পূর্বানুবৃত্তি: বোসস্যরের কথার প্যাঁচে পড়ে গিয়ে উচ্ছেদ-অভিযানে সঙ্গ দিতে রাজি হন ধীরেনবাবু। বেন্দাকে নিয়ে জায়গাটা ভাল করে চিনে আসতে বেরিয়ে পড়েন বোসস্যর। বেন্দার মনে পড়ে এই জায়গাতেই এক বার তার কাকার মুণ্ডহীন লাশ শনাক্ত করতে হয়েছিল তাকে। সেই আতঙ্কের দৃশ্য এখনও স্বপ্নের ভিতর দিয়ে তাড়া করে বেন্দাকে। সে বোসস্যরকে অনুনয় করে এমসিসিদের ঘাঁটিতে ঢোকার ঝুঁকি না নিতে। কিন্তু নিজের জেদে অনড় থেকেই অভিযানের পরিকল্পনা করেন বোসস্যর। পূর্বানুবৃত্তি: বোসস্যরের কথার প্যাঁচে পড়ে গিয়ে উচ্ছেদ-অভিযানে সঙ্গ দিতে রাজি হন ধীরেনবাবু। বেন্দাকে নিয়ে জায়গাটা ভাল করে চিনে আসতে বেরিয়ে পড়েন বোসস্যর। বেন্দার মনে পড়ে এই জায়গাতেই এক বার তার কাকার মুণ্ডহীন লাশ শনাক্ত করতে হয়েছিল তাকে। সেই আতঙ্কের দৃশ্য এখনও স্বপ্নের ভিতর দিয়ে তাড়া করে বেন্দাকে। সে বোসস্যরকে অনুনয় করে এমসিসিদের ঘাঁটিতে ঢোকার ঝুঁকি না নিতে। কিন্তু নিজের জেদে অনড় থেকেই অভিযানের পরিকল্পনা করেন বোসস্যর। সেই মূর্তির পরনে গাঢ় নীল ডোরাকাটা লুঙ্গি, ক্যাটকেটে হলুদ রঙের হাফশার্ট আর জয়পতাকার মতো একটা নতুন গামছা মাথায় জড়ানো। সেটার রং টকটকে লাল।
নিজেকে সামলে নিয়ে স্যর এমন ভাবে চিঠিটা পড়তে লাগলেন, যাতে সবাই শুনতে পায়।
‘‘মাননীয় রেঞ্জারসাহেব, উদরে প্রভূত বেদনা বোধ করায় আমি যেতে অপারগ। তবে যাকে পাঠালাম, তাকে সামান্য জ্ঞান করিবেন না। উনি প্রবল বলশালী ও সাহসী ব্যক্তি বটেন এবং আমার ডাহিনা হস্ত স্বরূপ। অধিকন্তু উক্ত এলাকাটি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানও রাখেন। আপনি এই ব্যক্তিকে আমিই মনে করিতে পারেন, ফলে আপনার অভিযান আরম্ভ করিতে বাধা নাই। আপনাদের অপর্যাপ্ত সাফল্য কামনা করি। নমস্কারান্তে...
‘‘হুঁ...’’ মুখে একটা শব্দ করে স্যর বলেন, ‘‘তা হলে ধীরেনবাবু, এ বার শুরু করা যাক!’’
কর্মকর্তার প্রতিভূ জোরালো প্রতিবাদ করে, ‘‘হামি ধীরেনবাবু লয়কো, হামার নামটো লম্ভোদর মানকি, উঁয়ার অগল-বগলের লোক বট্যি!
