রূপবতী: আনিতা দেলগাদো। তাঁর রূপেই মুগ্ধ হন রাজা জগৎজিৎ সিংহ।
মে মাসের এক সন্ধে। হাওয়ায় ভিজে তুলোর মতো শিরশিরে হিম। কিন্তু দিন দীর্ঘ। রাত দশটার আগে সূর্য অস্ত যায় না এখানে। গরমকালে ইউরোপের সর্বত্রই এই ঘটনা। তখন ১৯০৬ সাল। মাদ্রিদ শহর জমজমাট খানদানি বড়লোকদের ভিড়ে। মাদ্রিদের রাজা ত্রয়োদশ আলফানসোর বিয়ে উপলক্ষে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে রাজা, মহারাজারা এসেছেন এই শহরে। শহরের সেরা নাইটক্লাবে সে দিন জমায়েত রাজার অতিথিরা। আসর জমজমাট। পানাহার চলছে। এমন সময় মঞ্চ আলো করে এলেন এক ফ্লেমেঙ্কো নর্তকী। বয়সে কিশোরী। নাম আনিতা দেলগাদো ব্রিয়নেস। তাঁর রূপের ছটায় বেশির ভাগ অতিথি বাক্রুদ্ধ। যেন স্বর্গ থেকে নেমে আসা দেবকন্যা। আমন্ত্রিতদের মধ্যে ছিলেন তৎকালীন পঞ্জাবের কপূরথালার রাজা জগৎজিৎ সিংহ। তাঁর অবস্থা একেবারে ধরাশায়ী।
নর্তকীকে দেখে রাজা মনে মনে পণ করলেন, ওই অপ্সরাকেই বিয়ে করবেন। পরের দিন সকালে রাজা সেই কন্যাটির সামনে পাগড়ি খুলে, হাঁটু মুড়ে বসে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। মেয়েটি হতভম্ব। কারণ তার বয়স তখন মাত্র ষোলো। আর রাজা জগৎজিৎ সিংহের বয়স তার তিন গুণ! তা ছাড়াও মেয়েটির বাবা-মা গোঁড়া খ্রিস্টান। কিছুতেই তাঁরা কোনও হিন্দু নেটিভের হাতে কন্যাকে তুলে দিতে রাজি হলেন না। আগে দক্ষিণ স্পেনের মালাগা অঞ্চলে আনিতাদের একটি ছোট্ট কাফে ছিল। সেখানে জুয়ার ব্যবসাও চলত। স্পেনে তখন জুয়ার ব্যবসা নিষিদ্ধ হওয়ায় আনিতার বাবার ব্যবসাপত্র উঠে যায়। তখন তিনি বাধ্য হয়ে স্ত্রী ও দুই কন্যাকে নিয়ে নতুন কাজের খোঁজে মাদ্রিদে চলে আসেন। কিন্তু মাদ্রিদে এসেও তেমন কোনও কাজ জোগাড় করতে পারেননি আনিতার বাবা। এক প্রতিবেশী নিজের গরজেই বিনা পয়সায় আনিতা আর তার দিদিকে নাচ শেখাতেন। সংসারের এই হাল দেখে তখন দুই বোনই বিভিন্ন নাইটক্লাবে নৃত্য প্রদর্শন শুরু করেছে। রাজা জগৎজিৎ সিংহ তাদের সংসারে দারিদ্রের খোঁজখবর নিয়েই এগোলেন। তিনি আনিতার বাবাকে এক লক্ষ পাউন্ড দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন, যাতে তিনি তাঁর সঙ্গে আনিতার বিবাহে সম্মতি দেন। এক জন জীবিকা হারানো মানুষের কাছে এ ঘটনা লটারি জেতার শামিল। তিনি রাজাকে কন্যাদানের সম্মতি দিলেন।
