ছবি: রৌদ্র মিত্র
পূর্বানুবৃত্তি: কাজে আটকে যায় অভিরূপ। তিয়াষা ও অরুণের সঙ্গে দেখা করতে পারে না সে। পরে একটা দিন ঠিক করে তিয়াষার সঙ্গে দেখা করার জন্য। কিন্তু সে ঠিক করতে পারে না, সে দিন অরুণকেও ডাকবে কি না। তিয়াষার সঙ্গে দেখা করার দিন তার ইচ্ছে করে না হাসপাতালে যেতে। ছুটি নিয়ে শুয়ে থাকে ঘরে। অসময়ে শুয়ে থাকতে দেখেও অভিরূপের স্ত্রী চুমকি কারণ জানতে চায় না। বরং জানায়, নিউজ়ে অভিরূপের নাম না করে এক রোগীর মৃত্যুর জন্য তাকে দায়ী করা হয়েছে।
এত কাণ্ড করে বিলাসবুড়োকে বাঁচানো যে বনানীর কম্ম নয় সেটা অমল বুঝেই গিয়েছে। এখন শুধু খেলিয়ে খেলিয়ে ঠিক মতো সুতো টেনে জলের মাছ ডাঙায় তোলা। আন্দাজ করার চেষ্টা করে অমল। কত পরিমাণ টাকা থাকতে পারে বিলাসের! টাকা আছে বলেই দেশগ্রামে রটনা। কিন্তু সেটা কত লাখ? আর যে ভাবে দিনের পর দিন এদের নানা রকম ফিরিস্তি শোনা যাচ্ছে, তাতে খরচ-খরচা বাদ দিয়ে হাতে কী বা থাকবে, থাকলেও সেটা অমলের হাতে কী করে আসবে? এইগুলোই এখন বড় চিন্তা। চিন্তার কিছু ছিল না, যদি বনানীটা আগের মতো থাকত। এখানে আসার সময় তো অমলের ওটাই ভরসা ছিল যে, বনানীকে সে ছিপে গেঁথে তুলতে পারবে। আগে আগে ওর রকমসকম, ঠারে ঠোরে তাকানো, ইশারা-ইঙ্গিত সব কিছু দেখে অমলের মনে হয়েছিল, বনানী একটু বিশেষ চোখেই দেখে তার অমলদাকে। আত্মীয়তা তো এমন কিছু নেই, যা আছে তা লতায় পাতায়। সেই সম্পর্কটা বিলাসবুড়োর অসুখের ফাঁকে আরও ঝালিয়ে নেওয়া যাবে, এটাই আশা ছিল। কিন্তু এ তো সবটাই উল্টো দাঁড়াচ্ছে। ওই শুঁটকো বুড়োটার জন্য তো দিন দিন বনানীর দরদ আরও বেড়েই চলেছে। এখানে হাসপাতালের আশেপাশে ঘর ভাড়া পাওয়া যায় রোগীর আত্মীয়দের থাকার জন্য। অমল সেই ঘর নেওয়ার কথা বলেছিল। চারপাশে চেনা লোক কেউ নেই। মনে আশা ছিল, দুটো-তিনটে রাত এক সঙ্গে কাটালেই বনানীকে হাত করে ফেলা যাবে। কিন্তু বনানী রাজি হল না ভাড়ার ঘরে থাকতে। সারা রাত হাসপাতালের রিসেপশনের সোফায় শুয়ে থাকে। এখানেই স্নান বাথরুম সেরে নেয়। খাওয়ার জন্য ক্যান্টিন আছে। এত দিন হয়ে গেল, এই কৃচ্ছ্রসাধন করে যাচ্ছে। কেন করছে তার কোনও উত্তর অমলের কাছে পরিষ্কার নয়।
এটা ঠিক যে যা হোক তা হোক বলে সমানেই ওর কাছ থেকে আজ অনেকগুলো টাকা হাতিয়ে নিয়েছে অমল, কিন্তু সেটায় মন ভরেনি ওর। তার মগডালে নজর। সেই নজরের দিকেই তাকিয়ে বসে বসে নিঃশ্বাস ফেলে ও। ভেবেছিল লিভার পচে বুড়ো দু’চার দিনের মধ্যেই স্বর্গে যাবে। এখন শুনছে লিভার আবার পাল্টানোও যায়। তবে সেটা চট করে হওয়া মুশকিল, এটাই যা আশার কথা। তা ছাড়া বহু টাকার ধাক্কা। আর লিভার পাওয়াও সমস্যা। বনানীকে এই ব্যাপারটা ঠিক মতো খাওয়াতে পারলে এখান থেকেও মোটা দাঁও মারা যাবে।
অমল বসে বসে ভাবছিল কেমন করে বলবে বনানীকে। বনানী কাগজপত্র কিছু দেখে না, দেখলেও কিছুই বুঝবে না। সব ইংরেজিতে লেখা। এটাই বড় ভরসা। নইলে এরা যে দিল্লিতে রেফার করবে বলে বলছিল সেটা যদি লিখে দেয় আর বনানী যদি জানতে পেরে বেঁকে বসে, তা হলেই হয়ে গেল। অনেক চিন্তা এখন অমলের মাথায়। একটা একটা করে গুটি সাজিয়ে পাকা গুটি ঘরে তুলতে হবে। এক-এক বার মনে আশার সঞ্চার ঘটে, পরমুহূর্তেই আবার সব আশা নিভে যায়।