অয় ঢ্যাঙাডুংরি আর আশপাশের তামাম ইলাকা হামার হাথের তালুতে বট্যে, চল্যেন যায়েঁ কামটো খত্যম করি।’’
স্যর হেসে বলেন, ‘‘চিঠিতে তো ধীরেনবাবু আপনাকেই উনি মনে করতে লিখেছেন। নাঃ, আবার লিখেছেন যে, আপনি ওঁর ডান হস্ত। বোঝাই যাচ্ছে, ওঁর ডান হাত শরীরের তুলনায় অধিকতর সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। তা মানকিবাবু, রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে চলুন।’’
রেডি হয়েই ছিল সবাই, পনেরো-ষোলো জন ফরেস্ট গার্ড আর বনশ্রমিক সাইকেল নিয়ে আগেই বেরিয়ে গিয়েছিল। হিসেব মতো অকুস্থলের কাছাকাছি বাইক-আরোহীরা ওদের ধরে ফেলবে। আগে মোপেডে লম্ভোদর বা লম্বোদর, তার পর পাঁচটা বাইকে বোসস্যর, বেন্দা আর আটজন বিট অফিসার। লোকাল অফিসার গোপালবাবু অগ্রবর্তী টিমের সঙ্গে ঢ্যাঙাডুংরির দু’-তিন কিলোমিটার আগে মিট করবেন প্ল্যান অনুযায়ী।
প্রায় তিনটের সময় ডুংরির গোড়ায় পৌঁছে মানকিবাবুর পরামর্শে দু’টো শক্তিশালী বাইক সঙ্গে নিয়ে পুরো টিম জবরদখল করা জমির দিকে এগোল। বাকি বাইক মানকির চেনা লোকের জিম্মায় রাখা হল। গোটা এলাকা শুনশান, গরু-ছাগলগুলো কেবল খোঁটায় বাঁধা আর উঠোনগুলোয় মুরগির পাল চরে বেড়াচ্ছে আপনমনে। আগের দিনই ঘুরে যাওয়ার সুবাদে বেন্দার মনে হল, কোথাও একটা গন্ডগোল লাগছে যেন! একটু ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল স্যরেরও মুখটা থমথমে। মনে হয় একটা খটকা ওঁরও লেগেছে। এক সময় বললেন, ‘‘দল থেকে বেশি এগিয়ে যেয়ো না, পুরো টিম যেন একটাই লাইন মেনটেন করে।’’
গাছপালা কেটে ফাঁকা করা জায়গাটাও অস্বাভাবিক রকমের নিঃস্তব্ধ, বাড়িগুলোও খাঁ-খাঁ করছে। কেবল দু’টো কুঁড়েঘরের দেওয়ালে বেশি কালিঝুলি। যেন জোর করে পুরনো দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। সেই দু’টো ঘর থেকেই জোরদার ধোঁয়া বেরোচ্ছে, যেন ভিতরে রান্না হচ্ছে এখনও। কোনও কুঁড়েরই দরজা বা ঝাঁপ নেই, ভিতরে কেউ আছে বলেও মনে হচ্ছে না। ক্লাস এইট পাশ করা বা না-করা, রেঞ্জের অ্যাটাচড অফিসার লোহারবাবু আরসা-বাঘমুন্ডির লোক, সেই রকমই স্ট্যামিনা। সটান একটা অর্ধেক-তৈরি কুঁড়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তার চালাটা আধাআধি ধসিয়ে দেয়, তার পর দুর্বল দেওয়ালে লাথি মারতে থাকে ক্রমাগত। তার দেখাদেখি দেড় ডজন স্টাফ রে রে করে বাকি বাড়িগুলোর উপরে জোর ফলাতে শুরু করে। ওরা কেউ খেয়াল করে না যে, চার জন কমবয়সি মেয়ে-বৌ কলসি কাঁখে, ভেজা কাপড়ে নীচের কাঁদর থেকে অনেকটা খাড়া চড়াই বেয়ে হনহনিয়ে সেই বিশেষ ঘরদু’টোয় ঢুকে পড়েছে।
ব্যাপারটা লক্ষ করে স্যর ঘরদু’টোর দিকে এগিয়ে যান, পিছনে বেন্দা একটু দূরত্ব বজায় রেখে ফলো করে। স্টাফেদের সঙ্গে দা আর কুড়ুল ছিল, ফলে গোটাদশেক ঘর ধূলিসাৎ করতে বেশি সময় লাগে না। লোহারবাবু এ বার সঙ্গীদের নিয়ে ওই ঘরদু’টোর উপর চড়াও হতে যায়, স্যর ওদের বাধা দেন, ‘‘এই দু’টো ঘরে মেয়েরা ঢুকে পড়েছে, আমাদের সঙ্গে মহিলা-পুলিশ বা মহিলা ফরেস্ট গার্ড নেই। ফলে, অ্যাডভান্টেজ এখন ওদেরই। একটু ওয়েট করে দেখি ওদের বার করা যায় কি না!’’
