আমার মা-বাবা হেব্বি জুটি। শুনেছি বিয়ের পর প্রায়ই পার্ক স্ট্রিটের রেস্তোরাঁয় খেতে যেত, খামখাই ট্যাক্সি চেপে ঘুরত, সিনেমা দেখতে যেত সাহেব-পাড়ায়, আর বেড়াতে যেত গঙ্গার ধারে। বেহিসেবি বলে নাকি খুব বদনাম ছিল। আমরা যখন ছোট ছিলাম তখনও এ সব কিছু কিছু ঘটত।
তার পর মধ্যবিত্ত জয়েন্ট ফ্যামিলিতে যা হয়— সিনেমা দেখার বহর কমে আসে, বছরে কয়েকটা সন্ধে বেড়াতে যাওয়ার ফুরসত মেলে, তা-ও বাচ্চাদের নিয়ে। যৌথ পরিবারে আত্মীয় আর পুষ্যির সংখ্যা বেড়ে ওঠে। আর রোজগার পাল্লা দিয়ে কখনওই বাড়ে না। রোগ-অসুখ একটু বেশি ফ্রিকোয়েন্সিতে দেখা করতে আসে আর মাসের শেষে চিনি আসে মোটে আড়াইশো।
কেবল পুজো আসার আগে আগে যেন খিলখিল, হাহাহিহি একটু বেড়ে যায়। পিসতুতো দিদি নতুন সিল্কের শাড়ি কিনে এক বার মামিমাদের সঙ্গে দেখা করে যায়। কোনও ভাগ্নে বা ভাইপো চাকরি পেয়ে শাড়ি দিয়ে যায় জেঠিমা আর মা’কে। স্কুল থেকে ফিরে মায়ের সঙ্গে বাসে করে লিন্ডসে’র মুখে বাবার সঙ্গে দেখা করে আমরা নিউ মার্কেটে যাই পুজো শপিং করতে। রোজ অন্তত বার দশেক গোনাগুনতি হয় মোট ক’টা জামা হল।
বাবার আবার শিফ্টিং ডিউটি, তাই এক দিন নিয়ে গেলে তার পর হা-পিত্যেশ করে বসে থাকতে হয়, আবার কবে নিয়ে যেতে পারবে। এর মধ্যেই মা যায় অন্য সবার শাড়ি-জামা কিনতে। ভাইপো, ভাইঝি, ভাগ্নে, আরও অনেকের। আর তার পর এক দিন গড়িয়াহাট চষে কেনা হয় জমাদারের বউয়ের শাড়ি, ভারীর গেঞ্জি, কাজের মাসির শাড়ি, নতুন পাপোশ, বেড-কভার, ছাঁকনি, কাপড় মেলা দড়ি— সঅঅঅবব।
বাবা অফিস থেকে বাড়ি ফিরলে মা গজগজ করে, ‘কবে থেকে বলছি তোমার দুটো গেঞ্জি কিনবে চলো, আমার রোজকার পরার দুটো ছাপাও কিনতে হবে। তোমার আর সময় হয় না।’ বাবা একটা মৃদু, ‘যাব যাব’ বলে ছেড়ে দেয়।
তার পর হয়তো পঞ্চমীর দিন দেখি মা তাড়াতাড়ি গা ধুয়ে সেজেগুজে বেরোচ্ছে নিজেদের কেনাকাটার জন্য। সব সময় প্রশ্নবাগীশ আমি, ‘মা কোথায় যাচ্ছ?’ ‘নিউ মার্কেট, বাবু।’ তক্ষুনি আবদার, ‘আমিও যাব।’ ‘না বাবা, খুব ভিড়, কষ্ট হবে।’ আমি লাফাতে লাফাতে বলি, ‘তোমার শাড়ি কিনবে মা? সিল্কের শাড়ি?’ মা ছোট্ট করে শুধু বলে, ‘দেখি।’
খুব ছটফট করতে থাকি, বাবা-মা কখন কেনাকাটা করে ফিরবে। কী কিনবে। বাবার খুব আনকমন পছন্দ আছে বলে সবাই বাবাকে নিয়ে কেনাকাটা করতে যেত। আজ বাবা গেছে মা’কে নিয়ে। অতএব সবাই অপেক্ষা করছে কী আনকমন পাতে এসে পড়বে।
মা-বাবা এল। উজ্জ্বল মুখ, দুজনেরই। ছোঁ মেরে প্যাকেট দুটো ছিনিয়ে নিয়েই ফুস্স্স্স্। ‘মা, এ তো মাত্র একটা শাড়ি! আর তুমি যে বলেছিলে সিল্কের শাড়ি কিনবে, এটা তো অন্য রকম একটা কী!’
মা বলল, ‘এটা ভয়েল, নতুন বেরিয়েছে, আমার তো কমলা রং দারুণ পছন্দ। আর তা ছাড়া বড়দা একটা শাড়ি দিয়েছে, ছোড়দি একটা দিয়েছে, তা হলে তো অনেকগুলো শাড়ি হয়ে গেল।’
মা’র কথা পছন্দ হল না। এ বার বাবার প্যাকেটটা খুলে ফেললাম। সেখানেও মাত্র একটা জামা!
বাবাদের বুঝি পুজোয় একটা মাত্তর জামা হয়?