বনানী এক বার করে লিফট অবধি যাচ্ছে, আবার অপ্রসন্ন মুখে এসে বসছে। এখনও ভিজ়িটিং আওয়ার হয়নি। তাই ওপরে যাওয়ার পারমিশন পাচ্ছে না। এত দিনেও বনানী এই নিয়মের কড়াকড়িতে অভ্যস্ত হতে পারেনি। থেকে থেকেই এক কথা বলে যায়, ‘‘আমাদের মালদা হাসপাতালে যখন খুশি ঢোকা যায়।’’ অমলের বিরক্ত লাগছিল। একেই মাথায় হাজার চিন্তা। তার ওপর অকারণ প্যানপ্যান। মুখখানা তোলা হাঁড়ির মতো করে মনে মনে বহু কথা বলে যাচ্ছিল অমল। এমন সময় একটা মেয়ে এসে জানায় পেশেন্টের ব্যাপারে কথা আছে, ওপরে যেতে হবে। এমনকি ওদের দু’জনকে লিফট অবধি নিয়েও আসে। এ বার আর কেউ আটকায় না।
দূর থেকেই দেখা যাচ্ছিল, চার জন পুরুষ এক জন মহিলা ডাক্তার বিলাসের বেড ঘিরে দাঁড়িয়ে। কয়েক জন নার্সও আছে। সকলে নিচু গলায় কথা বলছে। অমলের সন্দেহ হয়। ব্যাপার কী! বিলাস বুড়ো টেঁসে গেল নাকি? বনানী প্রায় ছুটে গেল বেডের পাশে। বেডের স্ট্যান্ডে হাত রেখে হাঁপাতে হাঁপাতে তাকিয়ে থাকে সারা শরীরে অজস্র নল লাগানো, চোখ বুজে থাকা বিলাসের দিকে।
অমল এগিয়ে আসছিল। ঝড়ের বেগে ওর পাশ কাটিয়ে উল্টো দিকে চলে যান এক জন লম্বা ফর্সা ছিপছিপে চেহারার ডাক্তার। যাকে অমল এই ক’দিনের মধ্যে এক দিনও দেখেনি। তার বলা দু’চারটে শব্দ ছিটকে এসে অমলের কানে। “নো আই কান্ট... ইটস আনএথিক্যাল...” বেডের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অন্য সব ডাক্তারদের সঙ্গে এর কোনও কিছু নিয়েই বনিবনা হচ্ছে না। সেটা নজর করে অমল। তত ক্ষণে মহিলা ডাক্তার বেরা এগিয়ে এসেছে অমলের কাছে। এঁকে তো চেনে অমল প্রথম দিন থেকেই। পাশে দাঁড়ানো বয়স্ক ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে নিয়ে কথা বলে বেরা, “হ্যাঁ, যে জন্য আপনাদের ডাকা হয়েছে... আমরা দেখতে পাচ্ছি বিলাসবাবুর হার্টের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ। ইমিডিয়েট সার্জারি করা দরকার। নয়তো ওঁকে বাঁচানো কঠিন। আমরা ওঁর জন্য মেডিক্যাল বোর্ড বসিয়েছিলাম। বোর্ডের মত অনুযায়ী আমরা এই সার্জারি এখনই শুরু করতে চাই। তবে এটা অনেকটাই এক্সপেনসিভ...”
ডাক্তারের কথা শেষ হওয়ার আগেই বনানী হাইমাউ করে বলে ওঠে, “হ্যাটের কুনো ব্যামো ছেল না কো... লেভার খারাপ ছেল... লেভার পাল্টাপাল্টি কত্তি হবে শুনলাম, অ্যাখন আবার হ্যাটের অপারেশান কত্তি হবে বইলতেছেন... মানুষডার হইয়েছেডা কী? পোষ্কার করি বললে বলেন নাইলে মালদা ঘুরত নে যাচ্ছি ...”
সুবিধে করতে পারে না। এদের যেন স্পেশ্যাল ট্রেনিং দিয়ে রেখেছে কেউ। ভীষণ ভদ্র ঠান্ডা ব্যবহার করবে, কিন্তু কোনও ভাবেই ইনভল্ভড হবে না। অমলের গলা শুকোয় একটু চায়ের জন্য। কিন্তু ও আবার পায়ে পায়ে বনানীর কাছেই এসে দাঁড়ায়।
“চলো বনো, একটু চা খেয়ে আসি নীচে থেকে।’’
বনানী যেন শিউরে ওঠে, “বাবরে... সে লোকডারে নে গ্যাছে কাডাছেড়া কত্তি... অ্যাখুন চা জল কিছুই গলা দে নামবে না গো... আগে ঘুরত আসুক...”
