বিংশ শতকের বিশের দশকে বাংলায় এক ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। সাধারণ মধ্যবিত্ত, সম্ভ্রান্ত, ধনী মানুষদের পাশাপাশি এগিয়ে এলেন সোনাগাছির মহিলারা। তাঁদেরই এক জনের নেতৃত্বে ও উৎসাহে তৈরি হল ‘ভিখারিনী থিয়েটার’। এঁরা ‘রিজিয়া’ নাটক উপস্থাপন করলেন বন্যাত্রাণে আর্থিক সহায়তা করবেন বলে। সোনাগাছির মেয়েদের এই প্রচেষ্টা দেখে উৎসাহিত হলেন রূপাগাছির মেয়েরাও। তাঁরা মঞ্চস্থ করলেন ‘নরমেধ যজ্ঞ’। এই দু’টি নাটক পরিচালনা করেছিলেন ‘কাঙালিনী থিয়েটার’-এর প্রতিষ্ঠাতা, অভিনেত্রী ও সঙ্গীতশিল্পী রাজবালা দাসী। এর পরেই তাঁর হাত ধরে গড়ে উঠল পুরোপুরি মহিলাদের নিয়েই গঠিত ‘দি রামবাগান ফিমেল কালী থিয়েটার’ নাট্যদল। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটিই বাংলার প্রথম পেশাদারি ফিমেল থিয়েটার, যার কর্ণধার এই রাজবালা দাসী।
কে এই রাজবালা দাসী? তাঁর সম্পর্কে বলতে গেলে আমাদের আর একটু পিছিয়ে যেতে হবে, যেতে হবে সার্কাসের মঞ্চে। বাঙালির প্রকৃত সার্কাস বলতে যা বোঝায় তার সূচনা ‘বোসের গ্রেট বেঙ্গল’ সার্কাসের হাত ধরে। এই সার্কাস কোম্পানির মালিক ছিলেন ছোট জাগুলিয়ার প্রিয়নাথ বসু ও তাঁর সহোদর মতিলাল বসু। রাজবালাই প্রথম বাঙালি নারী হিসেবে এই সার্কাসের মাধ্যমে সার্কাসের জগতে পদার্পণ করেন, পরে মতিলাল বসুর সঙ্গে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন।
রাজবালা দাসীর জন্ম ১৮৮৭ সালে পাথুরিয়াঘাটায়। মা পুঁটি বৈষ্ণবী জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণ পরিবারের হলেও জন্মমুহূর্তে মা মারা যাওয়ায় পশ্চিম বনবিষ্টুপুরের এক বৈষ্ণব পরিবারে বেড়ে ওঠেন। এগারো বছরে তাঁর বিয়ে হলে স্বামীর সঙ্গে পাথুরিয়াঘাটায় চলে আসেন। তিন বছরের মাথায় স্বামী মারা গেলে বিধবা অসহায় পুঁটিকে আশ্রয় দেন পাড়ারই জনৈক ধনবান ব্যক্তি মুরলী আঢ্য। তাঁদেরই পনেরো জন সন্তানের মধ্যে সবচেয়ে ছোট রাজবালা। মাত্র চার মাস বয়সে মা ও তার কয়েক বছরের মধ্যেই বাবাকে হারালে, আত্মীয়রা প্রতারণা করে পৈতৃক বাড়ি ও সম্পত্তি হস্তগত করে। ভাই-বোনদের মধ্যে চার জন জীবিত। বড় বোন হরিমতি, মেজ বোন মতিবালা, দাদা তিনকড়ি ও রাজবালা।
গৃহহারা ভাই-বোনের দায়িত্ব নিলেন প্রতিবেশী খুদিমাসি। এই সময় রামবাগান অঞ্চলে মেয়েদের পালাগান ও যাত্রার দু’টি দল ছিল। ‘গোলাপীর দল’ ও ‘রাজাহরির দল’। এই দ্বিতীয় দলের পরিচালিকা ও অভিনেত্রী ছিলেন হরিদাসী। তাঁরই দলের ‘গঙ্গা আনয়ন’ পালায় ভগীরথের ভূমিকায় অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে মাত্র ছ’বছর বয়সে রাজবালার মঞ্চে হাতেখড়ি।
