ধারাবাহিক উপন্যাস, পর্ব ১৩

শেষ নাহি যে

মিনুর রিকশায় বসেই সে ব্যাকপ্যাকের সাইড পকেটে মোবাইল ঢুকিয়ে রেখেছিল। তাড়াতাড়ি ব্যাগ থেকে ফোন বার করল বিহান। কে ফোন করেছে? শ্বশুরমশাই? না মা?

Advertisement

ইন্দ্রনীল সান্যাল

শেষ আপডেট: ০৪ নভেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share:

ছবি: শুভম দে সরকার

পূর্বানুবৃত্তি: দরিয়ার কাছে পৌঁছনোর জন্য তড়িঘড়ি চলন্ত ট্রেন ধরার চেষ্টা করে বিহান। মুখ থুবড়ে পড়ে যাওয়ার আগে তাকে তুলে ধরে এক জন। ট্রেনের কামরায় উঠে বিহান বুঝতে পারে, যাত্রীরা সরগরম বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে।

Advertisement

কামরার যাত্রীরা আবার দু’ভাগে ভাগ হয়ে ঝগড়া শুরু করেছে। চিৎকারে কান পাতা দায়। তারই মধ্যে বিহান শুনতে পেল, তার মোবাইল বাজছে।

Advertisement

মিনুর রিকশায় বসেই সে ব্যাকপ্যাকের সাইড পকেটে মোবাইল ঢুকিয়ে রেখেছিল। তাড়াতাড়ি ব্যাগ থেকে ফোন বার করল বিহান। কে ফোন করেছে? শ্বশুরমশাই? না মা?

দু’জনের কেউ নয়। ফোন করেছে সনৎ। মোবাইল কানে দিয়ে বিহান বলল, “বল।”

“কোথায়?” আয়েশি গলায় জিজ্ঞেস করছে সনৎ। তার কথার মধ্যে হাওয়ার শনশন শব্দ শোনা যাচ্ছে।

“ট্রেনে,” উত্তর দিল বিহান, “তুই কোথায়? বাইকে চেপেছিস না কি? এত হাওয়া দিচ্ছে কেন?”

বিহানের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সনৎ পাল্টা প্রশ্ন করল, “ট্রেন এখন কোথায়? লাইনে কোনও গন্ডগোল আছে না কি?”

“এখনও পর্যন্ত সব ঠিক আছে,” সামান্য থেমে বিহান বলল, “তুই কোথায় বললি না তো?”

“সেটা জেনে তোর কী লাভ?” খিঁচিয়ে উঠল সনৎ।

বিহান ম্লান হেসে বলল, “কালকেই বকুলতলা চলে আসব। ডেটা এন্ট্রির পেন্ডিং কাজ সোমবারের মধ্যে তুলে দেব। প্রমিস।”

“আমাকে প্রমিস করে কী লাভ? আমি তোকে চাকরি দিয়েছি না কি?”

“হ্যাঁ। তুই-ই আমায় চাকরি দিয়েছিস। তুই প্লিজ দেখ, চাকরিটা যেন থাকে। না হলে বৌ-বাচ্চা নিয়ে না খেতে পেয়ে মরে যাব!”

বিহানের আকুতি সনতের কানে ঢুকল কি না কে জানে! সে ফোন কেটে দিয়েছে। মোবাইল ফোনটা ব্যাকপ্যাকের সাইড পকেটে ঢুকিয়ে বিহান সুদামের দিকে তাকাল। সুদাম এত ক্ষণ ফোনালাপ শুনছিল। কিন্তু সে বিহানকে একটাও কথা জিজ্ঞেস করল না। বাইরের দিকে তাকিয়ে গুনগুন করে গান গাইতে লাগল।

গানের সুর বিহানের চেনা। রবীন্দ্রসঙ্গীত। লাইনগুলো মনে পড়ছে না। দীনবন্ধু ইন্সটিটিউশনে নবীনবরণ উৎসবের দিন গানটা গাওয়া হয়েছিল। বিহান অল্প সময়ের জন্য অনুষ্ঠানে ছিল। শুরু হওয়ার একটু পরেই সুযোগ বুঝে টুক করে কলেজ কাটে।

