ফাইল চিত্র।
তাঁর জন্মদিন পালন করতে গিয়ে নিজেই লিখেছেন ‘২৫ বৈশাখের রবি ঠাকুর’। এ দিন ঘিরে কবির অনুভব কেমন ছিল, নানা ভাবে তা ধরা পড়েছে তাঁর লেখনীতে, বক্তব্যে। এই তারিখটি কবি কাটিয়েছেন কখনও শান্তিনিকেতনে, কখনও পুরী, আলমোড়া, কালিম্পংয়ে, সুদূর ফ্রান্স বা তেহরানেও। সেই সব লেখায় দেখা যায় কবির অন্তর্লোকের আশ্চর্য উন্মোচন।
জন্মদিন নিয়ে তাঁর বিশেষ কোনও অনুভূতি থাকলেও, কবি তা সর্বসমক্ষে প্রকাশ করেননি। ১৩১৭ বঙ্গাব্দে বোলপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংবর্ধনা-ভাষণে কবি তাঁর জন্মদিনের কথা উল্লেখ করেন। বলেছিলেন, “কতো পঁচিশে বৈশাখ চলে গিয়েছে, তারা অন্য তারিখের চেয়ে কিছুমাত্র বড়ো করে আমার কাছে প্রকাশ করেনি।” ‘জন্মোৎসব’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন, “উৎসব হচ্ছে জীবনের কবিত্ব, যেখানে রস সেইখানেই তার প্রকাশ।... আজ আমার জন্মদিনে তোমরা যে উৎসব করছ, তার মধ্যে যদি সেই কথাটি থাকে, তোমরা যদি আমাকে আপন করে পেয়ে থাক, আজ প্রভাতে সেই পাওয়ার আনন্দকেই যদি তোমাদের প্রকাশ করবার ইচ্ছা হয়ে থাকে, তা হলেই এই উৎসব সার্থক।”
১৩২৮ বঙ্গাব্দের পঁচিশে বৈশাখে কবি ছিলেন সুইটজ়ারল্যান্ডের জেনেভায়। জন্মভূমির জন্য মন খারাপ তাঁর। চার্লস এন্ড্রুজ়কে লিখেছিলেন, “তোমাদের কাছ হইতে দূরে আজিকার এই দিন আমার কাছে পুস্তিকার তারিখ মাত্র। আজ একটু নিরালা থাকিতে ইচ্ছা করিতেছি কিন্তু তাহা হইবার নাই।” সে দিন জার্মানদের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা জানানো হয়েছিল কবিকে। হাতে তুলে দেওয়া হয় জার্মান ভাষার কালজয়ী গ্রন্থসমূহ।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জন্মতারিখ নিয়ে এই অনুভূতি পাল্টায়। ১৩২৯ বঙ্গাব্দের ২৫ বৈশাখে লিখলেন— “রাত্রি হল ভোর।/ আজ মোর/ জন্মের স্মরণপূর্ণ বাণী,/ প্রভাতের রৌদ্রে-লেখা লিপিখানি/ হাতে করি আনি/ দ্বারে আসি দিল ডাক/ পঁচিশে বৈশাখ।” ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থের ‘পঁচিশে বৈশাখ’ কবিতায় কবি বললেন, কালবৈশাখীর মত্ত মেঘে, শাল, তাল, শিরীষের মিলিত মর্মরে, তপ্ত নিষ্করুণ রুক্ষ, শুষ্ক এক দগ্ধ প্রকৃতির মধ্যে দিয়ে আসে ২৫ বৈশাখ। কিন্তু বসন্তে বসন্তে যেমন শূন্য ডালে নতুন কিশলয় দেখা দেয়, এ জন্মদিনটিও তেমনই। প্রকৃতির দারুণ দাবদাহের মধ্যেও এই সকাল মনে করায় জন্মদিনের শুভক্ষণ। সে বসন্তের মতো সৌন্দর্যের বার্তাবাহী, আহ্বান করে নতুনকে। জন্মদিন এসে বলে যায়, “রিক্ততার বক্ষ ভেদি আপনারে করো উন্মোচন।/ ব্যক্ত হোক জীবনের জয়,/ ব্যক্ত হোক তোমা-মাঝে অনন্তের অক্লান্ত বিস্ময়...”
