ধারাবাহিক উপন্যাস, পর্ব ৫

পরিক্রমণ

মনে মনে অনেক হিসেব কষে দেখেছে সে। তিন চার লাখ টাকা বিলাসের পিছনে খরচা হলে তবে গিয়ে বাকি তিরিশ চল্লিশ লাখের বখরা জুটবে ওর কপালে।

Advertisement

রাজশ্রী বসু অধিকারী

শেষ আপডেট: ২৪ মার্চ ২০১৯ ০০:০০
Share:

ছবি: রৌদ্র মিত্র

পূর্বানুবৃত্তি: পিয়ার হাতের ব্যথার খোঁজ করতে গিয়ে সুমন ও রাকা বুঝতে পারে, পিয়া এক মোবাইল গেমের শিকার হয়েছে। যা শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাবে মৃত্যুতে। সুমন আত্মবিশ্লেষণ করে বারবার। কোথায় ভুল হয়েছে তার। আর হয়তো সেই জন্য রাকার কাছে এক দিনের জন্য থাকতে বলে পিয়াকে। রাকা আনন্দে আত্মহারা!

Advertisement

“লে! আমি আবার কী বাজে বললাম?” হাত ওল্টায় বিল্ব।

“আবার ওই ভাবে কথা বলছিস ওর সামনে?’’

Advertisement

“লে! আবার কি করলাম?’’

“উফফ! পারব না তোকে নিয়ে আমি...’’

পিয়া হঠাৎ বিল্বকে অনুকরণ করে হাত উল্টে ঘাড় বেঁকিয়ে বলে, “লে! আমার ডক্টর বাপিকে বলছে বাউল... কিচ্ছু জানে না মামা ...’’

“হল তো? হল এই বার? এই জন্যই বলছিলাম। সুমন আমাকে বলেছিল, শি’জ আ কপিক্যাট। আর শুধু ও কেন, সব বাচ্চারাই তাই। খুব সাবধানে কথা বলতে হয় ওদের সামনে, বুঝলি?’’

এ বার মামা-ভাগ্নি একসঙ্গে হাত উল্টে ঘাড় বেঁকিয়ে বলে, “লে!...”

হোহো করে হেসে ফেলে হঠাৎ থেমে যায় রাকা। নিজের হাসি ওর নিজের কানেই কেমন অদ্ভুত শোনায়। কোথায় ছিল ওর এই হাসি? আজ কত দিন পরে ও এমন প্রাণ খুলে হাসল?

যদি চিরদিনের জন্য এই হাসির উৎসটাকে বুকের কাছে আগলে রেখে দিতে পারত? প্রশ্ন এসে ঢেউ তোলে মনের গভীরে। পাশে তখন মামা-ভাগ্নির ফিসফিস কথা চলছে।

“দেখেছিস, আমার দিদিকে হাসলে কী সুন্দর দেখায়?” বিল্ব বলে।

“ইয়েস... শি’জ বিউটিফুল...’’ পিয়ার সুচিন্তিত মতামত।

তার পর একটু থেমে বলে, “আমার বাপিও খুব সুন্দর, কিন্ত বাপি হাসে না।’’ রাকা জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়েছিল, যেন পিয়ার চোখে চোখ না পড়ে যায়। আজ যে কেন বারবার চোখদুটো অবাধ্যতায় ভিজতে চাইছে! কান তো ফেরানো যায় না স্বল্প পরিসর থেকে। তাই সেখানে এসে পৌঁছে যায় প্রশ্ন, “আচ্ছা... আমি কার মতো হয়েছি গো?’’

