ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য
ডক্টর গ্যাবির আশ্বাস সত্ত্বেও অর্ণব চিন্তিত হয়ে উঠেছিল। হাতে একটা সামান্য ব্যথার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে? কত দিনের জন্য? ব্যবসা সংক্রান্ত অনেক কাজ জমে আছে। কতকগুলো কাজ এখনই না করলে নয়। কিন্তু কোনও আপত্তিই শোনেননি ডক্টর গ্যাবি। ভর্তি হতেই হয়েছে অর্ণবকে। এ দেশে সরকারি ব্যবস্থাপনা খুব ভাল। কিন্তু এনএইচএস বা ন্যাশনাল হেল্থ সার্ভিস-এর সমস্যা একটাই। সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার মূল মন্ত্র, রোগীর কতটা জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসা দরকার, সেটা রোগের গুরুত্ব অনুযায়ী নির্ণয় করা হয়। রোগীর আর্থিক স্বচ্ছলতার উপর সরকারি চিকিৎসা নির্ভর করে না। অর্ণবের একটা প্রাইভেট ইনশিয়োরেন্সও করা ছিল। চিকিৎসার মান একই, শুধু সরকারি হাসপাতালের মতো দীর্ঘ অপেক্ষার ব্যাপার নেই। ডক্টর গ্যাবি এই অপারেশনটা বেসরকারি ব্যবস্থাতেই করিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দিলেন। তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে।
যে শল্য-চিকিৎসকের নাম সুপারিশ করেছিলেন ডক্টর গ্যাবি, তিনিই এখন অর্ণবের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। অসামান্য হাত ভদ্রলোকের। নিখুঁত দক্ষতায় কাল অর্ণবের বাঁ হাতে অস্ত্রোপচার করেছেন। অপারেশন টেবিলে ঠিক কী হয়েছে, অর্ণব জানে না। অ্যানাস্থেটিস্ট ডক্টর বাসুদেবন তার সঙ্গে সাধারণ আলাপচারিতা চালাতে চালাতে অভ্যস্ত দক্ষতায় তাকে অজ্ঞান করে দিয়েছিলেন। ঠিক সময় জ্ঞান ফিরিয়েও এনেছিলেন। জেগে উঠে সামান্য বেদনাও বোধ করেনি সে।
‘গুড মর্নিং ডক্টর। বাট আই ওয়াজ নট এক্সপেক্টিং ইউ দিস আর্লি। এত সকালে তো আপনার দেখা পাব আশা করিনি।’
‘না, আপনার সঙ্গে একটা জরুরি আলোচনা আছে, সেটা সেরে ফেলতে চাই। তার আগে বলুন, আজ কেমন আছেন?’
‘আমার তো কোনও শারীরিক অসুবিধা হচ্ছে না। ভালই তো আছি। কিন্তু ঠিক কী পেলেন বলুন তো অপারেশন করে?’ ডাক্তারের কথায় একটু অবাক হলেও, সেটা প্রকাশ করল না অর্ণব।
‘কী পেলাম, সেটা বলতেই সাতসকালে আপনার কাছে আসা,’ ডক্টর ফিলিপসের কণ্ঠস্বরে আশ্বস্ত হল অর্ণব। কিন্তু ডাক্তারের পরের প্রশ্নটাই তাকে আবারও কৌতূহলী করে তুলল।
‘আচ্ছা, মিস্টার মুখার্জি, আপনি হাতে যে ব্যথাটা নিয়ে এসেছিলেন, সেই আঘাতটা পেলেন কী করে বলুন তো? কোথায় পেলেন চোট?’
‘আরে সেটাই তো ঠিক বুঝতে পারছি না। ভারতে গিয়েছিলাম, বুঝলেন! বেশ কয়েকটা জায়গা ঘুরেছি। কিন্তু কোথায় কী ভাবে চোট পেয়েছি, কিছুতেই মনে করতে পারছি না।’
‘কিছুই মনে নেই?’
