ছবি: শুভম দে সরকার
পূর্বানুবৃত্তি: দরিয়ার অ্যাম্বুল্যান্সের ড্রাইভার রাজুকে মারধর করে গণতান্ত্রিক মোর্চার ছেলেরা। শেষ পর্যন্ত সাম্যব্রতর জন্যই মরে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচে রাজু। ও দিকে বকুলতলা বাসস্ট্যান্ডে এসে বিহান দেখে কোনও বাস নেই। প্রাইভেট গাড়ির ভরসায় এগোয় সে।
খবরকাগজ যেন সতী সাবিত্রী!” খিঁচিয়ে ওঠে বয়স্ক চালক, “আর টিভিতেও তো বাস জ্বালানোটা দেখাচ্চে। চোকে ন্যাবা হয়েচে না কি?”
“তা হলে ওইটুকুই বলো। ফালতু গুজব রটিও না। এই হোয়াটসঅ্যাপটা হয়েছে যত নষ্টের গোড়া,” কথা থামিয়ে টিভি দেখতে থাকে কমবয়সি চালক।
দুই চালকের ঝগড়ার মধ্য থেকে সরে আসে বিহান। যা বোঝার বোঝা হয়ে গিয়েছে। আজ আর প্রাইভেট গাড়ি পাওয়া যাবে না। তা হলে ট্রেকার! ওটায় চড়ে যতটা সম্ভব যাওয়া যাক। যেখানে নামিয়ে দেবে সেখান থেকে অন্য ট্রেকার ধরা যাবে। বিহান বুঝতে পারছে তার লিলুয়া ফেরাটা ক্রমশ অসম্ভবের পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। কিন্তু চেষ্টা তাকে করতেই হবে। বকুলতলা বাসস্ট্যান্ডে অন্য দিন গাদা গাদা ট্রেকার দাঁড়িয়ে থাকে। আজ একটাও নেই। বিহান এ দিক-ও দিক তাকিয়ে দেখছে, এমন সময়ে বিকট চিৎকার করে এক মহিলা বলল, “ও বাবু! তুমি কোথায় যাবে?”
ঘাড় ঘুরিয়ে বিহান দেখল, মিনুদি।
মিনু মিস্ত্রিকে বকুলতলার সব্বাই চেনে। কারণ সে বকুলতলার একমাত্র মহিলা রিকশাওয়ালা! উচ্চতা পাঁচ ফুটের এক সুতো বেশি নয়। বেশ মোটা। গাছকোমর করে শাড়ি পরে যখন সাঁইসাঁই করে রিকশা চালায়, তখন সবাই ঘুরে দেখে আর ফ্যাকফ্যাক করে হাসে। মিনুর নাম হয়ে গিয়েছে ‘রসগোল্লা রিসকাউলি।’ মাস ছয়েক আগে পোর্টের অফিস থেকে বিহান সবে বেরিয়েছে, এমন সময়ে মিনু তাকে ধরেছিল। “এই যে ভালমানুষের পো! আমার একটা উব্গার করে দাও দিকি!”
“কী উপকার?” জিজ্ঞাসা করেছিল ব্যস্ত বিহান।
“আঁধার কার্ডে আমার বরের ঠিকানা ভুল আছে। কোনও সরকারি সুযোগ-সুবিধে পাচ্ছে না। তুমি ঠিক করে দেবে?”
বিহান বলেছিল, “এই সবের জন্য আলাদা দফতর আছে। সেখানে যাও।”
“থাক! আমাকে জ্ঞান দিতে এস না। আঁধারের আপিসে গিয়ে গিয়ে পায়ে কড়া পড়ে গেল। আমাদের পাড়ার এক জন বলল, তুমি কম্পিউটার নিয়ে কাজ করো। তাই বললুম। করে দাও না গো!”
