বিস্মৃত: সোমেন্দ্রনাথ ঠাকুর। ছবি সৌজন্য: রবীন্দ্র ভবন, বিশ্বভারতী
এপ্রিল মাস, সাল ১৮৮৪। নিমতলা শ্মশানঘাটে বাড়ির কয়েক জন ভৃত্যের সঙ্গে কর্তাবাবার হুকুমে চার যুবকও হাজির। পরিবারের এক আত্মীয়ার মৃতদেহ নির্বিঘ্নে সৎকার করে তাঁরা ফিরে এলেন চিৎপুরের বাড়িতে। প্রায় সমবয়সি, এই চার যুবক হলেন কর্তাবাবা অর্থাৎ মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দুই পুত্র, ছাব্বিশ বছরের সোমেন্দ্রনাথ, চব্বিশ বছরের রবীন্দ্রনাথ এবং মহর্ষির জ্যেষ্ঠপুত্র দ্বিজেন্দ্রনাথের প্রথম ও দ্বিতীয় পুত্র, যথাক্রমে বাইশ বছরের দ্বিপেন্দ্রনাথ ও একুশ বছরের অরুণেন্দ্রনাথ। সোমেন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথের চেয়ে দু’বছরের বড় হলেও তাঁরা আবাল্য সঙ্গী ও সহপাঠী ছিলেন। বন্ধু রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের বিশেষ অনুরোধে পঞ্চাশ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ ‘প্রবাসী’তে ‘জীবনস্মৃতি’ লিখতে শুরুই করেছিলেন এমন ভাবে— ‘আমরা তিনটি বালক একসঙ্গে মানুষ হইতেছিলাম। আমার সঙ্গীদুটি আমার চেয়ে দুই বছরের বড়ো।’
প্রথম সঙ্গী সোমেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৫৯ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। অপর সঙ্গী কবির বড়দিদি সৌদামিনীর পুত্র সত্যপ্রসাদ।
ডা. উমেশচন্দ্র রায়ের বায়ুরোগগ্রস্তদের জন্য একটি ওষুধের বিজ্ঞাপনে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘আমি ইহার উপকারিতা বহুকাল যাবৎ জ্ঞাত আছি।’
হঠাৎ রবীন্দ্রনাথ কেন এমন বিবৃতি দিয়েছিলেন, এর কারণ খুঁজতে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে ঢুকতে হবে। এ বাড়ির ছ’নম্বর দালানের মালিক দেবেন্দ্রনাথ এবং সারদা দেবীর চোদ্দো জন সন্তানের মধ্যে পঞ্চম এবং ত্রয়োদশ সন্তান, যথাক্রমে বীরেন্দ্রনাথ এবং সোমেন্দ্রনাথ বায়ুরোগগ্রস্ত ছিলেন। বীরেন্দ্রনাথের মস্তিষ্কবিকৃতির মাত্রা সোমেন্দ্রনাথের থেকে অনেক বেশিই ছিল। সোমেন্দ্রনাথকে কখনও উন্মাদাশ্রমে পাঠাতে হয়নি। এঁদের চিকিৎসার প্রয়োজনেই মস্তিষ্কবিকৃতির ওই ওষুধটি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ স্বাভাবিক ভাবে ওয়াকিবহাল ছিলেন। জানা গেছে, এই দুই ভাই-ই অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন।