এক সপ্তাহের মধ্যে রাজা জগৎজিৎ সিংহ আনিতাকে তাঁর প্যারিসের প্রাসাদে পাঠিয়ে দিলেন। কারণ রানির মুকুট পরার জন্য আনিতার ভোল বদলে ফেলতে হবে। স্প্যানিশ ছাড়াও বেশ কয়েকটি ভাষা শিখতে হবে। ইতিহাস, ভূগোল সম্পর্কে জ্ঞান থাকতে হবে। নাচ, গান, টেনিস, সাঁতার, স্কেটিং... সব মিলিয়ে এক মাস ধরে চলল প্রশিক্ষণ পর্ব।
১৯০৭ সালে আনিতা মুম্বই এলেন। মুম্বইয়ে এসে শুনলেন, রাজা জগৎজিৎ সিংহের আগের চার স্ত্রী রয়েছেন। আনিতা বেঁকে বসলেন। রাজা তাঁকে প্রতিশ্রুতি দিলেন, অন্য রানিদের সঙ্গে তাঁকে থাকতে হবে না। তাঁরা হারেমে থাকবেন। আনিতা আলাদা থাকবেন রাজপ্রাসাদে।
১৯০৮ সালের ২৮ জানুয়ারি শিখ মতে রাজা জগৎজিৎ সিংহের সঙ্গে আনিতার বিয়ে হয়ে গেল। কপূরথালা এস্টেটের রানি হয়ে আনিতা দেলগাদোর এর নতুন নাম হল প্রেম কৌর। এমন সুন্দরী রানিকে দেখে সাধারণ মানুষ থেকে প্রতিবেশী রাজা— সকলেরই চক্ষু চড়কগাছ। কারণ আগেই বলা হয়েছে, আনিতার রূপ দেখে সত্যিই মনে হত তিনি যেন স্বর্গ থেকে নেমে আসা কোনও দেবী।
সেই সময় পঞ্জাবকে বলা হত ‘প্রাচ্যের প্যারিস’। কারণ রাজা জগৎজিৎ সিংহের ফ্রান্স নিয়ে বিশেষ দুর্বলতা ছিল। রাজপরিবারের পানীয় জল আসত প্যারিস থেকে। কপূরথালার প্রাসাদটিও নির্মিত হয়েছিল ফ্রান্সের রাজপ্রাসাদের আদলে। ফরাসি খানাও খুব ভালবাসতেন রাজা জগৎজিৎ সিংহ। তাই তিনি প্যারিসের অন্যতম অভিজাত হোটেল ‘রিৎজ’-এর প্রধান বাবুর্চিকে কপূরথালার পাকশালায় উড়িয়ে এনেছিলেন। কাজেই ভারতে ইউরোপীয় স্বাচ্ছন্দ্যের সব কিছুই পেতেন আনিতা ওরফে প্রেম।
বিয়ের পর রাজার সঙ্গে মধুচন্দ্রিমায় বেরিয়েছেন আনিতা। তখন তিনি ডায়েরিতে লিখছেন, রাজা তাঁর দেখভালে পান থেকে চুন খসতে দিতেন না, এতটাই যত্নশীল ছিলেন নববধূর প্রতি। এমনকি রাজা নাকি এও বলেছিলেন আনিতাকে, “তোমার মতো সুন্দরী আমার স্ত্রী হবে আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। হয়তো ঈশ্বরের ইচ্ছে আর তোমার নিয়তি। না হলে আর কী ভাবেই বা সম্ভব হত!”