হাওড়া গার্লস কলেজটা হাওড়া ময়দান ফ্লাইওভারের নীচে। সোম আর মঙ্গলবার মঙ্গলাহাটের কারণে মানুষ আর মালপত্রে পুরো এলাকাটা নরক হয়ে থাকে। তখন রাস্তা দিয়ে হাঁটা দায়। সপ্তাহের বাকি দিনগুলো অবশ্য পরিষ্কার-পরিছন্ন।

মেয়েদের কলেজ বলেই বোধহয় ডিসিপ্লিন বেশি। দরিয়াদের ইতিমধ্যে ক্লাস শুরু হয়ে গিয়েছে। দরিয়া এমন ভাব করে, যেন একটা ক্লাস কাটলে পরীক্ষায় ফেল করে যাবে! সেই তুলনায় মণিদীপা ডাকাবুকো। সে-ই দরিয়াকে ফুসলে কলেজ থেকে বার করেছে। বিহানের সঙ্গে দু’জনে চলে এসেছে হাওড়া স্টেশনে। ফেরি সার্ভিস ধরতে। হাওড়া থেকে লঞ্চে করে ফেয়ারলি প্লেসে যাওয়া হবে। গঙ্গার ও পারে পৌঁছে, ইচ্ছে হলে এ দিক-ও দিক ঘোরাঘুরি করা হবে। ইচ্ছে না হলে ফিরতি লঞ্চের টিকিট কেটে হাওড়া ফিরে আসা। পরিচিত মুখের সঙ্গে লঞ্চে দেখা হয়ে গেলে মণিদীপা ভরসা। তিনজন কলেজের ছেলেমেয়ে এক সঙ্গে ঘুরতে বেরিয়েছে। কেউ সন্দেহ করবে না।

সেটা ছিল হেমন্তকাল। সকাল সাড়ে এগারোটা বাজে। গঙ্গায় একটু আগে জোয়ার এসেছে। অফিসযাত্রীদের ভিড় নেই। এখন লঞ্চে যাত্রী হাতে গোনা। লঞ্চের ডেকে উঠে দরিয়া বিহানকে জিজ্ঞেস করল, “যারা লঞ্চ চালায়, তাদের কী বলা হয়?”

“পাইলট,” আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে উত্তর দিল বিহান।

“ভ্যাট!” হাসিতে ফেটে পড়েছে মণিদীপা।

“ভ্যাট বললে কেন?” সিরিয়াস মুখে জিজ্ঞেস করল বিহান। “তুমি জানো? কী বলে?”

“যারা গাড়ি চালায় তাদের ড্রাইভার বা শফার বলে। যারা প্লেন চালায় তাদের পাইলট বলে। যারা জাহাজ চালায় তাদের সেলর বলে। যারা সাইকেল চালায় তাদের সাইক্লিস্ট বলে।”

“কুমোরপাড়ার গরুর গাড়ি চালাত বংশীবদন। তাকে কী বলে?” মণিদীপাকে জিজ্ঞেস করল বিহান।

“অত জানি না বাবা! ” বিহান আর দরিয়াকে একা থাকার সুযোগ করে দিয়ে মণিদীপা লঞ্চের সামনের দিকে চলে গেল।

চড়া রোদ উঠেছে। সঙ্গে শুরু হয়েছে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। ছোট ছোট ঢেউ খলবলিয়ে উঠে একে অপরের গায়ে ঢলে পড়ছে। বিহান হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির ফোঁটা মাখতে মাখতে বলল, “এই রকম ওয়েদারে শেয়াল কুকুরের বিয়ে হয়।”

দরিয়া ওড়নায় মুখ লুকিয়ে কুলকুলিয়ে হাসছে। বিহান অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “স্যরি!”

“কী জন্য?”

“ওই কথাটা বললাম বলে।”

“কোন কথাটা?”

“ওই যে! শেয়াল কুকুরের…”

“আমি কিছু মনে করিনি। আমি জানি যে আমাকে খারাপ দেখতে।”

দরিয়ার কথা শুনে বিহান আকাশ থেকে পড়ল। “যাব্বাবা! সে কথা আমি কখন বললাম?”