অন্য দিকে খুদিমাসি হরিমতির বিয়ে দিলে দিদির শ্বশুরবাড়িতেই ঠাঁই মিলল ভাই-বোনেদের। কিন্তু সেখানেও ভাগ্যের পরিহাস। বিয়ের অল্প দিনের মধ্যেই হরিমতি বিধবা হলেন। তাঁর ও ভাইবোনদের দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করল শ্বশুরবাড়ি। ফলে আবার তাঁদের পথে নামা।
এমনই অবস্থায় প্রফেসর বোসের গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস কলকাতায় শো করতে এল। তাঁদের কোম্পানি অল্পবয়সি ছেলেমেয়েদের সার্কাসের দলে আহ্বান জানিয়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল। নিঃস্ব তিনকড়ি বিজ্ঞাপন দেখে মতিবালা আর রাজবালাকে নিয়ে সার্কাসে যোগ দিলেন। সার্কাস কোম্পানির খাতায় দুই নবাগতর ঠিকানা, ১৫১ নং দর্পনারায়ণ ঠাকুর স্ট্রিট, পাথুরিয়াঘাটা। মা পুঁটিরানীরও শেষ ঠিকানা ছিল এই বাড়িটাই।
রাজবালা ছিলেন মূলত ট্রাপিজ় শিল্পী। খেলার সময় একটি ছোট টেবিলের উপর চারটে বোতল সাজিয়ে তার উপর কাঠের চৌকো তক্তা রেখে টেবিল তৈরি করা হত। তার উপর আবার চারটি বোতল, তার উপর আবার তক্তা, এই ভাবে সাজিয়ে উপর্যুপরি আটটি সমান মাপের টেবিল তৈরি হত। রাজবালা নীচের টেবিল থেকে জিমন্যাস্টিক দেখাতে দেখাতে নিখুঁত ভারসাম্যে সবচেয়ে উপরের টেবিলে উঠে দাঁড়াতেন। তার পর দেহটিকে সম্পূর্ণ উল্টো করে ঠিক পরের টেবিলে রাখা প্লেট থেকে চপ-কাটলেট খেতেন।
অতি অল্প বয়সেই রাজবালা সার্কাসে যোগ দেওয়ায় বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার পেশাগত দক্ষতা ও দৈহিক সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায়। তাঁর রূপ-গুণ গ্রেট বেঙ্গল সার্কাসের মালিক মতিলালকেও বিমুগ্ধ করল, তিনি তাঁকে প্রেম নিবেদন করলেন। সকলের বিরুদ্ধে গিয়ে উজ্জয়িনীর কালীবাড়িতে শাস্ত্রমতে তাঁদের বিবাহ সম্পন্ন হয়।
বিয়ের বছরেই অমৃতসরে তাঁর একমাত্র কন্যা, পরবর্তী কালের অন্যতম নামী সঙ্গীতশিল্পী ইন্দুবালার জন্ম হয়। বাংলা ক্যালেন্ডারে দিনটা ১৮ কার্তিক, ১৩০৫ বঙ্গাব্দ।
কন্যার জন্মের পর রাজবালার সার্কাসের প্রতি আগ্রহ কমতে থাকে। তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন এবং ২১ নং দয়াল মিত্র লেনের বাড়িতে বসবাস করতে শুরু করেন। মতিলাল রাজবালার এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেননি। তাঁদের মধ্যে এই নিয়ে দূরত্ব বাড়ে। এর পর ৫৩ বছর বয়সে মতিলালের মৃত্যু ঘটে দুরূহ অস্ত্রোপচারের ফলে।
