শিকার করতে করতেই তাঁর ভালবাসা বন্যপ্রাণ আর প্রকৃতিকে। শিকারি মন ক্রমশ ঝুঁকতে থাকল বুনো হাতি পোষ-মানানোর কৌশলে। এ বিদ্যায় এমন পারদর্শী হয়ে উঠলেন যে, একটা সময় ভুটান থেকে কোচবিহার, নেপাল কিংবা ওড়িশা, বিহার এবং অন্যান্য জায়গার রাজাদেরও প্রথম পছন্দ ছিল তাঁর তৈরি হাতি। শিকার শুরু করেছিলেন সাত বছর বয়সে, বছর কুড়ির মধ্যে তিনি পরিচিত হয়ে যান অন্যতম প্রধান হস্তিবিশারদ হিসেবে।
প্রকৃতীশ বড়ুয়া, ওয়াইল্ডলাইফ ফোরামে যাঁর পরিচিতি ‘লালজি’ নামে। তাঁর প্রয়াণ ছুঁয়ে ফেলল তিন দশক। তিন বছর আগে অতিক্রান্ত জন্মশতবর্ষও। পৃথিবী জুড়ে বাস্তুহারা বন্য প্রাণীদের অসহায় সময়ে লালজিও বিস্মৃতির গভীরে। প্রথম মহাযুদ্ধের বছরে, ১৯১৪-র ১ মে তাঁর জন্ম অসমে। প্রয়াত হন ৭৪ বছর বয়সে, ১৯৮৮-র ২ এপ্রিল। শেষ দিন পর্যন্ত ছিলেন হাতির পরম বন্ধু। শিকারি লালজির ঝুলিতে ৩৪১টি বাঘ, একশোরও বেশি লেপার্ড। কিন্তু প্রকৃতীশ মিথ হয়ে আছেন হাতি শিকারে। অসম-বাংলা-ভুটান মিলিয়ে তাঁর ঝুলিতে হাতির সংখ্যা ১০০৯। হত্যা নয়। তাঁর কাছে শিক্ষা পাওয়া হাজার খানেক হাতির কয়েকটি হয়তো এখনও ছড়িয়ে এ দেশে।
অসমের গৌরীপুর রাজবাড়ির সন্তান প্রকৃতীশ। আদি বাসস্থান ছিল রাঙামাটি এলাকায়। ১৮৫০-এ গৌরীপুরে স্থানান্তরিত হয় রাজবাড়ি। বাবা প্রভাতচন্দ্র গৌরীপুর সদরের মূল রাজবাড়ির পাশাপাশি মাটিয়াবাগ এলাকায় আর একটি বাড়ি তৈরি করেন। মাটিয়াবাগ শহুরে কোলাহলের বাইরে, নদী আর জঙ্গলে ঘেরা। কিশোর প্রকৃতীশ বাবার কাছ থেকে এই নির্জন প্রাসাদটি চেয়ে নিয়েছিলেন। ছোটবেলা থেকে জঙ্গল, শিকার আর বন্যপ্রাণীর উপর টান যে ছেলের, তার দাবি মেনে নিলেন রাজা প্রভাতচন্দ্র। গৌরীপুর সদরে মূল রাজবাড়ি রইল দাদা প্রমথেশের। ভাই প্রণবেশের জন্য তৈরি হল পাশেই একটি বাড়ি। আর প্রকৃতীশ চলে এলেন প্রকৃতির মধ্যে।
বাড়ির তিন দিক ঘিরে গদাধর নদী। এক দিকে গভীর জঙ্গল। প্রকৃতীশ নিজের মতো করে সাজালেন তাঁর প্রাসাদ, নাম দিলেন ‘হাওয়াখানা’। সেখানে এক দিকে ময়ূর, হরিণ, পাখি, সাপ, পায়রায় গড়ে উঠল আস্ত একটা চিড়িয়াখানা। অন্য দিকে হাতি। মূল রাজবাড়ির পিলখানায় তখন ৪২টি হাতি! সেখান থেকেও কয়েকটি এল এখানে।