“তুমি যে কথাটা বলেছিলে সেটা আর এক বার বলো।”

“আরে! ওই কথাটা তুমি সিরিয়াসলি নিলে না কি? ওটা তো প্রবাদ! মানে কথার কথা! সব্বাই বলে তো! এর মাধ্যমে তোমাকে শেয়াল বা কুকুর— কিছুই বলা হচ্ছে না। মানে, ওগুলো কাউকেই বলা হচ্ছে না। এটা জাস্ট…”

বিহান তোতলাচ্ছে। এক কথা বলতে গিয়ে অন্য কথা বলে ফেলছে। একেবারে ল্যাজে গোবরে অবস্থা। এই সময়ে মরার উপরে খাঁড়ার ঘা দেওয়ার কায়দায় দরিয়া বলল, “তুমি তা হলে আমাকে বিয়ে করবে না?”

কিছু না বুঝেই বিহান বলল, “আমি সে কথা কখন বললাম?” পর মুহূর্তে প্রচণ্ড ঘাবড়ে গিয়ে বলল, “এর মধ্যে বিয়ের কথা আসছে কোথা থেকে?”

দরিয়া নীচের ঠোঁট কামড়ে, ভুরু কুঁচকে সিরিয়াস গলায় বলল, “জানতাম।” তার পর লঞ্চ-চালকের কেবিনের পাশ দিয়ে হেঁটে গিয়ে মণিদীপার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। ফেয়ারলি প্লেসের লঞ্চ ঘাট এসে গিয়েছে।

লঞ্চ থেকে নেমে দুই বান্ধবী পাশাপাশি হাঁটছে। বিহান একটু পিছনে। স্ট্র্যান্ড রোডে পড়ে মিলেনিয়াম পার্কের দিকে হাঁটা লাগাল দু’জনে। বিহান কী আর করে! রাস্তার কোণে বসে থাকা বুড়ির কাছ থেকে একটা সিগারেট কিনে আয়েশ করে ধরাল। বিড়ি সিগারেট খাওয়ার অভ্যেস তার নেই। সনতের সঙ্গে থাকলে দু’একটা খেতেই হয়। এখন খাচ্ছে রাগ করে।

মণিদীপা হঠাৎ বান্ধবীকে ছেড়ে পিছিয়ে এল। বিহানকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি দরিয়াকে কী বলেছ? ও তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছে না কেন?”

“আমি জানি না বস!” হাত তুলে দিয়েছে বিহান, “তোমরা, মেয়েরা, খুব জটিল জিনিস। তোমাদের বোঝার জন্য সরকারের তরফ থেকে টোল ফ্রি নম্বর রাখা উচিত। ওয়ান এইট জিরো জিরো...” মোবাইল হাতে নিয়ে ফোন করার অভিনয় করে বিহান, “হ্যালো? স্যর? আমার বান্ধবী মুখ গোঁজ করে আছে। কী করব?”

“দুই টিপুন,” বলল মণিদীপা।

“কী বললে?” বিহানের চোখ ছানাবড়া হয়ে গিয়েছে।

মণিদীপা বিহানের দিকে নিষ্পাপ দৃষ্টি বিছিয়ে বলল, “হিন্দিকে লিয়ে এক দাবাইয়ে, বাংলায় কথা বলার জন্য দুই টিপুন, ফর ইংলিশ ডায়াল থ্রি।”

“ও আচ্ছা!” হুশ-হুশ করে সিগারেটে টান দিচ্ছে বিহান।

“কেন? তুমি কী ভাবলে?” জানতে চাইছে মণিদীপা।

“কিছু না। কিছু না। নাথিং।”

“টোল ফ্রি নাম্বার ছাড়া সরকার বাহাদুর অন্য কোনও ভাবে তোমাদের সাহায্য করতে পারে?”

