ছবি: রৌদ্র মিত্র
পূর্বানুবৃত্তি: ছেলের স্কুলে অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলার জন্য বিচ্ছিরি ভাবে অরুণকে কথা শোনায় তাঁর স্ত্রী বিপাশা। এ দিকে ডাক্তার সুমন সেন কোর্টে এসেছে মেয়ে পিয়াকে নিয়ে। স্ত্রী রাকার সঙ্গে বিচ্ছেদের পরে পিয়া তার কাছেই থাকে। রাকা আইনের পথে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে পিয়াকে কাছে পাওয়ার জন্য।
পিয়া কোন উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকে। হাতটা ধরে রাকা সামান্য টানতে চায় নিজের দিকে। বোধহয় বেকায়দায় ডান হাতের কনুইয়ের কাছটায় চাপ লেগে গিয়েছিল, চেঁচিয়ে ওঠে পিয়া।
চমকে ওঠে বিবাদমান বাবা-মা দু’জনেই। সুমন ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে, “কী রে? কী হয়েছে? লাগল কী করে?” পিয়া হাতটা গুটিয়ে নিয়েছে তত ক্ষণে। মুখে কোনও কথা নেই। রাকা ঝাঁপিয়ে পড়ে।
“দেখি কী হয়েছে ওখানটায়... লাগল কেন?”
থ্রি-কোয়ার্টার ঝুলের বাহারি লেসের ফ্রিল বসানো হাতাটা দিয়ে ঢাকা পড়ে ছিল কনুইয়ের ওপরটা। নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে সরে দাঁড়াতে চায় পিয়া। মুখে কোনও কথা নেই। কিন্তু তত ক্ষণে রাকা জামার হাতা সরিয়ে ফেলেছে। ফর্সা নরম হাতটায় গোল হয়ে ফুলে আছে জমাট বাঁধা রক্তের কালচে দাগ। বিচ্ছিরি ভাবে ফুলে আছে জায়গাটা।
“এ কী! কী করে হল?’’ আঁতকে ওঠে রাকা। বাইরে থেকে দেখে কিচ্ছু বোঝা যাচ্ছে না। মেয়েটা ভিতরে এ রকম একটা ব্যথা নিয়ে ঘুরছে! সুমনও বিচলিত।
“কী ভাবে হল বল? কখন লাগল এতটা?’’
পিয়া চুপ। মুখ গোঁজ করে দাঁড়িয়ে থাকে। রাকা মেয়েকে কোলের কাছে টেনে আনে। “চুপ করে থাকিস না পিয়া। কী করে হল বল। পিসি, ঠাকুমা কেউ জানে? কাউকে বলেছিলি? বাবাকেই বা বলিসনি কেন? ওষুধ দিতে হবে তো...”
অনেক ক্ষণ চুপ করে থেকে মাথা নাড়ায় পিয়া। কেউ জানে না। কাউকে দেখায়নি, বলেওনি। কাউকে বলার বা দেখানোর কথা নয় তো। যত ব্যথা পাবে সব একা একা নিজেকেই এনজয় করতে হবে। কাউকে বললে চলবে না। এই খেলার এটাই তো নিয়ম। মিষ্টির প্যাকেটে যে মোটা গার্ডার দেওয়া থাকে তাই দিয়ে একটা দু’টো তিনটে প্যাঁচ, আরও আরও অনেকগুলো প্যাঁচ দিয়ে রেখে দিয়েছিল হাতে দু’দিন ধরে। তার পর যখন খুলল, এই রকম দাগ হয়েছে। প্রচণ্ড ব্যথা। কিন্তু তাও আবার করবে। এটাই তো চ্যালেঞ্জ। যত দিন যাবে, খেলার নিয়ম তত কঠিন হবে।
সহ্য করতে পারে না রাকা। শিউরে ওঠা মুখ থেকে দু’টো শব্দ ছিটকে আসে, “সর্বনাশ!”