দাদা প্রমথেশ বড়ুয়া তত দিনে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে পাশ (১৯২৪) করে ইউরোপে। পরে তিনিই হয়ে উঠবেন নির্বাক ও সবাক যুগের বাংলা ছবির নক্ষত্র। প্রকৃতীশকে টানল আদিম প্রকৃতি। পারিবারিক রীতি মেনে বিজয়া দশমীর দিন ‘যাত্রা পুজো’ সেরে শিকারে বেরোলেন বছর সাতেকের প্রকৃতীশ।
শেষ জীবনে লেখা তাঁর দিনলিপি ‘হাবিজাবি’-তে জানাচ্ছেন, ‘আমার প্রথম শিকার একটি প্যাডি বার্ড। এ দেশে যা কালিবগা নামে পরিচিত। ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯২২ ছিল শিকারের দিন। স্থান: গৌরীপুর মহামায়া ট্যাঙ্ক। তখন আমার বয়স ৭ বছর ১০ মাস।’ প্রথম বাঘ শিকার করেছিলেন ১১ বছর ১০ মাস বয়সে। রাজবাড়ির ময়ালু নামে এক হাতির পিঠে চড়ে। ‘হাবিজাবি’-তে লিখেছেন, ‘এটি বাঘিনী। শিকারের তারিখ ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯২৬। স্থান: ভালুকি ক্যাম্প।’ পরের বছর, ১৯২৭-এর ২২ ফেব্রুয়ারি শিকার করেন তাঁর ছ’দশকের শিকারি জীবনের সবচেয়ে বড় বাঘটিকে। তখন তাঁর বয়স সাড়ে বারো! সে বারও সওয়ার হয়েছিলেন ওই ময়ালুর পিঠেই। বাঘটির দৈর্ঘ্য ছিল ১০ ফুট ৫ ইঞ্চি!
হাওয়াখানা: প্রকৃতীশ বড়ুয়ার বাড়ি, এখন যেমন
গৌরীপুর অসমে হলেও কোচবিহার থেকে ঘণ্টা তিনেকের মধ্যে পৌঁছে যাওয়া যায়। প্রমথেশ বড়ুয়ার বিখ্যাত তিনমহলা বাড়ি এখনও জেগে আছে। আর ‘হাওয়াখানা’-তে থাকেন প্রকৃতীশ বড়ুয়ার ছেলে প্রবীর ও তাঁর ভাইরা। একতলায় বিশাল মিউজিয়ামে দুষ্প্রাপ্য সব সামগ্রী রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ধুঁকছে। বাড়ির দেখভালের দায়িত্ব প্রবীরবাবুই সামলান। কিন্তু একার পক্ষে এত বড় মহল সংস্কার অসম্ভব। তাই যোগাযোগ করছেন অসম সরকারের সঙ্গে।
‘বাবা সত্যি-সত্যিই হাতির ভাষা বুঝতেন। ওদের সঙ্গে এমন ভাবে মিশতেন, মনে হত, ওরাও বোঝে বাবার ভাষা। আমাদের একটা বিশাল হাতি ছিল, জংবাহাদুর। ভয়ংকর মেজাজি। বাবাকে দেখলে কিন্তু সেও শান্ত, বাধ্য ছেলে। মাঝে-মাঝে খেপে উঠত। অনেক সময় এমন হয়েছে, জংবাহাদুর খেপে উঠেছে। বাবা হয়তো তখন নেই। মাহুতরা বাবার পরা জামাকাপড় এনে ওর সামনে ধরত। বাবার গায়ের গন্ধ পেয়ে ঠান্ডা হত জংবাহাদুর,’ বলছিলেন প্রবীরবাবু। তাঁর দিদি, হস্তিবিশারদ পার্বতী বড়ুয়াও বাবার কাছে থেকে হাতিদের ভাষা শিখেছেন। এই জংবাহাদুরকেই প্রমথেশ ‘মুক্তি’ ছবিতে ব্যবহার করেছিলেন। তবে লালজির প্রিয় হাতি ছিল প্রতাপ সিং। তাঁর অধিকাংশ শিকারে সে-ই সহযাত্রী। লালজিকে অনেক বিপদ থেকেও বাঁচিয়েছে। এক বার কোঁকড়াঝাড়ের জঙ্গলে হঠাৎ একটা বাঘকে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখে প্রতাপ মুহূর্তে শুঁড়ে পেঁচিয়ে সেটাকে আছড়ে মেরে ফেলে।