সোমেন্দ্রনাথ প্রথম জীবনে খুবই স্বাভাবিক প্রকৃতির ছিলেন। ছোট ভাই রবীন্দ্রনাথকে তিনি এতটাই ভালবাসতেন যে, ‘জীবনস্মৃতি’র পাতায় রবীন্দ্রনাথ সে কথা লিখেও গেছেন। রবীন্দ্রনাথ যখন কবিতা লিখতে শুরু করেন, তাঁর এই সোমদাদাই বাইরের লোকেদের ঘরে ডেকে এনে-এনে সগর্বে রবির লেখা কবিতা পড়ে শোনাতেন। বলতেন, ‘রবি একটা কবিতা লিখিয়াছে, শুনুন না।’ জ্যোতিদাদা সঙ্গীতে রবীন্দ্রনাথকে গড়ে ওঠার জন্য যতটা উৎসাহ দিতেন, সোমদাদা প্রায় ততটাই তাঁর কাব্য পড়ে এবং শুনিয়ে কবিকে উৎসাহ দিয়েছেন। এমনকি রবীন্দ্রনাথের প্রথম দু’টি কাব্যগ্রন্থ ‘কবি-কাহিনী’ ও ‘বনফুল’ প্রকাশে সোমেন্দ্রনাথের হাত ছিল। কবি তখন বিলেতে। বিলেত-প্রত্যাগত ভাইকে চমক দেওয়ার পাশাপাশি আনন্দ দিতে সোমেন্দ্রনাথ পরম আগ্রহে ‘বনফুল’ প্রকাশের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। কবি লিখেওছিলেন সে কথা, ‘...দাদা সোমেন্দ্রনাথ অন্ধ পক্ষপাতিত্বের উৎসাহে এটি গ্রন্থ আকারে ছাপাইয়াও ছিলেন।’
এই দুই ভাই যেন হরিহর আত্মা। বিশেষ করে সোমেন্দ্রনাথের দিক থেকে তো বটেই। উভয়েই প্রথম থেকে এক সঙ্গে ভৃত্যদের কাছে মানুষ হচ্ছেন। কুস্তি শিখছেন, গৃহশিক্ষকদের কাছে পড়াশোনা করছেন, একই রকম পরিধান পরছেন, ব্রাহ্মসমাজের উপাসনায় গান করছেন, জুড়িগাড়ি চেপে নাটক দেখতে যাচ্ছেন, স্কুলে যাচ্ছেন, হিন্দুমেলায় অংশ নিচ্ছেন, একে অপরের হয়ে পিতা মহর্ষিকে চিঠি লিখছেন, জ্যোতিদাদার সঙ্গে রিষড়ায় বেড়াতে যাচ্ছেন.... সবই ছিল একে-অপরের সঙ্গে ছায়ার মতো লেপটে। এমনকি দু’জনের উপনয়নও হয়েছিল এক সঙ্গে। উপনয়নে সত্যপ্রসাদও ছিলেন ওঁদের সঙ্গে। নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবীর হাতে তিন জনে মিলে হবিষ্যান্ন খাচ্ছেন, তখন তিন দিন নির্জনবাসকালে ঋষিবালক হিসেবে যে কঠোর সংযমে থাকার কথা, তাঁদের তা যে মোটেই হয়নি রবীন্দ্রনাথ অকপটে তাঁর বর্ণনা করেছিলেন, ‘মাথা মুড়াইয়া, বীরবৌলি পরিয়া, আমরা তিন বটু তেতালার ঘরে তিনদিনের জন্য আবদ্ধ হইলাম। সে আমাদের ভারী মজা লাগিল। পরস্পরের কানের কুণ্ডল ধরিয়া আমরা টানাটানি বাধাইয়া দিলাম।’
এ কথা থেকে বোঝাই যায়, কতটা হৃদ্যতা ছিল এদের মধ্যে। এর পরেই ঠাকুরবাড়িতে নেওয়া হল এক অদ্ভুত সিদ্ধান্ত।
উপনয়ন-পর্ব সবে শেষ হয়েছে। মাথা মুড়োনো রবির ডাক পড়ল তেতলায় মহর্ষির ঘরে। মহর্ষি জিজ্ঞেস করলেন, তাঁর সঙ্গে হিমালয়ে যেতে রাজি কিনা বারো বছরের রবি। ছোট্ট রবি রাজি হয়েছিলেন এবং কিছু দিনের মধ্যেই বাবার সঙ্গে হিমালয় ভ্রমণে চললেন। ঠাকুরবাড়ির হিসেবের খাতা বলছে যে, হিমালয়যাত্রার প্রায় দু’মাস আগে, ১৮৭২ সালের ডিসেম্বরে দেবেন্দ্রনাথের পছন্দ অনুসারেই ‘বনাতের মোগলাই চাপকান পেনটুলেন ও জোব্বা’ এবং ‘জরির কাজ করা গোল মখমলের টুপি’ দুই ভাইয়ের জন্যই করানো এবং কেনা হয়েছিল। তা হলে কি মহর্ষি দুই পুত্রকেই হিমালয় নিয়ে যেতে আগ্রহী ছিলেন! তা হলে কেন বাদ পড়লেন সোমেন্দ্রনাথ? এ প্রশ্নের উত্তর মেলে না। রবীন্দ্রনাথের পথ হয়ে গেল ভিন্ন। ফিরে আসার তিন বছর পর রবি, সোম এবং সত্য সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ আর মানিয়ে নিতে পারলেন না স্কুলের বন্ধ পরিবেশে।