বিয়ের পর পরই রাজা জগৎজিৎ সিংহ আনিতাকে নিয়ে ভারত ভ্রমণে বেরোন। সেই সময় রানি নিয়মিত ডায়েরি লিখতেন। পরে সেই ডায়েরি বই আকারে প্রকাশ পায়— ‘দি ইমপ্রেশন্স অব মাই ট্রিপ টু ইন্ডিজ়’ নামে বইটি খুব জনপ্রিয় হয়। এই সময়ই আনিতার প্রথম পুত্রসন্তানের জন্ম। রাজকুমারের নাম রাখা হয় অজিত সিংহ।
সেই সময় ভারতে অভিজাত ব্রিটিশরা আনিতাকে প্রকাশ্যে বিশেষ পাত্তা না দেওয়ার ভান করতেন। কিন্তু সে সময় আনিতার মতো সুন্দরী খুব বেশি ছিলেন না। কাজেই সর্বত্র তাঁকে নিয়ে, তাঁর রূপ নিয়ে একটা চাপা ফিসফাস সর্বক্ষণই হাওয়ায় ভাসত।
পুত্র হওয়ার পর আনিতা মুসৌরির কপূরথালা প্যালেসে থাকতেন। রাজা জগৎজিৎ সিংহের ফরাসিপ্রীতির মতো নারীপ্রীতিও ছিল তীব্র। অল্পবয়সি সুন্দরীদের প্রতি রাজার বিশেষ ঝোঁকের কথা আনিতা জানতেন। এক-এক দিন এক-এক জন রক্ষিতা নিয়ে রাজা বিভিন্ন জায়গায় রাত কাটাতেন।
১৯২৫ সালের ঘটনা। তখন রাজা-রানি দু’জনেই লন্ডনে। ওখানকার বিখ্যাত স্যাভয় হোটেলে উঠেছেন। ঘটনাচক্রে একই হোটেলে উঠেছিলেন মহম্মদ আলি জিন্নাও। তিনি রাজা-রানি দু’জনেরই বন্ধু ছিলেন। সেখানে এক দিন রাজা-রানির কথা কাটাকাটি এমন পর্যায়ে পৌঁছল, হোটেলের কারও বাকি থাকল না জানতে। রাজা আনিতাকে ডিভোর্স দেওয়ার হুমকি দিলেন। আনিতা সেই কথা শুনে আছাড়িপিছাড়ি খেয়ে কেঁদেছিলেন। দাম্পত্যকলহ সে দিন এমন জায়গায় পৌঁছেছিল, জিন্না বাধ্য হয়ে তাঁদের থামানোর চেষ্টা করেন। জিন্না বন্ধু জগৎজিৎ সিংহের স্বভাব-চরিত্র ভালই জানতেন। তাই সে দিন তিনি আনিতার পক্ষ নিয়েই কথা বলেন।
এবার আনিতা ক্রমশ বুঝতে পারছিলেন, তাঁদের সম্পর্কে ঘুণ ধরেছে। রাজাও বুঝতে পারছিলেন আর আনিতার সঙ্গে থাকা সম্ভব নয়। লন্ডনের হোটেলে সেই দাম্পত্যকলহের কিছু দিনের মধ্যেই তাঁদের ডিভোর্স হয়ে যায়। বিয়ের আঠেরো বছর পর এই বিবাহবিচ্ছেদ। বন্ধু মহম্মদ আলি জিন্নার ডায়েরি থেকে জানা যায়, রাজা জগৎজিৎ সিংহ আনিতার ভরণপোষণ হিসেবে মাসিক মোটা টাকা দিতেন। আনিতা রাজবাড়িতে বিয়ে উপলক্ষে প্রচুর অলঙ্কার পেয়েছিলেন। সেই সমস্ত রাজা তাঁকে দিয়ে দেন একটি শর্তে— আনিতা আর কোনও দিন ভারতে ফিরে আসবে না। আনিতা সে কথা রেখেছিলেন। বাকি জীবনটা প্যারিস, সুইটজ়ারল্যান্ড ও স্পেনে কাটিয়েছেন। শোনা যায়, তখনও তিনি অত্যন্ত বিলাসবহুল জীবন কাটিয়েছেন। সোনা ও রুপোর কাঁটাচামচ ছাড়া খেতেন না। খুব দামি দামি গয়না পরতেন।