লোহারবাবুর মাথায় তখন খুন চেপে গিয়েছে। স্যরকে প্রায় ঠেলে সরিয়ে দেওয়ার উপক্রম করে, ‘‘হঠ্যেন না স্যর, বাইকটো লিয়্যে ঘরদু’টোয় ঠ্যাসাঁই দিছি! তাইর পর গাড়ি থেক্যে প্যাটরল লিয়্যে ঘরদুইটা জালাঁই দিব্য। না রইব্যেক বাঁশ আর না বাইজব্যেক বাঁশুরি... হঁ!’’
দু’টো ঘরের ভিতর আধো-অন্ধকারে তখন মেয়েরা ভিজে পোশাকে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে। ফরেস্টের চাপরাশদের হুঙ্কার শুনে বেশ ভয় পেয়েছে বোঝা যায়। মাথায় লাল গামছা জড়ানো লম্বোদর ঘটনার অগ্রগতিতে সন্তুষ্ট হয়ে জামার পকেট থেকে একটা বিড়ি বার করে ধরাবার আগে কানের কাছে ঘুরিয়ে এবং টিপে তার মশলা পরীক্ষা করছিল মহুল গাছটার নীচে। হঠাৎই ডুংরির নীচে বসতির দিক থেকে একটা বিকট শব্দ শুরু হল। বেন্দা বান্দোয়ান বাজারে ফি হাটে মাংস বিক্রির জন্যে শুয়োর মারার আয়োজন দেখেছে, মরার সময় অসহায় জন্তুগুলোর রোমহর্ষক আর্তনাদও শুনেছে। অনেকটা সেই রকমই লাগে দূর থেকে আসা শব্দটা। প্রত্যেকেই হাতের কাজ ফেলে কান খাড়া করে।
সবচেয়ে জোরালো প্রতিক্রিয়া হয় ধীরেনবাবুর প্রতিনিধি লম্বোদরের। হাতের বিড়িটা ছুড়ে ফেলে বলে ওঠে, ‘‘বাপ্পো রে, এ শব্দোটা বড় সন্দেহভাজক বঠ্যে, হামি তব্যে আলি।’’ মুহূর্তের মধ্যে লুঙ্গিটা ভাঁজ করে, পরক্ষণেই মালকোঁচা আর তার পরেই ‘থাকিতে চরণ মরণে কী ভয়, নিমেষে যোজন ফরসা।’ একটা অত মোটা লোক যে ফার্স্ট গিয়ারেই অতটা স্পিড তুলতে পারে, না দেখলে বেন্দা বিশ্বাসই করত না। এ বার স্পষ্ট হয় যে বহু লোক এক সঙ্গে মুখে হাতের তালু দিয়ে ‘আ-আ’ শব্দ করছে এবং শব্দটা অনেক কাছে এসে গিয়েছে। মানে বসতিবাসীরা একযোগে আক্রমণ করতে আসছে। বেন্দার পায়ের তলার মাটি দুলতে থাকে, মাথা ঘুরতে শুরু করে, মনশ্চক্ষে ভেসে ওঠে শ্রাবণকাকার কবন্ধ আর কাটা মুণ্ডু। জোর করে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ আনার চেষ্টা করে ও, তাকিয়ে দেখে প্রায় সব স্টাফই লম্বোদরকে অনুসরণ করে বসতির উল্টো দিকে উতরাই বেয়ে প্রাণপণে দৌড়ে পালাচ্ছে। ওকে অবাক করে গোপালবাবু আর