ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য
• (গত সংখ্যার পর) •
সে সব দিনগুলো কোথায় হারিয়ে গেল অর্ণবের! এ বার সে দেশে এসেছিল নিতান্তই কাজের তাগিদে। বাবাকে দেখতে গিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু তার মধ্যেও যে তার একটা স্বার্থচিন্তা কাজ করেছিল, সে কথা নিজের কাছে অস্বীকার করবে কী করে অর্ণব? বাবা কি সেটা বুঝতে পেরেছিলেন কোনও ভাবে? তাই দেখা করলেন না?
ছোটকা’র মেয়ে পিউ এখন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ডাকসাইটে অধ্যাপিকা, ড. ইন্দ্রাণী ভট্টাচার্য। স্বামী অনিতেশ ডাক্তার। দিল্লি শহরের উচ্চবিত্ত এলাকা জোড়বাগে পিউদের বিশাল দোতলা বাড়ি। কিন্তু বাবা সেখানে ছিলেন না। অর্ণব গিয়ে পৌঁছনোর দু’দিন আগেই হরিদ্বার চলে গেছেন।
দিল্লিতে তিনটে দিন অবশ্য ভালই কেটেছে অর্ণবের। অনিতেশের সঙ্গে তার জমে বেশ। আর পিউয়ের সাথে বসলেই তো হুড়মুড়িয়ে ভিড় করে আসে শৈশব! চারতলার ঘরগুলিতে ছিল তাদের, ভাইবোনেদের রাজত্ব। বড়দা তখন ক্লাস নাইন বা টেন, ঠিক মনে নেই। বড়দা মানে বাপ্পা অর্ণবের থেকে তিন বছরের বড়। বড়কাকা অম্লানভূষণের একমাত্র সন্তান। তা ছাড়াও তার ছোটভাই মিন্টু, ওরফে অর্কেন্দু, মেজকাকা অরিত্রভূষণের দুই মেয়ে মঞ্জু আর বাবলি। আর এই পিউ।
পিউ ছিল তাদের যৌথ পরিবারের কনিষ্ঠ সদস্য। সকলের আদরের পাত্রী। বিশেষত অমিয়ভূষণের। ছেলেবেলা থেকেই সে দেখেছে, পুতুলের মতো ছোট্ট এই বোনটি কী ভাবে যেন অমিয়ভূষণের কঠোর আস্তরণ ভেদ করে নিজের একটা ঠাঁই করে নিয়েছিল। বাড়ির সবাই জানত, পিউয়ের সব আবদার বড়জেঠুর কাছে। আর সে আবদার অমিয়ভূষণ ফেলতে পারেন না। অথচ সে বা তার ভাই মিন্টু কখনও অমিয়ভূষণের কাছ থেকে অত প্রশ্রয় পায়নি। মঞ্জু আর বাবলিও না। কাকামণির দুটি মেয়েই ছিল খুব চাপা। অনেকটা কাকামণির মতোই। শান্ত, নির্বিরোধী মানুষ ছিলেন কাকামণি। বাবার সঙ্গে তিনিই ঘাড়ে তুলে নিয়েছিলেন পারিবারিক ব্যবসার দায়িত্ব।
নয় নয় করে বিষয় সম্পত্তি কম করেননি ঠাকুরদা। কলকাতা শহরে তিনটে পেট্রোল পাম্প। গ্রে স্ট্রিটের মোড়ের পাম্পটা তো এখন শহরের দিক-নির্দেশিকাগুলির মধ্যে পড়ে। ওটাকে ধরে রাস্তা বোঝায় শহরের লোক। ‘গ্রে স্ট্রিটের মোড়ে যে পেট্রোল পাম্পটা, ওটাকে বাঁ দিকে রেখে আর একটু এগিয়ে যাবেন,’ বা ‘গ্রে স্ট্রিটের পেট্রোল পাম্পটার ঠিক উলটো দিকের দোকান,’ লোকজনের মুখে এই ধরনের কথা শুনে তারা অভ্যস্ত। শহরে ছড়ানো-ছিটানো আরও সাত-আটটা দোকান— শাড়ির ব্যবসা, হার্ডওয়্যার। তা ছাড়া দুটো মাঝারি আকারের ছাপাখানা। একটা মৌলালির কাছে, অন্যটা মানিকতলায়। হাওড়ায় তিনটে ফাউন্ড্রি ছিল, বাবারা বেচে দিয়েছেন অনেক দিন আগে। ঠাকুরদার