‘না, মানে, এই আঘাতটা কোথায় লাগল সেটা ঠিক বুঝতে পারিনি বোধহয়। খেয়াল করিনি হয়তো। কেন বলুন তো?’
এ বার অর্ণব যারপরনাই অবাক। কিন্তু বিস্ময়ের এখানেই শেষ নয়। ডক্টর ফিলিপসের পরের কথাটায় সে নড়েচড়ে বসল।
‘বলব তো নিশ্চয়ই। সেই কারণেই তো আসা। কিন্তু আমি একা বলব না। আপনার সঙ্গে আরও এক জন দেখা করতে চান। ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর ব্রুস ব্লুমিং। বাইরে অপেক্ষা করছেন। ডাকি ভিতরে?’
‘মানে পুলিশ?’ অর্ণব হতভম্ব!
‘হ্যাঁ, মিস্টার মুখার্জি। আই অ্যাম রিয়েলি সরি। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী আমাকে পুলিশকে জানাতে হয়েছে আপনার অপারেশনের কথা। কেন জানাতে হয়েছে, সেটা ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর ব্লুমিং এলেই বুঝতে পারবেন।’
‘গুড মর্নিং,’ বলতে বলতে এ বার যিনি ঢুকলেন, তাঁকে দেখে পুলিশ বলে মনে হয় না। অন্তত প্রথম দর্শনে। বেশ লম্বা ভদ্রলোক, কিন্তু মোটাসোটা গোলগাল চেহারা। পরেছেন সাধারণ কালো স্যুট, লাল টাই। সপ্তাহের যে কোনও কর্মদিবসের সকালে লন্ডনবাসীর অতি পরিচিত পোশাক। কিন্তু মানুষটির চলাফেরা, হাবভাব একটু মন দিয়ে লক্ষ করলেই বোঝা যায়, এঁর শারীরিক এবং মানসিক তৎপরতার কোনও অভাব নেই!
নিজের পরিচয় দিলেন ভদ্রলোক। প্রথাগত পশ্চিমি ভদ্রতায় ধন্যবাদ জানালেন অর্ণবকে, এত সকালে দেখা করতে রাজি হওয়ার জন্য।
‘কিন্তু আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না!’ অর্ণব বেশ উদ্বিগ্ন।
এ বারে কথা বললেন ডক্টর ফিলিপস। ‘মিস্টার মুখার্জি, আপনি খুব বেঁচে গেছেন। মানুষের হাতের কনুই থেকে কবজির মধ্যের অংশটাতে দুটো বড় হাড় থাকে— রেডিয়াস আর আলনা। আপনার বাঁ হাতের আলনার কাছ থেকে আমরা একটা বুলেট বার করেছি। হাড় অবধি যায়নি গুলিটা। চামড়ার ঠিক তলাতেই আটকে ছিল। তাই খুব বেশি ক্ষতি হয়নি আপনার।’
গুলিটা তার হাতের চামড়া ভেদ করে ঢুকেছিল ঠিকই, কিন্তু বেশি ভিতরে যেতে পারেনি! সেই জন্যই কি কলকাতা এয়ারপোর্টে বারে বারে মেটাল ডিটেক্টরে অ্যালার্ম বেজে উঠছিল?
‘বুলেট?’ হতবাক অর্ণব শুধু একটা শব্দই উচ্চারণ করতে পারল। তার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে উজ্জ্বল মধ্যদিবস, দূরপাল্লার ট্রেন মাঝপথে দাঁড়িয়ে আছে, মৃত্যুর অদ্ভুত সান্নিধ্য, এক জন মানুষের দুটি চোখ কেঁপে উঠে স্থির হয়ে গেল।
‘বুলেট শুধু নয়। একটা বিশেষ ধরনের বন্দুক থেকে আসা বুলেট,’ বলে উঠলেন ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর ব্লুমিং। ‘স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন এআর ১৫ সেমি অটোম্যাটিক। এ বন্দুক যার তার হাতে থাকার কথা নয়। সাধারণ পুলিশবাহিনী এই বন্দুক ব্যবহার করে না। অন্তত ব্রিটেনে। সাধারণ অপরাধীরাও না। তাই আমরা একটু অবাক হচ্ছি। আপনার দেহে এ জিনিস ঢুকল আর আপনি টের পেলেন না!’