লোহারবাবু স্ট্যান্ড-করানো বাইক দু’টোয় স্টার্ট দেয়। একটু ইতস্তত করে লালমোহনবাবুও এক বার স্যরের দিকে তাকিয়ে একটা বাইকের পিছনে চেপে বসে। তার পর সঠিক অর্থে পথই নয়, এমন জঙ্গুলে সরু ঢাল বেয়ে ফুলস্পিডে বাইক চালিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়।
বেন্দার মাথার ভিতরে সব কিছু ওলটপালট হয়ে যায়। ওরা এখানে মোট সাতাশ জন লোক ছিল। কিন্তু এই মুহূর্তে শুধু স্যর একা দাঁড়িয়ে মহুল গাছটার নীচে, আর ও কখন যেন সরতে-সরতে কাঁদরের দিকে নেমে যাবার ঢালটায় এসে দাঁড়িয়েছে। দল বেঁধে উঠে আসা লোকগুলো স্যারকে তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলেছে। ওদের হাতে তির-কাঁড়, টাঙি, সড়কি আর ফারসা। পড়ন্ত রোদে টাঙি আর ফারসার ফলাগুলো চকচক করে উঠছে থেকে-থেকে, স্যর পায়ে-পায়ে পিছিয়ে মোটা গুঁড়ির মহুল গাছটায় পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ালেন। নিশিন্দা আর পুটুস গাছে মিলেমিশে একটা একটা দুর্ভেদ্য ঝোপ তৈরি করেছে ঢালের শেষপ্রান্তে। তার আড়ালে উবু হয়ে শুয়ে পড়ে বেন্দা এক বার পিছনপানে তাকায়। ক্ষীণ আশা, যদি পলায়মান দলটা ফিরে আসে সাহেবের কথা চিন্তা করে। কোথায় কী! পুরো রেডপার্টি তখনও লাইন ধরে ছুটে চলেছে পিছন দিকে না তাকিয়ে। তাদের লিড করছে মাথায় লাল জয়ধজা-বাঁধা লম্বোদর আর লাইনের শেষে দু’টো বাইক নিয়ে তিন বিটবাবু!
হঠাৎ পাকদণ্ডী বেয়ে জনাতিনেক ছেলে ওই ভিড়টার দিকে এগিয়ে যায়। বেন্দা লক্ষ করে, ভিজে কাপড় বদলে মেয়ে চারজনও ভিড়ে শামিল হয়। জনতা বিকট একটা চিৎকার করে ওঠে। বেন্দা আন্দাজ করে, আওয়াজটা নরহত্যার পূর্বাভাস। বেশ কয়েকটা ফারসা আর টাঙি ভিড়ের মাথা ছাড়িয়ে আন্দোলিত হতে থাকে। শোয়া অবস্থাতেই দু’হাতের ফাঁকে মাথাটা গুঁজে দেয় ও। স্যরের এই পরিণতি ও আশা করেনি দুঃস্বপ্নেও। কোথাকার মানুষ কোথায় এসে মরছে! তাও এমন নির্মম মৃত্যু! শ্রাবণকাকা তবুও দু’টুকরো হয়েছিল একটামাত্র লোকের হাতে, এখানে তো অন্তত পঞ্চাশ জন আততায়ী, প্রত্যেকে সশস্ত্র এবং খুন করতে উদ্গ্রীব!