হাওয়াখানার ফটক থেকে একটু এগিয়ে বাঁ দিকে উঁচু জমিতে প্রতাপ সিংয়ের কবর। সেখানে আজও মাথা নোয়ায় এ বাড়ির সকলে। অনেক ঐশ্বর্যে মোড়া প্রবীরবাবুদের অতীত। তখন ‘রূপসী’ নামের বিমানঘাঁটি ছিল কাছেই। সেখান থেকে এক ঘণ্টায় কলকাতা পৌঁছনো যেত। তাঁদের ছিল গোটা পঁচিশ দামি গাড়ি, বেশ ক’টা ট্রাক। বড় অভিনেতারা আসতেন। বহু ছবির শুটিং হত। আজ সে সব গল্পের মতো।
এ বাড়িতেই আছে প্রকৃতীশ বড়ুয়ার লেখা দিনলিপি ‘হাবিজাবি’। লম্বা বোর্ড বাঁধাই খাতা, ৪২০টি পাতা জুড়ে হাতি নিয়ে লালজির গভীর অভিনিবেশের নমুনা। জীবনের শেষ পর্বে এই দিনলিপি লেখা শুরু করেছিলেন লালজি। নিজের শিকার জীবনের গল্পের পাশাপাশি আছে হাতির শ্রেণিবিভাগ, হাতি চেনার কৌশল, হাতির খাবার, হাতির নানা রোগের ভেষজ ওষুধ, মাহুতের কর্তব্য, শিকারের ১৮ দফা শর্ত বা নীতি এবং হাতিশিক্ষার দুর্লভ গান। বাংলা, হিন্দি ও অসমিয়া ভাষায় লেখা গানগুলো লোকসাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। এই গান গেয়েই মাহুতরা হাতিদের শিক্ষা দিতেন।
লেখা আছে দেশ-বিদেশের খবরও। উত্তমকুমার, সঞ্জয় গাঁধীর মৃত্যুসংবাদ। ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৬-এর আনন্দবাজারে প্রকাশিত খবরের সূত্রে এক জায়গায় নোট: ‘কলকাতায় দৈনিক কাটা হয়, ছাগল-ভেড়া ৬০০০, গরু-মোষ ৬০০ এবং শুয়োর ২০০টি।’
এ কালে লোকালয়ে হাতির ঢুকে পড়া, তাদের ওপর মানুষের সমবেত হিংস্রতা প্রসঙ্গে প্রবীরবাবুর মন্তব্য, ‘বাবা থাকলে একটা পথ নিশ্চয়ই বলতে পারতেন। হাতি সহ অন্য জন্তুর বাসভূমি আমরাই ধ্বংস করে দিচ্ছি। খাবারের টানে ওরা ঢুকে পড়ছে লোকালয়ে, তখন অত্যাচার করে খতম করে দিচ্ছি ওদের। এতে যে বাস্তুতন্ত্রেরই ক্ষতি হচ্ছে, আমরা ক’জন তা ভাবি!’
‘হাবিজাবি’ কেন প্রকাশ করছেন না? এত অমূল্য মণিকণা ওখানে! প্রবীরবাবুকে প্রশ্ন করায় এড়িয়ে যান তিনি। বলেন পারিবারিক জটিলতার কথা। লালজিকে লেখা বিশিষ্টজনদের চিঠিও আছে এ বাড়িতে।
লালজির সেই হাওয়ামহল জুড়ে এখন দীর্ঘশ্বাস। গদাধরের হাওয়া আজও এসে লাগে, কাচের শার্সি ছুঁয়ে রোদও। শুধু তিনিই নেই!
ছবি সৌজন্য: বিক্রম গ্রেবাল