অন্য দিকে রাজবালা সঙ্গীতকে আকঁড়ে ধরেন ভালবাসা ও আর্থিক অনটন থেকে মুক্তির টানে। সেকালে অন্যতম পাখোয়াজবাদক দুলী ভট্টাচার্য, রাজবালার গানে সঙ্গত করতে শুরু করেন। গিরিবালা দেবী, গোবিন্দপ্রসাদ মিশ্র, গোবিন গুরু, সাতকড়ি ওস্তাদ, চণ্ডী বন্দ্যোপাধ্যায়, রজনীবাবু ছোট, বড় দুলি খাঁ, লছমীপ্রসাদ সিংহ, কেশবপ্রসাদ মিত্রের মতো বিশিষ্ট সঙ্গীতশিল্পী তাঁর বাড়িতে নিয়মিত সান্ধ্য সঙ্গীত আসরে যোগ দিতেন। ক্রমশ থিয়েটারকর্মী ও সমাজকর্মী রূপেও রাজবালা দেবী উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে শুরু করলেন।
রাজবালার পেশাদারি থিয়েটারে প্রথম অভিনয় মিনার্ভা থিয়েটারে গিরিশচন্দ্র ঘোষের ‘শঙ্করাচার্য্য’ নাটকে। এর পর ‘তপোবল’ নাটকে তিনি অদৃশ্যন্তীর ভূমিকায় অভিনয় করলেন। তার পর রাজবালার হাতে তৈরি ‘দি রামবাগান ফিমেল কালী থিয়েটার’ তাঁরই উদ্যোগে মোট বারোটি নাটক মঞ্চস্থ করে। যেখানে মূল চরিত্রগুলিতে রাজবালা নিজে ও তাঁর কন্যা প্রসিদ্ধ সঙ্গীতশিল্পী ইন্দুবালা অভিনয় করতেন।
১৯১২ সালে তাঁরা মনমোহন থিয়েটারে মঞ্চস্থ করলেন ‘বিল্বমঙ্গল’ ও ‘হীরের ফুল’। এ ছাড়াও আরও দশটি নাটক তাঁরা করেন, সেগুলির মধ্যে ‘নরমেধ যজ্ঞ’, ‘হীরে মালিনী’, ‘কুঞ্জ দরজী’, ‘আলিবাবা’, ‘রেশমি রুমাল’, ‘চন্দ্রগুপ্ত’ উল্লেখযোগ্য।
এই সব নাটকে কোনও পুরুষ অভিনেতা ছিলেন না। অথচ সেই সময় অন্য নাট্য দলে পুরুষরাই মহিলার চরিত্রে অভিনয় করতেন। আর এখানে উল্টো। সব বেশেই মেয়েরা। শুধুমাত্র মেয়েদের অভিনয়ে প্রদর্শিত এই নাটকের টিকিটের মূল্য ছিল সকালে দশ, আট, ছয়, পাঁচ, দুই ও এক টাকা। ব্যালকনিতে দুই টাকা। এক টাকার টিকিটে কেবল মেয়েরাই প্রবেশ করতে পারতেন। এই থিয়েটার দলের প্রচারপত্রে পরিচালক হিসেবে দানীবাবুর শিষ্য যোগীন্দ্রনাথ সরকারের নাম থাকত। কারণ সেই সময় পরিচালিকা হিসেবে রামবাগান অঞ্চলের মেয়েদের নাম থাকলে, সে নাটক আর মঞ্চস্থ করা সম্ভব হত না। অবশ্য আর্থিক সংস্থানের জন্য এগিয়ে এসেছিলেন ব্যবসায়ী বদ্রীনাথ ছেত্রী ও জীবনকৃষ্ণ ঘোষ।
ধীরে ধীরে এই দলের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে কলকাতার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলেও। মঞ্চে উপস্থাপনের আগে এই মহিলা নাট্যশিল্পীদের এক দল লালপেড়ে সাদা শাড়ি পরে সংশ্লিষ্ট অঞ্চল প্রদক্ষিণ করতেন। অন্য দল লাল পাড় গেরুয়া শাড়ি পরে নিজেদের অঞ্চল ঘুরে বন্যাদুর্গতদের জন্য অর্থ ও কাপড়চোপড় সংগ্রহ করতেন। সংগৃহীত সামগ্রী তুলে দেওয়া হত বঙ্গীয় বন্যাত্রাণ ভান্ডারে।
