ছবি: বৈশালী সরকার
ভদ্রলোক চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, “বুঝতে পারলে না, তাই তো! তবে শোনো, গত এক সপ্তাহ যাবৎ সে ঘরে ফেরেনি। যাওয়ার আগে চাবিটা আমার কাছে দিয়ে গেছে, এইটেই একটা সারপ্রাইজ়িং ব্যাপার। আগেও সে এ রকম ভাবে নিরুদ্দেশ হয়েছে, তবে চাবি রেখে যায়নি কখনও। যে হেতু তার মালপত্র এখনও ওই ফ্ল্যাটেই আছে, তাই সে যে পাকাপাকি এখানকার পাট গুটিয়েছে এ কথাও বলা যায় না। তুমি কি বুঝতে পারছ ইয়ং লেডি? তবে কাজটা সে ঠিক করেনি। আমি একলা উইডোয়ার, তার উপর আমার একটা মায়া পড়ে গেছিল, প্লাস আমার কুকুরটা পর্যন্ত তার ভারী ন্যাওটা ছিল। উত্তীয় চলে যাওয়াতে সেও খুব ডিপ্রেসড হয়ে পড়েছে।”
মঞ্জীরার মনটা তেতো হয়ে গেল। কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে ছেলেটা! উত্তীয় কি পুরোপুরি উন্মাদ হয়ে গেল? কয়েক দিন বাদে যার বিয়ে, নতুন জীবন শুরু হতে চলেছে, তার কি এমন বোহেমিয়ান জীবন কাটানো সাজে!
মঞ্জীরা পিছন ফেরার উপক্রম করতেই হঠাৎ ঘরের ভিতর থেকে ছুটে এসেছে বাছুর সাইজ়ের ডালমেশিয়ান। ভদ্রলোক হাঁ হাঁ করে উঠলেন। এই কুকুর ফেরোশাস প্রকৃতির। গত মাসে গ্যাস ডেলিভারি বয়কে এমন ভয় দেখিয়েছিল যে,
সে বেচারা সিঁড়ি দিয়ে পা পিছলে পড়ে ভাল রকম জখম হয়েছে।
কিন্তু তিনি অবাক হয়ে দেখলেন, রোমিয়ো আগন্তুক মেয়েটির পায়ের কাছে বাধ্য শিশুর মতো বসে কুঁই কুঁই করে আনুগত্যের শব্দ করতে লাগল।
মঞ্জীরা বুঝল, আজন্মলালিত কুকুরের ভয়টা আশ্চর্য ভাবে কোথায় যেন মিলিয়ে গেছে। সে হাঁটু মুড়ে বসে পরম মমতায় রোমিয়োর পিঠে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল।
প্রিয় পুরুষের শরীরের মতো প্রিয় সময়েরও একটা নিজস্ব গন্ধ থাকে, চন্দনের বনে যে গন্ধে ছুটে যায় মাতাল সাপিনী। কোন ঘটনায় যে প্রিয় মুহূর্ত, প্রিয় স্মৃতি ফিরে ফিরে আসবে, তা কে-ই বা
বলতে পারে?
এই মুহূর্তে মঞ্জীরার মনে হচ্ছে সে দাঁড়িয়ে আছে উত্তীয়র ফ্ল্যাটে। কোমরে ভিজে টাওয়েল জড়ানো উত্তীয়র দুই বলিষ্ঠ হাতের বেড়ে বন্দি হয়ে আছে সে। পৌরুষ-পুরু দুই ঠোঁট যেন পিষে দিচ্ছে
তার অধরোষ্ঠ।
হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়েছে মঞ্জীরা। দ্রুত পায়ে প্রায় তরতরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করেছে সে।
ভদ্রলোক এক বার রোমিয়োকে, আর এক বার মঞ্জীরার চলে যাওয়ার দৃশ্যটা দেখলেন, তার পর প্রায় স্বগতোক্তির স্বরে বললেন, “স্ট্রেঞ্জ!”