রেখে যাওয়া ব্যবসার মধ্যে ওই ফাউন্ড্রি তিনটেই বেচতে রাজি হয়েছিলেন বাবা, তাও শ্রমিক বিক্ষোভের চাপে পড়ে। কাকামণি কোনও দিনই বাবার উপর কোনও কথা বলেননি। কিন্তু তিনটে ফাউন্ড্রি একসঙ্গে বেচে দেওয়ার ব্যাপারে তাঁরও একটু আপত্তি ছিল। অর্ণবের মনে পড়ে, একতলার বৈঠকখানার পিছনে, বাবার অফিসঘরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মিটিং চলেছে বাবা-কাকাদের। ছোটকা সেখানে দর্শক।
বাবা-কাকাদের মধ্যে আপনভোলা এই মানুষটিই অর্ণবের সবচেয়ে কাছের লোক। পারিবারিক ধারাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে ছোটকাকা পোশাক-আশাকে অবিন্যস্ত, কিন্তু পরিপাটি করে ব্যাকব্রাশ করা চুল। ঠোঁটের ফাঁকে গোঁজা উইল্স নেভি কাটের সিগারেট। সারা জীবন অধ্যাপনা করেছেন। পদার্থবিজ্ঞানের ডাকসাইটে ছাত্র। সত্যেন বসুর স্নেহাস্পদ। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে পাশ করে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়, তারও পরে এমআইটি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চাকরি করেছেন, তার পর এসে কিছু দিন থিতু হয়েছিলেন কলকাতায়। অর্ণবরা তখন ছোট। অর্ণব যে বছর ক্লাস টুয়েলভে উঠল, সে বছরই ছোটকা জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি নিয়ে দিল্লি চলে গেল। সন্ধ্যা হলেই ছোটকাকিমার খোঁপায় বেলফুলের মালার গন্ধ, পিউয়ের যখন তখন হাত ধরে টানা আর নানা আবদার, বিনা নোটিসে উধাও হয়ে গেল তার জীবন থেকে।
এ সব অবশ্য ভাবার সময় তখন তার ছিল না। সে সময় ধ্যান-জ্ঞান-চিন্তা একটাই অর্ণবের, থিয়েটার। উৎপল দত্তের নাটকগুলো একের পর এক দেখে ফেলতে হবে— কল্লোল, অঙ্গার, ব্যারিকেড, এবার রাজার পালা, দাঁড়াও পথিকবর, আজকের শাজাহান। সুযোগ পেলেই অ্যাকাডেমি। সেখানে রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত আর স্বাতীলেখা। কখনও-সখনও রবীন্দ্রসদনে কুমার রায়। শম্ভু মিত্রের গ্যালিলেও দেখার জন্য সারা রাত্রি লাইন দিয়েছিল অর্ণব। তখন ক্লাস টেনে পড়ে। পরের দিন সকালে অমিয়ভূষণের সামনে তলব। সে দিন পিতৃরোষ থেকে বাঁচিয়েছিল ছোটকা। সারা রাত বাড়ি ফেরেনি ক্লাস টেনে পড়া বালক, যা তাদের বাড়ির পরিবেশে অভাবনীয়! সকালবেলা সন্তর্পণে বাড়ি ঢোকামাত্রই মেজকাকিমার উদ্বিগ্ন মুখ!
‘কোথায় ছিলি? কেউ ঘুমোয়নি বাড়িতে। বড়দা-মেজদা তো পুলিশে যাওয়ার তোড়জোড় করছেন!’
এরই মধ্যে বাড়ির পুরনো কাজের লোক শিবেনদার আগমন।
‘বড় খোকাবাবু, মেজ খোকাবাবু সব অফিসঘরে বইসে আছেন। তোমারে ডাকতিছেন, মনা।’
সেদিন ছোটকা না থাকলে বিপদ ছিল অর্ণবের।
‘আরে বলছেই তো থিয়েটারের টিকিটের লাইনে দাঁড়িয়েছিল। এদিক-ওদিক তো কোথাও যায়নি!’