কম্পিউটার নিয়ে কাজ করলে যদি পৃথিবীর সব সমস্যার সমাধান করা যেত, তা হলে কী ভালই না হত। কিন্তু সেটা তো হওয়ার নয়। বাধ্য হয়ে মিনু আর সুদামকে মেসে ডেকেছিল বিহান। সমস্ত কাগপজপত্র উল্টেপাল্টে দেখে বুঝেছিল, কাজটা শক্ত কিছু নয়। নিজে না পারলেও করিয়ে দেওয়া যাবে। আধার সহায়তা কেন্দ্রের ছেলেগুলো
তার চেনা।
দিন পনেরো সময় লাগলেও কাজটা করে দিয়েছিল বিহান। সংশোধিত আধার কার্ড পাওয়ার পরে মিনু আর সুদামের সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি বিহানের। ভুলেই গিয়েছিল ওদের কথা। আজ মিনুর চিৎকার শুনে বুকে বল পেল। যাক! এক জন অন্তত বিপদের দিনে দাঁত খিঁচিয়ে কথা বলল না।
বিহান মিনুর রিকশার কাছে গিয়ে বলল, “খুব বিপদে পড়েছি মিনুদি।”
“কী হয়েছে?” কুটকুট করে সুপুরি চিবিয়ে জিজ্ঞেস করল মিনু। সে পরে রয়েছে ময়লাটে হলদে রঙের শাড়ি আর লাল ব্লাউজ়। পায়ে হাওয়াই চপ্পল।
“আমার বৌয়ের বাচ্চা হবে। ব্যথা উঠেছে। ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এ দিকে গন্ডগোলের জন্যে আমি বাড়ি ফিরতে পারছি না।”
“মা ষষ্ঠীর কৃপা কবে কার উপরে পড়বে, কেউ বলতে পারে না,” ঘাড় নাড়ছে মিনু, “তোমার বাড়ি কোথায়?”
“হাওড়া স্টেশনের কাছে,” ইচ্ছে করেই লিলুয়া না বলে হাওড়া স্টেশনের নাম করল বিহান। মিনু লিলুয়ার নাম না-ও জানতে পারে।
বিহানের উত্তর শুনে মিনু অবাক হয়ে বলল, “তুমি বাসের জন্য দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করছ কেন? ট্রেনে চলে যাও!”
“এখন ট্রেন আছে?” বোকার মতো জিজ্ঞেস করল বিহান। “এখানকার ট্রেনের সময় সম্পর্কে আমার কোনও ধারণা নেই।”
“হাওড়া এস্টেশনে যাওয়ার ট্রেন বকুলতলা স্টেশনে আসে সাড়ে বারোটার সময়। এখন সওয়া বারোটা বাজে। তুমি আমার রিসকায় উঠে পড়ো।”
“না,” ঘাড় নাড়ে বিহান।
চোয়াল শক্ত করে মিনু বলল, “বকুলতলা এস্টেশন এখান থেকে তিন কিলোমিটার। দৌড়ে চলে যাও।”
বিহান দৌড় দিল। সে বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে পঁয়তাল্লিশ মিনিট সময় নষ্ট করেছে। সে একটা গাধা। অন্য যে কেউ হলে একে-তাকে জিজ্ঞেস করে ট্রেনের সময় জেনে রাখত। সে পনেরো মিনিটে তিন কিলোমিটার দৌড়তে পারবে তো? পাঁচ মিনিটে এক কিলোমিটার! বাপ রে! স্কুলে পড়ার সময়ে ফুটবল খেলত বিহান। তার পরে শরীরচর্চার সঙ্গে সম্পর্ক শেষ। এর মধ্যেই হাঁপ ধরছে। বাবা গো!
রিকশার হর্নের প্যাঁকপ্যাঁকানি শুনে মুখ ঘোরাল বিহান। রিকশার প্যাডেল চালিয়ে দ্রুত এগিয়ে আসছে মিনু। মুহূর্তের মধ্যে পাশে এসে বলল, “দৌড়লে যতক্ষণে পৌঁছবে, রিকশায় তার আগে। বুঝেছ ভালমানুষের পো? নাও। এ বার উঠে পড়ো।”
আজ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা হারিয়েছে বিহান। সে রিকশায় উঠে বসল। মোবাইল রেখে দিল ব্যাকপ্যাকের সাইড পকেটে। দৌড়োদৌড়ির সময়ে মোবাইল রাস্তায় পড়ে গেলে খুব ঝামেলায় পড়বে বিহান। মিনু সাঁইসাঁই করে রিকশা চালাচ্ছে আর বলছে, “মেয়েমানুষের ঘাড়ে চাপবে না। সে খুব ভাল কথা। আমাকে অনেক সওয়ারি এই কতা বলে। কিন্তু তোমরা ঘাড়ে না চাপলে আমার সোমসার কী করে চলবে বলতে পারো?”
বিহান উত্তর দিল না। রিকশায় বসে মনে হচ্ছে সবাই তাকে ঘুরে দেখছে। অস্বস্তি কাটাতে জিজ্ঞেস করল, “সুদামদা কী করে?”
“গান গায়,” প্যাডেল মারছে মিনু।
“কী গান?”