সিঁড়ি বেয়ে ফ্ল্যাটের নীচে নেমে এসে হঠাৎই শ্লথ হয়ে গেল মঞ্জীরা। কাঁধের অফিসব্যাগটা যেন হঠাৎ ভারী লাগছে কত। এত বড় প্রাণবন্ত শহরে তার নিজেকে এক সম্পূর্ণ একলা মানুষ বলে মনে হচ্ছে। যে অনুভূতিকে এত দিন নিজের মধ্যে লুকিয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে, সেটাই যেন হঠাৎ দৈত্য হয়ে টুঁটি চেপে ধরেছে তার।
উত্তীয়র ফ্ল্যাটের চার পাশের এলাকা বেশ ফাঁকা ফাঁকা। এখনও নগরায়ণের করাল থাবা এসে পড়েনি এখানে। ইতিউতি জলা জমি, কোথাও কোথাও মাটির সরু পথ। সেই উঁচু-নিচু পথ দিয়ে কিছুটা এগিয়ে গেলে তবে বড় রাস্তায় ওঠা যায়।
ঝিঁঝিপোকারা গলা খুলে ডাকছে, মঞ্জীরাকে যেন আলো দেখিয়ে নিয়ে চলেছে জোনাকিদের দল।
সন্ধ্যার সেই সদ্যোজাত অন্ধকারে আরও জমাট আঁধার হয়ে পথ চলছে মঞ্জীরা। মন খারাপ থাকলে সেই মানুষটার কাছে সব খুলে বলা যেত, আনন্দের দিনে মজার কথা বলে হেসে কুটিপাটি হত মঞ্জীরা। মা চলে যাওয়ার পর প্রকৃত অর্থেই এমন এক আশ্রয়ের বড় প্রয়োজন ছিল তার। দূরে বড় রাস্তার গাড়ি চলাচলের আলোগুলোর দিকে তাকিয়ে ঠিক তখনই মঞ্জীরা আবিষ্কার করল, এই নিঝুম পথে সে আর একা নেই।
কে যেন হাত ধরেছে তার।
সচকিত হয়ে মঞ্জীরা বুঝল, তার হাত ধরেছে এক কিশোরী। ডিস্ট্রিক্ট লেভেল চারশো মিটারে সেই মেয়ের সিলভার মেডেল আছে। পরনে তার রানারের পোশাক। টেনে বাঁধা চুল, বিন্দুমাত্র লালিত্যের ছাপ নেই কোথাও, শুধু তার চোখদুটো এই আঁধারেও আশ্চর্য রকম উজ্জ্বল।
মেয়েটি নরম গলায় শুধোল, “তোমার কি মন খারাপ, মঞ্জীরা?”
“হ্যাঁ, ও চলে গেল। চলেই গেল!” উদ্ভ্রান্তের মতো ফিসফিস করল মঞ্জীরা।
“হ্যাঁ, মঞ্জীরা। সে আর কোথাও নেই। চলে গেছে। তুমিই তো তাকে তাড়িয়ে দিয়েছ মঞ্জীরা। তবু কি তাকে ভুলতে পারবে তুমি? যত বার উতল হাওয়া বইবে, যখন যখন এই পৃথিবীতে কেউ কাউকে ভালবাসবে, তত বার ডাহুক ডাকা নিঝুম দুপুরে তার কথা মনে পড়বে তোমার।”
“আমি ভুলতে চাই! পালিয়ে যেতে চাই! আর পারছি না আমি!” প্রায় আর্তনাদ করে ওঠে মঞ্জীরা।
খিলখিলিয়ে হেসে উঠল কিশোরী মঞ্জি, “পালানোর সব পথ বন্ধ হয়ে গেছে মঞ্জীরা। সবার কাছ থেকে পালানো যায়, গোটা পৃথিবীর কাছ থেকেও হয়তো লুকিয়ে থাকা যায়... নিজের কাছ থেকে কী করে পালাবে মঞ্জীরা? যাকে তাড়িয়ে দিয়েছ তার ভিতরেই যে নিজে আটকে থেকে গেছ এ জীবনের মতো। যে ভালবাসায় বন্ধন থাকে
তাকে ছেঁড়া যায়, কিন্তু যে নিজেই মুক্তি দিয়ে
গেছে তার কাছ থেকে পালানোর উপায় তো কারও জানা নেই।”
মঞ্জীরা সাবধানে একটা ছোট গর্ত পার হল। আর একটু হাঁটলেই আলোকোজ্জ্বল বড় রাস্তা। আলোয় পৌঁছলে সম্ভবত সব আঁধারের মতো মনখারাপও পিছু ছেড়ে যাবে।
সে জানে জীবন থামবে না, ডাম্বোর ভাল মা হয়ে থেকে যাবে সে, মিহিকার দিদি মঞ্জীরাও হয়তো তার প্রিয় বন্ধু হয়ে উঠবে। পুরুষ! তাও হয়তো এক দিন আসবে তার জীবনে।
তবু সবটুকু পাওয়ার মাঝেও সেই দুঃখিনী নারী হয়েই থেকে যাবে মঞ্জীরা, মনের আঁধার আর হাজার দ্বিধার বেড়াজাল কাটিয়ে শুধু ভালবাসার কাছেই যাওয়া হয়ে উঠল না মঞ্জীরার।
ট্রাফিকের কোলাহলে হারিয়ে যাচ্ছে ঝিঁঝিপোকার ডাক। জমাট আঁধার গলে গলে মিশে যাচ্ছে নাগরিক কৃত্রিম আলোয়। আলোর কাছাকাছি এসে মঞ্জীরার সঙ্গ ছেড়ে দিল ঝিকমিক জোনাকিরাও।
শুধু আবছা আঁধারে দুই ছায়ামানবী একা একা পথ হাঁটতে লাগল।
১৫
আজকে সে এই শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছে। কথাটা এত ক্ষণ মাথায় আসেনি। সত্যিই তো! আজই তো তিরিশ তারিখ।
“একটা ফোন করবেন ওকে? আমার ফোন নিচ্ছে না।”
“লাভ নেই। ওর ফোন সুইচড অফ। তবে ইভনিং-এর ট্রেন, এখন ওর ফ্ল্যাটে পেয়ে যাবে। ইউ মাস্ট মুভ ফাস্ট।”
“ফ্ল্যাটে নেই। আমি গেছিলাম।”
“ওহ! ইন দ্যাট কেস ওকে স্টেশনে খুঁজতে হবে। ট্রেন ধরতে হলে তো স্টেশনে যেতে হবেই।”
মঞ্জীরা শশব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালো, “হ্যাঁ, বেরোই। ক’টার ট্রেন বলতে পারবেন?”
অভিরাজ দু'হাতে নিজের চুলের গোছা খামচে ধরল। অনেক কষ্টে একটু একটু করে উত্তীয়র সমস্ত খবর সে মনে করতে পেরেছে, কিন্তু মঞ্জীরার শেষ প্রশ্নের উত্তরের বেলাতেই স্মৃতি বিশ্বাসঘাতকতা করছে, “নাহ! অনেক কষ্টে তিরিশ তারিখটা মনে এসেছে, ইভনিং-এ, কিন্তু ট্রেনের টাইম মনে করতে করতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। তুমি বেরিয়ে পড়ো।”
ঝড়ের বেগে হসপিটালের কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল মঞ্জীরা। জুঁই এগিয়ে এসে অভিরাজের কাঁধে হাত রাখল। এত ক্ষণ মনের ওপর লোকটার অনেক চাপ গিয়েছে, বিশ্রাম প্রয়োজন। প্রায় চল্লিশ মিনিট উত্তীয়কে নিয়ে কথা বলে গেছে দু’জনে। এত বকবক করা কি এই শরীরে ঠিক!
জুঁই বলল, “একটু শুয়ে নাও, মুখচোখ লাল হয়ে উঠেছে।”
বাধ্য ছেলের মতো শুয়েছে অভিরাজ, ক্লান্ত স্বরে বলল, “কিন্তু মেয়েটা আমার প্রশ্নের উত্তরটা দিল না তো জুঁই!”
“কোন প্রশ্ন?”
“এটা কি মিষ্টি প্রেমের গল্প? না কি গ্রিক ট্র্যাজেডি?”