তার পরই মেয়েকে বুকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে, “আর কখনও এ সব খেলা খেলবি না... কোনও দিনও না... বল আমাকে... কথা দে... এগুলো খুব খারাপ সোনা...খুব খারাপ!”
সুমন পাথরের মতো দাঁড়িয়ে ছিল। ওর অহঙ্কারের প্রাচীরে বড় বড় ফাটল দেখা দিয়েছে। এ রকম যে হতে পারে তা ডাক্তার সুমন সেনের জ্ঞান বুদ্ধি চেতনার বাইরে। ওর ধারণা ছিল, বাড়িতে ছোট বোন রঞ্জনা আর মায়ের কাছে আনন্দেই থাকে মেয়ে। বোন নিজের কলেজ শেষ করে বাড়িতে এসে ওঠার পর থেকে তো পিয়ার সঙ্গেই বেশি সময় কাটায় বলে সুমনের ধারণা ছিল। আর সে জন্যই আরও বেশি করে ডুবে গিয়েছে নিজের জগতে। মেদিনীপুর শুধু তো নয়, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, তমলুক ঝাড়গ্রাম, আশেপাশের সমস্ত জায়গায়, এমনকি জামশেদপুর রাঁচি পর্যন্ত লোকে ইউরোলজিস্ট বলতে এক ডাকে সুমন সেনকে চেনে, এটা তো এমনি এমনি হয়নি। দিনরাত জল করা সাধনা রয়েছে আজকের এই প্রতিষ্ঠার পিছনে। এখানে পৌঁছানোর জন্য জীবনে অনেক কিছু হারাতেও তো হয়েছে সুমনকে। কিন্তু সে তো অন্য ইতিহাস। কিন্তু তাই বলে মেয়ের ব্যাপারে তো কোনও কম্প্রোমাইজ় কখনও করেনি সুমন। স্রোতের মতো উপার্জন তো ওই মেয়েরই জন্য। পিয়ার জীবন যাতে সুন্দর হয় সেই রাজপথটাও তো ওকেই তৈরি রাখতে হবে। এত কিছু বোঝার বয়স মেয়ের হয়নি। কিন্তু এক দিন তো বুঝবে যে, বাবার জীবনে ওর কতটা গভীর স্থান। যার জন্য এত কিছু, সেই মেয়ে কেন এই সর্বনাশা খেলার ভয়ঙ্কর বৃত্তে ঢুকবে? সুমন যেটুকু জানে, মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত বিধ্বস্ত মানুষেরাই এই রকম খেলার মাধ্যমে শান্তি সন্ধান করে, যার অন্তিম পরিণতি মৃত্যু! কিন্তু পিয়ার মতো একটা সুন্দর ফুটফুটে বাচ্চা কেন এই আগুনে ঝাঁপ দেবে? আর ঘটনাচক্রে যদি তাই হয়, তবে বাবা হিসেবে সুমন কী করে তার দায়ভার অস্বীকার করবে? তবে কি একের পর এক সমস্ত পদক্ষেপই ভুল নিয়ে ফেলেছে সুমন? তা হলে কি প্রথম থেকে আরও এক বার পাতা উল্টে দেখা দরকার?
নিজের মনের ভিতরের উথালপাথাল হয়ে ওঠা ঢেউগুলোকে জোর করে চেপে রেখে স্বাভাবিক থাকতে চায় সুমন। রাকা পিয়ার থেকে আলাদা থাকে, তবু এই মুহূর্তে ওকে দেখে সেটা একটুও বোঝা যাচ্ছে না। কেমন সুন্দর আর পাঁচ জন মায়ের মতোই পিয়াকে কোলের কাছে বসিয়ে খাইয়ে দিচ্ছে চকোলেট। একটু পাশে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে দেখতে থাকে সুমন। পিয়াও খুব বেশি কথা না বলে খেয়ে নিচ্ছে। তবে কি আমি সেই ছ’বছর আগে ভুল করেছিলাম? পিয়া কি ওর মায়ের সঙ্গেই বেশি ভাল থাকত? আমার কি রাকার হাতেই দিয়ে দেওয়া উচিত ছিল মেয়েকে? নিজেদের মধ্যে অগণিত দিন মাস বৎসরব্যাপী যে যুদ্ধ, তারই কি ফল পিয়ার হাতের জমাট বাঁধা রক্ত? প্রশ্নগুলো স্থির থাকতে দেয় না সুমনকে। রঞ্জনা আর মাকে নিয়ে গাড়িটা গিয়েছে কালীঘাটের মন্দিরে। ওরা ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করতেও মন চায় না। এত ক্ষণ পরে হঠাৎ জানতে ইচ্ছে হয়, পিয়া কী বলল বিচারকের কাছে। বাবা না কি মা? কার কাছে থাকতে চায় সে? জানতে ইচ্ছে হয়, কিন্তু জিজ্ঞেস করতে বাধে। এ কথা রাকার সামনে জানতে চাওয়ার অর্থ নিজেকে ছোট করা। বাবাকেই চাইবে, এটাই তো স্বাভাবিক, এটাই পিয়ার পক্ষেও মঙ্গলজনক। জানে সুমন। নিজের বিবেচনা দিয়ে জানে। কিন্তু এতখানি জানার পরেও একটা ছোট্ট সংশয়ের কাঁটা থেকেই যাচ্ছে যেন কোথাও। সেই কাঁটা কি পিয়ার হাতের ব্যথাটার মধ্যে, না কি রাকার হাত থেকে শান্ত হয়ে চকোলেট খাওয়ার দৃশ্যের মধ্যে? ঠিক বুঝতে পারে না সুমন। আর না বুঝতে পেরে একটা সম্পূর্ণ অন্য প্রশ্ন করে ফেলে তার প্রাক্তন বৌকে, “বলছিলাম, আজকের দিনটা কি তুমি পিয়াকে তোমার কাছে রাখতে চাও?’’
অবাক হয়ে তাকায় রাকা। এমন একটা প্রশ্নের কী উত্তর দেবে ভেবে পায় না। পিয়াকে তো সব দিন, সারা ক্ষণ, সমস্ত সময় নিজের সঙ্গে রাখতে চায় ও। কিন্তু সেই চাওয়ার কী দাম আছে এই অহঙ্কারী কেরিয়ারসর্বস্ব পুরুষের কাছে! এখন তো কোর্টের অর্ডারে মাসে দুটো দিন মাত্র মেয়েকে কাছে পায় রাকা। তার বেশি চাইলে অপমান ছাড়া আর কী জুটবে! কোনও উত্তর না দিয়ে চুপ করে সুমনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে ও।
“আজ তুমি চাইলে ওকে নিয়ে যাও তোমার কাছে। আমার পরশু একটা কনফারেন্স আছে টাওয়ার হোটেলে। ওটা সেরে নিয়ে যাব। কী রে? যাবি তো মায়ের সঙ্গে?’’
শেষের প্রশ্নটা মেয়েকে। রাকা এবং সুমন দু’জনেই অবাক হয়েই লক্ষ করে, পিয়া এক কথায় ঘাড় নেড়ে রাকার পিঠে মুখ গুঁজে বসল। বেশি কথা বলে না মেয়ে এমনিতেই। কিন্তু ওর বডি ল্যাঙ্গোয়েজে এমন একটা কিছু আছে যার থেকে ভিতরের সানন্দ সম্মতিটা বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না কারওই। রাকার হাঁ হওয়া মুখটার দিকে তাকিয়ে অনেক দিন পর সুমন বলে ফেলে “মুখটা বন্ধ করো। ভেসে বেরোনো জার্মসগুলো পেটে ঢুকে যাবে।’’
বিল্ব বোধহয় পিছনে দাঁড়িয়ে সব শুনেছে। চটপট একটা ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে ফেলে। কে জানে এক্স জামাইবাবুর যদি আবার মুড পাল্টে যায়! তার আগেই কোর্ট চত্বর থেকে সরে পড়া ভাল। একটা মাত্র ভাগ্নি হিসেবে পিয়ার উপর খুবই টান বিল্বর। এই সব মামলার চক্করে পড়ে বেচারি বাচ্চাটাকে খুব মিস করে। প্রতিটা ডেটে দিদির সঙ্গে নিজে যায় পিয়াকে আনতে। কিন্তু সে তো মাত্র দু’দিনের জন্য। আর আজকেরটা পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনা। খুব খুশি হয়ে তড়িঘড়ি পিয়াকে নিয়ে ট্যাক্সিতে চেপে বসে। রাকা ঠিক কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। সুমনকে কি থ্যাঙ্কস দেবে? নাকি যা রাকার চিরদিনের প্রাপ্য সেই খুশি থেকে রাকাকে বঞ্চিত করে রাখার জন্য আরও বেশি করে অভিযোগ করবে? আর ওই ‘জার্মস ঢুকে যাবে’ সংলাপটা? ওটাও কি আবার ওকে টেনে টেনে নিয়ে গিয়ে থামবে পিছন পাতায়? সেই বাইশ বছরের মফস্সলের রাকা যখন হাঁ করে করে জীবনে প্রথম তাজমহল দেখেছে বরের হাত ধরে, তখন সদ্য ডাক্তার হওয়া সুমন বৌকে খেপিয়ে তুলত ওই কথা বলে। সেই বাক্যবন্ধ তো একই আছে, শুধু মানুষ দুটোর জীবনটাই পাল্টে গিয়েছে।
“দিদি, উঠে পড়,” তাড়া লাগায় বিল্ব। “আমরা চিড়িয়াখানা যাব... সাউথ সিটি যাব... গড়ের মাঠ... আরও কত কত সব যাব... দেরি হচ্ছে তো!”
মামার চিৎকার শুনে পিয়া হাসছে। মেয়েকে এক ঝলক দেখে সুমন বলে, “একটাই অসুবিধা, ওর জামাকাপড় তো কিছু...’’
মনে মনে হাসে রাকা। দু’দিন বাদ দিলেও তো মাসের আঠাশ দিন পরে থাকে। তবে আর কার জন্য রাকা শপিং মলগুলোয় ঘুরে বেড়ায়। ব্যাগ উজাড় করে যা কিছু কেনে তার কতটুকুই বা দু’দিনে দেওয়া হয়ে ওঠে! এই এত ক্ষণ পরে সুমনের দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে ঝকঝকে একখানা হাসি আনে ঠোঁটে, “সে তুমি ভেব না। আমার সব ব্যবস্থা আছে।’’
গাড়ি চলছিল রেস কোর্সের পাশ দিয়ে। খানিকটা গিয়ে পছন্দসই জায়গায় নামবে পিয়া। সে চিড়িয়াখানা নাকচ করে দিয়েছে। ওটা অনেকবার দেখা জায়গা। মামার সঙ্গে গড়ের মাঠে ওয়াকিং রেস দিতেই বেশি আগ্রহী। মেয়েটার বেশ অ্যাডাপ্টেবিলিটি আছে! ভাবে রাকা। কোর্টে এত ক্ষণ ওর মুখের এই গ্লোটাই ছিল না। এখন মামার সঙ্গে পুরো জমে গিয়েছে। পিয়ার ও পাশ থেকে মাথা উঁচু করে বিল্ব বলে, “কী ব্যাপার দিদি? এক্স জাম্বু আজ ঠিক ফর্মে নেই মনে হল? কেমন উদাসী বাউল মার্কা লুক দিচ্ছিল তোর দিকে?’’
“যাহ... তুই কী রে? একটা বাচ্চা মেয়ের সামনে বাজে বকছিস...’’