রোহিণীইইইই...চমকে উঠত ও। আর্ত গলায় ত্রস্ত হয়ে উত্তর দিত, ‘কী রে! কী হয়েছে!’ আর আমরা, তার ফুতির্বাজ কলেজ-বন্ধুরা শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করতাম, ‘চা খেতে যাবি?’ ভারী রেগে উঠত, ‘তোরা সব সময় এ রকম ভয় পাইয়ে দিস কেন রে?’ ‘তুই বা এত কথায় কথায় ভয় পাস কেন রে?’ ‘ওই তো মুশকিল, বুকের ভেতর এমন ধড়াস করে ওঠে!’
এর পর আমরা সবাই যথাযথ বক্তৃতা ও জ্ঞান সাপ্লাই করতাম বেচারা মেয়েটাকে। থাকত বেশ দূরে। ট্রেনে করে বাসে করে তবে কলেজ পৌঁছত। আর সবর্দাই কোনও কিছুর তাড়ায় যেন ভারী অতিষ্ঠ। পঁচিশ বার ওড়না ঠিকঠাক করছে, তিরিশ বার দেখে নিচ্ছে টাকার ব্যাগ ঠিক আছে কি না। আমরা হেসে মরতাম, ঝাঁঝিয়েও উঠতাম, ‘আর ক’বার তোকে বলব, থার্ড পিরিয়ডটা কাল ক্যানসেল হয়েছে!’
এক বার কোনও একটা শনিবার কী একটা ফি দেওয়ার লাস্ট ডেট। দু’দিন আগে থেকে রোহিণী কোনও কারণে ক্লাসে আসেনি। শুক্রবার এসে যেই জানতে পারল শনিবার লাস্ট ডেট, কেমন একটা হয়ে গেল। ‘আচ্ছা, কাল দু’টোর আগে যদি পৌঁছতে না পারি?’ ‘কী আর হবে, তোর পরীক্ষাটা দেওয়া হবে না।’ আমরা ভাবলেশহীন হয়ে বলি। যেন, এ রকম ব্যবহারে, আমরা ওকে খুব শক্ত মানুষ তৈরি করছি।
পর দিন সত্যিই রোহিণীর দেরি দেখে একটু চিন্তাই হচ্ছিল। এক বন্ধু বলল, ‘প্যানিক-দিদি কই? ওর তো তা হলে পরীক্ষা দেওয়া হল না।’ হোহোহো হাসিতে আমরা সবাই ফেটে পড়লাম। অথচ সবাই জানতাম, শনিবার কলেজের অফিস হাফ ডে খোলা থাকবে বলে, সোমবার প্রথম দিকে এসে ফি জমা দিলেও হবে। কিন্তু আমরা কেউ ওকে কিচ্ছু বলিনি। ওই যে, ওকে শক্ত করার মিশনে আমরা ব্রতী ছিলাম।
একটা কুড়ি নাগাদ রোহিণী হন্তদন্ত হয়ে এল। ‘ট্রেনের খুব গন্ডগোল, তার ওপর আমাদের ও-দিকে কী বৃষ্টি! এখনও অফিস খোলা আছে তো?’ মিনিট পনেরো পরে ফিরে এল। মুখ কালো, গম্ভীর। ‘কী রে কী হল?’ কেমন একটা ফুঁসে উঠল, ‘এক বারও বলিসনি তো সোমবার সকাল অবধি ফি দেওয়া যাবে? আমি আজ কী কষ্ট করে এসেছি জানিস?’ এটুকুই ওর মতো নরম মেয়ের কাছ থেকে যথেষ্ট। হনহনিয়ে বাসে উঠে পড়ল প্যানিকদিদি।
সোমবার এল না সে। আমাদের মন খচখচ করছিল, ট্রেন ধরে গেলাম ওদের বাড়ি। ওর মা আমাদের দেখে ভারী খুশি। এক দিন মেয়ে না যাওয়াতে বন্ধুরা খবর নিতে এসেছে। কিছু পরে রোহিণী এল। একটা শুকনো হাসি। চা আনতে উঠে গেল একটু পরে। আমরা মাসিমাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ওর সব কিছুতে এত টেনশন কেন?’
ওঁর মুখটা নিবে গেল। ‘ক্লাস এইটে পড়ার সময় দু’দিন পর পর স্কুল যেতে দেরি হয়েছিল, ওর রিক্সাওয়ালা কামাই করেছিল। তাই ক্লাস টিচার দ্বিতীয় দিন সবার সামনে এত অপমান করেছিলেন যে রোহিণী বাড়ি এসে টানা পাঁচ দিন জ্বরে পড়েছিল। তার পর থেকেই ওর সব কিছুতে তাড়া ধরে গেছে। কত বোঝাই, কিন্তু কে আর বোঝে?’
আমরা তড়িঘড়ি উঠে পড়ি। আসার রাস্তাটা প্রায় সক্কলেই চুপ। আসলে, মজা করা আর মহান হওয়ার ঘষাঘষিতে আমাদের নুন-ছাল উঠে গিয়েছিল। সবাই মনে মনে প্ল্যান করছিলাম পরের দিন কে ঠিক কী ভাবে রোহিণীর মুখোমুখি হব। লজ্জিত হয়ে, ক্ষমা চেয়ে, না কি জাস্ট ক্যাজুয়াল থাকার ভান করে।