ও দিকে রাজা জগৎজিৎ সিংহ আবার একটি কিশোরী কন্যার প্রেমে পড়েন এবং বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এই পাত্রী ছিলেন চেক কাউন্টের অবৈধ কন্যা ইউজিনি গ্রুসুপোভা। বিয়ের পর তাঁর নাম হয় তারা দেবী। এই মেয়েটি আনিতার মতো উচ্ছল বা মিশুকে ছিলেন না। রাজপরিবারে কারও সঙ্গে মিশতে পারতেন না। ভারতীয়দের সঙ্গে মেলামেশা করতেও ইউজিনি ওরফে তারা দেবী বরাবর অনীহাই দেখিয়েছেন।
১৯৪৬ এর ৯ ডিসেম্বর সকালে ইউজিনি হঠাৎই রাজপ্রাসাদ থেকে বেরিয়ে একটি ট্যাক্সি নিয়ে কুতুবমিনারে যান এবং মিনারের পাঁচতলার সিঁড়ি থেকে ঝাঁপ দেন। সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। রাজা জগৎজিৎ সিংহ তারার এই আকস্মিক মৃত্যুর খবর পেয়ে ভীষণ ভেঙে পড়েন। আমৃত্যু সেই শোক তিনি ভুলতে পারেননি। ১৯৪৯ সালে মুম্বইয়ের তাজ হোটেলে রাজা জগৎজিৎ সিংহের মৃত্যু হয়।
১৯৬২ সালে বাহাত্তর বছর বয়সে আনিতাও মারা যান। মৃত্যুর আগে তাঁর যাবতীয় স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি দিয়ে যান তাঁর ছেলে অজিত সিংহ এবং বোনঝিকে।
পুত্র অজিত সিংহ ভারতীয় কূটনীতিক হিসেবে দূতাবাসে চাকরি করতেন। কেমব্রিজে লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে তিনি এ দেশে চলে আসেন। দিল্লিতে তাঁর স্থায়ী বাস হলেও চাকরির প্রয়োজনে বেশ কিছু কাল লন্ডন ও বুয়েনস আইরেসে ছিলেন। বিয়ে করেননি। ১৯৮৪ সালে দিল্লিতে মারা যান। আনিতা দেলগাদো ওরফে প্রেম কৌরের কাহিনি এখানেই শেষ হতে পারত। কিন্তু তা হওয়ার ছিল না। অজিত সিংহের মৃত্যুর আড়াই দশক পরে মানুষের চোখের সামনে আসে রানিকাহিনির উপসংহার। এবং তাও একেবারে এক অভাবনীয় সূত্র থেকে।
২০০৯ সালে আমেরিকান-লেবানিজ় সাংবাদিক মাহা আখতার তাঁর বেস্টসেলার ‘দি মহারানিজ় হিডেন গ্র্যান্ডডটার’ বইয়ে দাবি করেছেন, তিনিই অজিত সিংহের কন্যা। তিনি বার্থ সার্টিফিকেট খুঁজতে গিয়ে আবিষ্কার করেছেন, তাঁর বাবা কপূরথালার রানি আনিতার পুত্র অজিত সিংহ। অজিত সিংহের একটি বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক ছিল, যার কথা অজিত সিংহ কখনও কোথাও স্বীকার করেননি। সেই সম্পর্কেরই ফসল মাহা। এমনকি তিনি প্রমাণ করেছেন, তাঁর মধ্যমায় যে অ্যামেথিস্ট এর আংটিটি আছে, সেটি আসলে তাঁর ঠাকুরমা প্রেম কৌরের। জনশ্রুতি, আনিতা যখন এ দেশ থেকে চলে যান, বহু অলঙ্কার ও মূল্যবান জিনিস পরিবহণের সময় খোয়া যায়। অনেকে বলেন, রাজপরিবারের তরফে এখনও চেষ্টা চলছে সেই সব সম্পদ উদ্ধারের।