‘বুকে বা পেটে ঢুকলে তো আপনাকে বাঁচানো মুশকিল হত।’ ডক্টর ফিলিপসের গলায় কোনও উত্তেজনা নেই, কিন্তু স্পষ্ট বিস্ময়। ‘আপনার আঘাতটা এতই কম যে আমার বদ্ধমূল ধারণা, গুলিটা কোনও দেওয়াল বা ওই রকম কোথাও রিবাউন্ড করে আপনার দেহে ঢুকেছিল। না হলে আঘাত আরও অনেক বেশি হত।’
‘আপনি গত কয়েক দিনে এ রকম কোথাও গিয়ে পড়েছিলেন কি, যেখানে এই রকম একটা বন্দুকের সামনে পড়ার কোনও সম্ভাবনা ছিল?’
ব্লুমিংয়ের প্রশ্ন শুনে তার দিকে তাকাল অর্ণব। ‘কী বন্দুক বললেন?’
‘স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন এআর ১৫।’
সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক ভাবে অর্ণবের মনে হল, জিনিসটা দেখতে কেমন? ও রকম কোনও বন্দুক তো দেখেইনি সে!
৮
অনিন্দ্য নরকে
‘ও জিনিস তো কখনও চোখেই দেখিনি মশাই! এখানে কোত্থেকে আসবে ও জিনিস? স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন এআর ১৫? আপনি শিয়োর?’
‘হ্যাঁ, আমরা শিয়োর। এটা খুব বিশেষ এক ধরনের বুলেট। এ তো আপনাদের ওখানে পাওয়া যাওয়ার কথা না! ব্যাপারটা বোধহয় এএসপি অবধি গড়িয়েছে, বুঝলেন?’
ব্যালিস্টিক্সের এই ইন্সপেক্টর ভদ্রলোকের নাম মনে করার চেষ্টা করছেন অলকেশ। মজুমদার... সিতাংশু মজুমদার বোধহয়, বলেছিলেন ভদ্রলোক।
দুপুরে সবে সাধুর দোকানের ছেলেটা এসে থালাবাটি সাজিয়ে পরোটা আর কষা মাংস দিয়ে গেছে তাঁর টেবিলে। তখনই ফোনটা বেজে ওঠে।
পূর্বা এক্সপ্রেসে যে লোকটির মৃত্যু ঘটে, তার দেহ স্থানীয় হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল, নিয়ম মেনেই। সেখানে ময়নাতদন্তের সময় দেখা যায়, একটি গুলির আঘাতেই মানুষটির মৃত্যু ঘটেছে। সেটা অবশ্য মৃতদেহ দেখে প্রথমেই আঁচ করেছিলেন অলকেশ। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট কয়েক দিন আগেই এসে গিয়েছে। তাতে অলকেশের সন্দেহই সত্য প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু তার পরের ব্যাপারটার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না তিনি। যে বুলেটটা নিখুঁত ভাবে লোকটির হৃদ্যন্ত্র এঁফোড়-ওফোঁড় করে রিব কেজের একটা হাড়ের মধ্যে আটকে ছিল, সেটিকে কলকাতায় পাঠানো হয় ব্যালিস্টিক অ্যানালিসিসের জন্য। এটাও নিয়ম অনুযায়ীই ঘটেছে।
সেখান থেকেই ফোন করেছেন ভদ্রলোক। ব্যাপারটা উপরমহলে গড়ানো মানে বিস্তর ঝামেলা। ব্যালিস্টিক্সের কাজ হয় যেখানে, সেই বিভাগটি সিআইডি’র আওতায় পড়ে! ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট। এখন ব্যাপারটা কত দূর গড়াবে কে জানে! ভারত সরকারের অন্য যে কোনও দফতরের মতো, পুলিশেরও একটি আমলাতন্ত্র রয়েছে। আর তার নিয়মই হল, নিয়ম বহির্ভূত কিছু, বা সামান্য সন্দেহজনক কিছু দেখলেই ‘রেফার আপ’— উপরমহলে জানিয়ে নিজের দায়িত্ব মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা করা। সিআইডি’র অ্যাডিশনাল সুপার অবধি গিয়েছে ঘটনাটা। তার মানে এ বার হুড়ো আসা বিচিত্র নয়। আরও উপরে যদি গড়ায় তা হলে তো কথাই নেই!