আর-এক বার মাথাটা একটু তোলে বেন্দা। গোটা শরীর থরথর কাঁপছে। চাইলেও উঠে দাঁড়াতে পারবে না। টানা চিৎকার তো চলছিলই, এ বার এক জনের গলা সব আওয়াজকে ছাপিয়ে ওঠে।
‘‘শালোর ব্যাট্যা শালো, ইখ্যানেই লুচ্চা গার্ডকে কেট্যে সাত বচ্ছর ঘানি ঘুঁরাইচিঁ, ইবার সায়েব মরাঁই চোদ্দো বচ্ছরের লেগ্যে...’’ ভিড়টা দু’ভাগ হয়ে যায় আর লম্বা একটা লোকের দু’হাত ধরে চার জনে মিলে টেনে বাইরে নিয়ে আসে। লোকটার হাত থেকে হাততিনেক লম্বা একটা ফারসা টেনে ওরা মাটিতে ফেলে দেয়। বেন্দা এত দূর থেকে বুঝতে পারে না ওতে রক্ত লেগে আছে কি না... স্যরের রক্ত! এ বার টলতে টলতে ঢ্যাঙা লোকটা ঘুরে দাঁড়ায়, বোঝাই যায় আকণ্ঠ নেশা করেছে। বেন্দা এ বার পরিষ্কার দেখতে পায়, লোকটার কপালের মাঝ বরাবর একটা বেশ বড় মাপের আব! ওর মাথা আবার ঘুরে ওঠে। স্যর মরার জন্যে ছটফট করছিলেন খুব, তাঁর আশা পূরণ হয়েছে এত দিনে এখানে। লোকগুলো এ বার ওকেও দেখতে পাবে আর ওঁর মতো করেই টুকরো-টুকরো করে কাটবে। নিয়তির হাতে নিজেকে ছেড়ে ও সাময়িক ভাবে জ্ঞান হারায়।
কত ক্ষণ অজ্ঞান ছিল জানে না, তবে যখন হুঁশ ফেরে তখন সুয্যিদেব ডুবু-ডুবু। ডুংরির উপরে তবু আবছা দেখা যাচ্ছে, কিন্তু নীচের সমতলে অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। ও বোঝার চেষ্টা করে ব্যাপারটা কোন অবস্থায় আছে। নিজে বেঁচে আছে সেটা তো পরিষ্কার বুঝছে, কিন্তু স্যরের কী হাল? সামনের ফাঁকা ময়দানটায় বেশির ভাগ লোক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে আছে, কেন না হাঁড়িয়ার প্রভাবে ওদের দাঁড়ানোর ক্ষমতাই নেই। মহুল গাছটার নীচে দাঁড়িয়ে আছে সেই ছেলে তিনটে। ওদের দেখলেই এমসিসি বলে বোঝা যায়, কেন না ওদের পোশাক আর চেহারা বসতির আদিবাসীদের সঙ্গে মিলছে না। আর ওদের সামনে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে যে লম্বা লোকটা কথা বলছে... জয়গুরু!