ছোটকার রিল্যাক্সড বাচনভঙ্গিটা আজও খুব আকর্ষণীয় লাগে অর্ণবের।
‘তুই থাম, ভোম্বল। ভদ্রবাড়ির ছেলে সারা রাত থিয়েটারের টিকিটের জন্য লাইন দেবে? সেটা মেনে নিতে হবে? এর পর কী বলবি? শুঁড়িখানায় গেছিল, আর তো কোথাও যায়নি?’
বাবা ফেটে পড়লেন। অর্ণব চুপ। ভয়ে হাত পা ঠান্ডা। মাথা ঠিকমত কাজ করছে না। আর ও রকম অবস্থায় আজও অর্ণবের যা হয়, সে দিনও তাই ঘটেছিল। সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক সব চিন্তা ভিড় করে আসে মাথায়। ছোটকার নাম ভোম্বল কে রেখেছিল কে জানে।
সেই ছোটকা’ই সে দিন বাঁচিয়েছিল অর্ণবকে।
‘এটা কী বললে দাদা? তুমি বাংলা সাহিত্যের অনুগামী। ও তো শুঁড়িখানায় যায়নি। শম্ভু মিত্রর নাটকের জন্য লাইন লাগিয়েছিল। এই দুটো জিনিস এক?’
‘সেটা বাড়ির কাউকে জানিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি?’
‘আহা, জানিয়ে গেলে তো ওর যাওয়া আর হত না। হত কি? তুমি যেতে দিতে ওকে? বড়বউদি, সেজোবউদি দিত?’
সে দিনের মতো রেহাই পেয়েছিল অর্ণব। পরের দিন নাটকটা দেখতে যাওয়ার অনুমতিও পেয়েছিল।
সেই নাটকই এখন উধাও হয়ে গেছে তার জীবন থেকে। ভাল ছাত্র ছিল অর্ণব। আইআইটি থেকে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে একটা বিদেশি কোম্পানিতে চাকরি পায় সে।
সেই তার বাবার সঙ্গে প্রথম প্রকাশ্য বিরোধ।
অমিয়ভূষণের ইচ্ছে ছিল, বাড়ির বড় ছেলে পৈতৃক ব্যবসা দেখবে। কিন্তু সেই নাটক দেখতে যাওয়ার মতোই, ছেলের আগ্রহ ঠিক কতটা, সেটা বুঝতে পেরে বাধা দেননি অমিয়ভূষণ। তাঁর বিপ্লবী চেতনার মূলে ছিল গভীর প্রত্যয়, প্রত্যেকের নিজের মতো করে বাঁচার অধিকার আছে। সেই অধিকারে কখনও হস্তক্ষেপ করেননি তিনি। নিজে শত দুঃখ পেলেও না।
শুধু অর্ণব বুঝতে পারে, বাবা একটু একটু করে তার থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছেন নিজেকে। বিশেষত মায়ের আকস্মিক মৃত্যুর পর।
সেই বিদেশি বহুজাতিকের চাকরি সূত্রেই অর্ণবের প্রবাসে পদার্পণ। কিন্তু লন্ডনে পৌঁছে কিছু দিন চাকরি করার পরেই সে বুঝল, এখানে নিজের মতো কাজ করার অবাধ সুযোগ। তার রক্তে হয়তো ছিল ব্যবসা করা। এই সিদ্ধান্তেও অবাক হয়েছিলেন অমিয়ভূষণ। চাকরি ছেড়ে সে ব্যবসা করতে চায়, এ কথা শোনার পর স্ত্রীর কাছে দুঃখ করেছিলেন, ‘ব্যবসাই করবে সে, কিন্তু তাও বিদেশে। কেন, নিজের দেশ, নিজের লোকজন কি এতই খারাপ?’
বাবাকে কী ভাবে বোঝাবে অর্ণব, ঠাকুরদার তৈরি করা ব্যবসা চালানো নয়, সে চায় নিজের হাতে নিজের জীবন তৈরি করার স্বাদ।
সম্পূর্ণ নিজের মতো করে সে ব্যবসা গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখছে তখন, ঠিক যেমন এক সময় নিজের মতো করে নাটক লিখে, মঞ্চস্থ করার কথা ভাবত। একটু একটু করে বাবার সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়েছে তার। অবশ্য বাবার কাছের মানুষ সে কোনও কালেই ছিল না। তাও মা কনকবালার হাতে যত দিন সংসার ছিল, বড়কাকিমা, মেজকাকিমা ছিলেন, তত দিন তাঁরা চেষ্টা করেছেন নানা ভাবে অমিয়ভূষণকে বোঝাতে। কিন্তু যে দূরত্ব অমোঘ, তার উপর তাঁরা প্রলেপ দেবেন কী ভাবে?
জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে বাবার বিরুদ্ধে নীরব বিদ্রোহ অর্ণবের। জীবন, জীবিকা— তার প্রবাস, তার ব্যবসা, বাবা কোনওটাতেই খুশি হননি। রঞ্জনাকে বিয়ে করার ব্যাপারে তীব্র আপত্তি ছিল বাবার। অব্রাহ্মণ পরিবারের কন্যা। তিন কাকিমা আর ছোটকাকা বুঝিয়ে রাজি করিয়েছিলেন। পরে অবশ্য দেখা গেল, রঞ্জনা বাবার প্রিয়পাত্রী হয়ে উঠেছে। কারণ রঞ্জনারও পুরনো কংগ্রেসি পরিবার। ওর মাতামহ এক সময় যুগান্তর গোষ্ঠীর সদস্য ছিলেন— বোমা বানানোর অপরাধে একাধিক বার জেল খেটেছেন।
রঞ্জনার মাথা থেকেই বেরোয় বুদ্ধিটা। ইউকে-তে এখন অর্ণবের কেমিক্যালস এক্সপোর্ট ইমপোর্টের ব্যবসাটা বেশ প্রতিষ্ঠিত। বেশ কয়েকটি ছোট বড় এবং মাঝারি প্রতিষ্ঠানের সে এক জন নির্ভরযোগ্য সাপ্লায়ারও বটে। রঞ্জনা বলেছিল, ভারত থেকে যদি সে কিছু রাসায়নিক দ্রব্য আমদানি করে, তা হলে সেই ব্যবসায় সে তাদের পারিবারিক ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানগুলির কোনও একটিকে যুক্ত করতে পারে। কলকাতায় নতুন একটা কোম্পানি খোলাও যেতে পারে, তাদের যৌথ পারিবারিক ব্যবসার অংশ হিসেবে। তাতে হয়তো বাবা কিছুটা খুশি হতে পারেন।
‘তোমার তাই মনে হয়?’ কেনসিংটনের বাড়িতে ডিনার খেতে খেতে সে রঞ্জনার দিকে তাকিয়েছিল।
‘বলেই দেখো না। কী আর হবে? বড়জোর না করবেন, এই তো? তা কলকাতায় ব্যবসা না হলে তুমি তো আর পথে বসছ না।’
রঞ্জনার কথাটা নেহাত ফেলনা নয়। কয়েক দিন বিষয়টা নিয়ে মনের মধ্যে নাড়াচাড়া করেছিল অর্ণব। তার পর ভাইকে একটা সতর্ক টেলিফোন।
এখন পারিবারিক ব্যবসা কাকামণির সঙ্গে অর্কেন্দুই দেখাশোনা করে। কাকামণি, অর্থাৎ মেজকাকা অরিত্রভূষণ এখনও সে ব্যবসার হাল ধরে আছেন।
অমিয়ভূষণ ছিয়াশি বছর বয়সেও সচল। মেদহীন, টান টান চেহারা। মেরুদণ্ড সোজা করে চলাফেরা করার ভঙ্গিমায় কোনও পরিবর্তন হয়নি। শুধু একটু মন্থরগতি হয়েছেন। আগের মতো হনহন করে আর হাঁটেন না। আর ব্যবসার কাজ থেকেও গুটিয়ে নিয়েছেন নিজেকে।
দাদার প্রস্তাব শুনে লাফিয়ে উঠেছিল মিন্টু। ভারতের প্রধানমন্ত্রী এখন মনমোহন সিংহ। কেন্দ্রীয় সরকার ব্যবসার নানা ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগের সুবিধে করে দিতে আগ্রহী। পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকারেরও যেন একটু চেতনার উদয় হয়েছে। নতুন ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রস্তাব নিয়ে এখন তাদের ছুঁতমার্গ কম। হলদিয়ায় পেট্রোকেমিক্যাল ফ্যাক্টরিটা চালু হয়েছে। একটা কেমিক্যাল হাব তৈরির প্রস্তাব উঠেছে। এটাই উপযুক্ত সময়। মেজকাকুও এক কথায় রাজি। কিন্তু অমিয়ভূষণের মতামত ছাড়া এখনও তাদের পারিবারিক ব্যবসায় কিছুই হয় না। এত বড় একটা পদক্ষেপে তাঁর অনুমতি থাকা দরকার।