“খবরের কাগজ আর টিভিতে বিজ্ঞাপন দেওয়া, সিনেমা শুরু হওয়ার আগে নিউজ়রিল দেখানো, স্কুল আর কলেজে সাবজেক্ট হিসেবে ‘মেয়েলজি’ ইনক্লুড করা, অনেক কিছু আছে। মিনিস্ট্রি অব আন্ডারস্ট্যান্ডিং উইমেন খোলাটাও খুব জরুরি।”

বিহান আর মণিদীপা কথা বলতে বলতে হাঁটছে। সামনে দরিয়া। হঠাৎ সে পিছন ফিরে একগাল হেসে মণিদীপাকে বলল, “হ্যাঁ ভাই বকুলফুল! সেইটা কখন হবে মনে আছে?” দুই বান্ধবী যখন নিজেদের মধ্যে কথা বলে তখন পুরনো দিনের বাংলা সিনেমায় মেয়েরা যে ভাবে কথা বলত, সেই ভাবে বলে।

মণিদীপা স্মার্টলি বলল, “তা আবার মনে নেই কো! সেই আঁটকুড়োর বেটা তো গালে হাত দিয়ে বসে রয়েচে!”

“হায় ভকোপান! থালে কী করা উচিত? বল না লো সই!”

“ফিরে চল, বকুলফুল! ফিরে চল! বেশি ক্ষণ অপেক্ষা করালে সে যদি বিরক্ত হয়?”

দরিয়া এ বার বিহানের দিকে তাকিয়ে একগাল হেসে বলল, “চলো গো প্রাণনাথ! আমরা এ বার ফিরে যাই।”

“আমরা মানে কারা?” কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করেছে বিহান। “আজকে ঘুরতে আসার কথা ছিল তোমার আর আমার। তোমার বন্ধু কেন এসেছে?”

“আমার কোনও দোষ নেই রাজাধিরাজ!” দু’হাত জোড় করেছে মণিদীপা, “বকুলফুল ডেকেচিল বলে এয়েচি। আমার ভুল হয়ে গেচে। আমি এই ঘাট মানলুম,” স্ট্র্যান্ড রোড দিয়ে শিবপুর ট্রামডিপোগামী মিনিবাস যাচ্ছে। সেটায় চড়ে উধাও হয়ে গেল মণিদীপা।

সে দিকে না তাকিয়ে রাস্তার কোণে বসে থাকা বুড়ির কাছ থেকে আর একটা সিগারেট কিনে ধরাল বিহান। দরিয়া বলল, “এ বার কী হবে?”

“কার কী হবে? তোমার বান্ধবীর কথা বলছ?” সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বিহান বলল, “মণিদীপা হল গিয়ে আইএসআই ছাপযুক্ত, আগমার্কা চালু মাল। ওর কোনও বিপদ হবে না। আমার বরং মিনিবাসের প্যাসেঞ্জারদের জন্য চিন্তা হচ্ছে।”

“মণিদীপাকে নিয়ে তুমি আজেবাজে কথা বলবে না। ও আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। আর তুমি সিগারেটটা হাত থেকে ফেলে দাও। ও সব খেলে ক্যানসার হয়।”

“পয়সা দিয়ে কিনলাম। একটু ধোঁয়া খেয়ে নিই।” মুচকি হাসল বিহান।

সে দিন দু’জনে হাঁটতে হাঁটতে স্ট্র্যান্ড রোড পেরিয়ে কত জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছিল, তার হিসেব নেই। প্রথম বার কলেজ কাটা, প্রথম বার বন্ধুর সঙ্গে কলকাতার রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো, প্রথম বার কলকাতার রাস্তা থেকে নানা রকমের খাবার খাওয়া— দিনটা ভোলার নয়। সন্ধে নেমে আসার মুখে দু’জনে মিলে দাঁড়িয়েছিল বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটের একটা চায়ের দোকানের সামনে। দুটো স্পেশাল চা অর্ডার করে বিহান বলল, “বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে যাবে। বাবা-মাকে কী বলবে?”

“আমার কোনও চাপ নেই। সত্যি কথাই বলে দেব। তুমি কী বলবে?”

“কী বলব?” ভাঁড়ে চুমুক দিয়ে বিহান বলল, “সত্যি কথা মাকে বলতে আমারও কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু সত্যি কথাটা কী, সেটাই তো আমি জানি না।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement