অপচয় কোরো না, অভাব হবে না— সাদা কাপড়ে ফুল তুলে লিখে, ফ্রেমে বাঁধিয়ে টাঙিয়ে রাখা হত জানলার ওপরে। সে সব আদ্যিকালের কথা। আদ্যিকালের কিছু মানুষও হয়তো ছিলেন যাঁরা এ হিতোপদেশ মানতেন। তেমনই এক জনের কথা বলব। তিনি ছিলেন আমার বাবার দিদিমা।
বাবা তখন সব কলেজে ঢুকেছে। ফুরফুরে ভাব। পাখা গজিয়েছে। কিন্তু বাড়ির ছোট। অতএব বড় ও বুড়োদের খিদমত খাটা বহাল। এক দিন ঠাকুমা তলব করে বললেন, কোনও এক আত্মীয়ের বাড়ি দিদিমাকে নিয়ে ঘুরে আসতে। বাবা আর দিদিমা গেল। তারা খেতে দিল থালাভর্তি মিষ্টি, আম, আরও অনেক কিছু। বাবারা সব খেতে পারেনি। ফেরার সময়, বাবা হঠাৎ খেয়াল করল, দিদিমা হাঁটছে আর টপাটপ দানাদার পড়তে পড়তে যাচ্ছে। বাবা দিদিমাকে: ‘এটা কী হচ্ছে!!! তুমি কী করেছ?’ অনেক বিস্ময়বোধক চিহ্ন তখন বাবার মুখে। দিদিমা একটু থমকে গেলেন বটে, কিন্তু মোটেই লজ্জিত নন। বললেন, ‘আহা, ওরা অত খেতে দিয়েছিল, না খেলে নষ্ট হত তো! ওদের খারাপ লাগত। তাই শেমিজের ভেতরে নিয়ে নিয়েছি। আর, এতটা পথ যাবে, যদি তোমার খিদে পায়?’ বাবা প্রায় ফেটে যাচ্ছিল, খানিকটা রাগে, খানিকটা অসহায়তায়। রাস্তার লোকও দানাদার-বৃষ্টি দেখে কেউ কেউ দাঁড়িয়ে পড়েছে। বাবা কোনও মতে কান-টান লাল করে দিদিমাকে নিয়ে বাড়ি। এবং কোনও দিন দিদিমাকে নিয়ে আর কোথাও যাবে না, সেই ঘোষণা। তাতে অবশ্য খুব লাভ হয়নি। কারণ বাবারই কাজ ছিল দিদিমাকে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় যাওয়ার।
দিদিমার শেমিজটি ছিল মারাত্মক, এবং তা আরও একটা স্পিকটি নট অবস্থা তৈরি করেছিল। সেটার সঙ্গে অবশ্য অন্য রকম একটা হিতোপদেশের সম্পর্ক আছে: ‘মানুষকে সেবা কোরো, সে রেগে কাঁই হলেও সেবা করা ছেড়ো না।’ সেটা ষাটের দশক। চোঙা, ড্রেন-পাইপ প্যান্টের ফ্যাশনে ইয়াং ব্রিগেড মাত। এক দিন সাদা প্যান্ট আর সাদা শার্ট পরে, গেঞ্জিতে এসেন্স, ঘাড়ে পাউডার মেরে আমার আলট্রা ফ্যাশন কনশাস বাবা কলেজ কাঁপাতে বেরোবে, এমন সময় এল দিদিমাকে নিয়ে এক জায়গায় পৌঁছে দেওয়ার ফরমাশ। সময়টা এই রকমই ঠা ঠা গরমকাল। বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে, বাবা টের পেল, থপ করে মাথার ওপর কী একটা পড়ল। চমকে দেখে, দিদিমা একটা গামছা জলে ভিজিয়ে সেটাকে চার পাট করে বাবার মাথার ওপর ধরেছেন। প্রথমটা বাবা তো অবাক, ‘তুমি পেলে কী করে এটা?’ ‘শেমিজের ভেতরে করে নিয়ে এসেছি ভাই। মানা করো না। এত গরম, তোমার কষ্ট হবে সোনা-মানিক।’ সোনা-মানিক তো তখন সূর্যদেবের চেয়েও বেশি গনগন! ‘এটা কী? আমি কি ছোট? আর রাস্তার মাঝখানে...’ রাগে বাবার মুখ থেকে কথাও সরছিল না। দিদিমা নির্বিকার, এবং ভালবাসায় ডগোমগো। ‘ছিঃ ভাই, রাগ করে না।’ এবং থপ। বাবার মাথা থেকে আগুন তখন ড্রাগনের নাকের ভেতর দিয়ে আগুন বেরনোর তীব্রতা নিয়ে বেরচ্ছে। রাস্তায় ইতিউতি লোকজন ফিকফিক।
দিদিমা অবশ্য কখনওই তাতে দমে যাননি। নাতিনাতনিদের ভাল করা থেকে কেউ তাঁকে আটকাতে পারেনি। এবং বাবা ও পিসিরা অহরহ ফল্স পজিশনে পড়েছে। বাবারা অনেক বড় হয়ে দিদিমার ভালত্ব বুঝেছিল, যেমন আমার ঠাম্মা বিয়ের দিন জানতে পেরেছিল যে দিদিমা আসলে ঠাম্মার সৎমা।