আর বাইরে মন রেখে বসে থাকা যায় না। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে কানের কাছে মুখ রেখে রাকা বলে, “তুমি আমাদের দু’জনেরই মতো হয়েছ সোনা। আমরা দু’জন মিলেই তোমাকে বানিয়েছি।’’

“তা হলে দু’জন মিলেই বড় করছ না কেন?’’ আট বছরের পিয়া ছুড়ে দেয় জটিল প্রশ্ন।

লোহার গেট দিয়ে ঢুকে দু’পাশে সবুজ লনের বুক চেরা চওড়া লাল মোজ়েইক টালি বসানো রাস্তা। সোজা গিয়ে শেষ হয়েছে ওল্টানো একটা কাচের বাটির মতো ঝাঁ-চকচকে রিসেপশনে। চার হাজার স্কোয়্যার ফুট এরিয়া জুড়ে হরেক আয়োজন। এখানে ফোয়ারা, ওখানে ঝাউ গাছ, সেখানে জলের ফিল্টার। কত উন্নত আধুনিক সুসংবদ্ধ উপায়ে মানুষকে রোগ মুক্ত করে তোলা যায়, তারই রাশি রাশি উদাহরণ পাওয়া যাবে এখানে। শুশ্রূষা সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে এলে এক বার অন্তত মনে হতেই পারে, এমন জায়গায় মরেও সুখ। অন্তত মালদার গজাননপুর থেকে আসা বিলাস পালের তো তাই মনে হচ্ছে। রিসেপশনের গদি আঁটা চেয়ারে বসে সেন্ট্রাল এসির হাওয়ায় কেঁপে কেঁপে উঠেও মন একটুও বিরক্ত হচ্ছে না। ঠান্ডা হাওয়াটা মিনিমাগনার, তাই গায়ে চাদরটা ভাল করে জড়িয়ে নিয়ে রীতিমতো এনজয় করছে বিলাস পাল। আর খামোখা গুচ্ছের টাকা নষ্ট হল বলে পর্যন্ত সারাক্ষণ গালি দিয়েছে যে বৌকে, এখন বসে বসে তাকেই মনে মনে সুখ্যাতি করছে। সত্যি, বনানীরানি না থাকলে এমন একখানা রাজকীয় চিকিৎসা হতই না বিলাস পালের। দ্বিতীয় পক্ষের বৌকে নিয়ে বিলাসের মনে ভয় ছিল। ভেবেছিল সে হয়তো ঠিক মতো চিকিৎসা হতেই দেবে না, হয়তো ঘরে শুইয়েই মেরে ফেলবে তরতাজা মানুষটাকে। সেই সব কথা মনে পড়লে এখন নিজের কাছেই লজ্জা লাগছে। যতই ছমকছল্লু হাবভাব থাকুক না কেন, আদতে বনানীরানি ভাল মেয়ে, এ কথা এখন বিলাস স্বীকার করবে। বিলাসকে এত দূর টেনে আনা বনানীর সাধ্য ছিল না। কিন্তু সে হাল ছাড়েনি। বাপের বাড়ির পাড়া থেকে কোন মাসতুতো ভাই অমলকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে সঙ্গে এনেছে। নইলে বিলাস এত দামি জায়গায় আসত! সে ওর পয়সা যতই থাক। অনামী গজাননপুরের হাতুড়ে ডাক্তারের ওষুধ খেয়ে পড়ে থেকে থেকে এক সময় টেঁসে যেত। এখানে এসে এত সুন্দর পরিবেশে শরীর জুড়নো ঠান্ডা হাওয়ায় গদিওলা সোফায় বসে আবার বেঁচে ওঠার সাধ হচ্ছে তার। আশাও জাগছে মনে।

বিলাস চার দিকটা জুলজুল করে দেখছিল আর নানা কথা ভাবছিল। বনানী আর অমল ওকে সকালে এই খানে বসিয়ে দিয়ে কে জানে কোথায় গিয়েছে। চার দিকে সব এক রকম আকাশি সিল্কের শাড়ি পরা কুড়ি বাইশ পঁচিশের মেয়েরা ঘুরে ফিরে নানা রকম কাজ করচ্ছে। তাদেরই এক জন এসে দাঁড়ায় বিলাসের সামনে।

“এক্সকিউজ় মি, এই ফর্মটা ফিল আপ করে দিন। আর টাকাটা আমাদের ক্যাশ কাউন্টারে জমা দিতে হবে।’’

বিলাস হাত বাড়িয়ে ধরে কাগজটা। “কত টাকা?”