“তোমার সঙ্গে যখন দেখা করেছিল, তখন বুঝতে পারোনি যে ও এক চোখে দেখতে পায় না?”
লজ্জায় জিভ কাটল বিহান। এটা সে খেয়াল করেনি।
“বিয়ের আগে ও পাড়ার ফাংসানে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইত। গান শুনেই তো পিরিত হল। তার পরে ওর চোখে কী একটা বাজে রোগ হল। সেই থেকে এক চোখে দেখতে পায় না। তবে গানটা ছাড়েনি। ট্রেনে গান গেয়ে ভালই রোজগার করে।”
“অন্ধ কানাই পথের ধারে গান শুনিয়ে ভিক্ষে করে।” রবিঠাকুর মনে পড়ে গেল বিহানের। সুদাম মিস্ত্রি ট্রেনে গান গেয়ে ভিক্ষা করে সংসার চালায়।
মিনু বকবক করেই যাচ্ছে। “ও রোজ পোর্ট এস্টেশন থেকে ট্রেনে উঠে গান গাইতে গাইতে হাওড়া এস্টেশন চলে যায়। আবার ওই ট্রেনেই ফেরত আসে। পোর্টের পরের এস্টেশনই তো বকুলতলা।”
“ওই টাকায় সংসার চলে?” জিজ্ঞেস করল বিহান। ‘ভিক্ষে’ শব্দটা ব্যবহার করতে পারল না সে।
“আমি আছি কী করতে?” ফুঁসে ওঠে মিনু, “রসগোল্লা রিসকাউলি বলো আর যাই বলো, সারা দিনে পনেরো-কুড়িটা টিরিপ হয়েই যায়। দিনের শেষে তিনশো টাকা নিয়ে ঘরে ঢুকি। ও-ও নিয়ে আসে শ’দুয়েক টাকা। পনেরো হাজার টাকায় আরামসে সোমসার চলে যায়।”
বিহান চুপ। রিকশা চালিয়ে আর ভিক্ষে করে স্বামী-স্ত্রী তার সমান রোজগার করে।
মিনু বলল, “আমি রিসকা চালাই বলে সবাই খুব আওয়াজ দেয়। বেশি আওয়াজ দেয় ব্যাটাছেলে রিসকাওলারা। আমি ওদের ভাত মারছি কি না! তাই অত রাগ। আমি পাত্তা দিই না। ওদের বলি, একচোখো ভাতারকে যখন সহ্য করি, তখন তোদের একচোখোমিও সহ্য করে নেব।”
“বাবা! তোমাদের খুব প্রেম তো!” হাসছে বিহান।
“প্রেম কি শুদু তোমরাই করবে, ভালমানুষের পো? রসগোল্লা রিসকাউলি আর কানা গাইয়ে গরিব বলে পিরিত করবে না?”
“না না! আমি তা বলিনি,” লজ্জা পেয়েছে বিহান। তার মনে পড়ে যাচ্ছে অনেক বছর আগের কথা। স্কুলজীবনের এক সরস্বতীপুজোর কথা। যে দিন সে দরিয়াকে প্রথম দেখেছিল।
****
“কাল তপন স্যরের বাড়িতে সরস্বতীপুজো আছে। যাবি তো?’’ বঙ্গবাসী সিনেমা হলের ফ্রন্ট রোয়ে বসে ‘মন মানে না’ দেখতে দেখতে জিজ্ঞেস করল সনৎ। সে আর বিহান স্কুল কেটে সিনেমা দেখতে এসেছে।
ক্লাস ইলেভেনে পড়ার সময় থেকে স্কুল পালিয়ে সিনেমা দেখার শুরু। বিহানের মা শ্রীরূপা এখনও জানতে পারেননি। সনতের বাবা-মা সবই জানেন। কিন্তু তাঁরা ছেলেকে সামলাতে পারেন না। সনৎ বিড়ি-সিগারেট, পানমশলা-গুটখা, মদ-গাঁজা পর্যন্ত চেখে ফেলেছে বলে দাবি করে। দুই বন্ধু হরিহর আত্মা হলেও নেশার ব্যাপারে বিহান সনৎকে সঙ্গ দেয় না। দু’এক বার সিগারেট টেনে দেখেছে। ভাল লাগেনি।
একটা নেশা দু’জনেরই হয়েছে। স্কুল পালিয়ে সিনেমা দেখার নেশা। এই সিনেমাটা রিলিজ় করেছে গত বছরের শেষের দিকে। নতুন বছরেও রমরমিয়ে চলছে। নেহাত ব্ল্যাকারদের সঙ্গে সনতের চেনাশোনা আছে, তাই আজ টিকিট পাওয়া গেল।