জুঁই নরম হাত বুলিয়ে দিল অভিরাজের কপালে, “সব গল্প কি অত সহজ হয়? না কি চাইলেই আমরা নিজেদের ইচ্ছেমতো জীবনের স্ক্রিপ্ট লিখতে পারি? তুমিই তো বলো, ম্যাচের শেষ ওভার না ফুরোলে হারজিতের ফয়সালা হয় না।”
আজ দিনটা কষ্টের, খুব কাছের বন্ধু আজ চিরতরে এই শহরটা ছেড়ে চলে যাচ্ছে। সেই অবসাদ আর জুঁই-এর হাতের ছোঁয়ায় অভিরাজ গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।
অদ্ভুত স্বপ্ন দেখল অভিরাজ। ইডেন গার্ডেন্স এর সবুজ যেন দিগন্তে মিশেছে। মাঠের মাঝামাঝি বাইশ গজে ব্যাট হাতে একলা দাঁড়িয়ে আছে উত্তীয়। একটাও ফ্লাডলাইট জ্বলছে না। আকাশ ভরা জ্যোৎস্না। অথচ কী তীব্র! কী স্পষ্ট!
বোলার ছুটে এল। সে বল ছাড়ার পরেই সামান্য সামনে ঝুঁকে দাঁড়াল উত্তীয়, আর তার পর ছিলে ছেঁড়া ধনুকের মতো সোজা হল তার দীর্ঘ শরীরটা। ক্রিকেট বলে উইলো কাঠ আছড়ে পড়ার মধুর শব্দ স্পষ্ট শুনতে পেল অভিরাজ। বলটা উড়ছে, জ্যোৎস্না ভেজা সবুজ মাঠের থেকে অনেক উপরে হাওয়া কেটে কেটে মিলিয়ে যাচ্ছে দূরে, অনেক দূরে।
অভিরাজের দিকে তাকাল উত্তীয়, হাসিমুখে বলল, “আই কুইট, ক্যাপ্টেন।”
অদ্ভুত কষ্টে স্বপ্নের মধ্যেই অভিরাজের চোখে জল এসে গেল।
মঞ্জীরা হাত তুলে একটা হলুদ ট্যাক্সি দাঁড় করাল। পর পর তিনটে রিফিউজ়ালের পর অবশেষে।
ট্রেন ছাড়বে সন্ধেবেলায়, কিন্তু তার অনেক আগেই নিজের বুকের ভিতর রেলগাড়ির ঝমঝম আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে মঞ্জীরা। দিনের পর দিন তার বিরহে কাতর সেই লোক পথেঘাটে উদ্ভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়িয়েছে। কাজে যায়নি, অফিস ডুব দিয়ে ময়দানের ঘাসে শুয়ে থেকেছে সারা দিন, নিজের কেরিয়ার নিয়ে ছেলেখেলা করেছে।
হয়তো শেষে সামলে নিয়েছে, নতুন সঙ্গী নিয়ে জীবন শুরু করার কথা ভেবেছে, কিন্তু তা বলে চলে যাওয়ার আগে এক বারও দেখা করবে না সে মঞ্জীরার সঙ্গে!
বিকেলের হাওয়া ট্যাক্সির ভিতর মঞ্জীরার চুল এলোমেলো করে দিচ্ছে। এখানে হাওয়া আরও বেশি, কারণ মঞ্জীরার বাঁ দিকে এখন বিপুল সবুজের আয়োজন, কয়েক একর জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে কলকাতা ময়দান।
ময়দান! হঠাৎ বুকের ভিতর ধক করে উঠল মঞ্জীরার। কী ভেবে যেন ট্যাক্সি থেকে নেমেও পড়ল সে। পা রেখেছে নরম সবুজে। বিকেলের দিকে ময়দান তখন জমজমাট হয়ে ওঠার অপেক্ষায়।
এক্কাগাড়ি, ঝালমুড়ি, বেলুন আরও রকমারি জিনিসের পসরা ময়দান জুড়ে। ঘোড়ায় চড়ছে ছেলের দল, বাবা-মার হাত ধরে বেড়াতে এসে যেন পরির মতো উড়ে বেড়াচ্ছে খুদে দেবশিশু। কয়েকটা প্রকাণ্ড গাছের নীচে একটু নিরালা দেখে পরস্পরের নিবিড় সান্নিধ্য খুঁজে নিয়েছে প্রেমিক-প্রেমিকারা।
মঞ্জীরার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বেশি রকম সচেতন হয়ে আছে। তার মনে হচ্ছে, এই ভিড়েই কোথাও আছে সে।
ক্রমশ