“ওতে সব লেখা আছে”, মিষ্টি হাসে মেয়েটা। “আপাতত টোয়েন্টি ফোর থাউজ়েন্ড ডিপোজ়িট করলেই হবে। জাস্ট ফর অ্যাডমিশন। আপনি জমা দেওয়ার ব্যবস্থা করুন, আমি আসছি।’’ আবারও এক মুখ মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে চলে যায় মেয়েটি। আর বিছের কামড় খাওয়া মুখ নিয়ে বুকে হাত চেপে বসে থাকে বিলাস। এই হাসপাতালের যা ঠাটঠমক তাতে খরচ বেশি হবে তা জানাই ছিল, কিন্তু ভর্তি হতেই এতো টাকা লাগবে তা ভাবা যায়নি। গোলদারি ব্যবসা, ট্রাকে করে মাল আনা নেওয়ার কারবার আর লটারির টিকিট বিক্রি করে ভালই টাকা জমিয়েছে বিলাস। তা ছাড়া আর একটা বেআইনি কারবার আছে ওর। বাংলাদেশের বর্ডার দিয়ে গরু পাচার। আজকাল অবশ্য খুবই কড়াকড়ি। তা ছাড়া এ লাইনেও প্রতিযোগিতা কম নয়। তবে হাল ছাড়েনি বিলাস। এই ব্যবসায় বহু দিন জড়িয়ে আছে তলায় তলায়। তাই টাকাপয়সাও অঢেল করতে পেরেছে। কিন্তু সে যত টাকাই থাকুক, এ ভাবে হরির লুঠ দিতে গেলে বুকে লাগে বইকি। শুনেছিল এই হাসপাতালে খরচ অনেকটাই বেশি। তাই বলে ভর্তি হতেই চব্বিশ হাজার! নরম সোফায় ঠান্ডার মধ্যে বসেও যেন কুলকুল করে ঘাম বইতে থাকে ওর। একটু আগের মিষ্টি-মিষ্টি আমেজটা আর পাওয়া যাচ্ছে না যেন।

“কই দেখি কিসের ফরোম দিয়েছে...” বনানী সামনে দাঁড়িয়ে হাত বাড়ায়। সে বাইরের ক্যান্টিনে গিয়েছিল। সেখান থেকে ফিরে সোজা অ্যাডমিশন অফিস হয়ে খবর নিয়েই ফিরেছে। ফর্মটা হাতে নিয়ে সে বলে, “অমলদা এটা ভত্তি কর দিকি। তাতাড়ি কর। অনেক্ষণ দে গ্যাছে।’’

বনানীর বিদ্যে ক্লাস ফোর অবধি। সে জানে শহরে আসলে এক জন লেখাপড়া জানা মানুষ দরকার। তাই খুঁজে পেতে তুতোভাই অমলকে সঙ্গে এনেছে। অমল বহুকাল আগে মালদার কলেজ থেকে বিএ পাশ করেছিল। তার পর চাকরি না পেয়ে এক জনের দোকানে খাতা লেখে। সেই সঙ্গে পাড়ার লোকজনদের উপকার করে। তাই বনানী বলতেই এক কথায় চলেও এসেছে। বিনি পয়সায় কলকাতা ঘোরার সুযোগ ছাড়তে চায়নি। বনানীর পাশে পাশে থাকতে পাওয়াটুকু ব্র্যাকেটে!