এই ধরনের উদ্যোগ ইতিহাসে বিরল। রাজবালার উদ্যোগেই রামবাগান নারী সমিতি ১৯১০ সালে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের হাতে তুলে দিয়েছিলেন ১৫০ কেজি চাল, ৩০টি নতুন কাপড়, ২৬৪টি পুরনো কাপড়, ৯০টি জামা আর দু’খানা গায়ে দেওয়ার চাদর। এ ছাড়াও মোট সাত কিস্তিতে আরও ৯৯৬টি শাড়ি, ১৯০টা জামা, ও অন্যান্য সামগ্রী তুলে দেওয়া হয় ত্রাণ কমিটির হাতে।
সেকালের ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় এই দান নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের পাশাপাশি বেঙ্গল কমিটির রিপোর্টেও রামবাগান নারী সমিতির ভূয়সী প্রশংসা করে বলা হয়, “যে আন্তরিকতা দেখাইয়া বন্যা সাহায্য কার্যে অবতীর্ণ হইয়াছেন তজ্জন্য কমিটি তাহাদিগকে ধন্যবাদ না দিয়া থাকিতে পারিতেছেন না। গতকালও তাহারা স্টার থিয়েটারে অভিনয় লব্ধ ১৭০০ টাকা প্রদান করিয়া দেন।”
রাজবালার ফিমেল কালী থিয়েটার দল দু’-বছর চলার পর বন্ধ হয়ে গেলেও রাজবালা অবশ্য নাটক ছাড়েননি। মর্ডান থিয়েটারের নবীনচন্দ্র সেনের ‘রৈবতক’ নাটকে ‘সুলোচনা’র ভূমিকায় অভিনয় করে নাট্যপ্রেমী মানুষের তারিফ পান।
এ ছাড়াও ১৯৩৫ সালে তিনি বজরংলাল খেমকা প্রযোজিত বাংলা ও তেলুগু ছবি ‘রাতকানা’য় বৌয়ের চরিত্রে অভিনয় করে নজর কাড়েন। সমসাময়িক ‘আজকাল’, ‘সোনার বাংলা’, ‘স্বদেশ’ প্রভৃতি পত্রিকায় রাজবালা দাসীর অভিনয়ের প্রশংসা হয়। অনেক ক্ষেত্রে তাঁর নাম আবার রাজুবালা নামেও লেখা হয়। এমনকি কোথাও তাঁকে ছায়াবালাও বলা হয়। স্বয়ং ইন্দুবালা এই নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ক্ষোভ পর্যন্ত প্রকাশ করেন।
অবশ্য এর পর রাজবালা সব কিছু থেকে অবসর নিয়ে সামাজিক, সাংসারিক, সঙ্গীত ও ধর্মচর্চার মধ্য দিয়ে কাটিয়ে দেন আরও তেত্রিশ বছর। অবশেষে ৮৪ বছর বয়সে ১৩৭৫ সনের ২৭ ভাদ্র, মহিলা নাট্য দল ও নারী সমিতির প্রথম বাঙালি নারী প্রতিষ্ঠাতা রাজবালা মারা যান।
ঊনবিংশ শতকের শেষ দিকে মতিলাল বসুর গ্রেট বেঙ্গল সার্কাসের হাত ধরে যে বাঙালি মহিলা সার্কাসশিল্পীর উত্থান ঘটেছিল, সার্কাসকর্মী, সঙ্গীতশিল্পী, নাট্যশিল্পী অভিনেত্রী বা সমাজকর্মী— সব দিকে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠলেও আজ তিনি বিস্মৃতির অতলে, বেঁচে আছেন শুধু ইন্দুবালার মায়ের পরিচয়েই।