এ দিকে সোমেন্দ্রনাথ তখন সহপাঠীদের সঙ্গে দিন কাটাচ্ছেন। হিন্দুমেলায় গিয়ে ব্রহ্মসঙ্গীত গাইছেন। বেলেঘাটার কাছে নারকেলডাঙায় স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন-এর সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িয়ে পড়েছেন। সেখানে অল্পবয়সিদের শারীরিক ও মানসিক বল গড়ার এবং নৈতিক উন্নতির জন্য নানা রকম খেলাধুলো ও শিক্ষার ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলছেন। বাড়ির ভাইপো-ভাইঝিদের নিয়ে কখনও আলিপুর চিড়িয়াখানায় বা শিবপুরে বোটানিক্যাল গার্ডেন যাচ্ছেন, কখনও আবার মিউজ়িয়ামে নিয়ে যাচ্ছেন। এই ভাবে দিব্যি চলছিল তাঁর। কিছু দিন পারিবারিক কারণে শিলাইদহও গেলেন।
হঠাৎই ১৮৭৯ সালের মার্চ মাসে, দ্বিপেন্দ্রনাথ এবং তাঁর ভগ্নিপতি মোহিনীমোহন চট্টোপাধ্যায়, সোমেন্দ্রনাথের অসুস্থতার খবর পেয়ে তাঁকে শিলাইদহ থেকে তড়িঘড়ি কলকাতায় ফিরিয়ে আনলেন। কবিরাজ রসিকলাল গুপ্ত তাঁর অসুস্থতার খবর পেয়ে জোড়োসাঁকোয় এসে তাঁকে দেখে গেলেন। তাঁর বায়ুরোগ তখনই ধরা পড়ে, তবে তা বিপজ্জনক নয় বলেই চিকিৎসকদের রায় ছিল। এই অবস্থায় মহর্ষি আইনজ্ঞদের পরামর্শে ঠাকুর পরিবারের বিষয়-সম্পত্তির নতুন বিলি-বন্দোবস্ত করেন। সেই মতো ১৮৭৯-র পয়লা অক্টোবর কলকাতা হাইকোর্ট সোমেন্দ্রনাথকে অপ্রকৃতিস্থ ঘোষণা করে। এই সময়ে সোমেন্দ্রনাথের বয়স মাত্র কুড়ি বছর। উন্মাদ হবার ফলে পৈতৃক সম্পত্তির অধিকার থেকে তিনি বঞ্চিত হলেন। পরিবর্তে তাঁর জন্য মাসোহারা বরাদ্দ হল মাত্র কুড়ি টাকা।
পরবর্তী কালে ঠাকুরবাড়ির এই মানুষটি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের কলমের কালি ফুরিয়ে যায়। রবির বড়দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথের চতুর্থ পুত্র সুধীন্দ্রনাথ, তাঁর পুত্র সৌম্যেন্দ্রনাথ এবং অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্যা সুরূপা দেবী— ঠাকুর পরিবারের এই তিন সন্তানের স্মৃতিচারণায় তিনি উজ্জ্বল হয়ে আছেন। সুধীন্দ্রনাথ দীর্ঘ চল্লিশ বছর তাঁর এই কাকার সঙ্গে একই ঘরে দিনযাপন করেন। এক স্মৃতিচারণে তিনি বলেছেন, ‘সোমেন্দ্রনাথ — তাঁহার এই নাম যথার্থ সার্থক হইয়াছে; অন্তরে বাহিরে তিনি চন্দ্রের মত স্নিগ্ধদ্যুতিমান ছিলেন। এমন সাদা, সরল, উদার, পরদুঃখকাতর উচ্চপ্রাণ জগতে কদাচিৎ দেখা যায়।’