স্যর তো বহাল তবিয়তে ওদের কী সব বুঝিয়ে চলেছে। যাকগে, খুনেটা তা হলে ওঁকে কোপানোর সুযোগ পায়নি। ওদের সঙ্গে কথা শেষ করে স্যর ওর ঝোপের দিকেই আসছেন। মাঝখানে সেই জেলখাটা খুনেটা রাস্তা আটকাল।
এই টেনশন আর সহ্য হচ্ছে না বেন্দার। এই স্যরের মরব-মরব অবস্থা হচ্ছে, আবার এই বাঁচব-বাঁচব! আরে বাবা, যা হওয়ার একচোটে হয়ে যা! স্যর প্রায় ছ’ফুট লম্বা, লোকটার মাথা স্যরকে ছাড়িয়েও বেশ খানিকটা। আড়ালে পড়ে গিয়েছে বলে ওর হাতের অস্ত্রটা দেখা যাচ্ছে না, তবে কোপটা মারল বলে! কিন্তু ওকে আর এক বার অবাক করে লোকটা নিচু হয়ে কী যেন করল আর স্যর ওর দু’কাঁধে দু’হাত রেখে কিছু একটা বললেন। তার পর ঝোপটার কাছে এসে চাপা গলায় বললেন, ‘‘চলো হে বৃন্দাবন, যেমন শুয়ে আছ ওই ভাবেই বুকে হেঁটে ডাউনে ঝোরার দিকে খানিকটা নেমে যাও। অনেক কষ্টে ওদেরকে বুঝিয়েছি। তবে মাতাল আর গোঁয়ারদের তো বিশ্বাস নেই! তোমায় দেখলে নিভে যাওয়া আগুনটা আবার জ্বলে উঠতে পারে।’’
বেন্দা আর কিছু জানতে চায় না, অনেক কিছু জানা হয়ে গিয়েছে ওর। বিশেষ করে এই পাগল লোকটার সংস্পর্শে থাকলে এক দিন বেঘোরে মারা যাবে, সেটাও বুঝে গিয়েছে হাড়ে হাড়ে। তবে এই মানুষটাই নিজের জীবন বিপন্ন করে সাপের কামড় থেকে ওকে বাঁচিয়েছে, সেই কথাটাই ও যে ভুলতে পারছে না। বেশ খানিকটা গড়িয়ে-হড়কে নামার পর ও একটা পায়ে-চলা সরু রাস্তা খুঁজে পায়। স্যরও ওই পথ ধরে আসছেন। বললেন, ‘‘দেখো দেখি, মানুষের জীবনের মায়া কত দূর পর্যন্ত নিয়ে যায়! তির-সড়কির হাত থেকে বাঁচতে আমার বীরপুঙ্গব বিট অফিসাররা জীবনের কেমন ঝুঁকি নিয়েছিল এই ঢালু রাস্তায় বাইক চালাতে গিয়ে... ঘাড় ভেঙে মারাও যেতে পারত! রাস্তাটা দিয়ে এখানকার মেয়ে-পুরুষেরা ঝোরাতে স্নান ইত্যাদি কাজকর্ম করতে যাতায়াত করে। এতে পায়ে-হেঁটে ওঠানামা করা যায়, তা বলে ফুল স্পিডে বাইক চালানো? এরা কি আগে ‘মওত কী কুয়াঁ’-তে বাইক চালাত না কি?’’
বেন্দা এ দিক-ও দিক সাহায্যের প্রত্যাশায় তাকাচ্ছিল। অনেক দূরে পিচ রাস্তার শেষ প্রান্তে হঠাৎ দু’টো গাড়ির জোড়া হেডলাইট আর সাত-আটটা বাইকের সিঙ্গল হেডলাইট চোখে পড়ল ওর। দৃষ্টি আকর্ষণ করতে স্যর বলেন, ‘‘এই সেরেছে! স্টাফেরা পুলিশ নিয়ে আসছে আমাদের লাশ রিকভারি করতে। আমার সঙ্গে তুমিও তো মিসিং! এ বার দৌড়ে যাও বৃন্দাবন, টোলায় ঢোকার আগেই ওদের আটকাতে হবে, না হলে অনর্থক রক্তারক্তি-প্রাণহানি শুরু হবে, যা এত ক্ষণ আটকানোর চেষ্টা করে এলাম। দৌড় শুরু করো এ বার।’’
হ্যাঁ, দৌড়েছিল বটে সে দিন বেন্দা। যাকে বলে মনের আনন্দে দৌড়নো। একে তো পৈতৃক প্রাণ রক্ষা পেয়ে গেল একটুর জন্যে, উপরন্তু স্যরও বেঁচে গেল এ যাত্রা! স্যর ওর চোখের সামনে খুন হলে বাকি জীবনটা ও আর শান্তিতে ঘুমোতে পারত না। কাকার ঘটনাটাই ওর মনের খুঁটিটা নড়বড়ে করে দিয়ে গিয়েছে।
ক্রমশ