তপন স্যর এই এলাকার সবচেয়ে জনপ্রিয় মাস্টারমশাই। ওঁর কাছে ইংলিশ পড়লে সব প্রশ্ন কমন আসে। দুই বন্ধুই ইংলিশে কাঁচা। বাধ্য হয়ে তপনার টোলে নাম লিখিয়েছে।
‘তপনার টোল’ নামটা ছাত্রদের দেওয়া। হাওড়া ময়দান চত্বরের সব ছেলেমেয়ে ওঁর কাছে ইংরেজি পড়তে আসে। বাড়ির বাইরে যত চটি থাকে, তত চটি সেলের সময়ে জুতোর দোকানের স্টকেও থাকে না। আর সাইকেলের কথা না বলাই ভাল। বিশু নামের এক ছোকরা তপনার টোলের পাশে সাইকেল স্ট্যান্ড বানিয়ে ভালই কামাচ্ছে।
সরস্বতী ঠাকুরের প্রতি সনতের ভক্তি কতটা, বিহানের জানা আছে। তার কাছে সরস্বতীপুজো মানে পাড়ার প্যান্ডেলে দাদাগিরি করা, ড্যাবড্যাব করে মেয়ে দেখা আর সন্ধে থেকে প্যান্ডেলের পিছনে লুকিয়ে মদ খাওয়া। তার হঠাৎ তপনার টোলের পুজোয় যাওয়ার ইচ্ছে হল কেন?
সিনেমা দেখে বেরিয়ে প্রশ্নটা করেই ফেলল বিহান। “তুই পাড়ার পুজো ছেড়ে তপনার টোলের পুজোতে! ডাল মে কুছ কালা হ্যায়।”
সনৎ ঘোঁত করে একটা আওয়াজ করল। তার মানে ‘হ্যাঁ’, ‘না’, ‘তোর বাবার কী?’ যা খুশি হতে পারে। বিহান বলল, “ঠিক আছে। কাল তপনার টোলেই অঞ্জলি দেব। কিছু না খেয়ে থাকবি কিন্তু!”
পরদিন সকাল আটটার সময়ে তপনার টোলে গিয়ে বিহানের মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়। সপ্তাহের সাত দিন ধরে যতগুলো ব্যাচ এখানে টিউশনি নেয়, তার সব ছাত্রছাত্রী আজ মা সরস্বতীকে অয়েলিং করতে এসেছে। শাহরুখ খানের হাউসফুল সিনেমা চলার সময়ে হলের বাইরেও এত পাবলিক থাকে না। এর মধ্যে অঞ্জলি দেওয়া সম্ভব?
বিহান কেটে পড়ার ধান্দা করছিল। হঠাৎ শুনল তপনা হ্যান্ড মাইকে ঘোষণা করছে, “যারা অঞ্জলি দিবি তারা সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে থাক। দরিয়া আর মণিদীপা তোদের কাছে ফুল নিয়ে যাচ্ছে। কেউ যদি শয়তানি করিস, তা হলে তাকে কাল থেকে আর পড়াব না।”
মোক্ষম শাসানি! সব্বাই চুপ করে গেল। তারই মধ্যে দুটো মেয়ে ঘুরে ঘুরে সবার হাতে ফুল দিচ্ছে। দু’জনেরই পরনে বাসন্তী রঙের শাড়ি। মাথার চুল খোলা।
ক্লাস এইট থেকে বিহান বড় হতে শুরু করেছে। গোঁফদাড়ি গজাচ্ছে, বুকে লোমের পাপোশ, গলার স্বর ভেঙে ব্যাঙের মতো হয়ে গিয়েছিল। এখন বড়দের মতো। পায়ে লোম গজানোর পরে ফুলপ্যান্ট ছাড়া পরে না। স্নান করার সময়ে বাথরুমে ঢুকে অসভ্য কাজ করে। তার পরে লজ্জা আর অপরাধবোধে তিন-চার দিন ওই সব কথা ভাবে না। এই ভাবেই সবাই বড় হয়। বিহান ভেবেছিল, আঠেরো বছর বয়স হয়ে গেল। সামনের নির্বাচনে ভোট দেবে। কয়েক মাস পরে কলেজে ভর্তি হবে। তা হলে সে এখন অ্যাডাল্ট। বড়দের ব্যাপার-স্যাপারগুলো বোঝে।