সুধীন্দ্রনাথের কাছ থেকেই জানা যায়, যখন তাঁর মধ্যে উন্মাদভাব বেড়ে যেত, তখন তিনি লোকনির্বিচারে সকলকেই জড়িয়ে ধরতেন, সকলের সঙ্গে করমর্দন করতেন, এমনকি কুকুরকেও কোলে তুলে চুমু খেতেন, মেথরকে নিজের ঘরে ডেকে এনে পাশে বসিয়ে গল্প করতেন। সুধীন্দ্রর মতে এ সবই ছিল তাঁর মহাপ্রাণের তাড়না। বিশ্বপ্রেম, সমদর্শন তাঁর জীবনের মূলমন্ত্র ছিল। দর্শনশাস্ত্রের উপর তাঁর অনুরাগ ছিল প্রবল। মাতৃভক্ত সোমেন্দ্রনাথ নাকি থেকে থেকেই মায়ের কথা বলতেন।
সে আমলে সোমেন্দ্রনাথ অসম্ভব ভাল গান করতে পারতেন। গানের গলা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তুলনাও করেছেন কেউ কেউ। দ্বারকানাথের ভাগ্নে ঈশ্বরচন্দ্র মুখোপাধ্যায় সোমেন্দ্রনাথের গান শুনে বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ গলা হচ্ছে সোমবাবুর। যেমন গলা তেমনি গান গায় বটে। রবিবাবু আবার কী গান গায়।’ অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ঘরোয়া’য় এ তথ্য আছে। এ কথাতেই বোঝা যায় সোমেন্দ্রনাথের গানের কদর কখনও কখনও গায়ক রবীন্দ্রনাথের গানকেও ছাপিয়ে যেত। সোমেন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে সে কালের বিখ্যাত চিত্রশিল্পী এবং সমালোচক ও সি গাঙ্গুলি (অর্ধেন্দুকুমার গঙ্গোপাধ্যায়) তাঁর ‘ভারতের শিল্প ও আমার জীবন’ গ্রন্থে লিখেছিলেন, ‘ঠাকুরবাড়িতে আর একজন এমন আকর্ষণীয় মানুষ ছিলেন, যাঁর কথা অনেকেই জানেন না এবং বলেন না। তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের অগ্রজগণের অন্যতম সোমেন্দ্রনাথ বা সোমবাবু।’ সোমেন্দ্রনাথ যে অপ্রকৃতিস্থ ছিলেন তা তিনি জানতেন। তবু বলেছেন, ‘সোমবাবু গান করতেন বেশ ভালো এবং বেশিরভাগ রবীন্দ্রনাথের রচিত গান গাইতেন।’
রবীন্দ্রনাথ দূরে সরে গেলেও, ঠাকুরবাড়িতে তাঁর এই মহৎপ্রাণ দাদাটি কিন্তু বেঁচে ছিলেন তাঁর ভাইয়ের গান গেয়ে গেয়ে। বলতেনও সে কথা, ‘রবির এই গান গাইলে আমি বড় এক্সাইটেড হয়ে পড়ি।’ বিলেত থেকে ফিরে আসার পর ঠাকুরবাড়িতে রবীন্দ্রনাথের গানের চর্চা যখন কবির আত্মীয়-পরিজনদের মধ্যে পূর্ণোদ্যমে চলছিল তখন এই বাড়ির আর পাঁচ জনের মতো সোমেন্দ্রনাথও সেই দায়িত্ব সযত্নে পালন করে গেছেন।