অমল গম্ভীর হয়ে ফর্ম ফিল আপ শুরু করে। বনানী বিলাসের পাশের সোফায় বসে ব্যাগ থেকে টাকার পুঁটুলি বার করে। যখন টাকা বার করে নিয়ে ব্যাগ বন্ধ করছে, বিলাস এক বার ককিয়ে ওঠা গলায় বাধা দেয়। “কী কচ্চো বনো, এতগুলান টাকা ইভাবে জলে ফেইলতেচো... মালদার হাসপাতালে ফিরে যাই চলো।’’

“হ্যাঁ... তা আর নয়... যাব বুলেই তো এলম কিনা! টাকা টাকা করোনি। টাকা নে কি স্বগগে যাবে? মানুষ বাঁচলে তবে টাকা...’’ ঝাঁঝিয়ে উঠে দাঁড়ায় বনানী। অমলের হাতে ধরিয়ে দেয় টাকার গোছা।

“নাও... ভত্তি করে দে আসো... টাকা জমা পইরবে তবে গে চিকিচ্ছে শুরু হবে, যেখানকার যে ব্যবস্থা।’’

অমলেরও গা যে কচকচ করে না তা নয়। কিন্তু মনে মনে অনেক হিসেব কষে দেখেছে সে। তিন চার লাখ টাকা বিলাসের পিছনে খরচা হলে তবে গিয়ে বাকি তিরিশ চল্লিশ লাখের বখরা জুটবে ওর কপালে। অবশ্য সব হিসাবই যে মিলবে এমন কথা নেই। কথায় বলে না আঁচালে বিশ্বাস নেই। বনানীর ভাবগতিক দেখে ঠিক মতো বোঝা যাচ্ছে না ওর ঢল কোন দিকে। মাঝে মাঝে এমন বিলাস বিলাস করছে যে অমল চিন্তায় পড়ে যাচ্ছে। সে যাই হোক, পরে দেখা যাবে। আপাতত শুধু ওয়েট অ্যান্ড ওয়াচ নীতি ফলো করে যেতে হবে। শেষে গিয়ে কিছু যদি না-ই হয়, অমলের খাতা লেখার চাকরিটা তো আছেই। সেই সঙ্গে এতগুলো দিন এদের সঙ্গে থাকার জন্য পারিশ্রমিক হিসেবেও কি আর কিছু না দিয়েই খালিহাতেই ফেরাবে বিলাসবুড়ো? আর বাকি যা কিছু তা অমলের হাতযশ। কিন্তু এখন থেকেই অত ভাববার দরকারটাই বা কী পড়ল? অমলের একটা সুবিধা আছে। সে জল বাতাসা খেয়েও দিন কাটাতে পারে, আবার রাজভোগ পেলেও ছেড়ে কথা বলে না। এই গ্রহণ করার গুণটাই হয়তো ওকে এক দিন বড় মানুষ করে তুলবে। মনে মনে ভাগ্যের ওপরে সবটা ছেড়ে পায়ে পায়ে ক্যাশ কাউন্টারের দিকে এগোয় অমল। ওর গম্ভীর মুখ দেখে ভগবানও আন্দাজ করতে পারবেন না ভিতরে ভিতরে সারাক্ষণ কত হিসাবের কাটাকুটি খেলা চলছে।

বনানীর ধমক খেয়ে চুপ করে গিয়েছিল বিলাস। কিছু ক্ষণ পরে তার সামনে হুইলচেয়ার নিয়ে এসে দাঁড়ায় খয়েরি জামা পড়া এক মোটা মহিলা। “আসুন স্যর... এ বার যেতে হবে।’’

“কোথায় যাব?’’ অবাক গলায় প্রশ্ন করে বিলাস।

“ওয়ার্ডে স্যর। আপনার অ্যাডমিশন হয়ে গিয়েছে। থার্ড ফ্লোর। বেড নম্বর ফিফটি টু।’’

বনানী উঠে দাঁড়ায়। তার মানে অমল টাকা জমা দিয়ে দিয়েছে। বিলাসকে ঠেলা মারে, “ওঠো... ওঠো, একো একোটা মিনিট একো একোটা টাকা।’’

“বটেই তো! আর সেই টাকা তুমি জলের মতো ছড়াচ্চো বনো!” দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বিলাস।

ক্রমশ

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement