়? সায়নের সঙ্গে?”
সায়নের এখানেও আপত্তি। সুধন্য এ বার ধমকে উঠল সায়নকে, “ছোটবেলায় আমাদের মাটির বাড়িতে এ রকম দুটোই ঘর ছিল। তাতে অতিথি আসার বিরাম ছিল না। মাটির বারান্দা, মেঝে এমনকি উঠোনেও আমরা হাসিমুখে শুয়ে পড়তাম বিছানা করে। আর তুই একটা দিন অ্যাডজাস্ট করতে পারছিস না?”
পলা সায়নের পক্ষ নেয়, “সব কিছুর সঙ্গে নিজের তুলনা টেনে এনো না। তা ছাড়া ওর খাটটা বেশ ছোট! দু’জন বড় ছেলে কি শুতে পারে? সে কারণেই আপত্তি জানিয়েছে সায়ন। এতে দোষের কী হল?”
আবার সমাধান দিল পিপুল, “মা, আমাদের খাটটা তো অনেক বড়! দাদা রাত্তিরে তোমাদের সঙ্গে শুয়ে পড়ুক। আমি লাটাইদাদার সঙ্গে দাদার খাটে, তা হলেই তো হবে!”
বৃত্ত আঁকা নিয়ে ছেলেটাকে বেজায় বকেছে। কিন্তু সবার যখন লাটাইয়ের পড়া, শোওয়া নিয়ে হিমশিম, তখন ও-ই দুটোরই সমাধান বাতলে দিল! এই বয়সেই বেশ ভাবতে শিখেছে তো ছেলেটা! সুধন্য মুগ্ধ চোখে তাকাল পিপুলের দিকে।
লাটাই পরের দিন এসে পৌঁছল বিকেলে। লাটাইয়ের পৈতে হয়েছে গত বছর। পিপুল গিয়েছিল বাবার সঙ্গে। যদিও বেশি দিন ছিল না, লাটাই পিপুলকে খুব আদর করেছিল ওই ক’দিনেই।
লাটাইকে দেখে পিপুল হইহই করে উঠল। এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরল। ওর কাঁধ থেকে লাটাইয়ের বারণ সত্ত্বেও ব্যাগটা টেনে নামাল। বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরোনোর পর পিপুল ওর পড়ার টেবিলটায় লাটাইয়ের সঙ্গে ওর বইপত্র পৌঁছে দিল। লাটাই জল খাবে শুনে, ছুটে গিয়ে খাবার টেবিল থেকে নিয়ে এল জলের বোতল।
পিপুলের এই আচরণ এ বাড়ির পক্ষে বেমানান। পলা এক-আধ বার চোখ কটমটও করেছে, কিন্তু পিপুলকে ‘বেমানান’ কাজ থেকে নিবৃত্ত করা যায়নি। লাটাইদা যে এ বাড়িতে উটকো ঝামেলা, পিপুল বুঝেছে আগেই। কিন্তু কী করবে! লাটাইদাকে যে ওর ভাল লেগেছিল পৈতের সময় গিয়ে। পিপুল কত ছোট, কিন্তু তবু পৈতের অনুষ্ঠানের আগে পরে ওর সঙ্গে লাটাই কুমিরডাঙা খেলেছিল, কম্পিউটারে কার্টুন ছবি দেখিয়েছিল, ওদের ছাদে নিয়ে গিয়ে ঘুড়ি ওড়াতে শিখিয়েছিল। নিজের দাদাটির কাছ থেকে এ সব পাওয়ার আশাই নেই। পিপুলের সে দিন মনে হয়েছিল, নিজের দাদার সঙ্গে যদি লাটাইদাকে বদলাবদলি করা যেত!
সে দিনের সেই ভাল লাগা থেকেই পিপুল লাটাইয়ের সঙ্গে লেপটে রইল প্রায় সারা ক্ষণ।
লাটাইয়ের সঙ্গে পিপুল ছাড়া অবশ্য তেমন কথা বলছে না কেউ। এমনকি পিপুলকে লাটাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে দেখে এক বার তো পলা প্রকাশ্যে বাধাও দিল, “লাটাইদাদাকে বিরক্ত কোরো না। পরীক্ষার প্রিপারেশন নিতে দাও।”
দেখে মনে হল, লাটাইয়ের নিট পরীক্ষার প্রিপারেশনে সহযোগিতার জন্যই বাড়ির সকলে ওর সঙ্গে কথা বলছে না। কিন্তু পিপুল ছোট হলেও বুঝতে পারছে, আসল কারণ হল, লাটাই নামক উটকো সমস্যাটির সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছে নেই কারও। সুধন্যর নিজের মাসির ছেলে। সেই সুধন্যই কেবল এক বার দায়সারা শুধিয়েছে, “মাসি ভাল আছে?”
কিন্তু সে প্রশ্নের উত্তর জানারও আগ্রহ দেখা যায়নি সুধন্যর মধ্যে। লাটাইয়ের উত্তর শোনার আগেই সুধন্য অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
আর সায়ন তো খাবার টেবিলেও লাটাইয়ের সঙ্গে কথা বলেনি। পলা খাবার টেবিলে শুধু খাবার দেওয়ার জন্য যতটুকু কথা বলা দরকার, মেপে ততটুকুই বলেছে।
রাতে লাটাইয়ের পাশে শুয়ে পিপুল জিজ্ঞেস করল, “কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো লাটাইদা?”
“আমি তো পরীক্ষা দিতে এসেছি। সে কথাই ভাবছি। সুবিধে-অসুবিধের দিকে তাকাচ্ছিই না!” কথাটা অতটুকু ছেলেকে বলার মতো নয়। তবু হয়তো এ বাড়ির সবার আচরণেই কথাটা বেরিয়ে এল লাটাইয়ের মুখ দিয়ে।
“এই পরীক্ষা দিয়ে পাশ করলেই কি ডাক্তার হয়ে যাবে তুমি?” জিজ্ঞেস করল পিপুল।
“না। এটা তো ডাক্তারি পড়ার জন্য যোগ্যতার পরীক্ষা। বড় হলে তুইও দিবি নিশ্চয়ই!”
“কিন্তু আমার তো ডাক্তার হতে ইচ্ছে নেই।”
“কী হবি?”
“ইঞ্জিনিয়ার।”
“ইঞ্জিনিয়ার হতে গেলেও কিন্তু অনেক পড়তে হয়। লেখাপড়া কী করলি সন্ধেয়?”
“ওই তো স্যর এল, পড়লাম! পড়ার পর কম্পাস দিয়ে দুটো বৃত্ত আঁকা প্র্যাকটিস করলাম। কাল স্কুলে ভূগোল প্রজেক্ট খাতায় কম্পাস দিয়ে সূর্য আর পৃথিবী আঁকতে হবে।”
“কম্পাস দিয়ে বৃত্ত আঁকা শিখে গেছিস তুই!” অবাক হল লাটাই, “আমি তো তোর মতো বয়সে কম্পাস দেখিইনি রে!”
তার পর পিপুলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে লাটাই বলল, “তুই খুব ভাল পিপুল।”
লাটাইদার পাশে শুয়ে রাতে পিপুল একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখল। একটা বড় বৃত্ত। সেই বৃত্তের মধ্যে বসে আছে ও। কিছুতেই বেরোতে পারছে না। এ দিকে গলা শুকিয়ে যাচ্ছে, মাথা ঝিমঝিম করছে। কী ভয়ঙ্কর অবস্থা!
সকালে লাটাইয়ের পাশে বসে বৃত্ত আঁকতে আঁকতে পিপুল বলল, “বৃত্তের একটা দরজা থাকলে বেশ হত, তাই না লাটাইদা!”
লাটাই হেসে পিপুলের মাথার চুল ঘেঁটে দেয়। বলে, “যা বলেছিস!”
ছবি: বৈশালী সরকার