অথচ দীর্ঘদেহী গৌরকান্তি এই সুপুরুষটিকে দেখলে বোঝাই যেত না তিনি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক নন। অবনীন্দ্র-কন্যা সুরূপা দেবীও ৬-নং বাড়ির একতলার এই বাসিন্দাটি সম্পর্কে একই কথা বলেছেন যেন... ‘আপনমনে হাতের মুঠো খুলতেন আর বন্ধ করতেন, যেন কি ধরছেন আর ছেড়ে দিচ্ছেন। আমরা ছোটরা কিন্তু তাঁকে খুব ভালবাসতুম, একটুও ভয় পেতুম না। তিনি কত ছড়া বলতেন, গাইতেন।’ সাদা পাঞ্জাবি আর ঝোলা ইজের পরা, ধবধবে ফর্সা, গোঁফ-দাড়ি কামানো, প্রশস্ত কপাল আর সাদা কালো মাথাভর্তি চুলের মানুষটি গাইতেন —‘বলি ও আমার গোলাপ বালা, তোল মুখানি তোল মুখানি কুসুমকুঞ্জ কর আলা।’ বীরেন্দ্রনাথের মতো বিয়ে না করলেও বিয়েপাগলা ছিলেন সোমেন্দ্রনাথ। জানা যায় মনে মনে তাঁর একটি কল্পনার বৌ ছিল। তিনি তাঁর নাম দিয়েছিলেন প্রভাবতী, সে নাকি ছিল ভারী রূপসী। সুরূপা দেবী এই প্রসঙ্গে স্মৃতিচারণ করেছেন, ‘বাড়ির বড়রা ছেলেমেয়েরা মাঝে মাঝে একটি ছোট ছেলেকে দিব্যি মেয়ে সাজিয়ে প্রভাবতী বলে তাঁকে দেখাতো, তিনি মুগ্ধ চোখে তাকে দেখতেন, হাসিমুখে কথা বলতেন। ভারী মায়া করতো।’ সোমেন্দ্রনাথ এক জন সুনিপুণ গীতিকার ছিলেন। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের আগেই তিনি হাসির গান লিখেছিলেন। পাশাপাশি আধ্যাত্মিক গম্ভীর রসসমৃদ্ধ গানও তিনি রচনা করেন। সোমেন্দ্রনাথ মাথায় ফুলন তেল মাখতেন। বালিশে সেই তেলের গন্ধে পিঁপড়ে এসে জুটত। তাঁর পাশে শুয়ে দিনের পর দিন গল্প করতেন সুধীন্দ্রনাথের ছেলে সৌম্যেন্দ্রনাথ। ‘যাত্রী’ গ্রন্থে সোমদাদা সম্পর্কে এ সব কথা লিখে গেছেন তিনি।
১৯২২-এর ৩০ জানুয়ারি ৬৩ বছর বয়সে সোমেন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকোর বাড়িতে মারা যান, জানা যায় জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ডায়েরি থেকে। শ্রাদ্ধবাসরে উপাসনা করেন সুধীন্দ্রনাথ। শান্তিনিকেতন থেকে রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন, কিন্তু সে দিন তাঁর কোনও স্মৃতিচারণের কথা জানা যায় না। হয়তো তাই অবন-কন্যা সুরূপার আক্ষেপ, ‘এই যে একটি মানুষ কবির কাব্যে উপেক্ষিত থেকে গেলেন— তিনি হলেন রবিদাদার আর একটি দাদা সোমেন্দ্রনাথ, আমাদের সোমদাদা। রবিদাদা ছিলেন দীপ্ত সূর্য। তাঁর রশ্মির সহস্রধারে বিশ্ব আলোকিত করেছে, তাঁর অগ্রজ সোমেন্দ্রনাথ ছিলেন রাহুগ্রস্ত চন্দ্র, অন্য ভাইদের মত তাঁরও হয়তো কিছু প্রতিভা ছিল, কিন্তু তা আর বিকাশ হলো না, হলো অকালে অস্তমিত।’
কেউ কেউ আবার মনে করেন, রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘পাগল’ প্রবন্ধে যা লিখেছিলেন, তা হয়তো সোমেন্দ্রনাথের ছায়া অবলম্বনে রচিত— ‘পাগল বা প্রতিভাবান দুজনই দশের বাইরে। শুধু ‘পাগল বাহিরেই থাকিয়া যায়, আর প্রতিভাবান দশকে একাদশের কোঠায় টানিয়া আনিয়া দশের অধিকার বাড়াইয়া দেন!’