১৩৩৭ বঙ্গাব্দে কবির ৬৯তম জন্মদিন, কবি তখন চিত্রশিল্পীও। প্যারিসে তাঁর ছবির প্রদর্শনীও হয়। সেখান থেকেই কবি ইন্দিরা দেবীকে লেখেন, “ধরাতলে যে রবিঠাকুর বিগত শতাব্দীর ২৫শে বৈশাখে অবতীর্ণ হয়েছেন তাঁর কবিত্ব সম্প্রতি আচ্ছন্ন, তিনি এখন চিত্রকর রূপে প্রকাশমান।... এইবার আমার চৈতালী বর্ষ শেষের ফসল সমুদ্রপারের ঘাটে সংগ্রহ হল।” ফ্রান্স থেকেই জন্মদিনে নির্মলকুমারী মহলানবিশকে লিখেছিলেন, “আজ আমার জন্মদিন। কিন্তু জন্মদিনের সঙ্গে জন্মস্থানের মিল করতে না পারলে সমস্ত জিনিসটাকে মনের মধ্যে পাওয়া যায় না।”
১৩৩৯ বঙ্গাব্দে কবির ৭১তম জন্মদিনে ছিলেন তেহরানে। সেখানকার মানুষ কবির জন্মদিন উদ্যাপন করলেন, দিলেন উপহার। ওই দিনটিতেই কবি ‘পারস্যে জন্মদিনে’ নামক কবিতায় অকপট উচ্চারণে সাজিয়ে দিলেন প্রতি-উপহার, “ইরান, তোমার সম্মানমালে/ নব গৌরব বহি নিজ ভালে/ সার্থক হল কবির জন্মদিন।/ চিরকাল তারি স্বীকার করিয়া ঋণ/ তোমার ললাটে পরানু এ মোর শ্লোক,— / ইরানের জয় হোক।”
২৫ বৈশাখ দিনটিকে তাৎপর্যমণ্ডিত করতে সে দিন তিনি উৎসর্গ করেছেন বইও। ‘রাশিয়ার চিঠি’-র উৎসর্গপত্রে লিখলেন ‘কল্যাণীয়েষু শ্রীমান সুরেন্দ্রনাথ করকে আর্শীবাদ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’। এই দিনে সুরেন্দ্রনাথ কর ও সুরমার বিবাহ উপলক্ষ্যে রচনা করেছিলেন ‘পরিণয়’ কবিতা।
১৩৪৫ বঙ্গাব্দের ২৫ বৈশাখে লিখেছিলেন ‘জন্মদিন’ কবিতাটি— “আজ মম জন্মদিন। সদ্যই প্রাণের প্রান্তপথে/ ডুব দিয়ে উঠেছে সে বিলুপ্তির অন্ধকার হতে/ মরণের ছাড়পত্র নিয়ে। মনে হতেছে কী জানি/ পুরাতন বৎসরের গ্রন্থিবাঁধা জীর্ণ মালাখানি/ সেথা গেছে ছিন্ন হয়ে; নবসূত্রে পড়ে আজি গাঁথা/ নব জন্মদিন।” মানুষ পৃথিবীতে ক্ষণস্থায়ী, তার যাত্রাশেষে অপেক্ষা করে আছে স্বয়ং মৃত্যু, সে-ই যেন প্রতি জন্মদিনে যাত্রীর কপালে নতুন সূচনার তিলক এঁকে দেয়। জন্মদিনেও সে প্রসঙ্গ ছুঁয়ে গেছে কবিমন, “হেথা আমি যাত্রী শুধু, অপেক্ষা করিব, লব টিকা/ মৃত্যুর দক্ষিণ হস্ত হতে, নূতন অরুণলিখা/ যবে দিবে যাত্রার ইঙ্গিত।” এই জন্মদিনেই কবি লিখেছিলেন, “প্রথম যুগের উদয়দিগঙ্গনে/ প্রথম দিনের ঊষা নেমে এল যবে/ প্রকাশ পিয়াসী ধরিত্রী বনে বনে/ শুধায়ে ফিরিল, সুর খুঁজে পাবে কবে।”
১৩৪৭ বঙ্গাব্দের জন্মদিনে কবি ছিলেন মংপুতে। সে দিন ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধটি পাঠ করেন তিনি। আশি বছর পূর্তিতে বলেছিলেন, “আমার জীবনক্ষেত্রের বিস্তীর্ণতা আজ আমার সম্মুখে প্রসারিত। পূর্বতম দিগন্তে যে জীবন আরম্ভ হয়েছিল তার দৃশ্য অপর প্রান্ত থেকে নিঃসক্ত দৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছি এবং অনুভব করতে পারছি যে, আমার জীবনের এবং সমস্ত দেশের মনোবৃত্তির পরিণতি দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেছে...” এ দিনই তিনি লেখেন ‘জন্মদিনে’ কবিতাটি, যার শেষে ছিল, “...আজি এই জন্মদিনে/ দূরের পথিক সেই তাহারি শুনিনু পদক্ষেপ/ নির্জন সমুদ্রতীর হতে।” কবির জীবদ্দশায় পালিত তাঁর শেষ জন্মদিন এটিই।