‘আচ্ছা সিতাংশুবাবু, ব্যাপারটা কী বলুন তো? মারা তো গেছে একটা হিজড়ে! এটা নিয়ে এএসপি সাহেবকে বিরক্ত করা কি ঠিক?”
‘আরে হিজড়ে মারা গেছে, সেটা কিছু না। কিন্তু এই ধরনের বুলেট আপনাদের ওখানে কী করে এল? এটাই সকলকে ভাবাচ্ছে। এই ধরনের অত্যাধুনিক এবং অসম্ভব শক্তিশালী অস্ত্র পশ্চিমবঙ্গে আসছে কী করে? আর বিরাট ভয় যেটা তা হল, এ রকম ক’টা বন্দুক ঢুকেছে রাজ্যে? এ সব অস্ত্র ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলে...’
‘ছড়িয়ে পড়বে কেন? এই বন্দুকের যা দাম হবে তা দিয়ে কেনার মতো ক’টা গ্যাং এ তল্লাটে আছে বলুন তো?’
‘এ বিষয়ে আপনি নিশ্চিত? তা ছাড়া আরও একটা প্রশ্ন, আপনাদের তল্লাটেই থাকতে হবে তার কী মানে আছে?’
‘তার মানে এ বার উপরমহলের ফতোয়া আসবে, এই বলছেন তো? তা কী করতে হবে আমাদের?’ কণ্ঠস্বরে শ্লেষটুকু আর গোপন রাখতে পারলেন না অলকেশ।
‘আমাকে জিজ্ঞেস করছেন কেন? আমি তো চুনোপুঁটি! এএসপি সাহেব ফোনে কাউকে একটা বলছিলেন। আমি আপনার শুভানুধ্যায়ী হিসেবেই আপনাকে জানিয়ে রাখলাম।’
এই শুভানুধ্যায়ী সম্প্রদায়কে বেশ ভয় পাই আমি, জানেন তো? কথাটা প্রায় ঠোঁটের ডগায় চলে এসেছিল অলকেশের। বললেন না। শুধু শুধু শত্রু বাড়িয়ে লাভ কী? এই ভদ্রলোকের তো সত্যিই কিছু করার নেই। ব্যালিস্টিক রিপোর্টটা নিয়ে অফিসে একটু হইচই হয়েছে, সেটা নিয়ে মুখরোচক একটু আলাপচারিতার লোভ সামলাতে পারেননি সিতাংশু মজুমদার। এখন উপরমহল থেকে হুড়ো আসার আগেই এ দিকটা একটু সামাল দিয়ে রাখা দরকার। শুকনো একটা ধন্যবাদ দিয়ে ফোন নামিয়ে রাখলেন অলকেশ।
টেবিলের উপর পরোটা-মাংসের থালা। খাওয়ার ইচ্ছেটাই হঠাৎ উবে গেছে। কোথা থেকে এসে একটা হিজড়ে মরে পড়ে আছে হাসপাতালের মর্গে, এখন তাই নিয়ে হ্যাপা সামলাতে হবে।
ক্রমশ