টেলিফোনে বাবার সঙ্গে কথা বলেছিল অর্ণব। প্রস্তাব শুনে কিছু ক্ষণ অমিয়ভূষণ নীরব। তার পর নিরুত্তাপ কণ্ঠস্বর ভেসে এল, ‘হঠাৎ তোমার দেশের দিকে নজর ঘুরেছে যে? শোনো, আমাকে খুশি করার তাগিদে যদি এই প্রস্তাব করে থাকো, তা হলে এখনই বলে দিচ্ছি, তার কোনও প্রয়োজন নেই। যদি তোমার প্রস্তাব প্রকৃতই বাণিজ্যভিত্তিক হয়, তা হলে তোমাকে এখানে এক বার আসতে হবে। এ সব কথা টেলিফোনে হয় না। আর আসোই যদি তা হলে ঠিক কী করতে চাও, কী ভাবে এগোতে চাও, তার একটা লিখিত খসড়া নিয়ে এসো। বউমা ভাল আছেন?’
বাবার চিরপরিচিত ভঙ্গি। টানটান, স্পষ্ট উচ্চারণ। সংযত বাক্যবিন্যাস। কথায় তৎসম-তদ্ভব শব্দের আধিক্য।
সেই শীতল আহ্বানেই সাড়া দিয়ে এ বার দেশে আসা অর্ণবের। লন্ডন ছাড়ার আগেই সে জানত, কলকাতায় বাবার দেখা পাওয়া যাবে না। বাবা দিল্লিতে, পিউয়ের বাড়ি। তাই কলকাতায় নেমে হিন্দুস্থান পার্কের বাড়িতে কয়েক দিন কাটিয়েই সে রওনা হয়েছিল দিল্লির উদ্দেশে। বাবার অনুমতি পেলে ফিরে এসে মিন্টু আর কাকামণির সঙ্গে বসবে, এটাই বলে গিয়েছিল সে।
দিল্লিতে বাবা দেখা দিলেন না। তার উপর বাড়তি সর্বনাশটা ঘটাল তার আর একটা দুর্বলতা, ট্রেন। ট্রেন জার্নি ভালবাসে অর্ণব। নানা দেশে গিয়ে ট্রেনে চড়া তার শখ। নিজের দেশে তো বটেই। তাই কলকাতা থেকে দিল্লি যাওয়ার সময় প্লেনে গেলেও, ফেরার পথে সবার পরামর্শ-উপদেশ অগ্রাহ্য করে পূর্বা এক্সপ্রেসে টিকিট কেটেছিল সে। তার ছেলেবেলার ডিলাক্স। উত্তর ভারত দেখতে দেখতে কলকাতায় ফেরা যাবে। হাতে কয়েকটা দিন বেশি নিয়েই তো এসেছে সে।
আর একটু পরেই চিত্তরঞ্জন স্টেশনে ঢুকবে ট্রেন। দীর্ঘ যাত্রা প্রায় শেষ হওয়ার পথে। মধুপুর স্টেশনে নেমে এক কাপ চা খাচ্ছিল অর্ণব। তার এসি ওয়ান কম্পার্টমেন্ট যেখানে থেমেছে, সেখানেই চায়ের স্টল। দেখেই টুক করে নেমে পড়েছিল সে। কিন্তু ট্রেনটা যে অত অল্প সময় দাঁড়াবে, আর ও রকম নিঃশব্দে ছেড়ে দেবে, এটা তার খেয়াল ছিল না। ঘাড় ফিরিয়ে যখন দেখল সে অপস্রিয়মাণ ট্রেনটিকে, তখন সামনে যে কামরা আছে তাতেই দৌড়ে উঠে পড়া ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না। ওই কামরায় না উঠলে সেই ভয়াবহ মৃত্যুটার সাক্ষী হতে হত না তাকে। মুহূর্তের মধ্যে কেমন হিম হয়ে গেল এক জোড়া চোখের দৃষ্টি!
• (ক্রমশ) •