ন্যাকা! বলে রাজা ছাড়া রাজ্য চলে, উনি আর বুড়ো বরের শোক ধরে রাখতে পারছেন না। তাও তো এখনও বেঁচে আছে। না থাকলে কী করবে? সহমরণে যাবে কি? মনে মনে উচ্চারণ করে অমল। মুখ দেখে অবশ্য মনের ভাব বোঝা যায় না।
“অ... তুমি যাবে না? তা আমিই যাই। এট্টু চা খেয়ে আসিগে... গলাটা বড্ড...”
“হা... তাই যাও... তাই যাও দিনি... এট্টু একা থাকতে দাও আমাকে। কী মরণ রোগে ধইললো মানুষডারে... সব আমার পাপের ফল...” চোখে আঁচল চাপা দেয় বনানী।
আর সহ্য হয় না অমলের। অনেক ভেবেও ওর মাথায় আসে না, কোন দুঃখে বিলাস পালের জন্য কাঁদবে বনানী। ওই তিনগুণ বয়সের লোকটা কী এমন দিতে পেরেছিল বনানীর মতো একটা ভরভরন্ত মেয়েকে? আজ যদি বিলাসের কিছু একটা হয়েই যায়, বনানীর তো বরং খুশি হওয়ার কথা। বুড়োর রেখে যাওয়া টাকায় বাকি জীবন পায়ের ওপর পা তুলে স্বাধীন ভাবে থাকতে পারবে সে। আর সঙ্গে যদি অমলের মতো লোককে রাখে, তা হলে তো আর কোনও অভাবই থাকবে না। শরীরের সুখ তো অমলের মতো আর কেউ দিতে পারবে না ওকে। এই সব ভাবতে ভাবতে করিডর দিয়ে চলে যায় অমল।
লিফট পেরিয়ে সিঁড়ির কাছে এসে ঘড়ি দেখে অমল। সাড়ে পাঁচটা প্রায়। কপালে হাল্কা ভাঁজ পড়ে। সত্যিই তো বহু ক্ষণ হয়ে গেল। এখনও অপারেশন হল না? সেই বারোটার পরে নিয়েছে ওটি-তে। আনমনে এগিয়ে চলেছিল অমল। পিছন থেকে একটা মেয়ে এসে ডাকে ওকে,
“আপনি পেশেন্ট বিলাস পালের রিলেটিভ?”
“হ্যাঁ, কেন?”
“স্যর ডাকছেন আপনাকে। এ দিকে আসুন।’’ “আজ্ঞে কোন স্যর?”
“ডক্টর কুলকার্নি। যান, ভিতরে চলে যান।’’ করিডর থেকে বাঁ দিকে একটি দরজা দেখিয়ে দেয় মেয়েটি। অমল ভিতরে ঢুকে দাঁড়িয়ে থাকে চুপ করে। ওর মাথায় কিছু আসছে না। কেন এখানে ডাকল ওকে কে জানে। বনানীকে নিয়ে এলেই ভাল হত। নইলে আবার যদি একগাদা খরচ-খরচার কথা বলে, ওকে তো সেটা বোঝাতে হবে। প্রথম দিকে যেমন অমল বলা মাত্রই টাকা বের করে দিচ্ছিল, আজকাল ঠিক তা আর হচ্ছে না। বহু প্রশ্ন করে টাকা দেওয়ার আগে।
অমল পর্দা সরিয়ে ভিতরে পা রাখে। ও বাবা! এ তো সেই বয়স্ক হুমদোমুখো দাড়িওয়ালা ডাক্তার! যাকে বিলাস পালের বেডের পাশে দেখেছিল। ইনিই বুঝি ডক্টর কুলকার্নি? অমল চুপ করে টেবিলের সামনে দাঁড়ায়। আরও তিন জন বসে আছে। এঁদের মধ্যে অমল শুধু ডাক্তার বেরাকেই চেনে। বাকি দু’জন পুরুষ ডাক্তারকে এই প্রথম দেখল। ওদের গলায় স্টেথো। তা ছাড়া আরও দু’জন ভদ্রলোক বসে আছে সোফায়। খুব মনোযোগ দিয়ে হাতে ধরে থাকা কোনও কাগজ পড়ছে। বোঝা যাচ্ছে না তারা ডাক্তার কি না।
“আপনাকে একটা কথা বলার জন্য ডাকা হয়েছে,” বসে থাকা তিন জন ডাক্তারের মধ্যে এক জন বলে। সঙ্গে সঙ্গেই ডাক্তার বেরা বলে, ‘‘আপনি বসুন না। বসুন এখানে। এই মালতী... অমলবাবুকে চা দিয়ে যাও।’’
“না... না... থাক,’’ বলতে বলতে চেয়ার টেনে বসে অমল। সঙ্গে সঙ্গেই মালতী নামের কোনও এক জন এসে ওর সামনে নামিয়ে দিয়ে যায় সুগন্ধী সোনালি চায়ের কাপ ও দু’টো বিস্কুট। কাপে চুমুক দিয়ে অমল বোঝে, এটা ক্যান্টিনের চা নয়, ডাক্তারদের জন্য স্পেশ্যাল চা।
ক্রমশ
এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও। সাবস্ক্রাইব করুনআমাদেরYouTube Channel - এ।